কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

ময়ূরিকা মুখোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


জব্-লেস ক্যাফে


(১)

আলগা করে খুলে রাখা কভার ফাইলটার ভেতর খুব সন্তর্পণে একটা পর একটা মার্কশীট উল্টে-পাল্টে নিজের নামটা আপ্রাণ খোঁজার চেষ্টা করলো তিয়াস। কিন্তু পেল না। ভেতরের সবকিছু তালগোল পাকাতে শুরু করেছে হঠাৎ। আমারটা নেই কেন? নিজের মনকে অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেললো। কিন্তু উত্তর পেলো না। তার মানে কি আবার?

মনের ভেতর ভেতর একটা সাঙ্ঘাতিক প্রশ্নোত্তরের খেলা চললো তিয়াসের। হঠাৎ করে দেখতে পেলো ঋতুপর্ণাকে। প্রায় একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিল-

-এ ঋতু, বলছি ওখানে তোর মার্কশীট্ ছিল রে?

-কেন? তোর নেই? ওই যাদের সাপ্লি আছে, তাদের ম্যানেজমেন্ট থেকে নিতে হবে মার্কশীট্।

-সাপ্লি? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো তিয়াসের। ফাইনাল ইয়ারে সাপ্লি?

তার মানে চাকরী পাওয়ার যতটুকু সম্ভবনা ছিল, ততটুকুও… নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকলো তিয়াস, আর চোখের সামনে ক্রমশঃ যাওয়া-আসা করতে লাগলো ছ-মাস অন্তর ব্যাঙ্ক থেকে নিয়ে আসা ডিমান্ড-ড্র্যাফ্ট-এর অ্যামাউন্টটা… তারপর সব অন্ধকার।

 

(২)

 

একচোখ ভর্তি অন্ধকার নিয়ে ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বসলো তিয়াস।

‘ওহ্ এটা স্বপ্ন ছিল? সত্যিই স্বপ্ন ছিল তো?’

কোনরকমে বালিশ হাতড়ে ফোনের লক খুললো তিয়াস। কিছু সাত-পাঁচ না ভেবে তাড়াতাড়ি ডায়াল করলো মেঘার নাম্বার। যথারীতি ফোনের ওপাশ থেকে ফিরিস্তি সমেত জানিয়ে দিল যে নাম্বার ব্যস্ত।

-উফফ্ মেয়েটা এখনও প্রেম করছে?’ কিছুটা রেগে, মনে মনে বললো তিয়াস।

অবশ্য, ওর তো এখন প্রেম করারই সময়!

গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলো এরপর ঘুমটা খুব বিচ্ছিরি ভাবে ভেঙে গেছে। বাকি দু-জনকে একবার ফোন করার কথা অবিন্যস্ত ভাবে মাথায় এলো তিয়াসের। আসলে যতই লম্বা চওড়া গ্রুপ থাকুক না তিয়াসের, এই তিনজন বন্ধুই সবচেয়ে কাছের। বোকার মত বসে থাকতে থাকতে পাশবালিশে ধুপ করে মাথা গুঁজলো তিয়াস। ওমনি হঠাৎ ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো।

-এ হ্যালো… মেঘা… বলছি… শোন না… বলছি কি… আমাদের ফাইনাল সেমেস্টারের রেজাল্ট কবে রে?

-মানে? এই তুই কি রাত-দুপুরে গাঁজা খেয়েছিস? অত ঘটা করে রেজাল্ট বেরোলো, ঝুড়ি ঝুড়ি নাম্বার পেলি… তারপরেও… উফফ…

-ও, রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে, না! আসলে কি বল তো… আমি না এমন একটা স্বপ্ন…

তিয়াসের কথা শেষ হতে না হতেই মেঘা সপাটে উত্তর দিল, উফফ… তিয়াস… তোর আর তোর এই স্বপ্ন… মানে… যা তো। শুতে যা! রাত দুপুরে আর জ্বালাস না!

-সেই তো রে… এতক্ষণ তো তুই হরিনাম জপছিলিস, তাই না রে?

-যা, ভাগ এবারে, রাখলাম।

মেঘার ফোন রেখে দেওয়ার পর আর কিছুতেই ঘুম আসতে চাইল না। ক্লান্তিহীন ভাবে ফেসবুকের নিউজ-ফিড স্ক্রল করতে থাকলো। কী যে সাঙ্ঘাতিক একঘেয়ে এই ফেসবুক স্ক্রল করে যাওয়া, মনে মনে ভাবলো তিয়াস। বন্ধ দরজা-জানলার পরিবেশে হঠাৎ কেমন একা মনে হল তিয়াসের। নিস্তেজ হয়ে চেয়ে থাকলো পাখার ব্লেডের দিকে।

আচ্ছা, সত্যিই যদি আর কোনোদিন চাকরী না পাই, তাহলে কী হবে? মনে মনে নিজের কাছ থেকেই উত্তরের আশায় চোখ বুজলো তিয়াস।

 

(৩)

 দুমদাম করে এক থাবলা বাটার ফ্রাইংপ্যানে ঢেলে দিল লোটা। যদিও লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। দেখার মধ্যে ফ্রাইংপ্যানে বয়ে যাওয়া তরল মাখন আর তার ওপর কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবে ভেসে এল ডাবল্ ডিমের কাঁচাঝোল। ওপর থেকে পুষ্পবৃষ্টির মত ধেয়ে এলো পেঁয়াজ ক্যাপসিক্যাম আর ধনে পাতার আস্তরণ। তারপর সবশেষে নির্ভীক সৈনিকের মত ঘিরে ধরলো দুটো আস্ত সাদা পাঁউরুটি।

তিয়াসের ইন্সটাগ্রামের সাজেশন অংশে এইরকম হরেক রকমের স্ট্রিট ফুড-এর ভিডিও ছড়াছড়ি। তিয়াস রীতিমত গেলে এই এই ধরনের ভিডিওগুলো।

 

-কী একই খাবারের ছবি দেখিস বল তো? ভালোও লাগে?

-আরে মা, তুমি জানো না, পৃথিবীর সবচেয়ে ট্রেন্ডি বিজনেস্ হল ফাস্টফুড।

সেক্টর ফাইভের ফুটপাথে যদি একটা ডিম-পাঁউরুটির দোকান খুলতাম না, পুরো লাল হয়ে যেতাম।

-হ্যাঁ সেই… তোর তো আর, চাকরী-বাকরী কিছু হবে না, ওই করবি…

-খারাপ কি! আরেহ স্টার্টআপ ভাই স্টার্টআপ্… বিজনেস্ ইজ বিজনেস্।

-যা তো, খালি বড় বড় কথা!

সিরিয়াসলি, সত্যি করে যদি সল্টলেকের ফুটপাথে একটা দোকান খোলা যায়! মনে মনে ভাবলো তিয়াস।

 

(৪)

 -আচ্ছা, আন্দাজ কত দাম হতে পারে?

পটল-চিংড়িতে আঙুল চাটতে চাটতে প্রশ্নটা ডাইনিং টেবিলের একপাশে হাল্কা করে রেখে দিল তিয়াস। ও জানে, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত দুটো জিনিস হয়।

হয় তিয়াসের বাবা ব্যাপারটাকে হাল্কা করে সিরিয়াসলি নিয়ে সঠিক তথ্যই দেবে,  আর না হয়, ব্যাপারটা কোট-আনকোট ব্যঙ্গেই পরিণত হবে। তবে যাইহোক না কেন, কোথাও না কোথাও গিয়ে মধ্যবিত্তর গম ভাঙানো আটার রুটির মাঝখানে একটা সুন্দর মুহূর্ত তৈরি হয়ে যায়। যেটা দেখলে, অনুভব করলে, তিয়াসের ভারী আরাম লাগে।

-এই এককথা বলেই চলেছে, সেদিন থেকে। অত সস্তা নয়! ফুটপাথে দোকান খুলতে গেলেও এলেম লাগে।

খুব প্রত্যাশিত ভাবেই উত্তর দিল তিয়াসের মা।

 

(৫)

-না, সিরিয়াসলি বল না, কোনও ধারণা আছে? মানে কীভাবে… তবে আমার মনে হয় কি জানিস, কোনোরকম কোনো বিক্রি-বাটা বোধহয় হয় না। কিছু বোধহয় চাঁদা ফাঁদা আছে। না কিন্তু, চাঁদা…! ফুটপাথ নিতে গেলে চাঁদা?

কিছু তাহলে পারমিশনের ব্যাপার স্যাপার… খোঁজ নিতে হবে ভাই ভালো করে।

তিয়াসের এই সব পরিকল্পনা এক মুহূর্তে তাসের ঘরের মত হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো নূপুরের ধমকে। ল্যাপটপের ওপার থেকে বলে উঠলো, তুই যদি এরপর থেকে প্রোগ্রামের ইনডেনটেশান না ঠিক করিস, আমি তোর প্রোগ্রাম খুলবই না,  দেখা তো দূর। যদি ঠিক করে প্রোগ্রাম করতে পারিস, তবেই করবি, নয়তো করার দরকার নেই। কেউ তোকে জোর করছে না।

নূপুর ওইদিকে বকেই চলল তিয়াসকে। তিয়াস মনে মনে কল্পনা করলো, একটা দৃশ্য। আস্তে আস্তে নূপুরের দিক থেকে হাল্কা প্যান হয়ে, ওভার দ্যা শোলডার হয়ে, ক্লোজ আপ-এ আসছে তিয়াসের মুখ। নূপুরের রণং-চন্ডি মার্কা ভয়েস ওভারগুলো আস্তে আস্তে ফেড আউট হচ্ছে। হাসি পেল তিয়াসের।

 

 

(৬)

 

-উমম্… আইডিয়াটা মন্দ নয়… সেক্টর ফাইভ তো? তাহলে তো খাপে খাপ। যে যখন তোর দোকানে আসবে, তাকে তোর সিভিটা ধরিয়ে দিবি।

-ইয়েস! সি. ভি! উফফ্ রণদা, কী আইডিয়া দিলে গো… থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ!

শোনো, আমার দোকানের ইন্টিরিয়রগুলো হবে কী দিয়ে যেন?

আমার সি.ভি দিয়ে… যতগুলো সার্টিফিকেট আজ পর্যন্ত জমেছে, ততগুলো ল্যামিনেট করিয়ে, জায়গায় জায়গায় ডেকরেট করা হবে।নাম হবে কি জানো?

‘জবলেস্ ক্যাফে…’। না… এটা কিন্তু, একেবারেই এরকমটা বলা হচ্ছে না যে, আমি সাঙ্ঘাতিক যোগ্য, অথচ আমি চাকরী পাচ্ছি না। এটা একবারও বলা হচ্ছে না। বরং উল্টো। এটা কোথাও না কোথাও গিয়ে, সেই চিরাচরিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে কথা বলবে।

হ্যালো… হ্যালো রণদা, তুমি শুনছ?

-ওহ্… তোর বলা শেষ? আমি আসলে খেয়াল করি নি। হুম… তারপর?

-রণদা তুমিও? ধুর! ফোনটা রাখো তো…

রণদাকে ফোন রাখতে বললেও জব-লেস ক্যাফের ভূতকে মাথা থেকে কিছুতেই বের করতে পারলো না। ডিম-পাঁউরুটির সঙ্গে আর কী কী অ্যাড করলে ফিউসন বানানো যায়, সে সব চিন্তা-ভাবনায় ওর মাথা কিলবিল করতে থাকে। মাঝে মাঝে ঘোর ভাঙ্গে নূপুরের বকায়। আবার মন চলে যায় অ্যাডমিন পেজ-এর কোডিং-এ। তবু, এর মধ্যেই একদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে নিজের পাসবুকটা আপ-টু-ডেট করিয়ে এনেছে।

পঁয়তাল্লিশ হাজার চারশো বাহান্ন। ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে কি? মনে মনে ভাবতে বসে তিয়াস। এককেস ডিমের দাম একশো পঁয়ষট্টি… তিরিশটার মত থাকবে… একদম প্রথমদিকে, এককেসেই হয়ে যাবে… আর চার প্যাকেটের মত হাফ্ পাউন্ডের পাঁউরুটির প্যাকেট। পাঁচশো পেঁয়াজ, দেড়শোর মত লঙ্কা… আর একটা নুন-এর প্যাকেট… বাবা তো বোধহয় এককেজিরটাই আনে… যাইহোক… বেশী পড়বে না। কিন্তু সেক্টর ফাইভের ফুটপাথ! ওটার কী হবে? মাথায় হাত পড়ে তিয়াসের।

 

 (৭)

 

সল্টলেক নেই তো কী হয়েছে! বালিগঞ্জ তো আছে। গোলপার্ক আর রবীন্দ্র সরোবরের মাঝখানে এখন তিয়াসের ক্যাফে। কোনও একদিন রবিবারের সকালে গোলারুটি বানাতে বানাতে তিয়াসের মনে হয়েছিল, মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে রবিবারের জলখাবার একটা আলাদাই বিলাসিতা, তাই যদি ওটাকে নিয়ে কিছু করা যায়!

কথা মত কাজ। তিয়াসের ডিম-পাঁউরুটিও ঠাঁই পেল সেখানে। হ্যাঁ… লেখ তাহলে, পেনটা এগিয়ে তিয়াস সন্দেশকে বললো। সন্দেশ তিয়াসের আরেক বন্ধু।

 

এক নং হচ্ছে ডিম-পাঁউরুটি

দুই পাঁউরুটির পোলাও

তিন চিঁড়ের পোলাও

চার… চার… চার…

-চিকেন স্যান্ডউইচ – সন্দেশ বললো

ধুর ব্যাটা! বাঙালি রবিবার দেশি মুরগির ঝোল খাবে, না সকালবেলা গান্ডে-পিন্ডে চিকেন স্যান্ডউইচ গিলবে? যত্ত সব! লেখ চার নং – ধমকে সন্দেশকে চুপ করিয়ে দিল তিয়াস।

-তখন থেকে চার চার করে যাচ্ছে…আরে লিখবোটা কী?

-লেখ সাদা লুচি আর সাদা আলুচচ্চরি। তারপর পাঁচ কচুরি আর আলুর তরকারি। ব্রাকেটে লেখ, খোসা সমেত… ছয় রবিবারের চাউমিন…

-অ্যাঁ… সে আবার কী হয়? প্রশ্ন করলো সন্দেশ।

-আরে, রবিবারের চাউমিন খাসনি? আলু-বাদাম দিয়ে হাল্কা করে… যাইহোক… ছয় মুড়ি আর আলু-চচ্চরি, ব্রাকেটে সাদা।

-কী? ক্যাফেতে মুড়ি? আঁতকে উঠলো সন্দেশ।

-ইয়েস… লেখ… লেখ… তারপর হচ্ছে গিয়ে, মুড়ি আর ছোলা-মটর সেদ্ধ…

-আর দুদিন পর তোর হাতে হরি-মটর!

-চুপ কর! মধ্যবিত্ত পালসটা আর তুই কী করে বুঝবি! যাইহোক লিখেছিস… দে দেখি… এবার মেনু কার্ড  ছাপতে হবে… মেনু কার্ডের একপাশে থাকবে রেলিংওয়ালা ছাদের ছবি… কর্নার বরাবর খোলা আঁকার খাতা, আর এক পাশে একটা সাইকেল, যেটা বাবা চালাচ্ছে, আর তার বাচ্চা মেয়েট সামনে বসে আছে।

কেমন হবে বল? কী রে, কই গেলি? সন্দেশ… আরে ও সন্দেশ…

 

-বিছানাটা তাহলে তুইই তুলে নিস।

বাবার এই চির পরিচিত হুমকি শুনে ঘুম ভাঙলো তিয়াসের।

তার মানে, এটা স্বপ্ন ছিল? কিন্তু… তাও, যাইহোক… ভোরের স্বপ্ন তো… তাই, হয়তো একদিন… তিয়াস ভাবলো।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন