কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৪

১৩) মালিনী ভট্টাচার্য


নোট

(এক)
নিজস্ব সংবাদদাতা: আজ এক মৃত ভিখারিনীর কোলের কাছে রাখা পুঁটলি থেকে এক লাখ টাকার নোট উদ্ধার হওয়ায় এলাকায় রীতিমতো চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। আশ্চর্যের  ব্যাপার এই যে, নোটগুলি পুরনো হলেও সবই হাজার টাকার। এর থেকে স্পষ্ট যে, টাকাগুলি কোনোভাবেই ভিক্ষায় পাওয়া অর্থ নয়। তাহলে কি ভিখারিনী ভিক্ষার  আড়ালে কোনো অবৈধ ব্যবসায় লিপ্ত ছিল? পুলিস অনুসন্ধান করছে।

(দুই)
লোকে বলে শনিচরীর কপাল নাকি ভালো। দুমকা থেকে বিয়ে হয়ে এসেছিল বাঙ্গাল মুলুকে; কোলিয়ারী মজদুর বরের ‘পারমিন্ট’ চাকরি, পাকা ‘কোয়াটার’ বাড়ি। রোজ  রাতে বেদম প্রহার আর আসুরিক মৈথুনের ধাক্কা সামলে একটা ছেলেও বিইয়েছিল সে। সেই থেকে তার স্বপ্ন দেখা শুরু। ছেলেকে ঘিরে। পড়ালিখা করবে, ইজ্জতদার আদমি হবে। বাপের মতো মজদুর হবে না। বড়াসাব না হলে ছোটাসাব তো হবেই! ছেলেকে  ইস্কুল পাঠিয়ে সাহিব বাংলোর কলতলায় একপাঁজা এঁটো বাসনের মধ্যে বসে এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে চোখ ভিজে উঠত তার। কানে আসত না মেমসাবের অশ্রাব্য গালিগালাজ।
কিন্তু যে লোক সারা জীবন জ্বালিয়েছে, সে কি মরে নিষ্কৃতি দেবে? মদ্যপ লোকটা একদিন খনির মধ্যেই মরে গেল। অন ডিউটি ছিল, তাই টাকা বা চাকরি পাওয়ার  অধিকার ছিল কোম্পানির থেকে। শনিচরী চেয়েছিল, টাকাগুলো ছেলের পড়ার কাজে  লাগুক। ইউনিয়ন বাবুরা বুঝিয়েছিল, “আরে! ছেলেকে পড়িয়ে কি জজ ম্যাজিস্টের করবে! আর চাকরি না নিলে মাথার উপর ছাদটাও তো থাকবে না! খাবে কি?  থাকবে কোথায়? ছেলে তো আর ছোটটি নয়! বেশ লায়েক হয়েছে। তবে?” অতএব  লেট মদন সিং-এর জায়গায় বহাল হলো আঠারো বছরের পবন সিং। শনিচরীর  অনিচ্ছা সত্ত্বেও
দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটেছে। ছেলে জোয়ান হয়েছে। এবার বিয়ে দেবে শনিচরী। বছর ঘুরলে নাতি আসবে। সব আয়োজন সারা। ঘরকন্নার টুকিটাকি গোছাতে  গোছাতে ভাবে, এও তো এক রকমের সুখে থাকা! হঠাৎ স্বপ্নে ছেদ ফেলে অসময়ের  সাইরেন। খনির ভিতর আগুন লেগে গেছে। যে তিনশো জন আটকা পড়েছিল ভিতরে,  তারা আর বেরোতে পারেনি। পুড়ে কাঠ হওয়া একটা দেহ দেখিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসা করেছিল, ওটা তার ছেলে কি না! মাংসে বসে যাওয়া তোবড়ানো ট্যারাবাঁকা একটা তাবিজ দেখে ছেলেকে চিনেছিল শনিচরী। অনডিউটি মৃত্যু ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল  শনিচরী। তিন লাখ টাকা। তাও তার সারা জীবনের সঞ্চয় বিভিন্ন জায়গায় ঘুষ দিয়ে। সব কাজ করার জন্য দুই পার্টির দুই ইউনিয়ন বাবু নিয়েছিল দু' লাখ।  বাকিটা কেড়ে নেবার আগে রাতের ট্রেনে চড়ে বসেছিল শনিচরী। গন্তব্য অজানা।

(তিন)
শনিচরী স্বপ্ন দেখে, তার ছেলে রোজ রাতে তার কাছে আসে। সারাদিনের বাসি  রুটি-পাউরুটি খায়, তারপর কোল ঘেঁষে ঘুমোয়। ঘুমোতে ঘুমোতে ছোট্ট হয়ে যায়  পবন। না না, আগুনে পুড়ে কুঁকড়ে ছোট নয় — যেমন ছোট্টটা তাকে প্রথম কোলে নিয়েছিল শনিচরী। একটা তুলোর পুঁটলির মতো। পুঁটলি হয়ে যাওয়া ছেলে বা ছেলে হয়ে ওঠা পুঁটলিকে আঁকড়ে ধরে শনিচরী। শীতের রাতে ওম পায়। ছেলের জন্য রাখা খাবার নির্বিচারে খায় ভুলু কুকুরছেলের হাত থেকে না-পাওয়া গঙ্গাজল চোখ উপচে পড়ে, ভিজিয়ে দেয় শুকনো কষ।

1 কমেন্টস্: