কবিতা পাঠের অভিব্যক্তি : উচ্ছ্বাস না নীরবতা!
পথ চলেছে
পথের দিকেই বেঁকে।
এই অসীমের খোঁজ কখনও ফুরোয় না। তবু রোজ কেন
সে গন্তব্য হারায়! প্রশ্নটা এখানেই। জীবন একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে বাঁধা। প্রতিটি সকাল এক বৃত্তের ভোর। দিনের
চলাটাও শুরু সেই ভোর থেকেই। আমরা তাকে নতুন দেখি। একটা নতুন সকাল। মাঝে মাঝে ভাবি, শুরুরও কি শুরু থাকতে পারে! প্রতিটি শুরুর আগে সে কি আরম্ভ!
মুহূর্ত ভেঙে পল সেই আরম্ভের দিকে। ভেতরের অস্থিরতা হয়তো এভাবেই ভাঙে। টানাপোড়েনের ফাঁকে কিছু রঙ এসে ঢলে পড়ে। যেন সূর্যের সাতরঙ ভেঙে এই
রঙবাহার। তারপর মিলে মিশে একাকার। শুধু সাদা। তবে অনুভূতির বাহ্যত কোনও রঙ হয় না।
যেমন জল। তাই জলরঙে ভেতরে ভেতরে কণা কণা তাদের
মিলনের রাগ অভিব্যক্তিতে এসে মিলছে। আবার কখনও উপলব্ধির দিকে
বেঁকে যাচ্ছে। এই পাগলপ্রলাপের মতো তার ঘূর্ণন। কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কারণ ব্যক্তির সমস্ত অনুভূতিই
একান্ত ব্যক্তিগত।
একই বস্তু বা ঘটনা থেকে প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান। এটা নির্ভর করে দেখার চোখ
ও গ্রহণের ক্ষমতা থেকে। এভাবে একই বস্তু একই সময়ে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন।
এ থেকে আমরা অন্তত এখানে এসে পৌঁছতে পারলাম যে,
সমস্ত জ্ঞানই ইন্দ্রিয়লব্ধ। এ যদি হয় সত্য হয় তবে তা থেকে আমাদের
সামনে এখন শুধু শূন্যের এক খোলামাঠ। এসে দাঁড়ালাম। এই শূন্যের অব্যক্ততায় কিছু আলো
এসে পড়লো। কিছু ঘ্রাণ বাতাসে এলোমেলো উড়ছে। তাকে ধরার জন্যে দুহাত বাড়ালাম। কিন্তু
তাকে কি হাতে পাওয়া যায়! অতল
নীলিমায় নীল এক অফুরন্ত আকাশ মাঝে মাঝে কাশের ডানা মেলে উড়ছে আর নিঃশব্দের হাসিতে জাগিয়ে তুলছে কয়েকটি যুবতী নক্ষত্র। এই যে দেখা তা অনির্ভর অথচ যিনি দেখলেন তার কাছে
তো বাস্তব! এই বাস্তব-অবাস্তবের
মাঝখানে একটা জগৎ।
কবিতার জগৎ। তাকে মায়া বলা যায়। এভাবেই কিছু কিছু মায়া বিভ্রমের আলো-অন্ধকার নিয়ে, রঙ-বেরঙ নিয়ে কবির মনোজগতে দোলা দিতে
থাকে। যেন
ছোট ছোট পা ফেলে শূন্যের দিকে হেঁটে চলেছে। তাহলে কি এ জীবন ততটা দীর্ঘ নয়! এও এক আত্মজিজ্ঞাসা হতে পারে। এই দীর্ঘ-নাতিদীর্ঘ
নিয়েও নানা প্রলাপ জেগে উঠতে পারে। আসলে কবির জগৎ প্রলাপ ছাড়া আর কি!
এক অন্ধ ভিখারি পথে অতুলপ্রসাদী ধরেছেন। এই গান এক প্রসঙ্গ। কারণ এর মধ্যে
এক জীবন দেখা রয়েছে। এই দেখার মধ্যেই নিত্য তাঁর
গানের মহড়া। নতুন নয় তবে ফিরে ফিরে নতুন হয়ে ওঠে। ওই বোধ। মনের ভেতরে এক গভীর
বোধের নড়াচড়া। সুরের ভুবন তো হাওয়ায় হাওয়ায় ফিরছে। যখন হাওয়া ফেরে তখন মনে হয় এই
সুর হাওয়ারও। খণ্ড বিখণ্ডের অনুভূতি জুড়ে জুড়ে একক সুর দীর্ঘ হয়ে মধুর মূর্ছনায়
ধরা দেয়। গান তো আমরা শুনি, আবার
দেখিও।
দেখি গাইতে গাইতে গায়ক অনেক বেশি থামেন। এই থামাটাই মনে হলো সুরের ব্যঞ্জনা। যেন
মূল গানটা পড়ে আছে ওই নীরবতার মধ্যেই। যেমন কবিতা। তার বেলাতেও আমরা যেমন অনুভব
করি দুই পংক্তির ফাঁকে যে সাদা অংশগুলো,
কবিতা থাকে সেখানেই। তাহলে এভাবেও বলা যায় – যা দীর্ঘ নীরবতার অনুভব সে এক দীর্ঘ কবিতা। এই
দীর্ঘতা একটি মাত্র শব্দের মধ্যেও থাকতে পারে আবার পাতার পর পাতা জুড়ে তার বিস্তৃত
পরিসর। কবিও জীবনকে ভেঙ্গেচুরে নিজের মতো করে দেখতে বেরিয়েছেন। বলছেন –
দিনান্তে সব আসে একা একা
কথা শোনায় সৌভাগ্য গাঙের এবং বিড়ালের।
কুঁজো হয়ে বসে শোনে খদ্দের
শূন্য-বয়ামগুলি থেকে বাকি-রাখার
বাণী যায় উড়ে –
(নারায়ণ মুখোপাধ্যায়)
শূন্য থেকে শূন্যে, আরও
শূন্যে দিনান্তের চালাঘর জুড়ে রসিকের কেনাবেচা। জীবন চলে তারই ছন্দে। এই যে গাঙের হাওয়া, তার মধ্যে এক প্রবাহ। বিড়াল এক
প্রতীক, সঙ্গী থাকে জীবনের। শূন্যপাত্র এই জীবনসম্ভার, তা নিয়ে
কতটুকু আর বলা যায়! অথচ পড়ে থাকে এ জন্মের হাজার হাজার রজনীঘোর কথার ফের। কবিতার পাঠ এভাবে নিজের মধ্যে
কথার জন্ম দেয়। আমরা মাঝে মাঝেই নিজের সঙ্গে কথা বলি। নীরব কথা। নীরবতার সঙ্গে
কথা। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এক
নীরব নিঃসঙ্গতা বাস করে, কিন্তু সে আমাদের নিঃসঙ্গ করে না। তার সঙ্গতায় এক অপরূপ আনন্দের
জাগরণ ঘটে। এই যে গায়কের কথা এলো তিনি কিন্তু পোশাকি বাউল নন। অথচ বোঝা যায় ওই
মানুষটির দেহ এক, আর আত্মার মধ্যে আরেকজন। এক বাউলের বাস। যার
কোনও পোশাক হয় না। তার সঙ্গেই কথা হয়। কথার পৃষ্ঠে কথা জুড়ে জুড়ে ভাব, সুর আর প্রেম। আবার এই তিনে মিলে কখন যে নিরাসক্তি আসে! বৈরাগ্যের সাধ। সে এক আশ্চর্য গোলমেলে ব্যাপার। এই জগৎ, এ বিশ্ব চরাচর যে পথের ইশারা দেয় সে পথ ভাবনার। বিশ্ব হলো মন। মনের বাইরে
যাপনের অনেক শ্রম, অনেক রক্তঝরা। কিন্তু নিজের কাছে এসে
দাঁড়ালে বাইরে আর কোনও চেনা নেই, জানা নেই। শুধু একার মধ্যে একা হারিয়ে যাওয়া।
চরাচরে কবি ও পাগল তাই একই রসের নাগর। প্রেমের ভাব ও অভাব। প্রেমকেই মজিয়ে তোলে। একটা পথ বেঁকে চলে যায় ভেতর থেকে আরও ভেতরের দিকে।
অন্তর্নিহিতের ডাক ওঠে বারবার। ছিল প্রেম, হলো ভাব। এবার তাকে মজালে রসে। জীবনে চলার পথ তো অনেক,
যেতে হবে একই গন্তব্যের দিকে। কিন্তু তাকে আমরা অনন্ত বলতে পারি না। চির নির্ধারিত
গন্তব্যের কথাই রসিক বলতে চান। বলছেন – নাচো। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে খানিক নাচো। তবেই
তো প্রেমের ভাব বুঝবে। ভাবের রসে মজে ওঠো। তবেই জীবন বুঝবে। তার কতটুকু বুঝি আমরা! জীবন বোঝা কি অতই সহজ। বুঝতে বুঝতে এই নদী কোথায় যে হারায়! বললাম – সাধক যে সব ছেড়ে, এই সংসারের বাঁধন কাটিয়ে একলা পথের পথিক হয়ে ওঠার কথা বলেন। তার
বেলা!
উনি বলছেন – এই ভবের সত্যি-মিথ্যার আমি কি জানি ঠাকুর, আমি সামান্য ভিখিরি মানুষ। পথের ধুলো গায়ে মেখে পথে পথে ফিরি। দিনান্তে
মাধুকরির দুমুঠো অন্ন।
সংসারের ভার বইতে বইতে ভেতরে অন্ধ, বাইরেও। বলতে বলতে তিনি একটু থামেন।
উদাস হন। তারপর আপন মনে আবার গান ধরেন। মাঝখানে পড়ে রইলো শুধু টুকরো টুকরো তার
নীরবতা। সুর ঘুরে ঘুরে বাজে। শব্দ আর নৈঃশব্দ্য মিলে সেই সুরের নেমে যাওয়া। কখনও
কাছে আসে, আবার দূরে দূরে। এভাবে কোনও এক সময়
মিলিয়েও যায়। কিন্তু এই অব্যক্তের ব্যক্ততা যাঁকে আক্রান্ত করে, ভেতরে ভেতরে তিনিও নীরব যাত্রী হয়ে ওঠেন। উদাসীন লগ্নতা তাকেও জড়িয়ে
ধরতে বাধ্য।
মীর্জা গালিব বলছেন –
আমি রয়েছি
সেইখানে যেখান থেকে
আমার কাছে
আমারই খবর আসে না।
ওই যে পথের গায়কের কথা বলছিলাম – তিনি দূরের উদাসীনতায় হারিয়ে যেতে যেতে
এবার গেয়ে উঠলেন – "আশার আশা ভবে আসা, আসা মাত্র হলো"। অতুলপ্রসাদ থেকে রামপ্রসাদে পৌঁছতে এই যে সাঁকো তার উপর
মনের চলাচল। চরণ তো শূন্যে থাকে। শূন্যের পা শূন্যেই ফেলে ফেলে
আমরা কেমন দ্বিধা দ্বন্দ্বে ব্যাকুল হতে থাকি। কোথায় যেন মিলে যায় দুটি সুর। দ্বিধা
হলো 'আসা' আর
'আশা' নিয়ে।
চলে তো যেতেই হবে একদিন। তাই কোনও প্রত্যাশা নেই আর। করাও হলো না কিছু। কাজের কাজ
পড়ে রইলো সবই। নিজের কাছে নিজেও যেন শুধু হারিয়ে যাওয়া। সত্যের এই এক মরমী
যন্ত্রণা। কিন্তু যন্ত্রণার ভেতর সেই নীরবতার সুর দীর্ঘকবিতার মতো স্মৃতি নিয়ে
সত্তা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে ঘোরে আর ফেরে। এখানেই বেজে উঠলো যেন অনন্ত।
তো নিজের ভেতর যখন দুটি সত্তা একই সঙ্গে ক্রিয়া করতে থাকে, তখনই কি নিজেকে হারিয়ে ফেলার চরম মুহূর্তটি আসে!
অস্তিত্বের এই আজব খেলায় ভেতরে যতটা আলোড়ন, সেখানে উচ্ছ্বাসের ক্রিয়া নেই, ধর্ম নেই, নিশিপালন নেই। শুধু নৈঃশব্দ্য দিয়ে বুঝে নিতে হয় একটি হলো
বিষাদ, অন্যটি নিরাসক্তের
প্রণোদনা।
এই গান, সে এক মোহ। তার প্রবাহের টানে দুকূল
ছাপিয়ে অশ্রু আসে। বিষাদকে সে নিজের জলে স্নান করিয়ে দেয়। নিরাসক্ত আসে স্নানের পর
গা মুছিয়ে দিতে। তারপর আরেক পরত নৈঃশব্দ্যের চাদর জড়িয়ে বাইরের অস্তিত্বে একটু
হাওয়া খাওয়া। ঝিরিঝিরি দোলা লাগে হাওয়ার। যেন বসন্ত এলো এই শ্রাবণের দ্বারে। দ্বার
থেকে বাহির পর্যন্ত অপূর্ব আর অভূতপূর্বের ঘ্রাণ-গন্ধের আলপনাটা বৃষ্টিই আঁকছে।
কবি মাসুম রাজা বলছেন –
কোনো
অতিথিই আসত না যখন হৃদয় ছিল সমুজ্জ্বল
উজাড় হয়েছে
যেই, হৃদয় এখন যাতায়াতের পথ।
এ পথেই এক অতীন্দ্রিয় এসে নাড়া দেয়। হৃদয়ের মধ্যে অব্যক্তের নদীপ্রবাহ। উছল
কিন্তু ছলাৎছল আওয়াজ ওঠে না। সব ভেতরেই বাজে। তার উপর একটা সাঁকো। নদী বইছে। সাঁকো
দুলছে। কিন্তু পড়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। অতীন্দ্রিয়কে নিয়ে খেলছে মন। জগতের
সব সীমা ছাড়িয়ে, সব আবদ্ধতা ছাড়িয়ে
দেশকালের ঊর্ধ্বে।
এ হলো নিস্তব্ধতার বিস্তার। দীর্ঘ পরিসর রচনার আভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া।
প্রসঙ্গত, কবি রাহী
মাসুম রাজা বা রেজার কথা উঠলো। অনেকে নিশ্চয়ই জানেন, তিনি ছিলেন
উর্দু ও হিন্দী ভাষার বিখ্যাত কবি। তিনি কর্মজীবনে জড়িয়ে
ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে। বহু জনপ্রিয় হিন্দী গানের গীতিকার তিনি। বিখ্যাত অনেক সিনেমার
চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনাও করেছেন একেবারে নিজস্ব ঘরানায়। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১ সেপ্টেম্বর ১৯২৭ গাজীপুর এবং
মৃত্যু ১৫ মার্চ ১৯৯২ মুম্বাই।
যাহোক আমরা
ফিরে আসি
আমাদের একান্ত মায়া আর ভাবনার সংসারে। কবিতার একটি শব্দ ভেতরে বেজে
ওঠার আগে কত কত আলোড়ন যে সৃষ্টি হয় তা বোঝানো যায় না। কিন্তু ক্রিয়াটি চলতে থাকে।
প্রথমে তার আবহ সৃষ্টি হয়। কবিতা তো একই সঙ্গে সৃষ্টি ও নির্মাণ। সৃষ্টি যখন
নির্মাণের হাত ধরে, প্রথমে আলোড়িত করে শব্দকে। তখন তার পথে যে সম্ভাবনাগুলো, যাদের কুড়িয়ে কবি আমাদের সামনে অক্ষরের রঙ, রূপ, রসে সাজিয়ে দিতে চাইছেন, তার
মধ্যে কিছুটা বিভ্রম, কিছুটা মায়া তো কাজ করেই। ভাবনা তাদের ছাড়া বাঁচে না। ধরা যাক একটা দৃশ্য, বাস্তবে সেটা নেই, কিন্তু কবির ভেতর ভেসে উঠলো। যেমন গান আসে, কান্না আসে। কান্নার আবার অনেক রঙ। তাতে ভেসে যাওয়া। অরূপ আধার এক। এই অমূল্য
ভাণ্ডার গড়িয়ে শ্মশানের আভাস আসে, চিতা আসে, অগ্নি আসে। কখনও এমন হয় চোখের সামনে
নিরন্তর সেই চিতাটি জ্বলছে। চিতার উপর শুয়ে আছে একটা দেহ।
সে মৃত না জীবিত বোঝা যায় না। কখনও মনে হয় – এতো আমারই শব। এই অনুভূতি যখন জাগে, তা থেকে যে শব্দপুঞ্জের ঘনঘটা শুরু হয়, তা একজন পাঠকের মধ্যেও যখন চারিয়ে
যায় তখন পাঠক সবার আগে অবাক হন। অর্থাৎ বাক্যরহিত হন,
নৈঃশব্দ্যতাড়িত হন। অভিব্যক্তির উচ্ছ্বাস প্রকাশের তখন আর কোনও পথ নেই। ওই যে 'আমার কাছে আমারই খবর আসে না'– তাই নিজের মধ্যে নিজেকে তখন শুধু
খুঁজে ফেরা। নিজের মধ্যে নিজের আরেক
সত্তা, আরেক রূপ, প্রতিবিম্বের আলোছায়ায় খুঁজে ফেরা।
এখানে আমরা
দুটি অণুকবিতার কথা উত্থাপন করলাম। কিন্তু ভাবনার বিশ্বে তার বিস্তৃতি
অণু নয়।
দীর্ঘ পরিসর জুড়ে জীবনের এক
আশ্চর্য অনুভব জাগালো।
বোধের চিত্রায়ন ঘটলো। গোটা ক্যানভাস জুড়ে যে রঙ, সুর, তার কি
কোনও ব্যাখ্যা হয়! এই রঙের বিশ্বটিও অব্যক্ত। এই
অব্যক্ততার মধ্যেও যেটুকু বলা যায় তা হলো পরিসর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কবির অভিপ্রায়ই
প্রধান। তিনি তাঁর ভাবনাকে কীভাবে প্রকাশ করতে চান সেটাই লক্ষ্যণীয়।
ঠিক এভাবেই আমরা পরিসরে দীর্ঘ এমন কবিতাকে সামনে রেখেও কিছু কথা বলতে পারি।
বলার কথা হলো, চর্যাপদের পর থেকে উনিশ
শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমরা কাব্য বলতে যা বুঝেছি তা আসলে গান। কারণ কবিতাকে গান করেই শোনানো
হতো। অবশ্য আমরা পাঠযোগ্য কবিতায় এসে পৌঁছেছি সেই মহাকাব্যের হাত ধরেই। যা ছিল আখ্যায়িত কাব্য। যেখানে চরিত্র, ঘটনা, জীবনের অভিঘাত নিয়ে এক একটা পরিসর। সময় ও কাল
জুড়ে তার বিস্তার।
সেখানে নানা রসের সংমিশ্রণ রয়েছে। ফলে তার অভিব্যক্তিও নানারকম। হাসি, কান্না, ক্রোধ, উল্লাস, প্রতিশোধস্পৃহা সবই হয়তো রয়েছে। পরবর্তীতে গদ্যসাহিত্যের যখন
উদ্ভব হলো, তার কাহিনি, চরিত্র
বিন্যাস থেকে যে অভিঘাত, তার প্রতি মানসিক অবস্থান হয়তো একরকমই।
আখ্যানকাব্যে কবির প্রধান অভিপ্রায় ছিল দেবতার মাহাত্ম্য প্রচার এবং
ধর্মবিশ্বাস। সাহিত্যের বিবর্তনে সেখান থেকে দুটি শাখার উদ্ভব ঘটেছিল।
গদ্যসাহিত্যে কাহিনি, চরিত্র, ঘটনার সংঘাত – সব মিলিয়ে কিছুটা জীবনের কথা বলা শুরু হলো। তখন অভিব্যক্তিও পাল্টে
গিয়ে জীবনকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে লাগলো। মহাকাব্যের একটি শাখা এভাবে বেঁকে গেলো
উপন্যাসের দিকে। পরবর্তীতে উপন্যাস ছোট হতে হতে জন্ম নিলো ছোটগল্প। এক্ষেত্রে
লক্ষ্য করা গেলো কাব্যের প্রধান গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো আর গদ্যে থাকছে না। যেমন
কাব্যময়তা, যেমন রূপকচিত্র, রহস্যব্যঞ্জনা, তার ব্যবহার, প্রতীক, দৃশ্যকল্প ইত্যাদি। একেবারে যে থাকছে না তেমন নয়। সে প্রসঙ্গ অন্য।
আমরা উপন্যাসের কথা বললাম। সাহিত্যে গদ্যের পাশাপাশি বিশেষত মহাকাব্যের
প্রভাব ও প্রচারের গুণে আরেকটি শাখার জন্ম হয়েছিল। বলা যায় প্রতিকাব্য। সময়ের
আধারে মহাকাব্যের বর্ণময় চরিত্র, সংঘাতময়
ঘটনার অভিঘাত থেকে জন্ম নেওয়া নতুন কবিতা। দীর্ঘ রূপে। এছাড়া সংলাপ কাব্য, কাব্যনাটক ইত্যাদি। রবীন্দ্র-উত্তর
কালে দেখা গেলো দীর্ঘকবিতাও ক্রমশ নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠছে। আর এই নৈর্ব্যক্তিকতাই আমাদের টেনে নিয়ে যায় গূঢ়
নৈঃশব্দ্যের দিকে। এই নৈঃশব্দ্যই পাঠক মনের বিশেষ অভিঘাত।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সবই
বদলায়।
যেমন এখানে দেবতার অনুগ্রহ কমে কবিতার ধারা নেমে এলো মাটির মানুষের কাছাকাছি।
চরিত্র এবং ঘটনার মধ্যে নতুন ভাষায় নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ পেতে শুরু করলো সমকালীন
সমাজভাবনা, জীবনদর্শন, মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না, প্রেম, বিরহ ইত্যাদি। এখন সময় আরও বদলে গেছে।
দ্রুতগামী হয়েছে। তাই পাঠকের মানদণ্ডে সময় ছুটছে। শিল্প প্রকাশিত হতে
চাইছে তার তালে তাল মিলিয়ে। কম পরিসরে বৃহতের ভাবনা। কম শব্দে সহস্রের মূর্ছনা।
ছোটগল্প তাই ছোট হতে হতে আরও ছোট। অণুগল্প বা ঝুরোগল্প। তেমনি মহাকবিতা থেকে
অণুকবিতার দিকে যাত্রা। যদিও আমরা
উর্দু শের, জাপানি হাইকু ইত্যাদি বহু আগেই পেয়েছি। যা অণু হলেও প্রসারতায় অনেক অনেক দীর্ঘ নীরবতার
কথাই বলে।
এই নীরবতাই
আমাদের একটি কবিতার দুই পংক্তির মধ্যবর্তী সাদা অংশে বা এক স্তবক থেকে আরেক স্তবকে
যাওয়ার পথে নৈঃশব্দ্যের কাছে এনে দাঁড় করায়। যখন কবি বলছেন–
সন্ধ্যাপাতা ঝরে পড়ে রাত্রিগাছ থেকে। একাগাছ।
হিম রাত। পান্থশালা। পাশে নদী। একা নদী।
কারা যেন আগুন জ্বেলেছে। আঁকে আবছা তারাদের মুখ।
ছায়াকঙ্কালের
মত ট্রেন গেল দিগন্ত কাঁপিয়ে।
(অশ্বমেধ / মঞ্জুষ দাশগুপ্ত)
এখানে শুধু
পংক্তি নয়, স্তবক নয়, প্রতিটি শব্দের ফাঁকে ফাঁকে ভাবনার বীজ। দীর্ঘ দীর্ঘ নৈঃশব্দ্যের ওম জাগে। একটু একটু করে আমাদের আলোড়িত করতে চায়। পাঠককে ডাকে। বলছে – দেখো। মননের দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়াও। দেখো টুপ
শব্দে ঝরে পড়লো যে পাতাটি তার শরীর জুড়ে সন্ধ্যা। যে গাছ থেকে সে পড়লো, সেটি রাত্রিগাছ। বোধকে প্রসারিত করো। একাকী নিঃশব্দের মধ্যে
বাহিত আত্মার প্রবাহ। কবিতা এখানে।
সচেতন অভিপ্রায় বোধ ও মননকে ভিন্ন রূপে জাগায়। শব্দে তার প্রকাশ ঘটে। চেতনা
যত প্রসারিত হবে পথ তত দীর্ঘ হবে। এখানে বলার হলো,
মহাকাব্যের যুগ ছেড়ে যেমন একটি পথ বেঁকে গিয়েছিল গদ্যসাহিত্যের দিকে, আরেকটি পথ গেলো দীর্ঘকবিতার দিকে। জীবনানন্দ যাকে বললেন
মহাকবিতা। আমরা প্রসঙ্গক্রমে বলতে চেয়েছিলাম গদ্যসাহিত্যে কাব্যের প্রধান গুণ বা
বৈশিষ্ট্যগুলো বর্জিত হতে থাকে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্যে আমরা মাঝে মাঝেই
কবিতা ফুটে উঠতে দেখেছি। মহৎ সাহিত্যের এটা একটা দিক। আবার রবীন্দ্রনাথ যখন 'শেষের কবিতা' লিখছেন তখন সমগ্র উপন্যাসের মধ্যে যে
পাওয়া না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব, যে স্বপ্ন-ব্যর্থতা, যে ক্ল্যাইমেক্স, তা তো দীর্ঘ কবিতার আরেক রূপ। বুদ্ধদেব বসু এই উপন্যাসকে বলেছেন 'কাব্যোন্মাদ কাহিনী'। এরকম আরও অনেক কাহিনি আমরা
বাংলা সাহিত্যে পেয়েছি, যার পরতে পরতে সেই নৈঃশব্দ্যের মধুর মূর্ছনা। কবিতার আবহ নিয়ে টেনে নিয়ে যেতে
চায় আরও গভীর কোনও অনুভূতিদেশে। বিস্তীর্ণ সেই চরাচরে এসে বসে অবাক আঁচল পেতে।
কবির সৃষ্টিতে আত্মজৈবনিক উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে এই পরিসর রচনা। এ প্রসঙ্গে
অবশ্যই স্মরণীয় যে কবিতার জগৎ সবসময় রহস্যের
জগৎ। কবি বলছেন, "যে জগতে প্রবেশ করার চাবি পাঠককেই নিজের চেষ্টায় আপন
অনুভূতি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে। কবিতা কিছু বলবে না তা নয়, বরং অনেক
অনেক কিছু বলবে, স্তরে স্তরে তার অন্তহীন অর্থ ছড়ানো থাকবে। কিন্তু বলবে পরোক্ষভাবে, আকারে-ইঙ্গিতে, নানা সংকেতের মধ্যবর্তিতায়, শব্দকে তার
সাধারণগ্রাহ্য অর্থের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে।" ( রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিকতা / অরুণকুমার
সরকার)
এই সত্যের নিহিতে পাঠকের চারণভূমি। কবি চলেছেন তার সৃষ্টির বীজ আপন খেয়ালে
বিশ্বে ছড়িয়ে ছড়িয়ে। পাঠককে নেমে পড়তে হবে সমস্ত বাঁধন খুলে। মনের বাঁধন, চিত্তের বাঁধন, সংস্কারের বাঁধন খুলে। তা না হলে শব্দকে অর্থের
বন্দীদশা থেকে মুক্ত করা সম্ভব কীভাবে!
অভিজ্ঞতায় প্রসারিত বোধই কবির অভিপ্রায়কে ভাষা ও আঙ্গিকের খেলায় মাতিয়ে তোলে। আবার জাগতিক সমস্ত সংকট থেকেও
মূর্ত-বিমূর্তের খেলা তীব্র হতে
পারে।
এর সব কিছু নিয়েই কবির জগৎ। এক উপলব্ধিময় বিশ্ব। আমাদের নেমে যেতে হয় তার অতলে।
ধরা যাক
একটা দৃশ্য এলো।
জ্যোৎস্না খেলছে জাগতিক অস্থিরতার মধ্যে এক অবাক স্থির জলস্থলির উপর। মন ঠায়
দাঁড়িয়ে সেখানে। মুহূর্তে জল ভরে উঠছে ফুল, পাতা, রজনীচন্দনের ধূপগন্ধ নিয়ে। যেন রচিত হলো একটি মনবাসর। ঘর বলতে সেই শূন্যের
চরাচর। হঠাৎ বৃষ্টি এলো। যেন পায়ে নূপুর তার। অবিশ্রান্ত টাপুরের মধ্যে টুপুর
টুপুর ধ্বনি। বৃষ্টি কীভাবে এক নারীর আদল পায় কেউ জানে না। কবি তাকেই দেখেন। তার
হাঁটার তালে, নৃত্যের ভঙ্গিমায় যেন
মহাকালের মুহূর্তগুলোও ধ্বনিময় মাধুর্য হয়ে বেজে ওঠে। বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় আমাদের।
কবি দেখেন কখনও বৃষ্টি, কখনও নূপুরের ধ্বনি, কখনও বিস্তীর্ণ
ক্ষেত্রভূমি জুড়ে পাকাধানের শীষ দুলে উঠছে। বেজে
উঠছে বাঁশির সুর।
ভাঙা ভাঙা ধ্বনিগুলো কবি নিঃশব্দ দিয়ে জুড়তে বসেন সেই বাসরঘরের এককোণে।
এই দেখার মধ্যে যে বাস্তব, পাঠককে
সেখানেই পৌঁছতে হয়।
ওই যে অপার রহস্যের জগৎ, সেখানে
প্রবেশের চাবিটি।
সমস্ত কি খুলে বলা যায়! যা অনুভব
থেকে পাওয়া তাকে অনুভূতির তারেই বাজাতে হবে। সৃষ্টিরহস্যের বাকল খুলে দৃশ্যের আড়ালে যে দৃশ্য
তাকে উন্মুক্ত করতে হবে। যে স্রোত ভেতরে বইছে, সেখান থেকেই দৃশ্যের উদ্ভব, তারপর দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে পৌঁছে যাওয়া। বাস্তব থেকে পরাবাস্তব হয়ে
অতিবাস্তবের পথকে প্রসারিত করা। যে নারীটি বৃষ্টি থেকে আদল পেলো তার ছায়াও
ধারাপাতের বিন্দু থেকে নির্মিত। আবার দৃশ্যের পট যখন বদলায়, হয়তো এই
আলোকিত বাসর, এই ভরা শষ্যক্ষেত্র সব নিভিয়ে শ্মশাননিস্তব্ধতায় ভরে উঠলো। বাসরের সাজ হয়ে উঠলো চিতাসাজ।
শুধু আতর আর ধুনোর গন্ধ। সুদূরপ্রসারী রাত্রি এসে বাজিয়ে চলেছে পারাপারের গান।
কোনও গানই স্পষ্ট নয়। অশ্রুনদীটি খেয়া বাইছে চাঁদের ঘাট বরাবর। তো এই হলো জীবন
থেকে মৃত্যুর পথে শৈশব পেরিয়ে একবার বাসরের সাজ, ক্রমে ধূধূ মাঠ, জলাধার, শ্মশান, অগ্নি সব মিলিয়ে চক্রটি যখন পূর্ণ হয়, পড়ে থাকে
বিষাদের দুঃখ ছুঁয়ে আনন্দের মিশ্ররাগ। দুঃখ এবং আনন্দ তখন পাশাপাশি হাঁটে।
আমরা আগেই
বলতে চেয়েছিলাম চেতনার আলো আর বোধের বিস্ময়েরর কথা। একজন কবি যেমন পূর্বাপর শব্দের খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে
সময়কে অতিক্রম করেন তেমনি পাঠককেও তার চেতনার সঙ্গী হতে হয়। সময় পাল্টে দিচ্ছে
সৃষ্টির প্রবণতাগুলো। ফলে বদলে যাচ্ছে অনেক
লক্ষণ।
পরিবর্তনশীল সভ্যতার নতুন নতুন লক্ষণ ফুটে ওঠে কবিতার শরীরে। যা হয়ে ওঠে নতুন
দর্শন। কিন্তু পাঠবিশ্বে তার অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয় সেই নীরবতার মধ্যে দিয়েই। এর
বেশি আর বলার কী থাকতে পারে, শুধু পাঠক হয়ে ওঠা ছাড়া…!