কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

তর্কে বহুদূর


হাঁটুর কাছে লুঙ্গি গুছিয়ে বসল তাহির আলি। মন্দিরা ইশারা করল স্বপনকে, ‘ওই তোমার... এসেছে দেখদুদিন কামাই করেছে। দিনতিন আগে কাঠের দোকানের  দেবু সাহা ওকেই পাঠিয়েছে জানালা রঙ করাতে। লম্বাচুল, গালে দাড়ি, লুঙ্গি, কানে পেন্সিল নিয়ে নমস্তে সাহাব’, চিরকুট দেখিয়ে বলেছিল, ‘তাহির আছি। রংমহলের দেবুসাহাব পাঠাল

লোকটা কাজের হলেও অলস। অবিরাম বকরবকর দেহাতী এবং বাংলার জবরজঙ। বছরখানেক মাত্র কলকাতা দেখছে। বচনাবলী শোনার, বোঝার প্রয়াস নেই, কাগজে মুখ ঠুসে স্বপনের খালি হুঁ আর হাঁমন্দিরা চা দিতে এসে চোখ গরম করলেন, ‘কী গো? চোখের সামনে ফাঁকি মারবে, দেখবেও না?’ সুঠাম বাংলা তাহির ধরতে পারছে না। চোখ তির্যক, নিরীক্ষণ করছে। একদা তুমুল তণ্বী, শিখরদশনা থেকে অধুনা বেশ সমীহ জাগানো টলমল দশাশই।

চা খাবে?’
না মেডাম, রোজা চলছে
, আচ্ছা
চোখা চোখ শানিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, তাহির ডাকল, ‘মেডাম, আপনার পা কী টুটে গেছিল?’
এ্যাঁ কেন?’ টাল সামলে গলা থেকে শব্দ ছুঁড়লেন, ‘ভাঙে-টাঙে নি, এমনি ব্যথা। আর্থারাইটিস, একটা অসুখডাক্তার দেখানো, অহর্নিশ নিষেধাজ্ঞা, ব্যায়াম ইত্যাদির কাহন শোনানোর পরে, তাহির ঘোষণা করল,
কী আটিস? ওসব কিছু না। ডাক্তারেরা বাজে কথা বলে
বাজে কথা বলে?’
জী। ঝাড়ফুঁক মানেন? তাবিজ-কবচ?’
না না না না! কানে জ্যান্ত মাকড়সা নড়ার মতো ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা হয়েছেন  স্বপন, ‘ওসব মানি-টানি না
মানেন না? মানা উচিত। মেডামকে তিনমাসে আমি দৌড়ানর লায়েক করে দেবতাহির এল-ই-ডি-সদৃশ আত্মবিশ্বাসে স্থির। সরুচাকলির মতো মন্দিরার চশমার নিচে নড়ে চোখের তারা।

দুদিন কাজে এলে না?’
তাহির ঘোষণা করল, ‘মেডামের জন্যে মাজার থেনে ঘুরে এসেছিমন্দিরা চোখ কপালে তুলেছেন, ‘বাব্বা! বল কী গো? কোথায় মাজার?’
আমাদের মুলুকে
মালদা-বিহার-বর্ডারের কোন্‌ অজ জায়গাতে তাদের পিরের জাগ্রত মাজার। প্রায়োপবেশনে কাটানো মুখে চকচকে চোখ। মন্দিরা ওকারণেই খুশি, ‘দেখ তো তাহলে—’, স্বপনের দিকে তাকিয়েছেন। স্বপনের কেমন ভারহীনতা। বললেন, ‘তোমার ফকিরসাহেব বলেন কী?’
তাহিরের চোখ স্বপনের মুখে। কী টের পেল নিজে জানে।
মেডামের পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নিচের ধুলো কুড়িয়ে খারাপ জায়গায় পুঁতে গুণ করা হয়েছে বই পড়ে গুণিন বলেছে।জলপড়া মন্ত্রপূতঃ তাবিজধারণ করলে তিনমাসে অব্যর্থ ফল। লোকটা আনরিজার্ভড্‌ গেছে নিশ্চিত। তবু, সৌজন্যে গোটাগুটি নোট হাতে দিয়েছেন

জানালার ফাটলগুলোতে পুটি মেরে গেছে। সকালে আবার আসবে। রাতের বিছানার পায়ের কারণে অল্পবিস্তর চীখ পাড়েন মন্দিরা। নাকডাকা থামে স্বপনের। ধাতস্থ হয়ে ভাবেন, ওজন কমাতে পার না তো ভুগতে থাক।
উঃ, মায়াদয়া নেই গো তোমার?’
উঁ? কী করি? পেইনকিলার চার্জ করেছ আজ?’
সব সব
হুঁউ। তবে!
ওই তাবিজ বলল, একবার যদি...
স্বপন পাশ ফিরেছেন গরম নিঃশ্বাস ছুঁড়ে। বাহ, লা জবাব। চাকরি-ছোটা, তার্কিক, সক্রিয় মহিলার কবছর ধরে গৃহাভ্যন্তরে ল্যাদ খাওয়ার কারণ হাঁটুর বাত। বিশ্বাস হচ্ছে না, সহ্য হচ্ছে না। দাঁত কড়কে চিবিয়ে বললেন, ‘যেও তাহিরের গ্রামে। জড়িবুটি, জলপড়া
যেতে কি আছে? যদি সারে? বিশ্বাসে মিলায় বস্তু অবিশ্বাসীর খাজনা নেই।
শেষ ঘুমটা সম্পূর্ণ চটকে গেছে স্বপনের। দুর্বল দুর্বল ঠেকছে। আলোহীন, বাতাসহীন।

আলো এবং তাহির দুটিই তাড়াতাড়ি প্রবিষ্ট। রিমোটের ইশারায় খবরের চ্যানেল বদলাচ্ছেন স্বপন। অর্ধেক চ্যানেলে জ্যোতিষার্ণব অমুক তমুক। বিরক্ত লাগছে। খবরের কাগজ, দুধের প্যাকেট ও নীলা। দুধের প্যাকেট হাতে নীলা রান্নাঘরে। তাহির নিষ্ঠভাবে কৌটোতে রঙ গুলছে। আপাতত এই স্থিরচিত্র। চা ও মন্দিরা। আড়চোখে দেখল তাহির, পাও হতে পারে, দেহ বা মুখ। মন্দিরা বসেছেন।


কাল রাত ফুটো করে গ্রাম্যতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার লেকচার ঝাড়লে। খবর শুনেছ?’
কিসের খবর?’
কাগজ আর টিভিতেই না থুবড়ে থাক দিনভর—’?
আহ্‌, টপিক কী?’
তাহিরের কানদুটো কি খাড়া হয়ে উঠেছে? চোখের কোণা থেকে দেখছেন মন্দিরা। নাহ্‌, বুঝছে না। রঙগোলা ব্রাশহাতে উঠে যাচ্ছে অন্যঘরে।
গরু নাকি জাতীয় পশু হতে যাচ্ছে
হুঁ। হোক। কার কাছে শুনলে?’
নীলা। সি-ব্লকে মারোয়ারি বাড়িতে কাজ করে না? ওরা বলেছে।
হুঁ, তোমার নীলা আবার কস্মোপলিটন মহিলা!
নীলা উবাচ, ‘‘গরুর নাক থেকে ওসিজেন বের হয় বউদি। সে হাওয়াতে নাকি অ-নেক উপকার। গরুর গায়ে তেত্তিরিশকোটি দেব্‌তা। গরুর গোবর, মানে পটি আর সুসু খেলেও শরীর সুস্থু হয়’’নিউজে বেরিয়েছে না কাগজে, জানি না

একান্ত আগ্রহে শেষবেশ খবরটা খুঁজে পেয়েছেন স্বপন। গরুর নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাস দুটি সমাধা করতেই অক্সিজেন লাগে। বাকি নীলা যা বলে গেছে, অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। উপরন্তু হাইকোর্টের বিচারপতির সুপারিশ। বাঘের আসন টলল বলে!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন