বনফুলের ছোটগল্পঃ মানবতার জয়গান
“কপালেতে ছোট্ট টিপ-মানানসই দুল
খোপায় গোঁজা টাটকা চাঁপা ফুল
হাত দুটিতে হালকা চুড়ি,
চোখে ভরা লাজ
সত্যিকারের সুন্দরীর
আর কি চাই সাজ!...”
কবিতাটি দীর্ঘ হলেও বনফুলের গল্প সম্পর্কে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ‘বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন’
করতে হলে বনফুলের জুড়ি নেই। সহজ কথা সহজ ভাবে বলায় বনফুলের বিকল্প নেই। ঝরঝরে মেদহীন ভাষায় মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক এক অপূর্ব মুন্সীয়ানায় তিনি তাঁর
গল্পে তুলে ধরেছেন। ছোটগল্প লেখার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এ হচ্ছে ঊনপঞ্চাশ বায়ুর লীলা। এক একটা বিশেষ মুহূর্তে কেন এক একটা গল্পের প্লট মাথায় আসে তা বলা খুবই শক্ত। আমার মনে হয় যিনি আসল গল্পলেখক তিনি আমার নেপথ্যে বাস করেন। তাঁর যখন গল্প লেখার ইচ্ছে হয়, তিনি জোর করে আমাকে দিয়ে গল্পটা লিখিয়ে নেন।
‘গল্প লেখার গল্প’ বলেছিলেন বনফুল। বলেছিলেনঃ
“গল্প কি কৌশলে লিখি তা আমি নিজেই জানি না। আকাশে যেমন মেঘ ভেসে আসে, গাছে যেমন
ফুল ফোটে, তেমনি গল্পও মনে আপনি জাগে”।
‘ছোটগল্প’ই বাংলা সাহিত্যে বনফুলকে ‘বড়’ করেছিল। তাঁর প্রধান
বৈশিষ্ঠ্য হল, প্লট ভেবে আঙ্গিক তৈরী করে ছক কেটে তিনি গল্প লেখেননি। তাঁর গল্প আপনাতে আপনি বিকশিত। প্রতিদিন যেমন সূর্য ওঠে, আবার অস্ত যায়, চাঁদ ওঠে – এই মহাজাগতিক ব্যাপারগুলো যেমন খুব স্বাভাবিক, বনফুলের গল্পগুলোও তেমন স্বাভাবিক। সেখানে অনাড়ম্বর পাণ্ডিত্য নেই।
১৮৯২-১৯৭৯ পর্যন্ত
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জীবৎকাল। পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে
তাঁর জন্ম। সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় তাঁর পিতা। বনফুলের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পূর্ণিয়া ও হাজারিবাগ অঞ্চলে। বনফুল পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার। ডাক্তারির পাশাপাশি মানুষের
মনের ডাক্তারিও তিনি করতেন। কবিতা লেখার মধ্যে দিয়ে তাঁর
লেখক জীবনের সূত্রপাত হয়। শ্যাওড়াফুলি থেকে ডেলিপ্যাসেঞ্জারী করার সময় ট্রেনে বিভিন্ন
লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হত। ব্যক্তিগত নিভৃত আত্মবিচরণ
ছেড়ে বহু বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শেই তিনি তাঁর গল্পের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। সেই মানুষদের কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে গল্প লেখার ক্ষেত্রে অনেকটা
সাহায্য করেছে। যার ফলে তাঁকে গল্প লেখার জন্য কল্পনার আশ্রয় তেমন ভাবে নিতে
হয়নি। বাস্তবে দেখা চরিত্রগুলোকেই আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি অনবদ্য
সব গল্প রচনা করেছেন।
বনফুলের গল্পের প্রধান বিষয় মানুষ। মানুষের সুখ, দুঃখ, আশা, আকাঙ্ক্ষা, ব্যার্থতা,
মধ্যবিত্তের সাধ আর সাধ্যের যন্ত্রণাভরা দ্বন্দ্ব, লোভ, হিংসা, পাশবিকতাই বনফুলের
গল্পের প্রধান উপজীব্য বিষয়। কৃষক যেমন ধান চাষ করার জন্য মাটি খোঁড়েন, তেমন মানুষের মনের হদিশ পেতে সেই মনকেই খোঁড়েন(cultivate) বনফুল। তবে তাঁর গল্পের বর্ণনা প্রথম দিকে সাদামাটাই থাকে। অর্থাৎ গল্পের
কাহিনি একেবারে আটপৌরে ভাবেই চলতে থাকে।
কিন্তু সেই গল্পের চমক থাকে একেবারে শেষে। তাঁর পাঠক প্রথম থেকে নিতান্তই অলস ভাবে
গল্পপাঠ করছিল। কিন্তু গল্পের শেষে এহেন চমকের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সেই চাবুক যেন এসে পড়ে তার পিঠে।
মপাঁসার গল্পে থাকে চাবুক হাঁকড়ানো পদ্ধতি। চেখভের গল্পে থাকে অনিঃশ্বেস ব্যঞ্জনা। আর বনফুলের গল্পে থাকে বিরোধাভাস। প্রেমের ব্যর্থতার পাত্রে প্রেমের অমৃতকে কীভাবে পরিবেশন করা যায় তার পরিচয় লুকিয়ে
থাকে তাঁর গল্পের শেষ দুই চরণে। তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা প্রায় ছয়শো। বনফুলের গল্প পড়তে গিয়ে পাঠককে
তত্ত্বের গোলকধাঁধায় পড়তে হয় না। সহজ সরল নিরলঙ্কার পদ্ধতির
মধ্য দিয়ে তিনি যে গল্প পরিবেশন করেন তার আবেদন অনেক বেশি সাধারণ মানুষের কাছে।
বনফুল যে সময় সাহিত্য সাধনা করতে শুরু করেন সে সময় বাংলায় দুটি
পত্রিকা বেরত। দুটি পত্রিকাই আপন মহিমায় ছিল স্বতন্ত্র। একটি ‘কল্লোল’ এবং অন্যটি
‘শনিবারের চিঠি’। কল্লোলগোষ্ঠীর লেখকদের প্রধান
উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করা। রবীন্দ্রনাথের সুপ্রচলিত রোমান্টিক
সাহিত্যভাবনাকে নস্যাৎ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর মানুষের অসহায়তা, জীবিকার অনিশ্চয়তা, মূল্যবোধের ভাঙ্গন,
বিকৃত যৌনতা প্রভৃতি জিনিসকে সাহিত্যে তুলে ধরা। কিন্তু বনফুল বিশেষ কোনও গোষ্ঠীভুক্ত লেখক
ছিলেন না। তিনি নিজে এই কল্লোলযুগের হুজুগে না ভেসে নিজের সাহিত্যকর্মেই
ব্রতী ছিলেন। তাঁর
নিজস্ব একটা জীবনদর্শন ছিল। নিজের মত করে নিজের মনের কথা তিনি লিখতেন। তিনি জীবনের
বিভিন্ন প্রান্তকে স্পর্শ করেছেন সত্য। কিন্তু কখনোই একই বিষয় নিয়ে তিনি গল্প
লেখেননি। অর্থাৎ বিষয় বৈচিত্রে স্বাতন্ত্র্য ছিল। কল্লোলযুগে নতুনসৃষ্ট সাহিত্যের নামে যে হুজুগ চলছিল তাতে তিনি যথেষ্ট বিরক্তই হয়েছিলেন। শ্রীঅচিন্তকুমার সেনগুপ্ত ‘কল্লোলযুগ’
লিখেছিলেন। এই প্রসঙ্গে বনফুলের বক্তব্য,
‘…আমার মনে হয় নামকরণে কিঞ্চিৎ ভুল হইয়াছে। নামটা হওয়া উচিৎ ছিল কল্লোল হুজুগ’।
রবীন্দ্রনাথের আগে বিদেশী গল্পের অনুবাদ করার প্রভাব থেকে বেরিয়ে
এলেন ত্রৈলোক্যনাথ ও পরশুরাম। বৈঠকী রীতির গল্প বললেন পরশুরাম। বনফুলও বৈঠকী রীতি অনুসরণ করেছেন। তাঁর গল্পের মুখ্য বৈশিষ্ট্য
ব্যঙ্গ। সমাজের এমন কোনও দিক
ছিল না, মানুষের চরিত্রের এমন কোনও বৈশিষ্ট্য ছিল না
যাকে তিনি ব্যঙ্গ করেননি। ব্যঙ্গের কষাঘাত থেকে সমকালীন
সমাজের কোনও বিষয় রেহাই পায়নি। উদারনৈতিক মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি বিষয়গুলি দেখেছেন। সমকালীন জীবনের নানা দুর্গতি ও দুর্নীতি পীড়িত করেছিল তাঁকে। ব্যঙ্গের আঘাতে জড়তাপূর্ণ ও উন্মাদগ্রস্ত মানুষকে তুলে ধরেছেন তাঁর গল্পে। তবে তিনি হয়তো
রবীন্দ্রনাথের মতই মনে করেছেন –
“সবারে চাহে
বেদনা দিতে বেদনা ভরা প্রাণ
হাসির ছলে সবারে
চাহি করিতে লাজ দান”।
তাই পবিত্র নির্মল হাসি বা উইটের চেয়ে ঝাঁঝালো স্যাটায়ারের
হাসিই তাঁর গল্পে বেশি করে চোখে পড়ে। জীবনের বিভিন্ন অসংগতিকে ব্যঙ্গ করেছেন।
প্রেম এবং প্রেমহীনতাকে ব্যঙ্গ করেছেন,
আবহমানকাল ধরে চলে আসা সংস্কারকে ব্যঙ্গ করেছেন, অতিরিক্ত বিজ্ঞানমনস্কতা এবং
অন্ধের মত জ্যোতিষ বিশ্বাসকেও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি।
অতিরিক্ত প্রসাধনে তিনি বিশ্বাসী নন। যেমন করে আকাশে মেঘ ভেসে বেড়ায়, ফুল ফোটে তেমনই তাঁর গল্প স্মতঃস্ফূর্তভাবে আসে। O’ Henryর কাছ
থেকে তিনি পেয়েছিলেন short short storyর প্রেরণা। তাঁর গল্প snake
shot অর্থাৎ একটি মুহূর্তকে ফ্রেমে বন্দী করে রাখা। আসলে সহজ ও
সুন্দর জীবনের প্রতি অনুরাগই ছিল বনফুলের সম্পদ। সেজন্যই জগৎ ও জীবনের যেখানেই
তিনি মানবতার অপমান দেখেছেন সেখানেই তাঁর প্রতিবাদের কলম তীব্রভাবে ঝলসে উঠেছে। আলোচ্য
প্রবন্ধে বনফুলের কয়েকটি গল্পের আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা এই বিষয়টি আলোচনা করব।
‘ক্যানভাসার’ গল্পে দরিদ্র মধ্যবিত্তের অসহায়তার দিকটি ফুটে
ওঠে। স্ত্রী কাত্যায়নীর শৌখীন শাড়ির শখ মেটাতে না পারা বেকার, উপার্জনে অক্ষম ভৈরব
যখন সমস্ত বিলাসিতা আর প্রলোভনের ওপরেই খড়্গহস্ত হয়ে উঠেছে তখন সেখানেই ক্যানভাসার
হীরালালের আবির্ভাব হয়। সে দাঁতের মাজন বিক্রি করতে এসেছে। হতদরিদ্র পাড়াগাঁয়ে
যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেখানে শহুরে শিক্ষিত লোকের বিলাসিতার উপকরণ দেখিয়ে
গ্রামের মানুষকে লোভ দেখানো যথেষ্ট অপরাধ। তাই প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ভৈরব যখন সেই
হীরালালের গালে সপাটে চড় কষালো, সঙ্গে সঙ্গেই দাঁতের মাজন বিক্রেতার নকল বাঁধানো
দাঁত ছিটকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু এখানেই গল্পের শেষ নয়। তার কুচকুচে কালো গোঁফ জোড়ার
দিকে ভৈরবকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হীরালাল বলেছে- “আজ্ঞে হ্যাঁ। ওটাও নকল”। চড় খাওয়ার পরও মুখে হাসি
টেনে করুণ সুরে ক্যানভাসার হীরালাল বলে উঠেছে- “কেন মার-ধোর করছেন মশাই? গরিব
মানুষ- এই করে কষ্টে সৃষ্টে সংসার চালাই। বুড়ো
বয়সে উপযুক্ত ছেলেটি মারা গেছে”।
এখানে একটা জিনিস লক্ষ্যণীয়,
প্রথম থেকে সে নিজের কথা বলেনি। অপমানিত হবার
পর সে নিজের অবস্থা ব্যাখ্যা করেছে। জীবনের এই নির্মম চিত্র তুলে ধরার মধ্যেই রয়ে
গেছে লেখকের জীবনদর্শন। মানুষের আর্থিক অভাব তাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তার
প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই গল্পটি। হীরালালের মত ভৈরবও একই পরিস্থিতির শিকার। তাই সে যে
চড়টি হীরালালের গালে মেরেছে প্রকৃত পক্ষে সেই চড় মেরেছে সমাজকে, নিজের ভাগ্যকে,
নিজের অসহায়তাকে। তবুও মানুষ বাঁচে। দিন
বদলের স্বপ্ন দেখে। তাই গল্পের শেষে -
‘হতভম্ব নির্বাক ভৈরবের বাক্যস্ফূর্তি হইলে সে বলিল
–“আচ্ছা, দিন এক কৌটা মাজন-”
ভৈরব নিজে গরিব। বিলাসিতা করার মত তার আর্থিক সঙ্গতি নেই।
তবুও সে হীরালালের ব্যথায় ব্যথিত হয়েছে। এখানেই সাধারণ মানুষের মধ্য দিয়ে তিনি মানবতার
জয়গান গেয়েছেন।
‘পশ্চাৎপট’ নামক বনফুলের আত্মজীবনীতে তিনি বলেছিলেন- “আমার
লেখার বিষয় প্রধানত মানুষ”। এরকমই একটি গল্প ‘শ্রীপতি সামন্ত’। এই গল্পে
শ্রীপতি একজন ব্যবসায়ী। তার গায়ে একটা আধময়লা
থান, খালি গা, পায়ে দেশী মুচির তৈরী একরাশ ধুলোভর্তি চটি, চোখে নিকেলের তৈরী
ফ্রেমে ফাটাকাঁচের চশমা, তাও ডান দিকের ডাণ্ডিটা নেই, সেদিকটা সুতো দিয়ে বাঁধা,
টিকিট তৃতীয় শ্রেণীর। কিন্তু সমস্ত ট্রেন ছোটাছুটি করেও কোথাও একখানা বসার জায়গা
না পেয়ে অবশেষে গিয়ে উঠলেন প্রথম শ্রেণীতে। ‘কুরুকে’ নির্দিষ্ট ভাড়া দেবার কথাও
বললেন ছোটবাবুকে। সেখানে সাহেবদের পোষাক পরিহিত একটি আধুনিক বাঙালি বাবু বসে ছিল।
স্বভাবতই শ্রীপতির চেহারা দেখে তাকে প্রথম শ্রেণীর সহযাত্রী বলে মেনে নিতে তার
যথেষ্ট আপত্তি ছিল। কিন্তু শ্রীপতি নিরুপায়। কারণ সেদিন তার ঘুমের বড় প্রয়োজন ছিল।
কারণ পরের দিন তাকে অনেক টাকার কেনা বেচা করতে হবে। এমন সময় ক্রু এল। জাতে সে
পাঞ্জাবী। সামন্ত মশাই তার পকেট থেকে এক সুদীর্ঘ গেঁজে বের করে যাবতীয় টাকা পয়সা
মিটিয়ে দিল। কিন্তু সাহেবী বাবুটির কাছে দেখা গেল পাইপ, দেশলাই ও একটি সিনেমার
সাপ্তাহিক ছাড়া আর কিছুই নেই। ক্রু তার টিকিট না পেয়ে বাঙ্গালীদের আচার আচরণ দিয়ে
উল্টোপাল্টা বলতে শুরু করেন। এই কথাবার্তার জেরে সামন্ত মশাইয়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘটনাটা
অনুধাবন করেন তিনি। ঘুমটা তাঁর নিতান্তই দরকার। তাই বৃথা বাক্যব্যায় না করে নিজের
পকেট থেকে গেঁজে বের করে বাঙ্গালী বাবুটির যাবতীয় টাকা পয়সা মিটিয়ে দেন। দেওয়ার পর
পাঞ্জাবী ক্রুকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় বলেন- “কটা বাঙ্গালী আপ দ্যাখা হ্যায়? জাত তুলকে
গালাগালি দেওয়া কোন দিশি ভদ্রতা রে বাপু!”
এই জাত্যাভিমান বস্তুতপক্ষে লেখকেরও। এই স্বজাতিপ্রীতি,
সাজাত্যবোধের জন্য তিনি নিজেও গর্ব অনুভব করেন। শুধু মাত্র বাইরের চাকচিক্য দেখে
কোনও মানুষের আভ্যন্তরীন মনকে বিচার করা উচিত নয়। নোংরা পোষাকের জন্য যাকে আমরা
দূরে ঠেলে দিই তারা যে মনের দিক থেকে কত বড় মাপের মানুষ হতে পারে তার পরিচয় এই
গল্পটিতে পাওয়া যায়।
বনফুল যে সময়ে লিখেছেন সেই সময়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক
বিশৃঙ্খলার মেলবন্ধন ঘটেছিল। তিনি যুগের প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারেননি। খুব
স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর গল্পে তৎকালীন সমাজের অবক্ষয়ের দিকটি চোখে পড়ে। যেমন ‘উৎসবের
ইতিহাস’ গল্পটিতে নরেন মল্লিক প্রথম শ্রেণিতে এম.এ পাশ করেছে। এইরকম একটা মেধাবী ছেলেকে শুধুমাত্র তিরিশ টাকা মাইনের চাকরী
করার জন্য সমাজের ধ্বজাধারীদের তেল দিতে হয়েছে। বিশু সান্যাল, পরাণ সিঙ্গি, পানু
মিত্তিরকে প্রচুর পরিমাণে তেল দিতে হয়েছে। শুধু তাই নয় সামান্য এই চাকরীটুকু করার
জন্য পানু তথা ঘুঘু মিত্তিরের বয়স্থা কুৎসিৎ কন্যাটির পাণিগ্রহণ করতে হবে। এই
বিয়েকে পাণিগ্রহন না বলে পাণিপীড়ণ বলা উচিৎ। এই বিয়ে না করলে তার আবার চাকরী হবে
না। এই চাকরীর জন্য নরেনকে তার সমস্ত আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হয়েছে। আবার মানসম্মান বজায় রাখার জন্য
প্রবীণ মল্লিক মশায় ‘খাইয়ে’ মহাশয়ের কাছ
থেকে ধার করে ফিস্টি করেছেন। “মুখুজ্জের
অর্থে উৎসবের আয়োজন হইল। পোলাওটা সামান্য একটু ধরিয়া গিয়াছিল। কিন্তু তাহাতে বিশেষ
রসভঙ্গ হয় নাই। সকলেই পরিতৃপ্তি সহকারে খাইয়াছে”।
কিন্তু এই পরিতৃপ্তির আড়ালেই রয়ে গেছে উৎসব আয়োজকের
অশ্রুসিক্ত করুণ মুখ। লেখক হয়ত পরিহাস করেছেন।
মুখে হাসি থাকলেও অন্তরে কি গভীর বেদনা বহন করে নিয়ে চলেছেন গল্পের প্রতিটি
ছত্রে তা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। গল্পটিকে সিঁড়ি ভাঙ্গা অঙ্কের মত সাজিয়েছেন বনফুল।
গরিব বলে কি মানুষের আত্মসম্মান থাকতে
নেই! নাকি জীবনের দাবীতে সেটুকুকেও জলাঞ্জলি দিতে হয় সমাজের ভদ্রতার মুখোশধারীদের
পায়ে?
চাকরী জোগাড় করতে না
পারার করুণ ইতিহাস রয়েছে ‘পাশাপাশি’
নামক গল্পটিতে। গল্পের নায়ক শিক্ষিত বেকার
যুবক। সে কলকাতায় বহু দূর সম্পর্কের এক
আত্মীয়ের কাছে যায় চাকরীর সন্ধানে। বাড়ির কর্তা বিকাশবাবু অতন্ত
ব্যস্ত লোক। ‘লেট’ হয়ে যাবার ভয়ে প্রতিদিন সকালবেলায় কোনওরকমে বাজারটা
সেরে, গায়ে মাথায় তেল চাপড়িয়ে স্নানে যান। কলতলা থেকে তার বউকে ভাত বাড়ার নির্দেশ দেন। কেন না তার লেট হয়ে যাচ্ছে। সহজ সরল বউও ভাত বেড়ে দেন। নাকে মুখে দুটো ভাত গুঁজে তিনি নটার মধ্যে বেরিয়ে যান অফিসে। ফেরেন সেই রাত্রির দশটায়।
এইরকম ব্যস্ত বিকাশবাবুকে
দেখে খুব হিংসে হয় গল্পের নায়কের। সে ভাবতে থাকে কি ব্যস্ততার
জীবন বিকাশবাবুর। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে এসে ক্লান্তদেহে বাড়ি ফেরা। স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে ভরা সংসার। তারপর রাত্রির কোলে মাথা রেখে
কি নিশ্চিন্তির ঘুম। তাই সে তার নিজের চাকরীর আশায় একদিন বিকাশবাবুরই স্মরণাপন্ন
হয়। কিন্তু তারপর সে যা জানতে পারে তাতে গল্পের নায়কের সঙ্গে পাঠকও
চরম অবাক না হয়ে পারে না। বিকাশবাবু এম.এ ফার্স্টক্লাশ। তিনবছর ক্রমাগত চাকরীর চেষ্টা করেও পাননি। বাড়িতে থাকলে
তার গিন্নি আর ছোট ছেলেপুলেগুলোর অন্যায় আবদার সহ্য করতে হবে। তাই তাদের অত্যাচারে
অতিষ্ঠ হয়ে সকাল সকাল বাড়ি থেকে ‘পালিয়ে’ ইডেন গার্ডেনের গাছের ছায়ায় একটা
বেঞ্চিতে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেন। সেই বেঞ্চিরও আবার একজন দখলদার আছে-
“বউ জানে আমি কোনো বড় আপিসে বিনা মাইনেতে অ্যাপ্রেন্টিস
করছি। কিছুদিন পর মাইনে হবে। তাই তাড়াতাড়ি রোজ ভাত রেঁধে দেয়।”
বিকাশবাবু হয়তো হাসি মুখেই কথাগুলো বলেছে। পাঠকও হয়তো এমন
কথা শুনে হেসে ওঠেন। কিন্তু শিক্ষিত বেকার যুবকের যন্ত্রণা, আত্মগ্লানির যে চিত্র
ফুটে ওঠে এই গল্পে তা এক কথায় অসাধারণ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর হতাশা, বেকারত্ব, অনটন থেকে বাঁচতে গিয়ে পালিয়ে বাঁচতে
চেয়েছে। এই পলায়নবাদী মানসিকতা তো শুধু সমাজের কাছ থেকে, পরিবারের কাছ থেকে পালানো
নয়, নিজের কাছ থেকেও সে পালিয়ে যেতে চেয়েছে। তার এই আত্মপ্রবঞ্চনাকে ঘৃণাও বলা যায়
না। তাই গল্পের নায়ক অবাক বিস্ময়ে বিকাশবাবুর এই জীবনযুদ্ধে সঙ্গী হতে চেয়েছে- “পাশাপাশি
দুই জনে দ্রুতবেগে হাঁটিয়া চলিয়াছি। ইডেন গার্ডেনের খালি বেঞ্চটা না হাতছাড়া হইয়া
যায়”।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর এক কবিতায় লিখেছিলেন, “নদীর
কাছে গিয়েছিলাম নিজের কান্না
জানাতে।/কিন্তু নদীর নিজেরই যে এত কান্না আছে তা বুঝিনি”। কবিতার এই দুটি লাইন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক উপরোক্ত
গল্পটি সম্পর্কে।
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলেছিলাম, প্রেম এবং প্রেমহীনতাও
বনফুলের গল্পের বিষয়। মানুষের লালসার অসংযম যে কী পরিমাণ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে
তার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বুধনী’ গল্পটিতে। অরণ্যচারী সাঁওতাল যুবক বিল্টু ভালবেসে
বিয়ে করেছিল সাঁওতাল যুবতী বুধনীকে। নবীন যৌবনে নব প্রেমের উন্মাদনায় বেশ আনন্দের সঙ্গে তাদের দিন কাটছিল। কিন্তু কিছুদিন
পর বুধনী তার সন্তানের জন্ম দেয়। তার মধ্যে মাতৃত্বের স্নেহ জেগে ওঠে। মাতৃত্ব
বন্য বর্বর সেই অনার্য জননীকেও এক অজানা আনন্দলোকের জন্ম দিল। স্বাভাবিক
ভাবেই বিল্টু বুধনীর কাছে গৌণ হয়ে গেল। সে আগের মত বিল্টুকে পাত্তা দেয় না। বিল্টু
দেখল- “একি! বুধ্নীকে দখল করিয়া বসিয়াছে
এই শিশুটা! বুধ্নী তো তাহার আর একার নাই! অসহ্য!” বলা বাহুল্য জৈবিক নিয়মে বুধ্নীর
সন্তানের সে পিতা হলেও তার মধ্যে পিতৃত্ব জাগেনি। আপন আত্মজের প্রতি কোনও বাৎসল্য
তার জেগে ওঠেনি। তার পুত্র যেন তার লালসা পরিতৃপ্তির প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তাই
পুনরায় বুধ্নীকে আগের মত করে কাছে পাওয়ার জন্য সে তার সন্তানকে হত্যা করে। পশুদের
মধ্যেও নিজের শাবককে হত্যা করার রীতি আজও প্রচলিত। মানবসমাজ বিল্টুর এই আচরণকে
ক্ষমা করল না। তার ফাঁসী হল। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে সমানে
চিৎকার করে গেল- “বুধ্নী-বুধ্নী-বুধ্নী-বুধ্নী।
ভগবানের নাম পর্যন্ত একবার করিল না”।
সে যে তার বউকে ভালবাসত না, তা নয়। একটু বেশিই ভালবাসতো।
কিন্তু ভালবাসলে মানুষ উদার হয়। কিন্তু এই
আদিম অরণ্যচারী সাঁওতাল যুবকের ভালবাসা ছিল স্বার্থসর্বস্ব। বউয়ের প্রতি তার
ভালবাসা তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে
দিয়েছিল। সন্তান বধ করতেও তাই তার হাত এতটুকু কাঁপেনি।
আবহমানকাল ধরে কুসংস্কারকে মানুষ তার চিন্তায় চেতনায়, অস্থি
মজ্জায় গ্রহণ করেছে। বিজ্ঞান যতই
কুসংস্কারের বিরুদ্ধাচারণ করুক কুসংস্কার ছিল, আছে, থাকবে। দৃঢ় প্রথিত একটি সংস্কার কীভাবে মানুষের
স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধিকে নিঃশেষিত করে ফেলে তা দেখালেন বনফুল ‘জাগ্রত দেবতা’ গল্পের
মধ্যে দিয়ে। এই গল্প একই সঙ্গে মানুষের আবার সমাজেরও। বৈশাখী পূর্ণিমার দিন মহাদেবকে
কেন্দ্র করে প্রতিবছর বিরাট অনুষ্ঠান হয়। মেলা বসে। আর দেবতা যে জাগ্রত তার প্রমাণ
স্বরূপ ঐ গ্রামের একজন লোক পাগল হয়ে যায়। প্রতিবছরই এরকম হয়ে আসছে। সেই বছরও
ধূমধাম করে পুজো হল, উৎসব হল। কিন্তু কেউ পাগল হল না। সনাতনপুরের গ্রামবাসীরা
অজান্তে পাপের ফল মনে করে। অমঙ্গলের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। গ্রামের নাম সনাতনপুর। সনাতন
যা মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। দেবতার প্রতি অবিশ্বাস স্থায়ী হতে পারে না।
মানুষ ইচ্ছে করলে দেবতা হতে পারে, আবার ইচ্ছে করলে শয়তান হতেও পারে। মানুষ তার
সীমা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। কুসংস্কারের কবলে পড়ে যা ঘুমিয়ে পড়ে তা হল মানুষের
বিবেক। মানুষের মূল্যবোধের বিনাশ ঘটে। জাগরণ ঘটে দেবতার।
তাই সকলে দমে গেলেও প্রবীণ নীলমণি কিন্তু দমলেন না। তার
বিশ্বাস কেউ না কেউ নিশ্চয় পাগল হয়েছে। সনাতনপুরের শিবের মহিমা এত ঠুনকো হতে পারে
না। তাই বৈশাখের প্রবল রোদে দুপুরবেলা তিনি পাগল খুঁজে ফেরেন। “রক্তচক্ষু স্ফীত
নাসা, নীলমণি ঘরে ঘরে খোঁজ করিতেছেন, পাগলটা কোথায় গেল। তাহাকে খুঁজিয়া বাহির
করিতেই হইবে। সনাতনপুরবাসীগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিলেন। জাগ্রত মহাদেবের মহিমা
জাগ্রতই আছে।”
বিজ্ঞান মানুষের এই আবহমানকাল ধরে বহন করে চলা সংস্কারের কাছে
মুখ লুকোতে বাধ্য।
বনফুল পোস্টকার্ড সাইজের গল্প
লিখতেন। এরকমই একটি গল্প ‘নিমগাছ’। কোনও তত্ত্ব দিয়ে গল্পের অন্তঃসারশূন্যতাকে
বিচার করা যায় না। মানুষের জীবনের এক একটি খণ্ড মুহূর্তকে তুলে ধরেছেন তিনি তাঁর
গল্পে। আগাগোড়া সাদামাটা গল্প। কিন্তু যাবতীয় চমক থাকে গল্পের শেষে। ‘নিমগাছ’
গল্পটি প্রথম থেকে পাঠ করলে মনে হবে যেন একটি নিমগাছের বর্ণনা পড়ছি। একটি নিমগাছ,
এই নিমগাছকে সাধারণ মানুষ কীভাবে ব্যবহার
করে তার কথাই উঠে আসে গল্পে । তবে যাবতীয় রহস্য
লুকিয়ে থাকে গল্পের শেষে। যে যার মত প্রয়োজনে নিমগাছকে ব্যবহার করে। কিন্তু
নিমগাছের যত্ন কেউ করে না। শান দিয়ে বাঁধিয়েও কেউ দেয় না। আবর্জনা এসে জমে সেই
গাছের গোড়ায়- “হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরনের লোক এল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল
নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙ্গলে না। মুগ্ধ
দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু। বলে উঠল, ‘বা! কি সুন্দর পাতাগুলো... কি রূপ! থোকা থোকা
ফুলেরই বা কি বাহার... এক ঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে।
বা!’ কিছুক্ষণ থেকে চলে গেল। কবিরাজ নয়, কবি।”
নিমগাছটার ইচ্ছে হয়েছিল সেই কবির সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু
পারেনি। কারণ তার শিকড় মাটির বুক ভেদ করে বহু দূরে চলে গেছে। তাই সে ঐ
আবর্জনার মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল। গল্পের একেবারে শেষের লাইন- “ওদের বাড়ির গৃহকর্ম
নিপুণা লক্ষ্মী বউটার ঠিক এই দশা”। শুধুমাত্র এই শেষের লাইনটিতে কি অপরিসীম যন্ত্রণা লুকিয়ে
আছে। এই শেষ বাক্যটিই তো আসল গল্প। গল্প
এখানে কাব্যের ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। একটা
গৃহবধূর যন্ত্রণাভরা করুণ জীবনের আলেখ্য গাঁথা হয়ে গেল শুধু মাত্র ঐ একটি ছত্রে। এটাই বনফুলের whip crack ending। নিমগাছের
মত ঐ বধূর শিকড় ছড়িয়ে আছে সংসারের অনেক গভীরে। সে চাইলেই সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে
না। শুধুমাত্র নিজে ভাল থাকতে চেয়ে প্রচলিত সমাজ সংসারকে সে উপেক্ষা করতে পারেনি।
নিমগাছের মত তাকেও সকলের প্রয়োজন। সে ছাড়া সংসার অচল। কিন্তু কেউ তার স্বাধীন
সত্তায় বিশ্বাসী নয়। এই গৃহবধূটি আপামর সাধারণ গৃহবধূর প্রতিনিধিত্ব করেছে। আমাদের
সাধারণ পরিবারের এরকম একটি গৃহবধূর ব্যথাদীর্ণ জীবনকাহিনি বনফুল তুলে আনলেন
সামান্য একটি নিমগাছের রূপকে।
কথায় বলে ভালবাসার অনেক নাম।
একাধারে মানবিকতা অন্যদিকে এক অন্যরকম ভালবাসার গল্প ‘তাজমহল’। আগ্রার তাজমহলের
কাছেই এক দাতব্য চিকিৎসালয়ে এক বৃদ্ধ মুসলমান তার স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য বয়ে নিয়ে
আসে। ক্যাংক্রাম অরিসে মুখের আধখানা পচে গেছে। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। স্বাভাবিক ভাবেই
তার স্থান হয় ফুটপাতের গাছপালায়। ফকিরের প্রশ্নে গল্পকার চিকিৎসককে সত্যি কথা
বলতেই হয় যে তার বেগমের আর বাঁচবার কোনও আশা নেই। যেখানে দুর্গন্ধে কেউ টিকতে
পারছে না, সেখানে নিজের স্ত্রীর প্রতি কতটা ভালবাসা কতটা সহমর্মিতা থাকলে তবে এরকম
এক রুগীকে পরম যত্নে শুশ্রূষা করা যায়। কিছুদিন পর একদিন দেখা যায় প্রখর রোদের
মধ্যে সেই বৃদ্ধ ফকির মাঠের মধ্যে কি একটা করছে। ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তরে বলে- “বেগমের
কবর গাঁথছি হুজুর”। নামধাম
জিজ্ঞাসা করায় জানা যায় আগ্রার আশে পাশেই এই ভিক্ষাজীবি বৃদ্ধ মানুষটির নাম ‘ফকির
শা-জাহান’। সামনেই মোঘল সম্রাট শাজাহানের স্মৃতি সৌধ সেই বিশাল তাজমহল। শাজাহানও
তাঁর প্রিয়তমা পত্নী মমতাজের স্মৃতি রক্ষার্থে তাজমহল গড়েছিলেন। সেখানে পত্নীর
প্রতি প্রেম যতটা না প্রকাশ পেয়েছে তার চেয়ে বেশি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অহংকার। নিজের কৃতিত্বকে
স্বীকৃতি দেবার জন্য মমতাজের মৃত্যুর
প্রয়োজন ছিল। তার বিপরীতে এহেন গরীব মুসলমান ফকিরের কবর গাঁথা যথেষ্ট বৈপরীত্য তৈরী করে বৈকি। ভালবাসা বনাম অহংকার। গরীব বনাম ধনী।
কিন্তু গরীব মুসলমান ফকিরের ভালবাসার কাছে কোথাও যেন ম্লান হয়ে গেল সম্রাট
শাজাহানের ভালবাসা।
আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা বাছাই করা কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা করলাম,
যার প্রধান উপজীব্য বিষয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর
মানুষ। এর বাইরেও রয়ে গেল আরও অসংখ্য অজানা মানব চরিত্র যা বিস্তারিত
আলোচনার অপেক্ষা রাখে। গল্পগুলির অতি সংক্ষিপ্ত আকারই বনফুলের বৈশিষ্ট্য। অনেকক্ষণ
ধরে পড়ার শাস্তি তিনি দেননি। কিন্তু অতি অল্প কথনের মধ্যে
দিয়েই আমরা মহৎ জীবন সত্যে উপনীত হতে পারি। গল্পগুলি অনেকটা মৌমাছির হুলের
মত যা আমাদের মননে বিদ্ধ হলে সেই জ্বালার অনুরণন চলতে থাকে অনেকটা সময় ধরে। তাঁর গল্পের তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতাই মূল কথা। তিনি তাঁর লেখায় যুগের প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারেননি। কোনও লেখকই তা পারেন না। তিনি সমাজকে কলুষমুক্ত করতে
চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন মানুষের মননকে পরিবর্তন করতে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন – “বন্দুকের চেয়ে কলমের ধার সবচেয়ে বেশী”। সবথেকে বড় কথা মানুষকে পর্যবেক্ষণ করার
ক্ষমতা ছিল তাঁর অপরিসীম। তাই কল্পনার আশ্রয় তাঁকে নিতে হয়নি। বাস্তবে দেখা চরিত্রগুলিকেই তিনি তাঁর গল্পে স্থান দিয়েছেন।
খুব ভালো।
উত্তরমুছুনউপকৃত হয়েছি।
উত্তরমুছুনদারুণ সুন্দর।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ।খুবই উপকৃত হলাম
উত্তরমুছুনখুব ভালো লিখেছেন।ভালো লাগলো।আশা রাখছি আগামী দিনে আরো নতুন তথ্য পাবো।
উত্তরমুছুন