কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯১ |
সুখবিন্দর যখন প্রায় বাউন্ডারি লাইন থেকে লাল রঙের ডিউস বলটা ডান হাতের তালু ও আঙুলে গ্রিপ করে দৌড়তে শুরু করে তখন শুধুমাত্র ব্যাটসম্যান নয়, গ্যালারিতে হাজির কয়েক হাজার দর্শকেরও শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কেননা পরমুহূর্তেই সেই বলটা পিচে ড্রপ খেয়ে কী ভয়ংকর গতি ও বাঁক নিয়ে যে স্ট্যাম্পের দিকে ছোবল মারতে ছুটে যাবে অথবা ব্যাটের কাণায় লেগে উইকেটকিপার বা স্লিপারের হাতে ধরা পড়ে যাবে, তা কারও জানা নেই। আর যদি বলটা বাউন্সার হয়, তাহলে ব্যাটসম্যানের সমূহ বিপদ। ঘাড় নিচু করবে, নাকি পেছন দিকে সরিয়ে নেবে, ভাবার আগেই বুলেটের মতো বলটা বেরিয়ে যায়। মাথায় লাগলে আর রক্ষা নেই, হেলমেট ক্র্যাক করবেই আর ব্যাটসম্যানের মাথার ঘিলু উথালপাথাল হবেই।
মাঠের গ্যালারিতে যেদিন আসরা হাজির থাকে, সুখবিন্দর বল করতে দৌড় শুরু করলেই তারও একই অবস্থা হয়। বুকটা দুড়দুড় করতে থাকে, শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে ভুলে যায়, কখনও কখনও ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে যায়। আসরা এই নিয়ে অনেক হাঙ্গামা করেছে। সুখবিন্দরকে বলেছে, তুমি কী গো? বোলার না মার্ডারার? ক্রিকেট খেলছ নাকি দাঙ্গা করছ? দৈত্যের মতো ছুটে গিয়ে তুমি কি শত্রুবধ করতে চাইছ?
আসরার কথায় সুখবিন্দর হাসে। তার হাসিটা খুব মিষ্টি। হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ তো! একরকমের যুদ্ধই তো! যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। আর যুদ্ধ হলেই শত্রুবধ করতে হয়। না হলে জিতব কেমন করে?
আসরা সবই বোঝে। ক্রিকেটের সব নিয়মকানুন জানে। সুখবিন্দরদের দল জিতে গেলে তারও কতটা আনন্দ হয়, আর হেরে গেলে কেমন কান্না পায়, আসরা তা জানে, বোঝে। তবু সুখবিন্দরের জন্য খুব চিন্তা হয় আসরার। ভয়ও হয়। একই মানুষের মধ্যে অদ্ভুত এই দুই বৈপরীত্য তাকে কেমন যেন আশঙ্কিত করে তোলে। এমনিতে সুখবিন্দরকে খুব ভালো লাগে আসরার। লতার মতো তাকে জড়িয়ে থাকতে মন চায়। পড়াশোনায় মেধাবী, দীর্ঘ স্বাস্থ্যবান চেহারা, যে ইস্পাত কারখানায় চাকরি করে সেই কারখানার ক্রিকেটদলের ক্যাপ্টেন এবং সুপারফাস্ট বোলার, কথাবার্তায় বিনয়ী এবং হাসিমুখ, সব মিলিয়ে সুখবিন্দরের আকর্ষণে ও সান্নিধ্যে আসরা বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু খেলার মাঠে সেই সুখবিন্দরের চেহারা কেমন যেন পালটে যায়। বিশেষত যখন সে বল করতে বাউন্ডারি লাইন থেকে দৌড় শুরু করে। সুন্দর সেই মুখের মধ্যে তখন একটা রুক্ষতা ফুটে ওঠে। চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। চোখের দৃষ্টি তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। একটা বিধ্বংসী অবয়ব নিয়ে যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় বিরুদ্ধ দলের ব্যাটসম্যানের ওপর। সুখবিন্দরের বলের গতি অনুমান করে উইকেটকিপার দাঁড়ায় স্ট্যাম্প থেকে অনেকটা দূরে। অন্যান্য ফিল্ডাররাও দূরে দূরে। কেননা ঐ দুরন্ত গতির বলে ব্যাটসম্যানের ব্যাটের ছোঁয়া লাগলেই সেই বল আরও গতিসম্পন্ন হয়ে দৌড়াবে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে।
আসরা ভালোবাসে সুখবিন্দরকে। আগামী অগ্রহায়ণে তাদের বিয়ে। শুধু একটাই দুর্ভাবনা আসরার, যদি কোনোদিন কোনো কারণে তাকে আর সুখবিন্দরের ভালো না লাগে, সেদিন সুখবিন্দর কি সুপারফাস্ট বোলারের চরিত্রে অবতীর্ণ হবে?
৫৮ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর গিল্ক্রিসটের দৌড় মনে পড়ছে ইডেন উদ্যানে...
উত্তরমুছুন