সমকালীন ছোটগল্প |
সে
লিফটের মধ্যে একা পেয়েই জাহ্নবীর কোমর
জাপটে ধরল জীষ্ণু। এক হাতের বেড়ে তাকে শক্ত করে ধরে, অন্য পটু হাতটি গলিয়ে দিল জাহ্নবীর
শার্টের নিচে। হাত নাভিতে ঘোরাফেরা করে যত উপরে উঠতে লাগল, জাহ্নবী ততই সুতোয় বাঁধা
ফড়িং-এর মতো ছটফট করতে লাগল। 'কেউ এসে পড়বে', বলল সে। জীষ্ণু ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট বন্ধ করে দিল তার। অনেকক্ষণ
অপেক্ষা করেছে।
অবশ্য একথা ঠিক যে লোকে তাকায়। বিশেষত
পুরুষেরা। জীষ্ণু যেন তাদের সবার প্রতিনিধি
হয়ে লোভের শরীরকে ছুঁয়ে দিচ্ছে, উন্মোচিত করছে, টিপেটুপে নেড়ে-ঘেঁটে দেখছে। যেন সে
এক যূথবদ্ধ কাজেরই একক কর্তৃ সেই মুহূর্তে। তাই সেই শরীরের ওঠাপড়া, নড়াচড়া, খাঁজখোঁজ,
সব দেখার অধিকার যেন তাদেরও আছে।
রেস্তোঁরায় সেইসব ক্ষুধার্ত চোখের সামনে
কিছুতেই নিজেকে ছুঁতে দেয়নি জাহ্নবী। তারপর তারা বসেছিল ট্যাক্সিতে। সেখানেও একবার
চেষ্টা করেছিল জীষ্ণু। জাহ্নবী ইশারায় দেখিয়েছিল, সামনের আয়নায় সেঁটে ছিল চালকের দুটো
চোখ। অবশেষে লিফটে তাকে প্রথমবার একা পেল জীষ্ণু। জাহ্নবী বলে, 'ঘরে... প্লিজ'! জীষ্ণু
আরও জোরে জাপটে ধরতে যেতেই দরজা খুলে যায়। প্রবেশ করে আটতলার মাকিজা দম্পতি। জাহ্নবী ছিটকে সরে গেছে নিমেষে।
ছতলায় লিফটটা নিঃশব্দে থামে। মাকিজা-গিন্নীর
সন্দিগ্ধ চোখের সামনে দিয়ে অধোমুখ জাহ্নবী নামে জীষ্ণুর পিছু পিছু। মুগ্ধচোখে দ্যাখে,
কীহোলে চাবি ঢোকানোর সময় জীষ্ণুর গা থেকে কেমন প্রত্যয় ঝরে পড়ে! এই বহুতলে এই বয়সে
একটা টু-রুম কিনে ফেলা, চাট্টিখানি কথা নয়। জীষ্ণু হিসেবি। অন্য হোয়াইট কলার কর্পোরেটদের
মতো শুক্রবার হলেই বারে ছোটে না। বরং ইউনিভার্সিটি
থেকে জাহ্নবীকে ডেকে নেয় কোনো রেস্তোঁরায়। সেখানে খাওয়া দাওয়া, খুনসুটি। তারপর উবের
ডেকে নিজের ফ্ল্যাটে। অন্য খিদে কে আর মেটাবে প্রেমিকা ছাড়া? ফেরার সময় জীষ্ণুই উবের
ডেকে দেয় আবার।
জাহ্নবীর এ ব্যবস্থায় আপত্তি নেই। পাত্র
হিসেবে জীষ্ণু মন্দ কী? চুনখসা ঘর ছেড়ে এলিট বহুতলে থাকা যাবে, ভাবলেই ফুরফুরে লাগে। জীষ্ণুকে মোটামুটি কমিটেডই মনে হয়।
নাহলে যেচে বাবা-মার সঙ্গে দেখা করত কি? আশা করা যায়, গাড়িও কিনে ফেলবে একটা শিগগির। চিন্তাজাল ছিন্ন
করে তালা খোলার খুট শব্দ। জাহ্নবীর ঢোকে, পিছু পিছু জীষ্ণু।
দরজা বন্ধ হতেই পৌরুষ আবার ক্রিয়াশীল।
জাহ্নবী ডাইনিং টেবিলের সামনে, জল খাচ্ছে। দু'হাতে বোতল ধরে ঢালছে গলায়। জীষ্ণু পিছনে
এসে দাঁড়ায়। নিজেকে ঠেসে ধরে জাহ্নবীর শরীরের সঙ্গে। প্রায়-খালি বোতলটা জাহ্নবীর হাত
থেকে পড়ে যায় টেবিলে। সামান্য জল গড়িয়ে যায়... আর সেই সময়... আচমকা... ঘুরে দাঁড়িয়ে
জাহ্নবী জীষ্ণুকে সপাটে এক চড় মারে।
**********
ডাইনিং চেয়ারে স্থানুবৎ বসে আছে জাহ্নবী।
নাকের পাটা আর চোখ দুখানি লাল। শোবার ঘরের দরজাটা বিগত এক ঘণ্টা ধরে বন্ধ। চলে যাওয়াই
কি উচিত হবে এবার?
চড়টা খাওয়ার পর প্রচণ্ড বিস্ময়ে চেঁচিয়ে
উঠেছিল জীষ্ণু। তারপর কি ঝাঁকিয়েছিল জাহ্নবীর দুই বাহু ধরে? কী কী অশ্রাব্য খিস্তি
বেরিয়েছিল তার মুখ দিয়ে? কিছুই সঠিক মনে পড়ছে না। যেন একটা ঘোরের মধ্যে সে ছিল। কিন্তু
ঊর্ধ্ববাহুদুটিতে এখনও কনকনে ব্যথা। অতএব আন্দাজ
করা যায়, কিছু ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়ে থাকবে।
তারপরেই জীষ্ণু চলে গেছিল নিজের শোওয়ার ঘরে। ভিতর থেকে বন্ধ করে
দিয়েছিল দরজা। ও ঘর থেকে এখন ভেসে আসছে সিগারেটের
কটূ গন্ধ। পরপর সিগারট খাচ্ছে জীষ্ণু, বোঝা যায়। জাহ্নবীর মনে পড়ে, কোনো এক নরম-সরম
মুহূর্তে জীষ্ণু কথা দিয়েছিল, চেইন স্মোকিং ছাড়বে। সেসব এখন অতীত। একে একে ভেসে ওঠে
সেই প্রথম আলাপ। ফেসবুক চ্যাট। প্রথম দেখা হওয়া। কী এক বোকামিতে সবটা মাটি করল সে নিজে!
এই হাতে! নিজের অবাধ্য হাতটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় জাহ্নবী। সম্পর্কটা যে শেষ,
তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কী বলবে সে বাবা-মাকে? পাড়া-প্রতিবেশীকেই বা কী বলবে, যারা
এতদিন দেখেছে বাড়িতে জীষ্ণুর আনাগোনা? ক্ষমা
চাইবে কি? খুব একগুঁয়ে জীষ্ণু, একথা জাহ্নবী জানে। সহজে ক্ষমা পাওয়া যাবে বলে মনে হয়
না। পায়ে-হাতে ধরবে?
আরেকটু জল খেলে হত। সঙ্কোচ হয়। গৃহস্বামীকে
চড় মারার পর জলগ্রহণ করা কি উচিত হবে? কান্না
পায়। নিজের বিছানায় ঝাঁপিয়ে হাপুস কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মূল দরজা খোলা রেখে চলেই
বা যায় কী করে জাহ্নবী?
অগত্যা টোকা মারে সে শোবার ঘরের দরজায়।
একবার। সাড়া নেই। দুবার। সাড়া নেই। তৃতীয় বারে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে জীষ্ণু দরজা খোলে।
শার্টখানা খাটে ছুঁড়ে ফ্যালা। বাঁ হাতের গেলাসে হুইস্কি। ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট।
কথা ছিল, বাড়ি ফিরে নিজের হাতে পেগ তৈরি করবে জীষ্ণু। তুলে দেবে জাহ্নিবীর ঠোঁটে। তারপর
আরও গভীর আদর… আহা সপ্তাহান্তের মদির রাত! কোথা থেকে কী হয়ে গেল!
জাহ্নবীর চমক ভাঙে। সামনে একরাশ রাগ
আর বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে জীষ্ণু।
-আসছি
আমি।
-গেট
লস্ট।
-আয়াম সরি।
-হাউ
ডেয়ার ইউ স্ল্যাপ মি?
-আয়াম সরি।
- তুমি 'না' বলতে পারতে! গায়ে হাত তোলো
কোন্ সাহসে? বিচ!
চলে যাচ্ছিল। আরেকবার ঘুরে দাঁড়ায় জাহ্নবী।
চোখদুটো এখনও কান্নাভেজা, তবু গলায় বিস্ময়।
-কেমন করে 'না' বলে? কেমন করে বললে
'না' শোনা যায়?
থমকায় জীষ্ণু। 'না' শুনতে কি সে-ও প্রস্তুত
ছিল? বারবার সরে গিয়ে যতবার আকারে-ইঙ্গিতে 'না' বলছিল জাহ্নবী বিকেল থেকে, তাদের-কে
সে ছদ্মবেশী 'হ্যাঁ' ধরে নেয়নি?
-একটাই
কথা বলার ছিল। ওই চড়টা তোমার জন্য ছিল না। তুমি দায়ী নও। কী থেকে কী যে হয়ে গেল...
-মানে?
-আজ
বাসে... মানে নতুন কিছু নয়... এমন তো রোজই ঘটে। একটা হাত হ্যান্ডরেইলে, আরেক হাতে ব্যাগ...
আমি দাঁড়িয়েছিলাম। কয়েকটা ছেলে পিছনে এল। তাদের মধ্যে একজন... কোন্জন কে জানে! মুখও
তো দেখিনি। শুধু আমার পিছনে তার শক্ত পুরুষাঙ্গ টের পেয়েছিলাম... আমি জানি, বুঝতে পারি,
ভুল করে নয়, অ্যাক্সিডেন্টালি নয়… ইচ্ছে করেই ও... এবং জানো, পুরো সময়টাই সে ওভাবেই থাকল।
-তুমি...
তুমি কিছু বললে না! শুওরের বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিলে? গায়ের সাথে সেঁটে থাকতে দিলে সারাক্ষণ?
জাহ্নবীর
থেকে জীষ্ণুর রাগ সরে গিয়ে কোনো মুখহীন পুরুষের উপর পড়ে। ওই শরীরটা, অন্তত আজ সন্ধে
পর্যন্তও, তার ছিল। তার একার। অন্য কেউ তাতে ছোঁ মারবে কেন?
-
আমার গা গুলোচ্ছিল। বমি পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ঘুরে একটা চড় মারি। কিন্তু পারিনি৷ ইচ্ছে
করেছিল, সজোরে 'না' বলি। গলা দিয়ে স্বর বেরোয়নি।
-যাশ্লা!
মানে অকারণ চড়চাপড় ঘরে চালাবে আর বাইরে ভিজে বেড়াল? ন্যাকা নাকি তুমি? নাকি ভালো লাগছিল?
হোর! কচি খুকি তো নও!
জাহ্নবীর
আহত চোখদুটো রঙ পাল্টাচ্ছে। সেখানে রাগ জমা হচ্ছে৷
-কচি
খুকি নই। কিন্তু খুকি বয়স থেকেই... ওভাবে পুরুষাঙ্গ ঘষেছে বাসে-ট্রেনে কেউ না কেউ।
মা বলেছে, ভিড় বাসে না উঠতে। বলেছে, চুপ থাকতে। 'না' কী করে বলে জীষ্ণু? বলবে আমায়?
জীষ্ণু
থতমত খায়।
-বাড়িতেও
একবার, এক মামাতো দাদা ওইভাবে... সেকথাও বলেছিলাম। আবারও মা বলেছিল, চুপ থাকতে। চিৎকার
করতে কেউ বলেনি জীষ্ণু। আমার গাইড বুকের দিকে এমন করে তাকায়, মনে হয় স্বচ্ছ জামা পরে
আছি, ভিতর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। তাকে যদি চিৎকার করে 'না' বলি, খুব কেচ্ছা হবে। ওরকম
কেচ্ছাওয়ালা মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে?
-আর
কত কিছু বলবে অবান্তর একটা চড়কে জাস্টিফাই করতে?
-আমার কেমন যেন সব গুলিয়ে গেছিল, জানো!
যখন তুমি ওইভাবে পিছন থেকে… কীভাবে 'না'
বলে জীষ্ণু? সিঁটিয়ে যাওয়া, সরে যাওয়া, কাঠ হয়ে যাওয়া, এগুলো 'না' নয়? যদি 'না' বলতাম
সজোরে, লিফটে, ট্যাক্সিতে, রেস্তোরাঁয়... তুমি তাতে অপমানিত হতে না? উফ্, আবারও সব
গুলিয়ে যাচ্ছে। তুমি তো 'সে' নও। ইউ ডোন্ট ডিসার্ভ দ্য স্ল্যাপ। আমারই ভুল। সরি।
জীষ্ণু হতবাক দাঁড়িয়ে থাকে। 'তুমি তো
সে নও'। বলল জাহ্নবী। জীষ্ণু কি নিশ্চিন্ত হবে সেই শংসাপত্রে? হতে পারছে না কেন? জাহ্নবীর
সত্যি গুলিয়ে গেছে? নাকি জীষ্ণু ধরা পড়ে গেছে আসলে? অফিসের ফ্রেশার মেয়েটারও কি নিজেকে
স্বচ্ছবেশাবৃতা মনে হয় জাহ্নবীর মতো, যার প্রজেক্ট-হেড জীষ্ণু? জীষ্ণু কতখানি ধোপদুরস্ত
ওয়েল-ম্যানার্ড ভদ্রলোক? জীষ্ণু কতখানি 'সে'?
ক্যাঁচ শব্দে দরজা খুলে চলে যায় জাহ্নবী।
আবারও গালে হাত বোলায় জীষ্ণু। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। 'তুমি তো সে নও।' ব্যাঙ্গ ছিল না তো
গলায়? দাঁড়াও জাহ্নবী। বলে যাও। তুমি কি 'না' বলতে গিয়ে স্বরহীন হয়ে পড়তে আমার সান্নিধ্যেও,
যেভাবে হয়েছ আশৈশব? জীষ্ণু অনুভব করে, তার সমস্ত অস্তিত্বে ওই অব্যর্থ চড়ের মতো আছড়ে
পড়ছে কোনো অচেনা 'সে'। জীষ্ণু তাকে প্রাণপণ ঝেড়ে ফেলতে চায়।
খুব ভালো লাগল। গভীর চিন্তার ফসল এই ছোটো গল্পখানি। আরও ভালো ভালো লেখার আশায় থাকব।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুন