সমকালীন ছোটগল্প |
৭০
কোটির চিঠি
ভারতীয় নৌবাহিনীর ভাইস-চিফ অ্যাডমিরাল সান্যাল সদ্য জাহাজ থেকে
নেমে নাভাল কম্যান্ডের মুম্বই অফিসে এসে বসলেন। আরবসাগরে লাল আবীর ছড়িয়ে সূর্য
অস্ত যাচ্ছে। ঠিক যেন ক্লদ মনে’র পেইন্টিং। বিগত পনেরো দিন জাহাজে একটানা কাজ। আরবসাগর
চষে ফেলতে হয়েছে। কেউ এই সময় পাকিস্তান থেকে আরবসাগর হয়ে ভারতে ঢুকছে কিনা, কেউ
জলপথে নৌকো নিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে কিনা, আবার
সাথে সাথে জাহাজে কোন কেবিন ক্রু করোনায় সংক্রামিত হল কিনা, একসাথে সবকিছু সামলাতে হয়েছে। সৌভাগ্য, এই পনেরোদিন জাহাজে কারো কিছু
হয় নি। সবাই সুস্থ। তাই জাহাজ থেকে নেমেই সোজা নিজের অফিসে এসেছেন, একটা কাজ আজ
করেই যাবেন।
কাল বিকেলে একটা ঘটনা সান্যালসাহেবের মনে ঘা দিয়ে গেছে। জাহাজে
ডেকের ওপর রাখা চারটে প্লেনের একটার চাকা কিভাবে জ্যাম হয়ে গেছিল। স্টাফ-অফিসার
কেউ পারল না ওটা সচল করতে। পাড় থেকে এক স্পিডবোটে দুজন খালাসি এসেছিল জাহাজে তেল
ভরতে। ওরা এসে অদ্ভুতভাবে দড়ি আর শাবল দিয়ে সেই চাকা উদ্ধার করে দিল। সেই প্লেন তারপর
উড়ে গিয়ে সমুদ্রে এক চক্কর দিয়েও এল। উনি দুজনকে ডেকে পাঠালেন।
- ‘তোমাদের নাম কি?’
প্রশ্নটা শুনে দুজনে দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর একজন
আমতা আমতা করে উত্তর দিল।
- ‘স্যার, আমাদের তো নাম হয় না। আমরা এখানে ক্যাজুয়াল খালাসি।
আমাদের একটা করে নম্বর দেওয়া হয়। আমাদের দুজনের নম্বর ‘৫০’ আর ‘৫১’।
সান্যালবাবু একটু অবাক হলেন।
- ‘নাম হয় না মানে?’
- ‘না স্যার, আমাদের কেউ নাম ধরে ডাকে না। নম্বর ধরেই ডাকে।
এটাই বহুবছর ধরে দেখছি। আমরা সরকারি হিসেবে তেল কোম্পানির কাছে দিনে ৩৮৭ টাকা পাই।
একমাস কাজ করি। পরের মাস বসি। আমাদের জায়গায় অন্য খালাসি আসে। পরের মাসে আবার আমরা। এভাবেই বছরে ছ’মাস কাজ করি আর ছ’মাস ঘরে বসি’।
- ‘কি কি কাজ পারো?’
- ‘সব পারি স্যার। পেটের জ্বালায় সব কাজ শিখে রাখতে হয়েছে।
বাথরুম পরিষ্কার থেকে ফ্ল্যাগম্যানের কাজ, সব’।
আজ তাই সান্যালসাহেব অফিসে এসেছেন ওনার বস চিফ অ্যাডমিরালকে
চিঠি লিখতে। এইসব কাজের মানুষগুলোকে যাতে মানুষ হিসেবে ট্রিট করা হয়। অন্তত একটা
আইডেন্টিটি কার্ড, যাতে ওদের নির্দিষ্ট কোন ক্যাডেট হিসেবে উল্লেখ করা থাকবে। আর
সেখানে ওদের ফটো সমেত নাম লেখা থাকবে। সেই নাম ধরেই ওদের ডাকা হবে, ৫০-৫১ হিসেবে
নয়। ল্যাপটপটা সবে অন করেছেন, ওনার আর্দালি ঢুকল।
- ‘স্যার, একটা পার্সোনাল চিঠি আছে। আপনার নামে। একটু আগে
ড্রপবক্স খুলে এটা পাওয়া গেছে’।
চিঠি? তার নামে? সান্যালসাহেব একটু অবাক হলেন। উনি মাত্র দু’মাস হল এখানে বদলি হয়ে এসেছেন। তাকে তো কেউ চেনে না!
- ‘দেখি, কি রকম চিঠি। কে দিয়েছে? কার হাতে দিয়ে গেছে?’
- ‘কেউ জানে না স্যার। রাস্তার ওপর বক্স খুলে পাওয়া গেছে।
চিঠিটা হিন্দিতে নয় বলে কেউ পড়তে পারেনি। আপনার জন্যই রেখে দেওয়া হয়েছে। চা আনব
স্যার?’
- ‘হ্যাঁ, আনো’।
চিঠিটা হাতে নিয়ে সান্যালসাহেব অবাক হলেন। দুটো নোংরা ভাঁজ হয়ে
যাওয়া ফুলস্কেপ কাগজ। চারভাঁজ। চিঠির ওপর গোটা গোটা অক্ষরে কাঁচা হাতের লেখায়
ইংরাজিতে লেখা অ্যাডমিরাল সান্যাল। ভেতরে বাংলায় লেখা এক চিঠি। কাঁপা হাতের লেখা।
পেন্সিলে। ওনার চেনা কেউ নয়। শেষে কোন নাম নেই।
“স্যার, খুব কষ্টে
পড়ে আপনার কাছে এই চিঠি লিখছি। দু’মাস আগে আমরা এক কনসট্রাকশন সাইটে দিনমজুরের কাজ
করছিলাম। আমাদের একজন লোহার খাঁচায় উঁচু থেকে পড়ে মাথা ফেটে রাস্তায় ছটফট করছিল।
পুলিশ আসে নি। পাবলিক দেখছিল। সেই সময় আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের কাঁদতে
দেখে আপনি গাড়ি থামিয়ে নেমে আপনার সঙ্গের পুলিশকে বলেছিলেন ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
হাসপাতালে যাবার পর চিকিৎসায় আমাদের সেই বন্ধু ভাল হয়ে যায়। সেদিন দেখেছিলাম আপনার
বুকে জ্বলজ্বল করছে সোনার পাতে লেখা নাম ‘অ্যাডমিরাল সান্যাল’। বুঝেছিলাম আপনি
বাঙালি। আজ তাই বিপদে পড়ে আপনাকেই লিখছি স্যার।”
সান্যালসাহেবের মনে পড়ল। সেদিনই উনি এখানে কাজে জয়েন করেছিলেন।
অফিসে আসার মুখে ঘটেছিল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উনি আবার চিঠিতে চোখ রাখলেন।
“আমাদের একটু মাঝসমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসতে পারেন স্যার?
জীবনের বাকি কটা দিন অন্তত শান্তিতে বাঁচতে চাই। এভাবে কুকুর-ছাগলের মত জীবনে আমরা
হাঁপিয়ে উঠেছি। আপনার তো অনেক বড় বড় জাহাজ আছে। মাঝ সাগরে আমাদের সঙ্গে কিছু কাঠের
গুঁড়ি বা বাঁশ বা প্লাস্টিকের জঞ্জাল ফেলে দেবেন। যে’কদিন বাঁচব, আমরা সেগুলো ধরেই
ভেসে থাকব। আর কিছু চাই না।”
সান্যালসাহেবের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। এরকম বেয়াড়া আবদার তো কেউ
কখনো করে না! আরেকবার প্রথম থেকে চিঠিটা পড়লেন। মাথা খারাপ বলে মনে হচ্ছে না।
চিঠির ভাষা থেকে অশিক্ষিত বলেও মনে হচ্ছে না। তাহলে?
“আমার বাড়ি সুন্দরবনে। বাবা নেই। দাদু সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে আর
ফেরেনি। পরিবারে আমি একা পুরুষমানুষ। তাই উচ্চমাধ্যমিক দিয়েই কাজে লেগে পড়লাম।
কিন্তু মাছ ধরে আর মধু বেচে কি অতগুলো পেট চলে? বিপিএল কার্ড আছে কিন্তু রেশন
দোকানে অর্ধেক জিনিষ দেয় না, কম কম দেয়। কিছু বললে পার্টির ভয় দেখায়। তাই মুম্বই
চলে এলাম বাড়ি তৈরির মিস্ত্রি হয়ে। বিয়ে করলাম। বউ বাড়ি বাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে।
একটা ছোট একবছরের ছেলে। দিন আনি দিন খাই। বাড়িতে মা’কে কিছু টাকা পাঠাই। কিন্তু
আপনার সঙ্গে যেদিন দেখা হল, তার ঠিক কুড়ি দিনের মাথায় সবকিছু হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
আমার কাজ, আমার বউয়ের কাজ। আমাদের দেশে নাকি মহামারী লেগেছে। কারো ছোঁয়া লাগলে মানুষ
মারা যাচ্ছে। মালিক কাজ বন্ধ রেখে চলে গেল। আমাদের বলল, বাড়ি চলে যা। কিন্তু কোথায়
যাব? কিভাবে যাব? সব তো বন্ধ। মালিকের ফ্ল্যাটবাড়ি যেখানে বানাচ্ছিলাম, সেখানে
পাশে ঝুপড়ি বেঁধে থাকতাম। কদিন পর পুলিশ
এসে লাঠি দিয়ে মারতে মারতে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিল। দৌড়ে গেলাম সামনের ওভারব্রীজের
নিচে। সেখানে গিজগিজ করছে মানুষ। সবাই পুলিশের লাঠি খেয়ে এসে মাথা গুঁজেছে। পেটে
ভাত নেই। পরের দিন পুলিশ আবার এসে বেদম মারতে মারতে সেখান থেকেও তাড়িয়ে দিল। এবার
গিয়ে উঠলাম একটা নালার পাশে, ঝোপে ঘেরা, দুর্গন্ধ। পুলিশ এখানে দেখতে পাবে না।
আমরা ছ’বন্ধু, পরিবার নিয়ে। তিনদিন আমরা কেউ কিছু খাইনি। ছেলেটা দুধ না পেয়ে
অজ্ঞান হয়ে গেছে। গায়ে জ্বর। শুনলাম কোথায় নাকি এক পার্টি খেতে দিচ্ছে। আমরা
দৌড়লাম। তিনদিন পর সেই প্রথমবার রাস্তার ওপর বসে কুকুরদের সঙ্গে খেলাম। ফেলে দেওয়া
খাবার এনে ছেলেটাকে খাওয়ালাম। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে হেঁটে গেলাম মালিকের বাড়ি।
যদি কিছু টাকা পাই। দারোয়ান তাড়িয়ে দিল। তারপর যখন কোন পার্টি খেতে দেয়, খাই। আবার
দু’দিন না খেয়ে থাকি। কয়েকদিন পর বলল, বান্দ্রায় নাকি সরকার আমাদের ট্রেনে চাপিয়ে
বাড়ি ফিরিয়ে দেবে। ছেলেটাকে মাথায় চাপিয়ে গেলাম। কিন্তু আবার পুলিশের মার খেয়ে
ফিরলাম। এবার বউয়ের গলার রূপোর হারটা এক পুলিশকে দিলাম। সে আমাদের একটা ঝুপড়িতে
থাকার ব্যবস্থা করে দিল। এগুলো নাকি সরকার বানিয়েছে এই মহামারীর জন্য। খাবার নেই।
শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই। মাঝে মাঝে এক ডাক্তারবাবু এসে আমাদের দেখে যান। তো, একসপ্তা
পর এসে আমার ছেলেকে নিয়ে চলে গেল। বলল, হাসপাতালে দিতে হবে। সঙ্গে আমাদের যেতে দিল
না। শুধু একজন পুলিশ বলে গেল, আমরা নাকি কুকুর-বেড়ালের জাত। আগে ৩০ কোটি ছিলাম,
এবার মহামারীর পর ৭০ কোটি হয়ে যাব। আমরা জন্মেই কেন মরে যাই না! আমার বন্ধুরা খিদে
সহ্য করতে না পেরে ঠিক করল ১৫০০ কিলোমিটার হেঁটে তেলেঙ্গানা হয়ে ছত্তিসগড় হয়ে
ওড়িশা হয়ে সুন্দরবন যাবে। ঘুরপথে, জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে। এক দালাল টাকা নিয়ে
ওদের রাস্তা দেখাবে। ১৫০০ কিলোমিটার হাঁটব কি করে স্যার? পেটে দানা নেই জল নেই। আমার
বন্ধুর বছর দশেকের হাড় জিরজিরে মেয়েটা কি পারবে? হয়ত ওর নিথর ছোট্ট দেহ মাঝরাস্তায়
সেই বনজঙ্গলের ভেতরেই পড়ে থাকবে। কে জানে! কিন্তু আমরা কি করে যাব? আমাদের ছেলেকে
না নিয়ে?”
সান্যালসাহেব চিঠি থেকে চোখ সরিয়ে একবার শ্বাস নিলেন। লক-ডাউনের
মাঝে দেশের শ্রমিকদের এত কষ্ট-দুঃখ উনি শোনেন নি। শেষ ১৫ দিন জাহাজের ভেতর কেটেছে।
আর ওনার ফ্যামিলি থাকে নৌসেনার সুরক্ষিত ঘেরাটোপে, যেখানে সরকারের তরফ থেকে
সবকিছুই সময়ে পৌঁছে যায়। অফিসের হাওয়াটা কেমন যেন গুমোট হয়ে উঠেছে। উনি উঠে গিয়ে
আরবসাগরের একটা জানলা খুলে দিলেন।
“চল্লিশ দিন হয়ে গেল স্যার। দেশে সব কিছু বন্ধ। বাংলার সরকার
নাকি আমাদের ফিরিয়ে নিতে চায় না। তাই আমাদের এখানেই পড়ে থাকতে হবে। এখানকার সরকার
চায় না আমরা থাকি কারণ আমরা তো এখানকার ভোটার নই। ছেলেটার এখনো খোঁজ
পেলাম না। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলে কিছু উত্তর দেয় না। সবাই বলছে, ভুলে যা। আর পাবি
না। এইসব ঝুপড়ি থেকে যাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, আর কেউ ফিরছে না। একজন ছেলে এসে বলল,
আমাদের মত শ্রমিকের লাশ পোড়াতে না পেরে হাসপাতালের মধ্যেই একটা ঘরে ওরা ডাঁই করে রেখে
দিচ্ছে। আমাদের কেউ নেই স্যার। শুধু ভোটের সময় নেতারা আমাদের গায়ে হাত বুলোয়। ভোট
হয়ে গেলে আমরা আবার কুকুরের বাচ্চা হয়ে যাই সবার চোখে। সেজন্য বলছিলাম, এভাবে রোজ মরতে আর ভাল্লাগে না স্যার। আমি
আমাদের মত ৭০ কোটি মানুষের হয়ে আপনাকে এই চিঠি দিচ্ছি। আমাদের শুধু গিয়ে
মাঝসমুদ্রে নামিয়ে দিন। আর কিছু চাই না। যে কদিন বাঁচব, বুকভরে সমুদ্রের হাওয়া
খেয়ে বাঁচব। দু’চোখ ভরে প্রকৃতি দেখব। মানুষের নোংরামো দেখে মন ভরে গেছে। আমরা, ৭০
কোটি কুকুর-ছাগলেরা, এই জঞ্জাল থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাই।”
সান্যালসাহেব বুঝে পাচ্ছিলেন না এই চিঠি নিয়ে কি করবেন। কাকে
পাঠাবেন, কে এর প্রতিকার করবে। কিভাবে উনি এই মানুষদের সাহায্য করতে পারেন। আর
তখনি ওনার দৃষ্টি গিয়ে আটকে গেল ল্যাপটপের অনলাইন খবরের কাগজে। আজ সকালের খবর।
মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদের
কাছে রেললাইনে শুয়ে থাকা ১৬ জন পরিযায়ী শ্রমিকের ওপর দিয়ে সকালের আলোয় মালগাড়ী চলে
গেছে। সবাই মৃত। পেটের জ্বালায় এরা রেললাইন ধরে লক-ডাউনের মাঝেই বাড়ি ফিরতে
চাইছিল। অনলাইন খবরের কাগজের পাতাজুড়ে তাদের ছিন্নভিন্ন মাংসের টুকরোর ছবি।
আপনার কলম দীর্ঘ জীবি হোক
উত্তরমুছুনসমসাময়িকতার অদ্ভুত প্রস্তুতি। সত্যিই এই গল্পে অনেক গভীর প্রশ্ন রয়েছে কিন্তু উত্তর পাওয়া মুশকিল। বাস্তবিকতার প্রতিনিধি গল্প
উত্তরমুছুন