কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৭ মে, ২০২০

ঝিলম ত্রিবেদী



কবিতার কালিমাটি ১০০


অরণ্য ১

ভেসে যায় কুশীনদী, ভেসে যায় নীল শৈলমালা
গেরুয়ায় ওড়ে শূন্য, ওড়ে লাল লবঙ্গের মালা
ধুনোয় গুগ্গুলে সাজে বজরঙ্গবলীর দুয়ার
ধূপে দীপে ভরে ওঠে করতোয়া পূণ্য দেওদার
দূরে দূরে কড়ারি, দূরে দূরে পদ্মমূল ফোটে
ধুতুরা, আকন্দ, জবা, সর্ষের আরতি ফুটে ওঠে
গেঁড় এনে পুঁতে দেয়, শীর্ণকায় যুগলপ্রসাদ
গোকুল আরক্ত-ধাম, মেলে ধরে ক্ষীণ কর্ণপাত
নয়নে মায়ার জল, ফুলে পুষ্পে গাঁথি মালাখানি
গনোরি তেওয়ারি ডাকে, আয় কৃষ্ণ, ধর হাতখানি
দারিদ্র্য দারিদ্র্য বড়, গ্র্যান্টসাহেবের বটতলে
বাথুয়া ফলিছে মৃদু, শাক তুলে আনে মেয়েগুলি
আঁধারে আকাশ জ্বলে, পূর্ণিমায় জ্বলে চাঁদমণি
সকলে মিলিয়া বসে চটে চটে, গান ধরে তাঁর
বাহুর নিরিখে যাঁর পূজা চলে মাঝরাত তক্
তাহাতে মিলায় বিশ্ব, নাচে যুবকের দল-মাদল
ধাতুরিয়া, ওষ্ঠে ধরে বিষ আর বুভুক্ষু রোদ
নেচে চলে ছক্করবাজী নাচ, পায়ে বাজে ক্রোধ
মুখে তার রক্ত ওঠে, গৌরবহীন একা বালক
যশস্বী নয় কেউ, এরা সব দরিদ্র-লোক!
বনবাদাড়ের মত উড়ে যায় গেরস্থালি তার
আঘাতে বিদীর্ণ তোড়া, কণ্ঠে দেশোয়ালের বাজার
কুন্তীর মত যার অস্তাচলে সূর্য করে ওঠে
রসাতলে যায় বুনো ভাণ্ডারীর অবাধ্য খেত
চারিদিক নির্জন, চারদিক তুরঙ্গসম
ঘোড়ার বুকের প্রতি নিঃশ্বাসে নেমে আসে পরী
উড়িয়ে উড়িয়ে দেয় ধ্বজাধারী শিবের আদল
এখানে প্রকৃতি বহে নিজমনে বহতা পাগল...
গাছে গাছে শীতবস্ত্র, শাখে শাখে ডাকে শ্যামাপাখি
মটুকনাথের ঠোঁটে বেজে উঠলে সন্ধ্যার-রতি
সকলে কারুণ্য খুলে, পরে নেয় সঙ্গীতের-ক্ষত
আরণ্য মানুষের শিখা ওড়ে আগুনের মত...


অরণ্য ২

মাঠে সর্ষের খেত
আর কিছু ফুল
যেন ঝোরা ঝরঝর
মঞ্চীর দুল
ভীমদাসটোলা হতে
গানে ভাসে লয়
হাঁসুলির মত বাঁকা
চন্দ্র-উদয়
আপনি আচরি গীত
রৌদ্রে শেখায়
রোদের মধ্যে যেন
কেউ পুড়ে যায়
স্বামীন নামক বর
বুড়ো করতাল
মেয়েটি তরুণী
তার মত্ত দামাল
স্তন ভরে গাইয়ের
মতন সুবাসে
জঙ্ঘায় পূর্ণিমা
রাস ঘিরে আসে
দোল খায় চুল তার
এলো এলো মুখ
বুড়োর বাউণ্ডুলে
অনর্থ সুখ
বুকে ধরে, ঝিম লাগে
মরণের পায়ে
মঞ্চীর তীর হতে
নীড় ভেঙে যায়
আকুড়া মাকুড়া তিথি
অদৃশ্য তাপ
মেয়েটির ব্যথা বোঝে
দুঃখের সাপ
সকালে অরন্ধন
বিকালে ফকির
আশমানে মেঘ করে
জমে ওঠে ভিড়
সকলে নিশীথ পালে
পেটের ভিতর
বুনোঝাউ কড়ি গোনে
শূন্যের 'পর
বাতাসে হুতাশ বাজে
বাজে নিশিডাক
ধনুকের মত বাঁকা
শিউলির ঝাঁক
বসেছে শুভঙ্করী
টোল বসেছে যে
হাওয়ার নিদ্রা আসে
ছাত্রের বেশে
বিদ্যুতে বিদ্যুতে
ফালা হয় ঘর
অরণ্য থেকে ভাসে
পুষ্পের স্বর
মঞ্চী, শরীর তার
অস্ত্রের মত
রেখেছে সে তূণে ঢেকে
বিধাতার মত
পালিয়ে পালিয়ে যায়
পায়ের ঘুঙুর
কাঁটায় ছিঁড়িয়া যায়
উদাস সুদূর
অভিসার লাগি নারী
থরথর কাঁপে
আকাশে বাতাসে রুখা
আলোর প্রতাপে
ছুটে চলে কাণ্ড, জ্ঞান
ছুটে চলে খেয়া
ফুলকিয়া বইহারে
ফুটে ওঠে কেয়া
ফুলের মতন শিশু
নাগপাশে বাঁধা
রাত্রি তাহার নাম
তাহার বারতা
ছুটে চলে শূন্যতায়
ছুটে চলে শাম
আঁধারের রথে রথে
মঞ্চী তার নাম!
মোহনবাঁশির মেয়ে আয়নায় দোলে
গাঙ্গোতার ঘর ভাঙে, শিশুর কানাত
টুলটুলে জল থেকে শৈশব তোলে
মুখে দেয় সিঁদুরের গোগ্রাস ভাত...


অরণ্য ৩

শৈলশিরার কাছে এসে বসে অমৃত মানুষ
বহেড়া, আমলকীপাতা, বুনোনিম
ছোলাসেদ্ধ খায় কিছু লোক
হরটিট্, বনটিয়া, আকাশের মাদুরের উপর
সূর্যের পাড়বোনা, কাঁথাখানি পড়ে আছে রাতের
পাখি উড়ে যায়, উড়ে আসে
পাহাড় তো হারিয়ে যাওয়ার ডাকনাম
পাহাড়ের কাছে কাছে বসে আছে, অলীক দেবযান
খসে পড়ছে ঝুরোপাতা, ঝোড়োপাতা, খসখসে, অমসৃণ পাতা
তুলে নিয়ে গালে রাখলে
পুকুর পুকুর মনে হয়
সাধ হয়, বইয়ের পাতায় পাতা রাখি
দূরে চলে গেলে, চলে গেলে রূপ ছেড়ে, পাতারা... মনে রাখে না কি!
মটুকনাথের টোল থেকে, ভেসে আসে দিগম্বরী-পাঠ
মানুষের ধারাপাত, মানবের জীবনবিস্তার
বিপুল বিপুল
এই সুনিপুণ আঁধার আলোয়
মানুষটা শিক্ষক, মানুষটা ধীর লয়ে বয়...
সারারাত খায়নি কিছু
সারারাত উপোস করে আছে
সকালে তবুও খোলে পাঠশালা, পড়াতে বসেছে যে
অনেক সন্তানের বাবা, পিতা সে, ভেঙে যাওয়া পিঠ
তবুও
লোভীর মত এসে বসে বিদ্যালয় খুলে
যেখানে কয়েকটি ছেলে, কতগুলি খুব শূন্য পেট
পড়াই পারে না তারা, শুধু মাছি ঠোঁটে এসে বসে
তারা পড়ে
মাছি পড়ে
সমস্ত জগৎ পড়ছে
মানুষের প্রাণের কথা, সমস্ত জগৎ পড়ছে...
অমৃত মানুষটিও চোখ বোঁজে, মন খাড়া করে
সুদূরে শুনতে পায়, দারিদ্র্য পড়া করছে
গাছ থেকে খসে পড়ছে পাতা, খসবেই
নিঃশ্বাস বন্ধক রেখে, ওরা তবু পড়া করবেই...






18 কমেন্টস্:

  1. বোধের অনন্যতায় মৌলিকতায় স্বকীয়তা কাব্যের জগতে এক উজ্জ্বল দিকনির্নয়ী কবি ঝিলম। বহুকাল স্মরণে ঝিকমিক করবে তার ভাবনার ছটা

    উত্তরমুছুন
  2. এত বিশুদ্ধতা, মুগ্ধতার রেশ রয়ে গেল।

    উত্তরমুছুন
  3. 'আরণ্যক'ই একটু অন্যভাবে ইঙ্গিতবহ কাব্যে বর্ণিত হল, কবিতাগুলি পড়বার সময় এই বোধ হচ্ছিল!ঐ অপরূপ উপন্যাস পঠনের স্মৃতি জাগরিত হল মননে।
    চমৎকার! অতীব চমৎকার!

    উত্তরমুছুন
  4. অসাধারণ.. ভিন্ন অনুভূতির শব্দ বুনন

    উত্তরমুছুন
  5. অসাধারণ.. ভিন্ন অনুভূতির শব্দ বুনন।উপন্যাসটি নিবিড়ভাবে
    আত্মস্থ করতে না পারলে এ লেখা সম্ভব নয়।

    উত্তরমুছুন
  6. বেশ ভালো কবিতা | ভালো লাগলো...

    উত্তরমুছুন
  7. ঝিলমের কলমে কবিতায় 'আরণ্যক'

    উত্তরমুছুন
  8. ভীষণ ভীষণ ভালোলাগা দি। তোমার কবিতা মানেই তো পাঠক মননের অপার ঋদ্ধতা।

    উত্তরমুছুন