কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৭ মে, ২০২০

আলম তৌহিদ




জগত সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির গল্প





(৩)

সর্বশেষ একেশ্বরবাদের উৎপত্তি হয়েছে মক্কা নগরীতে। নবী মুহাম্মদ এর প্রচারক। তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাবের নাম কোরআন। পূর্ববর্তী কিতাব জেন্দ আবেস্তা-তাওরাত-ইঞ্জিলের প্রচুর তথ্য কোরআনে পাওয়া যাবে। কেবল পাওয়া যাবে না তাদের সৃষ্টিকর্তার নাম। কারণটা এখানেও জাতিগত। জোরওয়াস্টার ছিলেন ইস্তিমা জাতির লোক, আর ইব্রাহীম-মুসা-ঈসা ছিলেন ইহুদী। কিন্তু মুহাম্মদ ছিলেন একজন আরব। হাজার হাজার বছর ধরে কুরাইশরা কাবাঘরের প্রধান দেবতা আল্লাহ ও তাঁর কন্যাদের উপাসনা করে আসছিল। ইব্রাহীম যখন মক্কা আগমন করেছিলেন, সেই সময়েও কুরাইশরা ছিলেন পৌত্তলিক। নবী মুহাম্মদ ছিলেন মূলত মূর্তি পুজার বিরোধিতাকারী। তিনি তৎকালীন কাবার প্রধান দেবতা আল্লাহর বিরোধিতাকারী ছিলেন না। তিনি কাবাঘরের মূর্তি ভেঙ্গেই আল্লাহকে লা-শরীক ও নিরাকার করেছেন। তাছাড়া বিজাতীয় সৃষ্টিকর্তাকে গ্রহণ করার চেয়ে তাদের হাজার বছরের উপাস্য আল্লাহকে জগৎ স্রষ্টার আসনে বসানো তাঁর জন্য অধিক যুক্তিযুক্ত এবং মর্যাদার ছিল। এতে আরব জাতীয়তাবাদ গঠন সহজ হয়েছিল।

ইসলাম পূর্ব আরবের পৌত্তলিক ধর্মমতে আল্লাহ ছিলেন চন্দ্রদেবতা। তাঁর সাথে বিয়ে হয় সূর্যদেবীর। তাঁদের কন্যারা হলেন উজ্জা, লাত, মানাত। ইসলামে এই আল্লাহ হলেন জগৎস্রষ্টা।

কোরআনে সৃষ্টিতত্ত্ব সুবিন্যস্ত ভাবে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সুরায় খণ্ড খণ্ড রূপে উল্লেখ পাওয়া যায়। সুরা আরফ-এ আছে, আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। সূরা হ-মীম সেজদাতে বলা হয়েছে- আল্লহ দুই দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীর উপরিভাগে স্থাপন করেছেন অটল পর্বতমালা। তাতে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন এবং চার দিনের মধ্যে তাতে খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধুম্রকুঞ্জবিশেষ। অনন্তর তিনি উহাকে ও পৃথিবীকে বললেন, 'তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়'। উহারা বলল, 'আমরা আসিলাম অনুগত হইয়া'। অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলকে দুই দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশে বিধান ব্যক্ত করলেন। আল্লাহ আকাশকে সুশোভিত করলেন প্রদীপমালা দ্বারা এবং করলেন সুরক্ষিত।

সুরা আন-নযিয়াতে বর্ণিত আছে, 'তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কঠিনতর, না আকাশ সৃষ্টি? তিনিই ইহা নির্মাণ করিয়াছেন। তিনি ইহার ছাদকে সুউচ্চ ও সুবিন্যাস্ত করিয়াছেন। আর তিনি ইহার রাত্রিকে করিয়াছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং আকাশকে করিয়াছেন ইহার সূর্যালোক; এবং পৃথিবীকে ইহার পর বিস্তৃত করিয়াছেন'।
সূরা আম্বিয়াতে আছে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে। আল্লাহ উভয়কে পৃথক করে দিলেন। এবং প্রাণবান সবকিছু সৃষ্টি করলেন পানি থেকে।

দেখা গেল যুগে যুগে ধর্ম প্রচারকগণ যাকে সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, তাঁর অনুসারীরা ঐ সৃষ্টিকর্তারই এবাদত করেছে। এতে যেটা ঘটেছে তা হলো নতুন ধর্ম প্রচারকের সাথে সাথে নতুন সৃষ্টিকর্তার আবির্ভাব হতে।

মানব ইতিহাস থেকে আমরা আরও অনেক সৃষ্টিকর্তার নাম পাই। 'ক্ষুণুম' ছিলেন মিশরের প্রাচীন অধিবাসীদের সৃষ্টিকর্তা। তিনি প্রথমে ডিম্বাকার পৃথিবী এবং পরে মানুষ সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যেও আবার সৃষ্টিকর্তা নিয়ে বিভক্তি দেখা যায়। অন্যদলের সৃষ্টিকর্তা হলেন 'টা'। তিনি ঐ ডিম হাতুড়ী দ্বারা ভেঙ্গে ফেলেন এবং সেই ডিম থেকে উৎপন্ন হয় পৃথিবী ও প্রাণীকুলের। আবার প্রাচীন মিশরের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করত 'রা' বা 'রে' (সূর্য) হলো পৃথিবীর সকলের সৃষ্টিকর্তা। প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে একথাও প্রচলিত ছিল যে, 'থোথ' বা চন্দ্র-দেবতার ইচ্ছায় বা আদেশে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল। ফিনিসিয়ার অধিবাসীদের সৃষ্টিকর্তার নাম 'ক্রনস'।


"ফিনিসিয়ার অধিবাসীদের বিশ্বাস ছিল,-'ক্রনস' নামক দেবতা ফিনিসিয়া ও তাহার অধিবাসীদিগকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন। খৃষ্ট-পূর্বব দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রচলিত 'জেবেল-বিবলস্‌' প্রবর্তিত মুদ্রায় ক্রনসের মূর্তি অঙ্কিত ছিল। সেই মূর্তিতে সৃষ্টিকর্তা ক্রনসের পশ্চাতে ও সম্মুখে দুই দিকে চক্ষু ছিল বলিয়া বুঝিতে পারা যায়। তাঁহার ছয়টী পক্ষ ; তন্মধ্যে কয়েকটী বিস্তারিত এবং কয়েকটি সঙ্কুচিত। প্রাচীন ফিনিসীয়দিগের মতে, তিনিই এই বিশ্ব- সংসারের সৃষ্টিকর্তা।"৩

প্রাচীন ব্যাবিলনের অধিবাসীরা বিশ্বাস করতো মার্দক ছিলেন দেবতাদের অধিপতি। আদিকালের আলোকের নাম হলো মার্দক। গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টির পূর্বে তিনি ছিলেন একমাত্র আলোকের অধীশ্বর। *তিয়ামাৎএর সাথে দেবতাদের বিরোধ সৃষ্টি হলে মার্দক তিয়ামাৎকে দ্বিখণ্ডিত করে হত্যা করেন। তিয়ামাৎএর দেহের এক অংশ হতে পৃথিবী এবং অপর অংশ হতে স্বর্গ সৃষ্টি হয়েছিল। আবার ব্যাবিলনের প্রধান ঈশ্বর হিসেবে 'বেল নিপ্পার' নামও পাওয়া যায়।

আফ্রিকার বন্য-জাতিদের সৃষ্টিকর্তার নাম মাণ্টিস। মান্টিস হলো এক জাতীয় পতঙ্গ। এই পতঙ্গদের মধ্যে 'কাগন' বা 'ইকাগন' মানুষের মঙ্গলকারী দেবতা বলে পূজিত হয়ে থাকে। মাণ্টিসের স্ত্রী, কন্যা ও জামাতা আছে। তিনি স্বীয় পাদুকা হতে চন্দ্র উৎপাদন করেন এবং জামাতার পাদুকা থেকে দ্বীপ সৃষ্টি করেন। মাণ্টিসের পাদুকায় রক্তবর্ণ ধুলা ছিল বলেই চন্দ্র রক্তিমাভ দেখায়।

'সুনি গোয়ান' হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার হটেনটট জাতির সৃষ্টিকর্তা। তিনি শূন্য থেকে বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন। দক্ষি আফ্রিকার জুলু জাতির সৃষ্টিকর্তার নাম  'উন্‌কুলুলু'। তিনি ছিলেন জুলু জাতির আদিপুরুষ এবং পৃথিবীর প্রথম মানুষ। তাঁর থেকেই সকলের উৎপত্তি হয়েছে। জুলুরা তাই পিতৃপুরুষগণের উপাসনা করেন।

অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশের আদিম অধিবাসীদের সৃষ্টিকর্তা হলো একটা পাখি। এর নাম 'পণ্ডজিল'। তাদের বিশ্বাস পণ্ডজিলই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। পণ্ডজিল পৃথিবীকে খণ্ড খণ্ড অংশে বিভক্ত করেছে। অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য আদিবাসীদের বিশ্বাস 'নুরালি' পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।

গ্রীক পুরাণে আছে, দেবতা ক্যায়োসএর জন্ম হয়েছে অন্ধকার থেকে। ক্যায়োস জন্ম দেন তার কন্যা ইউরোনোমে'কে। জন্মের পর ইউরোনোমে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও পা রাখার জায়গা পেলেন না। কারণ তখন আকাশ ও সাগর একত্রে ছিল। তাই তিনি আকাশ থেকে সাগর পৃথক করলেন এদিকে ক্যায়োস  অন্ধকারের সাথে মিলিত হয়ে উৎপন্ন করলেন রাত-দিন-অন্ধকার ও বাতাস। ক্যায়োস থেকে উৎপন্ন হয়েছিল ওফিয়োন নামক এক বিরাট সাপ। ইউরোনোমে যখন নাচতে লাগলেন ওফিয়োন তা দেখে কামাসক্ত হলেন। সে তার কুণ্ডলী দিয়ে ইউরোনোমেকে আকর্ষণ করলে ইউরোনোমে একটি ঘুঘুর রূপ ধারণ করে একটি ডিম প্রসব করলেন। ওফিয়োন ডিমে তা' দিতে থাকলেন। অবশেষে এই ডিম দুইভাগে বিভক্ত হলো। সেখান থেকে সৃষ্টি হলো চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র। ক্রমে পৃথিবী নদী-সাগর-পাহাড় দ্বারা সুসজ্জিত হলো। তারপর সৃষ্টি হলো উদ্ভিদ ও প্রাণী।

আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান, আলাস্কাবাসী ও উত্তর-পশ্চিম তীরের 'থিলিঙ্কিট ইন্ডিয়ান' নামক অধিবাসীদের সৃষ্টিকর্তা হল দাঁড়কাক। এই দাঁড়কাকের ডিম থেকেই পৃথিবী এবং মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। দাঁড়কাকটি একটি বাক্স হতে চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রপুঞ্জ বের করে এনে পৃথিবীকে আলোকিত করেছে।

উত্তর আমেরিকার 'আল্‌গকিন্‌' জাতির সৃষ্টিকর্তার নাম 'মিকাবো'। এই মিকাবো হল এক বৃহৎ খরগোস। এই খরগোসই পৃথিবী সৃষ্টি করেছিল। খরগোসটি ভেলার সাহায্যে অন্যান্য জন্তুকে রক্ষা করেছিল। ভেলায় অবস্থিত জন্তুদের মধ্য থেকে তিনটিকে একে একে সমুদ্রের তলদেশে মাটি আনবার জন্য প্রেরণ করেন। সমুদ্রের তলদেশ থেকে তারা অল্প অল্প মাটি নিয়ে আসে। সেই মাটি দিয়ে খরগোস একটি দ্বীপের সৃষ্টি করেন। সেই দ্বীপটিই হল পৃথিবী।

উত্তর আমেরিকার 'ইরোকো' জাতির মধ্যে সৃষ্টি সম্পর্কে কোনো জীবজন্তুর গল্প পাওয়া যায় না। তাদের মতে, উপরে স্বর্গ ও নিম্নে অনন্ত জল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। স্বর্গের একটি ছিদ্রের মধ্য দিয়ে 'আতোয়ান্ত্রিসিক' নামে একজন নারী জলের মধ্যে পতিত হয়। সেই স্থানে ছিল একটি কচ্ছপ। আর কচ্ছপের পৃষ্টদেশে ছিল সামান্য মাটি। আতোয়ান্ত্রিসিক পতিত হয়েছিল সেই কচ্ছপের পিঠের উপর। তিনি তখন গর্ভবতী ছিলেন। তার গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয় একটি কন্যা। সেই কন্যা জন্ম দেয় যমজ দুই পুত্র। তাদের নাম- জোস্কেহা ও টাওয়াস্কারা। দুই ভায়ের মধ্যে বিরোধ হওয়ায় টাওস্কারা স্বীয় মাতাকে হত্যা করে। তাদের মাতার কঙ্কাল থেকে উদ্ভিদ-সকল উৎপন্ন হয়। জোস্কেহা সৃষ্টি করে মানুষ ও পশু।

মেক্সিকোর আধিবাসীরা বিশ্বাস করেন বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে পাঁচটি পর্যায়ে। প্রথম চারটি পর্যায়ের নামের উল্লেখ আছে। এগুলো হল স্থল, অগ্নি, বায়ু ও জল। পঞ্চমটির নাম পাওয়া যায় না। প্রথম যুগে সৃষ্টি হয় মৃত্তিকা; দ্বিতীয় পর্যায়ে সৃষ্টি হয় অগ্নি বা আলোকপুঞ্জ; তৃতীয় ধাপে বায়বীয় পদার্থ এবং চতুর্থ ধাপে জলীয় বা বাষ্পীয় পদার্থ।

পেরুবাসীদের সৃষ্টিকর্তা তিনজন। প্রথম জন হলেন পাচাকামাক। তিনি ভূগর্ভস্থ অগ্নিদেবতা। দ্বিতীয় জন ভিরাকোচা। তিনি পৃথিবী সৃষ্টি ও গঠন করেন। আর তৃতীয় জন হলেন মাংকোকাপাক। তাকে বলা হয় অদ্বিতীয় মানুষ। তার পত্নী ও ভগ্নী সৃষ্টিকারী ডিম্ব নামে অভিহিত। অদ্বিতীয় মানুষ ও ডিম্ব সূর্য ও চন্দ্ররূপে প্রকাশমান হন। ব্রাজিলের কিছু কিছু জাতিদের বিশ্বাস জামোয়া নামক দেবতা পৃথিবীর প্রথম মানুষের পিতামহ। তার দ্বারাই সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে।

পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন জাতির মধ্যে সৃষ্টি সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। স্যার জর্জ প্রে-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, পলিনেশীয়ার মাওয়ারী জাতির বিশ্বাস ছিল 'রাঙ্গী' ও 'পাপা' অর্থাৎ স্বর্গ ও পৃথিবী প্রথমে একত্রে ছিল। হঠাৎ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ায় স্বর্গ উপরে উঠে যায় এবং পৃথিবী নিম্নে পড়ে থাকে। রাঙ্গী ও পাপার পুত্রের নাম ছিল তাঙ্গালোয়া। তিনি ছিলেন জলদেবতা বা সমুদ্রের অধিপতি। তিনি মৎস এবং সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী সৃষ্টি করেন। পলিনেশীয়ার কিছু কিছু অংশের অধিবাসীরা আবার তাঙ্গালোয়াকেই পরমেশ্বর বলে মান্য করে। তাদের মতে তিনিই সৃষ্টিকর্তা। শ্যামোয়া দ্বীপের লোকেরা তাকে ডাকে তাঙ্গালোয়া লাঙ্গী। অনেকের ধারণা কখনো কখনো তিনি কচ্ছপের মধ্যে বাস করতেন। আবার কখনো কখনো তিনি কচ্ছপটি পরিত্যাগ করতেন। তিনিই পৃথিবীর অবয়ব ও প্রাণী সংখ্যা বৃদ্ধি করতেন। অন্যান্য বিশ্বাস মতে তিনি ডিম্বের মধ্যে বাস করতেন। মাঝে মাঝে তিনি ডিম্ব ভেঙ্গে ফেলতেন। তখন দ্বীপসমূহ সৃষ্টি হত। তার সম্পর্কে আরও একটি প্রবাদ হল, অতি প্রাচীনকালে তাঙ্গালোয়া এক বৃহদাকার পক্ষীর রূপে সমুদ্রের উপর বিচরণ করতেন। সেই সময় তিনি জলের উপর একটি ডিম্ব রক্ষা করেন। সেই ডিম্বই পৃথিবী ও স্বর্গ বা সূর্য। পলিনেশীয়ার অধিবাসীরা বিশ্বাস করে 'পো' হতে দেবগণের উৎপত্তি হয়েছে। পো শব্দ দ্বারা অন্ধকার বোঝায়। এমন কি, তাঙ্গালোয়া পর্যন্ত উদ্ভূত হয়েছিলেন অন্ধকার থেকে।

মেসোপটেমিয় পুরাণ স্বীকার করে সৃষ্টির আদিতে সমুদ্র ছিল। অর্থাৎ জলের অস্তিত্ব ছিল। বেদও জলাকৃতি থেকে বিশ্বভুবন সৃষ্টির কথা বলে। খৃষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে গ্রীক দার্শনিক থেলেসও আমাদেরকে জানান, জলই সৃষ্টির উৎস।  বাইবেল বলে, আদিতে ঈশ্বরের আত্মা জলে ভাসমান অবস্থায় ছিল। ইসলামও বিশ্বাস করে সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহর আরশ জলের উপর ভাসমান অবস্থায় ছিল। উত্তর আমেরিকার 'ইরেকো' জাতিও সৃষ্টির পূর্বে জলের অস্তিত্ব স্বীকার করে। এসব গল্পে সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বর ও জলের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তখন জল কোথায়, কোন পাত্রে এবং কীভাবে সৃষ্টি হল তা আমাদের জানায় না। ধর্ম প্রণেতা ও প্রচারকরা মানুষের ধর্ম নিয়ে মশগুল ছিল বিধায়,  তারা জলের ধর্ম কী তা জানত না। ইসলাম যখন বলে প্রত্যেকটা মুসলমান একে অপরের ভাই ভাই, তেমনি দেখা যায় ধর্ম ও পুরাণের মধ্যে একটা সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।

মেসোপটেমিয় পুরাণে তারকারাজি দ্বারা আকাশ সুশোভিত ও মাটি দ্বারা মানুষ বানানোর উল্লেখ পাওয় যায়। বাইবেল-কোরআনেও একই কথা বর্ণিত আছে। খৃষ্টপূর্ব ২০০০ বছর কিংবা তারও পূর্বে রচিত 'গিলগামেশ' মহাকাব্য থেকেও আমরা জানতে পারি মাটি থেকে মানুষ বানানোর গল্প। ইহুদীদের প্রাচীন গ্রন্থ 'তালমুদে'ও আমারা অনুরূপ গল্প পাই। দেখা যাচ্ছে পুরাণের সাথে তাদের ভাব-গল্পের বৈসাদৃশ্য নেই। বরং পুরাণের অনেক কিছুই ধর্মে স্থান করে নিয়েছে। নাসদিয় সূক্তে বলা হয়েছে প্রথমে কিছুই ছিল না, কেবল ঈশ্বর ছিলেন। অর্থাৎ ঈশ্বর ছাড়া সবকিছু শূন্য ছিল। কিন্তু আবার বলা হচ্ছে অন্ধকার ছিল, চারদিক জলময় ছিল। যদি তাই হয় তাহলে আদিতে শূন্য কথাটা গৌ হয়ে পড়ে। ধরে  নিতে হয় জল ও ঈশ্বর সমার্থক অথবা জল ভিন্ন ঈশ্বর।


আবার ছান্দোগ্য উপনিষদে জলতত্ত্বের কথা নেই। সেখানে আছে ডিমতত্ত্ব। অর্থাৎ ডিম থেকেই জগত সৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য উপনিষদ থেকেও ডিম্বের কথা জানা যায়। ব্রহ্মা স্বয়ং ডিম্বে অবস্থান করেন ও ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন। আবার অহুর মজদা মহাবিশ্বকে ভাসমান ডিম্ব আকারে সৃষ্টি করেছেন। প্রাচীন মিশরীয়দের সৃষ্টিকর্তা ক্ষুণুমও ডিম্ব আকৃতির পৃথিবী সৃষ্টি করেন। এই ডিম ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় পৃথিবী ও মানুষ। গ্রীক পুরাণেও আছে ডিম্বতত্ত্ব। এই ডিম্ব দুইভভাগ হয়ে বেরিয়ে এসেছিল  চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্র-পৃথিবী এবং আরও কতকিছু। আমেরিকার কিছু কিছু জাতিরও বিশ্বাস ছিল দাঁড়কাকের ডিম থেকে পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের মধ্যেও ডিম্বতত্ত্ব প্রচলিত আছে। তাদের সৃষ্টিকর্তা তাঙ্গালোয়ও ব্রহ্মার মতো ডিমের মধে বাস করতেন। ডিম ভেঙ্গে সেখানেও সৃষ্টিকার্য সমাধা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে জাতি-স্থান-কাল ভেদেও ধর্মশাস্ত্রগুলো ডিমবচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি। ধর্মশাস্ত্র মানব রচিত বলেই এই সংক্রামক ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারে নি।

মেসোপটেমিয় পুরাণে আছে অসুরের দ্বি-খন্ডিত দেহের ঊর্ধ্বাংশ থেকে আকাশ ও নিম্নাংশ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। এই দ্বি-খণ্ডিত তত্ত্ব বেদেও আছে। ভারতীয় পুরাণ বলে আদিতে ঈশ্বর পুরুষ ও প্রকৃতিতে বিভক্ত হয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই সৃষ্টিগুলো একটার পর একটা বেরিয়ে আসে। শিবও যোগের মাধ্যমে নিজেকে দ্বি-খন্ডিত করে সৃষ্টির কাজে সহায়তা করেছিলেন। সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতিও নিজেকে দ্বি-খণ্ডিত করে হয়েছিলেন একভাগ পুরুষ ও অপরভাগ নারী। মার্দকও তিয়ামৎকে দ্বি-খণ্ডিত করে হত্যা করলে তাঁর দেহের এক অংশ হতে পৃথিবী ও অপর অংশ হতে স্বর্গ সৃষ্টি হয়েছিল।

জেন্দ আবেস্তাতে আমরা পাই ছয় বারে সৃষ্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। প্রথমে আকাশ, দ্বিতীয়তে জল, তৃতীয়তে পৃথিবী, চতুর্থতে বৃক্ষাদি, পঞ্চমতে জীবজন্তু এবং ষষ্ট বারে সৃষ্টি হয় মানুষ। তাওরাত কিতাবেও দেখা যায় জেহোবা ৬দিনে সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তিনিও প্রথম দিনে আকাশ, দ্বিতীয় দিনে জল, তৃতীয় দিনে পৃথিবী, চতুর্থ দিনে চন্দ্র-সূর্য, পঞ্চম দিনে জীবজন্তু এবং ষষ্ট দিনে মানুষ সৃষ্টি করলেন। এখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে সৃষ্টিকর্তা জেহোবা তাঁর সৃষ্টিকার্যে অপর সৃষ্টিকর্তা অহুর মজদাকে অনুসরণ করেছেন। ইসলামও বলে আল্লাহ ৬দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে পূর্ববর্তী সৃষ্টিকর্তাদের সাথে আল্লাহও খাপে খাপে মিলে গেলেন। তবে তিনি এখানে একটু ব্যতিক্রমের পরিচয় দিলেন। তিনি পূর্ববর্তী সৃষ্টিকর্তাদের মতো প্রথমে আকাশ সৃষ্টি করলেন না। তিনি প্রথমে সৃষ্টি করলেন পৃথিবী, তাও দুই দিনে। চার দিনের মধ্যে খাদ্যের ব্যবস্থা করে আকাশ সৃষ্টিতে মনোযোগ দিলেন। শেষ ২ দিনে সপ্তাকাশ সৃষ্টি করলেন। আবার অন্যত্র উল্লেখ আছে, আকাশ ও পৃথিবী এক সাথে মিশে ছিল, তিনি উভয়কে পৃথক করে দিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তিনি যদি প্রথমে পৃথিবী সৃষ্টি করেন, তাহলে তখন আকাশটা কোথায় ছিল? যদি আকাশ ও পৃথিবীকে পৃথক করেন, তবে দুটিই তো এক সাথে সৃষ্টি হওয়ার কথা। তাই কোরআনের বর্ণনাকে অগোছালো মনে হয়।

-----------
তথ্যসূত্র
১। সৃষ্টিতত্ত্ব - হিন্দু দর্শন (ইন্টারনেট থেকে)
২। ভারতবর্ষ (৩য় খন্ড) - শ্রীদুর্গাদাস লাহিড়ী/প্রকাশক- শ্রীধীরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, হাওড়া, কলকাতা। ১,২,৩
৩। পবিত্র বাইবেল - বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা।
৪। আল-কোরআন (অ্যারাবিক টু বেঙ্গলী) - ইসলামের আলো পাবলিকেশন।
----------------
*ডক্টর স্পিগেল জার্মানির প্রসিদ্ধ পণ্ডিত। তিনি জেন্দ-আবেস্তা গ্রন্থের অনুবাদক এবং 'জেনেসিস' ও 'আবেস্তার' তুলনামূলক সমালোচনা করেন।
*পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে অপ্‌সু ও তিয়ামাৎ (নর ও নারী) জলরূপে বিদ্যমান ছিলেন। তিয়ামাৎ হলো সাগর-রূপিণী। অন্য মতে তিয়ামাৎ হলো ড্রাগন।




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন