সমকালীন ছোটগল্প |
লুডোফোবিয়া
রোগা। ঝাঁকড়া
চুল। শ্যামবর্ণ। নাম-সীতারাম গুছাইত। সবই তো মিলে যাচ্ছে। ঘোষণাটা শুনতে শুনতে স্মৃতির
পাতায় হারিয়ে গেলেন মিলনবাবু। ঢলঢলে একটা
গেঞ্জি প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছে, বোঝাই যাচ্ছে অন্য কোনো সম বয়সী ছেলের পরিবারের
দাক্ষিণ্যে পাওয়া পোশাক। দাক্ষিণ্য সঙ্গে মর্যাদা কখনোই সমান্তরাল পথে চলে না। এই
পোশাক তারই প্রমাণ। পায়ের কেডসটাও তেমনই ইঙ্গিত করছে। সীতারামকে প্রথম দেখার দিনটা
এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারেন মিলনবাবু। সেক্রেটারি মিলন ভৌমিক ও তার সাঙ্গো-পাঙ্গোরা
রীতিমতো হাসাহাসি করত সীতারামকে দেখে। ১৫ বছর বয়স থেকেই নাকি স্বপ্ন দেখতো ফুটবলে
দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার। ‘ক্লাসকে’ ‘কেলাস’ বলা ছেলেটা বলে কী! পুঁইশাকের নাকি
ক্যাশমেমো! ক্লাবের সহ-সচিব কৌস্তভ বলতো। তবে সকলের উপহাস, ব্যঙ্গ, শ্রেণীবিভাজনের বোধের মাথায়
বাড়ি দিয়ে সেই ছেলে বিখ্যাত ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিল। কৃতিত্বের দাবীদার
অনেকটাই ছিল অনিকেত। সীতারাম গুছাইতের পায়ে নাকি জাদু ছিল। চামড়ার গোলকটা ওর পায়ের
সঙ্গে কথা বলতো। সমস্ত শটের ইশারা বুঝতো। অনিকেতের এমনটাই মনে হতো। বারবার মিলনবাবুকে
এই কথাগুলো বলত। সীতারামের একটা ড্রিবলে নাকি রূপকথার জন্ম হতো। অনিকেত আর সীতারামের
এই রূপকথায় ছিল হিংসুটে দৈত্য। কৌস্তভ। অনিকেত আর কৌস্তভের রেষারেষির ফল ভুগতে হয়েছিল
সীতারামকে। কৌস্তভের ঝাঁ-চকচকে ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শেখার আর্থিক ক্ষমতা ছিল না
সীতারামের। ধুলোয় পড়ে থাকা রত্নকে চিনে নিতে
অসুবিধা হয়নি অনিকেতের। কৌস্তভ আর অনিকেত দুজনেই ভালো ফুটবল খেলতো। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়
ডিভিশন বা সাব-ডিভিশনকে রিপ্রেজেন্ট করতো। নেশা, পেশা, অর্থ সবই সমান ছিল কৌস্তভের
কাছে। তাই ওর প্রশিক্ষণকেন্দ্রে শেখার সুযোগ পাওয়া বেশ কঠিন ছিল। অনিকেত একেবারেই
উল্টো। সাদা চামড়ার গোলকটার গায়ে যেন আবেগের চাদর লাগাতো অনিকেত। সীতারামকে নিয়ে
ফুটবলের গায়ে স্বপ্নের পালক সাজিয়েছিল সে। ইচ্ছে আর জেদের নৌকায় অধ্যবসায়ের পাল
তুলে দিয়েছিল সীতারাম। সকলের কাছে উপহাসের পাত্র হয়ে ওঠা রোগা, লম্বা, ঝাঁকড়া চুলের
যুবকটির স্বপ্ন জায়গা পেয়েছিল অনিকেতের বুকে। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সীতারামকে।
নানা স্তরে বেশ সুযোগও পাচ্ছিল। কিন্তু সব কিছুতে লম্বা দাঁড়ি টেনে দিল হৃদরোগে অনিকেতের
অকালমৃত্যু।
কৌস্তভও অনিকেতের
চলে যাওয়ার সুযোগে নানাভাবে অপদস্ত করতে লাগলো সীতারামকে। বেশকিছু খেলা থেকে বাদ পড়েছিল
ছেলেটা। সীতারামের শেষ ম্যাচের দৃশ্যটা এখনো মনে আছে মিলনবাবুর। ওর পায়ের কাছে ফুটবল,
খুব সহজ একটা শটেই ম্যাচটা জেতা যেত। সীতারামের সুযোগও ছিল আরেকবার নিজেকে প্রমাণ করার।
বল চোখের সামনে দেখে থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছিল ও। কিসের যেন ভয়। কোনরকম আক্রমণ
ছাড়াই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মিলনবাবু পরে ওকে দেখতে গিয়েছিলেন। কোটরগত
স্বপ্নহীন দুটো চোখে যেন ছিল কিসের যন্ত্রণা। সেদিনের পর থেকে আর খোঁজ নেওয়া হয়নি
ওর। কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে চিকিৎসার জন্য, এটুকুই জানতেন। তারপর পেশার জন্য
জায়গা বদল করতে হয়েছে মিলনবাবুকে। স্বাভাবিকভাবেই অনেক কিছুই মনের কোন এক অদৃশ্য
তালাবন্ধ কোটরে বন্দী থেকেছে। নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণাটা যেন সেসবের আগল খুলে দিল।
পুরনো ডায়েরি ঘেঁটে বের করলেন ওর বোনের নাম্বার।
স্বপ্ন, ইচ্ছে,
আশা এই সব অনুভূতির মৃত্যু কেমন দেখতে হয়! মিলনবাবুর শেষ ম্যাচে দেখা সীতারামের মুখটার কথা মনে পড়ল! মনের
সব আশা, আকাঙ্ক্ষাগুলো যদি ভয় নামের অন্ধকার কুঠুরিতে হারিয়ে যায়? একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের সব স্বপ্নগুলো কি ফানুসের
মতো উড়ে যায় তবে! লুডোফোবিয়া! ক্রীড়াভীতি! খেলার অদম্য ইচ্ছে থাকে, কৌশলও জানা
থাকে, শুধু সকলের সামনে সেই কৌশলের পরিচয় দিতে ভীতি। অবসাদ, কষ্ট, চেতনার অগোচরে দীর্ঘদিন
জমা হতে হতে জন্ম নেয় এই ভীতির। সীতারামের বোন জানালো লুডোফোবিয়ায় আক্রান্ত ছিল
ও। চিকিৎসা চলছিল একটা হাসপাতালে। কৌস্তভের ষড়যন্ত্র, ছোটবেলা থেকে সহ্য করা সকলের
ব্যঙ্গ সবকিছুই হয়তো জমা হচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। অনিকেতের মৃত্যুটা সেই জমে থাকা গ্লানির
বরফকে গলিয়ে ভয়ে রূপান্তরিত করেছিল। তাই খেলতে পারত না সীতারাম। নিজের অজান্তেই মিলনবাবুর
চোখ বেয়ে গড়িয়ে এলো জলের ধারা। তবে ওর বোন বলেছিল, হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার
মতো কোন লক্ষণই ছিল না ওর মধ্যে। এমনকি চিকিৎসায় ভালো সাড়াও মিলছিল। তারপরই একদিন
হাসপাতাল থেকে সীতারাম হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়।
অপ্রত্যাশিত কোনকিছুই
কি বোধ, চেতনা এ সবকে জাগিয়ে দেয়? হঠাৎ করেই মিলনবাবুর মনে হল, সম্প্রতি সীতারামের
জীবনের অন্যতম আইকন মারাদোনার মৃত্যুই কি তাকে সাধারণ জগত থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে
দিল? সে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা না করে মিলনবাবু কল্পনা করলেন, একটা ছোট্ট বাতি এক ঝলমলে আলোর সঙ্গে মিলেমিশে কোন অচেনা অলীক
জগতে মিলিয়ে গেলো।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন