জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের
রানি – ৯
“…এবার
তোমাকে নিয়ে যাবো আমি নক্ষত্র-খামারে নবান্নের দিন
পৃথিবীর
সমস্ত রঙিন
পর্দাগুলি
নিয়ে যাবো, নিয়ে যাবো শেফালির চারা
গোলাবাড়ি
থেকে কিছু দূরে রবে সূর্যমুখী পাড়া
এবার
তোমাকে নিয়ে যাবো আমি নক্ষত্র-খামারে নবান্নের দিন।
যদি
কোনো পৃথিবীর কিশলয়ে বেসে থাকো থাকো ভালো
যদি
কোনো আন্তরিক পর্যটনে জানালার আলো
দেখে
যেতে চেয়ে থাকো, তাহাদের ঘরের ভিতরে-
আমাকে
যাবার আগে বলো তা-ও, নেবো সঙ্গে করে…”
ঠিক
কোথা থেকে শুরু হয় কবিতা নিয়ে কথা, এখনও জানি না। একটা শব্দ, একটা বাকপ্রতিমা, একটা
ধ্বনিঝংকার, একটা অপ্রত্যাশিত নীরব যতি, কে যে কবিতা'কে ডেকে আনে, বোঝা যায় না। কবিতা
কি অক্ষরবদ্ধ কিছু নির্মাণ, ভিতরে প্রস্তুত বারুদস্তূপে ফুলকি লাগানোর ডিটোনেটর? কবির
প্রস্তুতি আগে হয়, না পাঠকের? যার বারুদ যথেষ্ট শুকনো নয়, তার জন্য কবিতার কোনও যাথার্থ্য
রয়েছে কি? কবিতা কি শুদ্ধ তীক্ষ্ণতা, না নিরাময় প্রলেপ; না সব কিছু নিয়েই কবিতা? কবিতা কি
কথিত বিশুদ্ধ পাগলামি, না পবিত্র বোধির অক্ষরবৃত্ত শ্রমপ্রতিমা? যে শব্দ ব্রহ্ম, তার
রূপ কেমন? অক্ষরবদ্ধ না শ্রুতিসম্ভব?
নক্ষত্র-খামারে
নবান্নের দিন এবং সেখান থেকে শুরু এক আন্তরিক পর্যটন। তা'কে মনে রেখেও উঠানে কুয়ার
জলে পড়ে থাকা চাঁদ, অনন্ত, সার্বভৌম। পৃথিবীর রঙিন পর্দাগুলি আর জানালার আলো, সবই ঘরের
অন্তর্মুখ ব্যপ্তি। সবই সঙ্গে যাবে, যদি চাই। এই তো কবিতা, ব্যাখ্যাহীন, জটিলতাহীন,
অমলিন। এখান থেকেই যদি শুরু হয় শক্তির পদ্যের দিকে যাত্রা, কবির উদ্দেশ্যটি চিনে নেওয়া
যায়, কোনো ক্রূর কাব্যপ্রকরণের পরোয়া না করে।
“…সে
কি জানিত না যত বড়ো রাজধানী
তত
বিখ্যাত নয় এ-হৃদয়পুর
সে
কি জানিত না আমি তারে যত জানি
আনন্দ
সমুদ্দুর
আজ
সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন
ছিলো না আষাঢ়-শেষের বেলা
উদ্যানে
ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী”।
এইখানে
তাঁর গুরু, সেই 'বুড়ো' হাত ধরে লিখিয়ে নিচ্ছেন তাঁকে। যেন আমার গানের শেষে, থামতে পারি
সমে এসে, ছয়টি ঋতুর ফুলেফলে ডালা ভরে নেবার আকাঙ্ক্ষা। অন্তহীন আশাবাদ আর শুদ্ধ বাঙালি
পেশকারি। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলীর মতো সীবনচিণ্হহীন আবহমান বাংলা। 'মহাপৃথিবী' বা
'সাতটি তারার তিমিরে'র মতো য়ুরোপীয় মার্জনা আর নিখুঁত অক্ষরচিত্র থেকে একটু দূরে, দেখা
যাচ্ছে, কিন্তু ছোঁয়া যাচ্ছে না। প্রায় একসঙ্গে
শুরু করে, একসঙ্গে দীর্ঘকাল হেঁটে গিয়ে সুনীলের গরিমা বিবর্তিত হয় একজন কবিদলপতি রূপে,
কিন্তু শক্তির যাত্রার অভিমুখ চিরকাল অন্তর্দিশার আলোকস্তম্ভের দিকে। তাঁর কবিতার শেষ
ট্যাগ লাইনকে হতে হবে “আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী”।
সুনীল
আর শক্তি দু'জনেই পড়াতে যেতেন শান্তিনিকেতনে। সুনীল নিবিষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে, প্রকৃত
অধ্যাপকের মতো বিনিময় করতেন। মুগ্ধ করে রাখতেন প্রস্তুত শ্রোতাদের। কিন্তু শক্তি সব
ছেলেমেয়েদের নিয়ে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াতেন। কথা-কথকতা সব উঠে আসতো মানুষকে দেখে, বৃক্ষকে
দেখে; কাক-চড়াই, পুকুর-জলা, শ্যাওলা-পানা,
সবাইকে সামনে রেখে। বৃষ্টির মতো কবির সংলাপমালায় ভিজে যেতো স্নাতক বালকবালিকারা। তাদের
দেখার চোখ, শোনার কান ধারালো হতো নিজের ছন্দে। শক্তি'র সেই 'বুড়ো' বোধ হয় এরকমই কিছু
চাইতেন।
শক্তি
বলেছিলেন, কবিতা হবে দ্বিপ্রহরের রোদের মতো স্বচ্ছ। এই স্বচ্ছতাই হবে তার রহস্য। আধো
অন্ধকার দিয়ে তাকে আবৃত রাখার প্রয়োজন নেই। যখন মনে হয় সব কিছু দেখা যাচ্ছে, সবই 'বোঝা'
যাচ্ছে হয়তো; এটা জরুরি নয়, সুন্দরের অন্তর্লীন রহস্যও উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে প্রশ্নহীন।
এই রকম কিছু ভাবতেন শক্তি। একটা ব্র্যান্ড তৈরি করতে চেয়েছিলেন নিজেকে নিয়ে; যে অর্ধেক
মানব, অর্ধেক কল্পনা। মদ্যপান তাঁর সমসাময়িক অনেকেই করতেন, বন্ধহীন। কিন্তু সেই পর্যায়ের,
শিশুর কাঁধে ছুটন্ত মড়ার পালকি আর পরপারে বুড়োদের লম্বালম্বি বাসরঘরী নাচ, সামাজিকভাবে
পরিবেশন করতে আর কাউকে দেখা যায়নি।
এখানটায়
এসে রিমা বলে, তিনি আসলে কী? স্বেচ্ছাচারী, না পাগল, না অলোকরঞ্জনের ভাষায় আয়াসকৃত
উৎকেন্দ্রিক? বলি,
-দ্যাখ,
তাঁর পদ্য লেখার শুরুটা কেমন?
তিনি
লিখেছেন, রাত্তিরবেলা বাড়ি ফিরে হিসেব মিলিয়ে একটা সনেট খাড়া করি। পরের দিন সুনীলের
বাসায় যাই। লেখাটা অতি সাধারণ, 'যম', ওর কাছ থেকে 'কবিতা'র ঠিকানা নিয়ে বুদ্ধদেবকে
পাঠাই। উনি চিঠি দেন, সামান্য সংশোধন করে ছাপবেন। হাতে স্বর্গ পাই- কিংবা মনের মধ্যে
কী যেন এক অবাস্তব হাওয়া বাড়তে থাকে। প্রায় দৌড়ে সুনীলের কাছে গিয়ে চিঠিটা দেখাই এবং
দু'তিনটি টানা গদ্যে-লেখা 'সুবর্ণরেখার জন্ম' আর 'জরাসন্ধ'। সুবর্ণরেখা কৃত্তিবাসের
জন্যে রেখে দিলে পরের ডাকেই 'জরাসন্ধ' বুদ্ধদেবের কাছে পাঠাই। পদ্য লেখার আকস্মিক জন্ম
প্রকৃতপক্ষে সেদিনই। প্রেরণা না, কোনো সনির্বন্ধ ভালোবাসায় না- শুধুমাত্র চ্যালেঞ্জের
মুখোমুখি এসে এই সব পদ্য লেখা।
যদি
এটাই শুরু হয়, তবে সেখানে কোনও ব্যতিক্রম নেই, আর পাঁচটা তরুণ কবির গল্পের মতো-ই। কিন্তু
১৯৬২ সালের 'হে প্রেম...' থেকে তিন বছরের মধ্যে ১৯৬৫তে 'ধর্মে আছি...' , একই বইয়ের ভিতর পরপর 'হৃদয়পুর'
আর 'আমি স্বেচ্ছাচারী', সচেতন গণনা কিছু তো চোখে পড়েই। দৈবী তাগিদ থেকে দীর্ঘদিন স্বতঃস্ফূর্ত
'নষ্ট' হয়ে গেছেন, 'চ্যালেঞ্জ'টির পরোয়া করেননি। কিন্তু যখন প্রতিষ্ঠান তাঁকে পোশাকি
পরিচয় দিতে এল, তিনি প্রথম দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ভিতরের 'কবি'টি পূর্ণ সক্রিয়, কিন্তু
আলখাল্লার ভার বড়ো বালাই। বহির্জীবন আর অন্তর্জীবনে যতদিন ফাঁক রাখতেন না, ততদিন কিংবদন্তির
গরিমা তাঁকে অনুসরণ করতো ছায়ার মতো। একদিন
যখন সেই 'রহস্যময়' রোদ মাথার পিছনে, নিজের ছায়া পূর্বগামিনী, তিনি নিজস্ব মুদ্রা ভাঙাতে
শুরু করলেন। তখনও তাঁর রাজত্বে কোনও চ্যালেঞ্জ নেই, কিন্তু সৃষ্টির পথ ক্রমশঃ ছলনাময়ী।
টের পেয়েছিলেন, যশের ভিতর ক্রমিক অবরোহণ। শব্দের মোচড়ে ভাষা, ভাষার মোচড়ে করতালির প্রত্যাশা
বাড়তে লাগলো। না পেলে বিষণ্ণ হয়ে পড়তেন। জীবৎকালেই খ্যাতির সমুৎসার, প্রকৃত কবি'কে
পিছনে টানে, গতিরহিত করে দিতে চায়। কিন্তু তাঁর যাবতীয় গণিত-বিপ্রতীপ যাপন, পাঠকের
কাছে শেষপর্যন্ত প্রশ্রয় পেয়ে গেছে। আপ্রাণ অপ্রকৃতিস্থতায় গড়ে তোলা হানাবাড়ির ত্রাস
থেকেও 'পার' পেয়ে গেছেন পাঠকের প্রেমে।
দিনের
শেষে তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়,
“…বস্তুর
গ্রন্থনা থেকে বস্তুকেই মুক্তি পেতে হবে
-একদিন।
তা
না হলে সব ব্যর্থ-উদ্যোগ, উদ্যম,অভ্যর্থনা
জীবনধারণ
ব্যর্থ, ব্যর্থ সব কৃত্রিম প্রকৃতি
কায়ক্লেশ,
দুঃখ-সুখ, মনে পড়া স্বপ্নে ঘুমঘোরে
বালকের
দোলমঞ্চ, ভাঁটফুল, মর্নিং-ইস্কুল
ব্যর্থ
ক্ষয়রোগ আর রক্তের ভিতর তার খেলা-
অমরতা
নাম্নী ঐ নারীটির ভ্রূমধ্যে আমার
চুম্বন
দেবার কথা- দেবো না, দেবো না কোনোদিনও
-এইভাবে
বস্তুর
গ্রন্থনা থেকে বস্তুকেই মুক্তি পেতে হবে”।
------------------------------
সূর্য
এখানে এভাবেই অস্ত যায়। প্রথম শাদা থেকে নীলাভ ছায়। তারপর হলুদ, সোনালি, কমলা। তারপর
হঠাৎ আকাশের স্মেল্টার থেকে উপচে গলন্ত লোহার মতো আগুন ছড়িয়ে যায় এপার ওপার সাতশো পাহাড়ের
নীলিম দিগন্তে। কিমাশ্চর্যম... আমি যদি যুধিষ্ঠির হতুম, নহুষ যক্ষের প্রশ্নের উত্তর
হতো অন্যরকম। রোজই সারা পৃথিবী জুড়ে সূর্য ওঠে আর অস্ত যায়, কিন্তু পুরনো হয় না কেন?
বারান্দায় বসে দেখি ঝুঁঝকো আঁধার নেমে আসছে, ঘাসজমি, লালমোরম, ঘোরানো পথের টার্নিং
মিলিয়ে যাচ্ছে নিশ্চুপ। সবুজ অরণ্যের আভা গাঢ় হয়ে মিশে যাচ্ছে আবহের অন্ধকারে।
-শিবাজিদা,
তোমার একট কবিতা ছিলো না, মোরান সাহেবের বাংলো...
-আরে
সে তো কোন পুরাকালে, কোথায় যেন বেরিয়েছিলো...
-‘কালিমাটিতে’
-আরে,
তোর মনে আছে তো… গজব হ্যাঁ…
-আমার
এই ডাকবাংলাটা দেখে সেই কবিতাটা মনে আসছে...
-হমম,
মোরান সাহেবের বাংলো'তে রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন থেকেছিলেন, আর এখানে থাকতেন তাঁর চ্যালা,
বাবু শক্তি চট্টোপাধ্যায়...
ক্রমশ
আবছায়া হতে থাকা অরণ্যবৃক্ষের জড়াজড়ি করে থাকা আড়ালের ওপারে গাঢ় ধূসর আকাশের দিকে সে
তাকিয়ে রয়েছে। তাকিয়েই রয়েছে, দেখছে না কিছু। বুধিয়া একটি লণ্ঠন জ্বেলে রেখে গেলো সামনের
ছোটো টুলটিতে। কেরোসিনের ছেলেমানুষি গন্ধ। তাকে ঘিরে পতঙ্গের ওড়াউড়ি...
-দিনটা
খুব শিগগির শেষ হয়ে গেলো...
-হয়তো,
জানি না, কতোক্ষণ থাকার ছিলো রে দিনটা?
-কখনও
ভেবেছো?
-তুই
ভেবেছিস?
-ভেবেছি...
বহুবার... এই তো এখনও...
-এখনও
!
-আশ্চর্য
হলে নাকি?
-একটু
হলুম, ভেবেছিলুম আমি তোকে সারপ্রাইজ দেবো... শেষপর্যন্ত তুইই আমাকে মাৎ করে দিলি...
-তোমাকে
মাৎ করে দেবার জন্য জন্য শক্তি আছেন, আরও কেউ, যেখানেই থাক, আছেই... আমি নই…
-তাই
তো জানতুম এতোদিন... বোধহয় ভুলই জানতুম...
-কেন?
ভুল কেন?
-কে
জানে? জানলে ভুলটা তো আর হতো'ই না ...
-বাবা,
এ তো শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর ডায়ালগ মনে হচ্ছে। তা ভুলটা কী ছিলো বলবে একবার?
-ওটা
একটা নাম, ডাকার ছিলো, আমার আর ডাকা হয়নি…
-নাম?
কার নাম?
-নামটা
শোনার জন্য এতো আকুলতা কেন তোর?
-তবু
বলো'ই না একবার, একবার তো শুনি...
সাঁঝগহনের
সারান্ডায় পাতার ফাঁকে, নেই আলোতে দেখলুম গণেশ পাইনের রানি নির্নিমেষ আমার চোখের দিকে
নিয়তির মতো চেয়ে আছে। সাতশো পাহাড়ের প্রতিটা শৃঙ্গে প্রতিধ্বনির নিঃশব্দ কোলাহল। সন্ধে
হাওয়ায় নিমীল, নীরব, নির্মম।
-দেরি
হয়ে গেলো রে রিমা, সত্যিই অনেক দেরি গেলো...
নিরুত্তর
অন্ধকারে দূরে জ্বলছে নিভছে সারে সারে সম্বর কিংবা চিতল হরিণের সবুজ চোখের ঝিকিমিকি...
জঙ্গলে
রাত নেমে এলো...
এই লেখা টি বেশ ভালো লাগছে পড়তে
উত্তরমুছুন