টাবলু ও মরুভূমি
সকাল থেকে ভ্যাপসা গরম। ঘেমো বিছানায় শূন্য জলের বোতলটা গড়াগড়ি খাচ্ছে। জানালার পর্দাগুলো যে যার নিজের জায়গায় স্থির। বাইরে
একটা কাক চিল্লিয়ে যাচ্ছে তারস্বরে। মেসেঞ্জারে দেখাল সাতান্নটা পেন্ডিং মেসেজ,
আনরীড্। মনে হল কাছাকাছি কোনো মানুষজন নেই। মাথা কপালে টিপটিপে ব্যথা, গায়ে হালকা জ্বর। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। সে ঘড়ি দেখল। সাড়ে সাতটা। আকাশে একটা
ভ্যাবলানো সূর্য। পাশের বাড়ির টিভি থেকে গুড
মর্নিং আকাশের গান কিছু চুঁইয়ে আসছে এদিকে। আজ
সোমবার। সপ্তাহের প্রথম দিন। সে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। নিতেই ঘুমিয়ে পড়ে। বরাবর দেখেছে ঘুমোলে একদম গরম বোধ থাকে না, খিদে
পায় না। মাথা যন্ত্রণা কপাল টিপটিপ সব কোথায়, এমনকি রাগও হয় না। দেখেছে একমাত্র ঘুমোলেই তার কথারা আসে।
জেগে থাকলে যেটা ভ্যানিশ। না, সে স্বপ্ন মোটেই দেখে না। বরং সে যা দেখে সবই সত্যি। রাজকুসুমের প্রোফাইল পিকচারের মত। একশো আটান্নটা
পিপিতে তিন হাজার একুশখানা লাইক।
তিনটে কমেন্টসের দুটো ভগবানের বাবার।
এই তিতকুটে সকালেও রাজকুসুমের
প্রসঙ্গ তাকে কমনীয় করে তোলে।
হোক না সে প্রোফাইল পিকচারের। ফলে দ্বিতীয় দফার
ঘুমে সে
স্লো মোশনে মরুভূমি পাড়ি দেয়। সেখানে বালির মধ্যে
দু’ধারে জলন্ত
মশাল গাঁথা। রাতের মরুভূমি সোনালী রঙে
ভর্তি। পেছন ফিরলে সে দেখতে পায় বহুদূর পর্যন্ত তার নিজেরই পায়ের ছাপ। নেই আঁকাড়া শিশুর মত এতদূর পায়ে পায়ে চলে এসেছে। কোনও আসন্ন ধুলিঝড়ই পারবে কেবল সেগুলোকে মুছে দিতে। একটা মশাল উঠিয়ে তার আলোয় সবথেকে নিকট যে ছাপ
সেটাকে পরীক্ষা করতে থাকে। হ্যাঁ এটা তারই পায়ের ছাপ বটে। সেই আঙ্গুল সেই গোড়ালি! উবু হয়ে এদিক থেকে সে ছাপ
গুনতে বসল। হাউ মেনি? পঁয়ত্রিশটা ছাপ গোনার পর সাবধানে সেগুলোর ছবি তুলে সোশাল নেটওয়ার্কে
পোস্ট করে দিল –
শুভ সকাল আমার মিষ্টি বন্ধুরা!
চব্বিশ সেকেন্ডের মধ্যে প্রথম
লাইকটা পড়ে গেল। সঙ্গে কমেন্ট, বাজার যাচ্ছেন বুঝি?
তিন মিনিট পর দ্বিতীয় লাইক।
সঙ্গে কমেন্ট, হাউ ফানি? কী সু্য়িট!
তৃতীয় কোনও লাইক নেই। শুধু
কমেন্ট, চুমু...
চতু্র্থ...
সে রাজকুসুমের লাইকের জন্য
রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করে। বারবার কমেন্ট বক্স চেক করে।
ভ্যাপসা গরমে কপালে বিন্দু
বিন্দু ঘাম জমে যায়। ঠিক এই সময় দূরে কোথাও গুড়গুড় করে মেঘ ডাকে। রাজকুসুম সাড়া দেয় না। আরও মন দিয়ে পায়ের ছাপগুলো লক্ষ্য করে। নাঃ!
কোথাও কোনও ভুল নেই। যেখানে যেটা থাকার সবই ঠিকঠাক আছে।
সোমবারের কাজগুলো করতে করতে মাথা
ধরাটা খানিক হাল্কা হয়ে যায়। সেদ্ধ ডিম থেকে
খোসা ছাড়ানোর সময় চোখের কোণায় আর ঠোঁটের নীচে একটু হাসি ঝুলতে দেখা যায়। হাসতে হাসতে মশালের আলো ধরে সামনে এগিয়ে চলে। সোশাল নেটওয়ার্কে এই সময় তার পোস্টে ঊণআশিতম লাইকটি পড়ে। খাবার জায়গায় লম্বা
লাইন। দূর থেকে খাদ্য সম্ভার সজ্জিত টেবিলটা সে দেখতে
পেল। বালির ওপর দ্রুত চলা সম্ভব নয়। পা দেবে যায়। তবু ওই রকমই চলে কোনও রকমে টেবিল অব্দি পৌঁছায়। কিছু কিছু খাবার মুখে তুলে আবার হাঁটা লাগায় সামনে।
পেছনে যথারীতি পায়ের ছাপ। পুরনো বই অনেক জমেছে। আসছে রবিবার এই সব বই ঠিক করল পুরনো বইএর দোকানে
পাঠিয়ে দেবে। না,
নতুন বইএর নাম আপাতত সেই রকম কিছু মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। গ্যাসে চায়ের জল চড়াল। ডিব্বা খুলে কাপে চিনি নিল। এক চামচ। সূর্যটা সেই একই
রকম অর্থাৎ ভ্যাবলানো। এই সময় রোজ সে বাগানের ফুল গাছগুলোয় জল দ্যায়। বালতি মগ নিয়ে রেডি হবার সময় খুব মনে এল এখন রাজকুসুম কী করছে?
এখন রাজকুসুম চুল বাঁধছে।
এখন রাজকুসুম কী করছে?
এখন রাজকুসুম গয়না পড়ছে।
এখন রাজকুসুম কী করছে?
এখন উনি আয়নায় মুখ দেখছেন।
নিজস্ব তহবিলে এ সময় নিরানব্বইতম
ফ্রেন্ড রিকয়েস্টটা জমা পড়ে। বালি সরিয়ে সে একে একে সব কটা ডিলিট মারতে শুরু
করে।
মরুভূমির অর্ধাচন্দ্রাকৃতি
বালিয়াড়ি বার্খান। বার্খানের ওপর থেকে দূরে দেখতে পায়
ছোট ছোট ঘর বাড়ি
মানুষজন দোকানপাট... সবই প্রায় বালি দিয়ে গড়া।
এদিকে তার গা বেয়েও বালি ঝড়ে
পড়ে... ঝুরঝুর...
‘আর
খেলা নয় টাবলু! অনেক রাত হয়েছে, ঘুমোতে এসো এবার!’
চমৎকার লিখেছিস । হিংসে হয় ।
উত্তরমুছুন