শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ
শীর্ষেন্দুদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় টেলিফোনের মাধ্যমেই।
প্রথমবার কথা বলেই খুব ভালো লেগেছিল।
সেইসময় ওনার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে নিই। জাহিরুল হাসানের ‘সাহিত্যের
ইয়ারবুক’ থেকে ওনার ঠিকানা নিয়ে নির্দিষ্ট দিনের অপেক্ষা করতে থাকি।
ছোটবেলা থেকেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলো পড়েছি।
এমনকি পরিণত বয়সে পৌঁছেও ওনার কিশোর উপন্যাস সমান ভাবে আকর্ষণ করেছে। সাহিত্য
মানুষের নান্দনিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। আর এই কিশোর উপন্যাসগুলো শুধু রসবোধ সম্পন্ন
মানুষই তৈরি করতে সাহায্য করে না, পাশাপাশি একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতেও সাহায্য করে। এই উপন্যাসগুলো পড়তে পড়তে
একবারও মনে হয়নি যে, তিনি এমন একটা কিছু
লিখেছেন, যা অসঙ্গত। তা খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের কাছে সঙ্গত বলে মনে হয়। তাঁর কিশোর উপন্যাস
ফ্যান্সি ও ফ্যান্টাসির সংমিশ্রণ। তিনি শুধু মাত্র ছোটদের জন্য উপন্যাস লিখলেও
বড়দের কাছেও সমান ভাবে মনোযোগ দাবী করে। এই কিশোর উপন্যাস সম্পর্কে আরও বিস্তারিত
তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই শীর্ষেন্দুদার
একটা সাক্ষাৎকার প্রয়োজন হয়েছিল।
নির্দিষ্ট দিনে গেলাম যোধপুর পার্কে। অনেক খোঁজার পর তাঁর
বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখি প্রচুর লোক। আমাকে সময় দেওয়া ছিল বারোটা
থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে। ভাবলাম এই ব্যক্তিগুলিও হয়তো আমারই মতো শীর্ষেন্দুদার কাছে কোনো প্রয়োজনে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ বসে
থাকার পর এক ব্যক্তি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন-
"আপনিও কি দীক্ষা নিতে এসেছেন?"
প্রশ্নটা শুনে ধাতস্থ হতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। বিভিন্ন
পত্র-পত্রিকায় শীর্ষেন্দুদার জীবনে ঠাকুর শ্রীশ্রীঅনুকূলচন্দ্রের মাহাত্ম্যের কথা
শুনেছিলাম। তাই উক্ত ভদ্রলোকের প্রশ্নই আমার সমস্ত কৌতূহলের নিরসন করে। এনারা
সকলেই তাহলে শীর্ষেন্দুদার কাছে দীক্ষা নিতে এসেছেন। বললাম-
"না। আমি ওনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি।"
পাল্টা প্রশ্ন- "কোন্ চ্যানেল বা পত্রিকা থেকে?"
বললাম, আমি কোনো চ্যানেল বা পত্রিকা থেকে আসিনি। পুরোটাই
ব্যক্তিগত কাজের জন্য। এমন সময় দেখি,
শীর্ষেন্দুদা নামছেন ওপর থেকে। প্রথম দর্শনেই আমি অভিভূত। গলায় একটি পাটের জোড়, পরনে লুঙ্গি।
করজোড়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। গিয়ে প্রণাম
করলাম। উনি আশীর্ব্বাদ করলেন। সেই সময় অত ভিড়ের মধ্যে নিজের পরিচয় দিতে ইচ্ছে হলো না।
যারা দীক্ষা নিতে এসেছিল তাদের সকলকে নিয়েই তিনি পাশে ঠাকুরঘরে গেলেন। প্রায় একঘণ্টা পর তাঁর
দীক্ষাদান সম্পূর্ণ হয়। এরপর তিনি বৈঠকখানায়
এসে বসলেন। সবাই ওনাকে আধ্যাত্মিক
বিভিন্ন প্রশ্নে জর্জরিত ক্রতে থাকে। কিন্তু তিনি একটুও বিরক্ত না হয়ে সবার সমস্ত
প্রশ্নের উত্তর দেন। কয়েকজন নিজের ব্যক্তিগত
জীবনে মানসিক চাঞ্চল্য নিরসনের উপায় জানতে চাইলে তিনি সকলকেই ইষ্টভীতি করার কথা
বলেন। ঠোঁট বন্ধ করে মানসিক জপ করার কথাও বলেন।
এক মহিলা জানতে চান, বাচ্চা যখন খুব দুষ্টুমি করে তখন রাগের
বশবর্তী হয়ে বাচ্চার গায়ে হাত তুলতে হয়। এটা
কি অন্যায়? এই রাগ কীভাবে প্রশমিত করা যায়? শীর্ষেন্দুদা বললেন, সন্তানকে শাসন
করার মধ্যে কো্নো অন্যায় নেই। কিন্তু ক্রোধ
প্রশমিত করতে হলে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
আমি তখন শুধুই নীরব শ্রোতা। একসময় ওনার সঙ্গে সকলের অনেক
ছবিও তোলা হলো। বাড়ি থেকে সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হলো। এরপর তাঁর দৃষ্টি পড়ে আমার দিকে। বলেন- “অনেকক্ষণ ধরে তুমি অপেক্ষা করছ।
আর একটু বোসো”। যারা এসেছিল সকলকে দরজা
থেকে বিদায় জানিয়ে আমার কাছে এসে বসলেন। বেশ কিছু বিষয়ে
আলোচনার পর আমি তাঁর কিশোর উপন্যাসের ওপর প্রশ্ন করতে শুরু করলাম।
প্রঃ ১৯৮০-২০১০
পর্যন্ত যে সমস্ত উপন্যাসগুলি প্রকাশিত হয়েছে, সে বিষয়ে আপনার মতামত
কি?
--যারা আমার কিশোর উপন্যাস পড়েছে, তারা জানে যে আমি জটিল কোনো
উপন্যাস লিখিনি। আমি যেটা লিখেছি, সেটা
মজার। এই উপন্যাসগুলোতে ভূত থাকে, দারোগা থাকে,
গ্রাম থাকে। অঞ্চলগুলো সব গ্রাম ভিত্তিক। পরিবেশটা তাতে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় কথা
গ্রামের লোকগুলো সহজ সরল হয়। শহরের লোকেদের মতো এত প্যাঁচাল হয় না। গ্রামের পরিবেশটা
আমার ব্যক্তিগত ভাবে ভালো লাগে। শহরের পরিবেশ আছে দু-একটি গল্পে। যেমন ‘বক্সার রতন’। ‘বনি’
উপন্যাসে বিদেশের পটভূমিকা আছে। গ্রামের পরিবেশ নিয়ে উপন্যাস লিখতে আমার ভালো
লাগে। শহরের পরিবেশও আছে দু-একটি উপন্যাসে। বৈশিষ্ট্য যদি বলতে, এইই। আর কোনো বৈশিষ্ট্য আমার মুখ থেকে শুনে বিচার না করাই ভালো।
কারণ আমার উপন্যাসের পরিবেশ তো অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে! সব থেকে বড় বিষয় হলো,
আমি বাচ্চাদের নিয়ে মজা করতে ভালোবাসি, তাই মজাটাই করি। রসিকতা থাকে, চোর থাকে,
ডাকাত থাকে, চোরগুলো আবার ভালো চোরও হয়।
ভূতগুলোও ভালো ভূত।
আমার উপন্যাস ঠিক ভূতের উপন্যাসও নয়। ভূত ও মানুষ মিশিয়েই
উপাদান আছে। ভূতকে উপাদান রূপে গ্রহণ করার
প্রধান কারণ হলো, ভূতকে নিয়ে মজা করা যায়। আবার যে সব কাজ মানুষ করতে পারে না, সেগুলো ভূত
করে দেয়।
প্রঃ ১৯৭৮-২০১৪ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে যে উপন্যাসগুলো বেরিয়েছে,
আপনার কি মনে হয়, যে একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে সেগুলোর গতি পরিবর্তিত হচ্ছে?
--খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে তো আমার মনে হয় না। মাঝে
মাঝে কিছু পরিবর্তন তো আনতেই হয়। যেমন
‘বনি’, ‘বক্সার রতন’।
প্রঃ চতুর্থ খণ্ডের কিছু উপন্যাসে আগ্নেয় অস্ত্রের ব্যবহার
দেখি। সেদিক থেকে কি কিছু পরিবর্তন হিসাবে ধরা যায়?
--আমার লেখায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার খুব একটা নেই। বন্দুকের
ব্যবহার আগেও ছিল, যেমন ‘মনোজদের অদ্ভুত
বাড়ি’তে বন্দুকের ব্যবহার ছিল। বন্দুকের মাধ্যমে খারাপকে খুব একটা দেখাই না, যে
সেখান থেকে বিপদ হচ্ছে এরকম কিছু। তাই খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে নতুনত্ব তো
আনতেই হয়।
প্রঃ আপনি কিশোর উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু সেগুলো কি শুধুই
কিশোরদের জন্য? সেগুলো কি শুধুই ভূত, শুধুই কল্পবিজ্ঞান; নাকি সেখান থেকে কোনো
মহত্তর জীবন সত্যে উপনীত হওয়ার কথাও
বলেছেন?
--আমার কিশোর উপন্যাস তো কিশোরদের থেকে বড়রাই বেশি পড়ে।
হ্যাঁ, কল্পবিজ্ঞান অনেকগুলোই লিখেছি।
কল্পবিজ্ঞানের ওপর লেখা বেশ কিছু উপন্যাস আছে। যেমন ‘বনি’, ‘পাতালঘর’ প্রভৃতি।
মিলিয়ে মিশিয়ে সবগুলোতেই উপাদান ঘুরে ফিরে এসেছে। আমি যে টানা ভূতের উপন্যাস
লিখছি, কি টানা কল্পবিজ্ঞান লিখছি, এমন নয়।
ভূতের উপন্যাসের মধ্যে কিছুটা বাস্তব, কিছুটা পরাবাস্তব মিশে যাচ্ছে। বেশ একটা
পাঁচ মিশেলী ব্যাপার। একই সঙ্গে ভূত আছে কল্পবিজ্ঞান আছে ছোটদের উপন্যাসে। ভালোত্বের
মহত্ব বা ভালোকে জিতিয়ে দেবার একটা প্রবণতা আছে। Good and bad, black and whiteএর যে পার্থক্য, সেভাবেই
একটা ব্যাপার চলে আসছে। আমি যখন লিখি, তখন অত
ভেবে লিখি না। যা মনে আসে তাই লিখি। আধুনিকতার বিষয়গুলোকে
বিচার করে লিখি না। মূলতঃ অভিজ্ঞতা থেকেই লিখি। মনে যা আসে তাই লিখি।
প্রঃ এই উপন্যাসগুলোতে কোনো নীতিবোধ সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন?
--থাকে, একটা ভালো-মন্দের ব্যাপার থাকে। সেটা পড়লেই বুঝতে পারবে। নীতিবোধ প্রতিটি গল্পেই আছে।
প্রঃ গোয়েন্দা নিয়ে কি লিখেছেন?
--বরদাচরণ বলে আমি একটি গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেছিলাম। কিন্তু তাকে নিয়ে আমি খুব বেশি খেলা করিনি। কারণ প্রাইভেট গোয়েন্দা
আমার কাছে খুব ইম্প্র্যাক্টিক্যাল মনে হয়। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ উপন্যাসে গোয়েন্দা চরিত্র
সৃষ্টি করেছিলাম। পরবর্তীকালে তাকে নিয়ে আর কিছু লিখিনি।
(এরপর শীর্ষেন্দুদার সঙ্গে
আরও অনেক বিষয় ও প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু সেসব কথা এখানে নয় আপাতত।
অন্য কোনো প্রসঙ্গিকতায় পরে আবার লেখা যেতে পারে। কলকাতায় শীর্ষেন্দুদার সঙ্গে
তাঁর যোধপুর পার্কের বাড়িতে দেখা করেছিলাম গত ১৫ই আগষ্ট ২০১৪, শুক্রবার দুপুরবেলায়।
কথা বলেছিলাম দুপুর ১-২০ থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত।)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন