বর্ষামঙ্গল
পাঁচটে!
না না... ওই কোণেরটা
দেখিসনি,
ওই লাল সাদা!
আমি যে কাল গুনলুম!
তুই অংকে কাঁচা ওই জন্য তো কাকু মারে... যা আবার গুনে আয়...
এই সন্ধেবেলা! মা
জানলে বকবে।
যাবি আর আসবি, কেউ দেখবে না।
জানিস! চোখ ফুটেছে! আমি এইমাত্র দেখলাম, মা কালীর দিব্যি...
চ' দেখে আসি!
দুজনে দুদ্দাড় ছুট...
আজ ওরা প্রথম বাইরে বেরোলো, চায়ের দোকানের পেছনের গুমটিঘরে চটপাতা বিছানায় লালু শুয়ে। ওরা একটু
বেরোয় আবার ভয় পেয়ে মায়ের কোলের তলে ঢোকে। শিবু একটা ভাঙা কলাইকরা বাটি যোগাড় করেছে। মায়ের থেকে রোজ দুধ চেয়ে আনে আর বেলায় চা'উলি একটু বেচে যাওয়া দুধ ঢেলে দেয়। মা হওয়ার পরে লালুর
গুমোর বেড়েছে, আজকাল কাউকে রেয়াত করে না। শিবু, সাজু কাছে গেলে কেমন
গরর গরর রাগী আওয়াজ করে। সকালে বিকেলে যায় রতন জ্যাঠার হোটেলের খদ্দেরের এঁটোকাঁটা
খেয়ে আবার সেই রাজশাহী মেজাজ নিয়ে চটের বিছানায় গা এলায়। বাচ্চাগুলো আজকাল বাটিতে
চুক চুক করে দুধ চেটে খেতে শিখে গেছে, কাল বিকেলে একটা নোংরা ব্যান্ডেজ নিয়ে খেলছিল শিবু। এমন ধমক দিয়েছে কুঁই কুঁই করে সোজা লালুর কোলে। লালুটা কেন এত
প্রশ্রয় দেয়, বোঝে না শিবু। নামেই মা হয়েছে, বাচ্চাদের কোন শাসন নেই। শিবুর মা হলে
টের পাইয়ে দিত কত ধানে কত চাল। সাজুর মা নেই।
বিকেলের দিকে বৃষ্টিটা বেড়েছে। কচুপাতা
দিয়ে টুপটুপ জল বাইরে ছিটকে যায়। এমন একটা কাচের গোল বল মত হয়ে পাতায় পরেই গড়িয়ে
যায় জলটা। বোসেদের বাগানেও ওদিকটা জলের
তোড়ে ঝাপসা, কিছু ঠাওর করা যায় না।
মাটিতে কেমন একটা গন্ধ ওঠে থেকে থেকে। শিবু, সাজু কাদামেখে ভূত। ডানহাতে বাতাবিলেবু নাচাচ্ছে, ফুটবলের বাতাবিবল। বাঁশের বেড়াটা এই বৃষ্টিতে আরো ভেঙেছে। গুঁড়ি মেরে
দুজনে বাগানে ঢুকল। এটা শর্টকাট রাস্তা। বৃষ্টির জল পেয়ে ঝোপঝাড়
লকলকিয়ে বেড়েছে। অড়হর পাতার গাছটা জলে ঝড়ে কাত হয়ে পরে আছে। সাজু মায়ের
জন্ডিসের সময় এই গাছ থেকে রোজ পাতা নিয়ে যেত। একটা জিয়ল গাছের দুটো ডাল ভেঙে দুজনে ঝোপঝাড়ে বাড়ি
মারতে মারতে হেঁটে যায়।
এবার আরো জোরে ঝেঁপে এলো। ওদের চুল বেয়ে
কপালে অঝোরে জল ঝরছে। কাদা ধুয়ে
জামা প্যান্ট প্রায় ফর্সা। কচুপাতা কতক্ষণ মাথায় ধরে রাখা যায়! বাগানের যত্ন নেবার লোক প্রায় নেই বললেই চলে। বোসেরা আসে না
কত বছর! একটা মালী ছিল, এখন নেই। পায়ের
কাছে সড়সড় করে কী একটা সরে যেতেই শিবু এক ঝটকায় সাজুকে সরিয়ে দেয়। শামুকভাঙ্গা
কেউটে! আস্তে আস্তে ওই খামআলুর লতা বেয়ে সুপুরি গাছের খোলে ঢোকে। ঝটপট পা চালায়
দুজনে। জলের ঝাঁপে হি হি কাঁপুনি ওঠে...
হঠাৎ ধুপ করে শব্দ! একটা এই বড় কাঁঠাল পড়ল। দু’ একটা কোয়া ছড়িয়ে পড়েছে কাদা জলে। সোনার মত বরণ। কী মিষ্টি সুবাস! সাজু আর শিবুর
চোখ চকচক করে। খানিকটা খেয়ে সাজু দৌড়োয়
গামলা আনতে, শিবু বসে পাহারা দেয়। ওই ধোঁয়া
ধোঁয়া বন বাদাড় পেরিয়ে সাজু ছুটে আসে। হাতের স্টিলের গামলা চকচক করে। গামলা ভরা
কোয়া কচুপাতায় ঢেকে মাথায় তোলে সাজু। রতন জ্যেঠুর হোটেলে
উনুনে আঁচ পড়েছে। ধোঁয়া
ভেসে আসছে। কাঁচা
কয়লার আঁচের ধোঁয়াটে গন্ধ। কোন বাড়িতে ডালে সম্বার দিল। রতন জ্যেঠুদের গোয়ালের পাশ
দিয়ে যেতে যেতে সাজু বলল, লালুর বাচ্চাদের নাম রাখবি না? মাথাটা মুছে
শিবু গম্ভীর হয়ে একটু ভেবে বলল – লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ আর অসুর।
গোয়ালে ধুপ দিচ্ছে রতন খুড়ি। গরুগুলো
একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে কেন বুঝতে পারে না শিবুরা। সাজু
চোখ পাকিয়ে বলল, ঠাকুরের নামে ওদের নাম রাখলে কাকি বকবে!
ধুস আমারো তো ঠাকুরের নাম!
না পশুদের নাম রাখা যায় না...
তাহলে বাঘ, সিংহ, বাঁদর, হরিণ, ছাগল - হাততালি দিয়ে
ওঠে সাজু ওই লালটার নাম হরিণ।
রাস্তায় এক হাঁটু জল। তাল পুকুরের সব মাছ বয়ে গিয়ে পথে। কোনোমতে দৌড়ে গামলাটা বাড়িতে রেখে দুটো বড় গামছা আর একটা
বালতি নিয়ে দৌড়োয় ওরা। আম গাছের গুঁড়ি বেয়ে কই উঠছে। গামছায় জাপটে
বালতিতে ফেলে মুখটা বেঁধে নেয়। এইই বড় লাল
একটা পোকা বোঁওওও করে মাথার চারপাশে ঘুরে যায়। রেল কোয়াটারের স্টেশন মাস্টারের বাড়ি থেকে হারমনিয়াম
বাজিয়ে গান ভেসে আসছে, আবাআআআর
এএএসেএএএছেএএএ আআআআষাআআঢ়অঅঅ আকাআআআআশওওও ছেএএএয়েএএএএএ...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন