কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২১

সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

তপনকর ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


সুপারি

 

চাবি ঘুরিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে আলো জ্বালাতেই চমকে উঠলাম। আমার ঘরে, আমার সোফায় দুর্নিবার বসে আছে। ওর কাছে চাবি নেই, আমার বন্ধ ফ্ল্যাটে কীভাবে…, তাছাড়া ও এখনও বেঁচে আছে… ওর তো এতক্ষণে…  ভাবতে গিয়ে আমার শরীর কেঁপে উঠল।

কী হল, চমকে গেছিস?

আশ্চর্য! সামনে দুর্নিবার, অথচ এই কন্ঠস্বর ওর নয়। আমার কানে পৌঁছোনো ওর স্বর ফ্যাসফ্যাসে, ঠান্ডায় কাবু হওয়া শ্লেষ্মা মেশানো কিছু শব্দ — যার সঙ্গে দুর্নিবারের গম্ভীর ভরাট, যা কখনো কখনো গুরুগম্ভীর — সেরকম কিছু  শুনতে না পেয়ে আমার মনে হয়েছিল, এ কী তবে দুর্নিবারের প্রেতাত্মা! প্রতিশোধ নিতে তালাবন্ধ ঘরে-- তালা না খুলে ঢুকে পড়তে পেরেছে! শুধু যে ঢুকে পড়েছে তাই নয়, আমারই সোফায় বসে, আমাকে  হতচকিত করে মজা লুটছে।

আরে বসে পড়। যে ভাবে তোর ঠ্যাং দুটো…

দুর্নিবার কথা শেষ না করে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দেয়, কোথায় বসতে হবে।

কী অবস্থা! আমার ঘরে আমি কোথায় বসব — দুর্নিবার ঠিক করে দেবে! ওর কথা অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই, কারণ আমার দুটো পা অসভ্যের মতো কাঁপছে। যে কোন সময় পড়ে যাব, এক্ষুণি বসে পড়া উচিত, পা দুটো নিয়ন্ত্রণে নেই — ফলত শেষ পর্যন্ত বসতে হল।

ধপাস শব্দটা আমার বসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, যা দুর্নিবারের কানে ধরা পড়ে। সে হাঁ হাঁ করে ওঠে — সোফা ভেঙে যাবে যে! এভাবে কেউ বসে?

যেন তোর বাপের সোফা— মনে মনে বললাম। শব্দ, আওয়াজ — সে যাই হোক না কেন, তোর বাপের কী? এই টালবাহানার মধ্যে মরিয়া হয়ে বসেছি এই ঢের — সোফা ভাঙলে আমার ক্ষতি, তোর কী?

আহা, রাগ করছিস কেন?

আমি কী ভাবছি, দুর্নিবার পড়ে ফেলছে দেখে মনে হয়েছিল, ওকে নিয়ে  একটু নাড়াচাড়া করা দরকার আর তার জন্য জরুরি, ওকে ভালো করে, আপাদমস্তক দেখা। যার বেঁচে থাকার  কথা নয়, সেই দুর্নিবার, না ওর ভূত,  ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করা দরকার ছিল।

একথা ভেবে চোখ কচলে ভালো করে তাকাতেই দেখি, দুর্নিবারের চোখে চশমা নেই। চশমা ছাড়া দুর্নিবার! আগে তো কখনো হয়নি। ওর চশমার কাচ পুরু ও মোটা, যে কারণে ও চশমা চোখে সব সময়, অথচ এখন এই অবস্থায়, না– ওর মুখের চেহারার কোন বদল ঘটেনি। অচেনা বা খাপছাড়া মনে হচ্ছে না। দুর্নিবারকে আগের মতই চেনা লাগে।

কী ভাবছিস? চশমা নেই কেন?

কী আর ভাবব! ভাবার কী-বা আছে! সেই কথাটুকু বলার মতো কথা গলা থেকে বেরোলো না।

আমি কনট্যাক্ট লেন্স পরে আছি। এর মধ্যে কোন রহস্য নেই।

রহস্য মানেই রোমাঞ্চ। ডিটেকটিভ। খুন। এক বা একাধিক এবং তার জন্য গোয়েন্দা। সে মাঠে নামতে না নামতেই আর একটা খুন। গোয়েন্দাকে ভয় দেখানো। লাল কালির অক্ষরে  লেখা — সাবধান। শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দার হাতে গ্রেফতার খুনি।

দুর্নিবার বলল, এর মধ্যে কোন রহস্য নেই। তার মানে রোমাঞ্চ নেই। তার মানে গোয়েন্দাও নেই। আমি কিছু বলছিলাম না দেখে দুর্নিবার বলল, কী ভাবছিস? আমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে?

চশমা ছাড়া মোটেই আলাদা কিছু না। কোনরকমে বলি — তফাত কিছু নেই।

হাঁটুর কাঁপুনি আগের থেকে কমেছে। কিন্তু হাঁটু থেকে শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে ভয়। ভয়ের চোরাস্রোতে আমি বসে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।

দুর্নিবার সিগারেট ধরায়। আশ্চর্য, ওকে আগে কোনদিন ধূমপান করতে দেখিনি, উলটে ও আমাকে নেশা করার জন্য বারবার সাবধান করত। কাজ না হওয়ায় তিরস্কার পর্যন্ত।

ধোঁয়ায় ঘর ভরে যাচ্ছিল। তামাকের গন্ধে নেশার জন্য স্নায়ুর ছটফটানি শুরু হতেই আমার হাত প্যান্টের পকেটে। কিন্তু সেখানে সিগারেটের প্যাকেট নেই।

তোর প্যাকেট আমার কাছে। দুর্নিবার আমাকে প্যাকেটটা দেখায়। — এই লাইটারটা, এটাও তোর।

আমি তো হাঁ। আমার অবস্থা দেখে সে বলল, কি দেখছিস? এতক্ষণে সব তো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, তাই না?

আমার তো বেঁচে থাকার কথাই নয়। এখন ঘড়িতে রাত এগারোটা পঞ্চান্ন। দমদমে ফ্লাইট থেকে নেমেছি আটটায়। বাইপাসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত দশটা। সেখানেই অপারেশন। আমাকে ঝাঁঝরা করে কয়েকটা গুলি। এই তো ছক ছিল—

একটানা কথার ঝোঁকে দুর্নিবার উত্তেজিত। অ্যাসট্রের মধ্যে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে কাশতে থাকে। শ্লেষ্মার ঘরঘরানি থেকে মুক্তি পেতে গলা খাঁকারি দেয়। ধূমপানের অনভ্যাস তাকে কাহিল করেছে মনে হয়।

সেই সুযোগে আমি দুর্নিবারকে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। তার ঘন কালো চুলে রূপোলী রেখাগুলো  স্পষ্ট ও প্রকট। আমার মতোই তার চুলের বিন্যাস।

রাজুকে খুনের সুপারি দিয়েছিলি— আমাকে মারার জন্য?

দুর্নিবারের চোখ হিংস্র হয়ে উঠেছিল। শক্ত চোয়ালে প্রতিশোধের স্পৃহা। এত বেশি বেশি করে আমার পা কেঁপে উঠল যে বসে থাকা অবস্থায় স্থির হয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। বুকের ধুকপুক শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।

রাজু! রাজু শেখ! তবে কি আমি ধরা পড়ে গেলাম? ভয়ানক ত্রাসে আমার চোখ বুজে আসে। দুর্নিবারকে দেখার শক্তি হারিয়ে ফেলি।

এত ভয়? বাচ্চাদের মতো ভয় পেয়েছিস? চোখ বন্ধ করে আছিস কেন?

আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। দুর্নিবার এরপর কী করবে? কী করতে চাইবে?

তোর পা কাঁপছে অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু এখন যে তোর হার্টও খারাপ। যে ভাবে ধকধক করছে, মনে হচ্ছে যে কোন সময় ফেটে বেরিয়ে আসবে।

এই কথাটা বলে দুর্নিবার মজা পাচ্ছিল। মজা আর আমোদের জমাট ক্ষীর সে আমার জন্য সাজায়। চেটেপুটে খাওয়ার জন্য আমাকে ডাকে। আমিও চাটতে শুরু করি। এক নদী মজা, পাহাড় প্রমাণ আমোদ চেটে যাই। এছাড়া আমার উপায় থাকে না।,এখন থেকে ওর ইচ্ছেতে আমার কর্ম।

ঠোঁটে সিগারেট রেখে লাইটার জ্বালিয়েও সিগারেট না ধরিয়ে পা নাচায়। বলে,এই প্যাকেটটা তোর।

বসে থাকলে আমি তো এভাবেই পা নাচাই। নাচাতে নাচাতে এভাবেই এক পা অন্য পায়ের উপর তুলে দিই। সেভাবে পা নাচাতে গিয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। আমার পা নেই। দুটো পা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। জানতেও পারিনি। একবার বলেছিলাম বটে, পায়ের কাঁপুনি সামলাতে ক্রুদ্ধ কথাগুলো ছিল — নিকুচি করেছে শালা তোদের, যেখানে খুশি যা, আমাকে রেহাই দে।

সেই কথায় ওরা চলে গেল! গেল, কিন্তু কোথায়?

দুর্নিবার বলল, এই দ্যাখ, তোর পা দুটো আমি নাচাচ্ছি।

আমার হৃৎপিণ্ড থেকে বের হয়ে আসে রক্ত আর হাওয়া।

দ্যাখ, ভালো করে দ্যাখ। দুর্নিবার আমাকে ডাকে, দেখায়। আমার প্যান্ট ওর পরনে। মধ্য রাতের নীলে, সাদা স্ট্রাইপ। আমার প্রিয় রঙের প্যান্ট। তার আড়ালে আমার পা নাচাচ্ছে দুর্নিবার।

রাজু শেখকে দশ লাখে ঠিক করেছিলি? সুপারি দেওয়ার সময় বুঝিসনি আমিও তোকে মারতে চাইছি? তুই আমার সেই কবেকার বন্ধু। পারমিতাও তাই। তুই পারমিতাকে ভালোবাসিস। পারমিতাও তোকে। আমিও পারমিতাকে। পারমিতা আমাকে।

দুর্নিবার আবার  ঠোঁটে সিগারেট রেখে লাইটার জ্বালিয়েও সিগারেট না ধরিয়ে বলল, পারমিতা কি জানত? সে কি রাজি হয়েছিল?

এর উত্তরের উপর নির্ভর করবে কে বেঁচে থাকবে — তুই  না আমি। রাজুকে তুই দশলাখ দিয়েছিলি। আমি কুড়ি লাখ। রাজু তোকে মারার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমাকে? কেন? কোথায়?

পাশের ঘরে। তোর বেডরুমে। তোর বউয়ের সঙ্গে।

আমার বউ?

আমাকে খুনের সুপারি দিয়ে আজ সকালে  তুই পারমিতাকে বিয়ে করিসনি?

কিন্তু রাজু পারমিতার সঙ্গে কী করছে?

আমার শোবার ঘর থেকে রাজু বেরিয়ে এসেছিল। আমাকে দেখে হেসে বলেছিল, নমস্কার স্যার। এই নিন আপনার দশলাখ।

রাজুকে দেওয়া আমার বাদামী চামড়ার ব্যাগ। রাজু আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, টাকা নিয়ে বেইমানি করি না। এই স্যার আপনাকে মারার জন্য কুড়িলাখ দিয়েছেন।

শুধু আমাকে মারার জন্য?

ম্যাডামের জন্য আরও কুড়ি লাখ।

আমার হৃৎপিণ্ড লাফাতে লাফাতে আমাকে ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তারপর দু'হাত, নাক, কান, চোখ — একটা একটা করে আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খুলে দুর্নিবারের শরীরে — এভাবেই আমি দুর্নিবারের শরীরে ঢুকে যেতে থাকি।

দুর্নিবার প্রমাদ গোনে। রাজুকে বলে, তাড়াতাড়ি ম্যাডামকে নিয়ে এস। ম্যাডামের সামনে এটাকে শেষ করে দাও।

হাত-পা শূন্য, চোখ-কান-নাকহীন আমাকে দেখিয়ে রাজু বলে, এ তো কবেই মরে গেছে। এর সবকিছু তো আপনার শরীরে। একে কীভাবে মারব?

দুর্নিবার চিৎকার করে বলল, তাহলে ম্যাডামকে শেষ করে দাও। তার জন্য তোমাকে কুড়িলাখ দিয়েছি।

রাজু বলল, টাকা তো যা পাবার পেয়ে গেছি, কিন্তু ম্যাডামকে মারা যাবে না, কারণ উনি বলেছেন — আপনাদের দু'জনকে ফিনিস করতে পারলে, পঞ্চাশলাখ দেবেন। এই নিন আপনার টাকা।

আমি দেখলাম আমার দেওয়া বাদামী ব্যাগটার মতই একটা ব্যাগ, দুর্নিবারের কাছে ঠেলে দিল রাজু। দুর্নিবার দাঁতে দাঁত ঘষটে বলল, বিশ্বাসঘাতক!

রাজু প্রতিবাদ করে।বলে,ওকথা বলবেন না। আমি স্যার প্রফেশনাল। আপনাদের কাজ করিনি,তার জন্য টাকা ফেরত দিয়েছি।আমার রেপুটেশন আছে,সব কেস আমি নিই না।

রাজুর কথার মধ্যে যুক্তি ছিল। আমরা দু'জনেই ব্যাকফুটে,চালিয়ে খেলার পরিস্থিতি নেই, আবার ডিফেন্স করলে রাজু পেয়ে বসবে।

রাজু দুর্নিবারকে বলল, আপনাকে দিয়ে শুরু করব। সোফায় বসে থাকুন। আপনার কপালের মাঝখানে একটা দানা ভরে দেব। কষ্ট হবে না।

আমি তোমাকে সত্তরলাখ দেব। ম্যাডামকে শেষ করে দাও।

দুর্নিবারের প্রস্তাবে রাজুর চোখ চকচক করে উঠেছিল। চওড়া হাসিতে জ্বলজ্বল করছিল তার মুখ। একটাই কথা সে বলতে পারল, এ্যাত টাকা…

রাজুকে আমার শোবার ঘরের দিকে এগোতে দেখে দুর্নিবারকে বললাম, পারমিতাকে সম্পূর্ণ করে পাব বলে তোকে খুন করাতে চেয়েছিলাম। সেই পারমিতা তোর সঙ্গে আমাকেও শেষ করে দিতে বলেছে। পারমিতা আমার বউ। আজ সকালে ওকে বিয়ে করেছি। কিন্তু ও কি অন্য কাউকে ভালোবাসে?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে দুর্নিবার বলল, সে হতেই পারে। একজন কেন, একশোজনকে ভালোবাসার হক তার আছে, কিন্তু তার জন্য আমাদের কেন মরতে হবে?

আমি বলি, চল— পারমিতার সঙ্গে দেখা করি। কথা বলে জানি, ও কী চায়।

দুর্নিবার রাজি হয় না। বলে, আমি ওর মুখ দেখব না।

আমাদের কথার মাঝে রাজু দাঁড়িয়ে ছিল। দুর্নিবারের চোখের ইশারায় সে এগিয়ে যায়। সত্তর লাখের বিনিময়ে সে এক্ষুণি পারমিতাকে মেরে ফেলবে— কিন্তু তার আগে আমার জানা দরকার, ও কাকে ভালোবাসে।

আমি পারমিতার কাছে যেতে চাই, কিন্তু পারি না। দুর্নিবারের সত্তর কেজি ওজন আমার শরীরে। আমার সত্তর কেজি, দুর্নিবারের শরীরে। দু'জনের ওজন নিয়ে আমাদের পক্ষে একা হাঁটা সম্ভব না, দুর্নিবারকে কাতর স্বরে  বলি, পাগলামি করিস না। রাজু তোর সুপারি নিয়ে এক্ষুণি পারমিতাকে গুলি করবে। সময় নেই, চল।

দুর্নিবার আমার কথায় কান দেয় না। সে গুলির শব্দ শুনতে চাইছিল। তখনই পারমিতার ঘর থেকে রাজু বেরিয়ে এল। প্রচুর পরিমাণে মদ খাওয়া টলমলে ওর শরীর। তার কথা জড়িয়ে যায়। জড়ানো স্বরে সে বলে, ম্যাডাম এক কোটি দেবে বলেছে— আপনাদের মধ্যে একজনকে মারতে হবে।

কাকে? আমরা একসঙ্গে জানতে চাই।

যে কোন একজনকে, রাজু বলে।

কিন্তু তা তো সম্ভব না। দুর্নিবার রাজুকে থামাতে চায়। আমিও শিউরে উঠি। ভয়াল ত্রাসে ঘাবড়ে যাই। বলি, গুলি করলে দু'জনেই মরব।

ম্যাডাম বলেছেন, যে কোন একজনকে বাঁচিয়ে রাখতে।

তাহলে পারমিতা অন্য কাউকে ভালোবাসে না। আমার মধ্যে বেঁচে থাকার ক্ষিধে জেগে উঠল।

দুর্নিবারকে ও  চিরকাল আমার থেকে বেশি ভালোবাসে। এখন রাজু দুর্নিবারকে মেরে ফেললে আমার রাস্তা খোলা।

দুর্নিবার আমার মনের কথা জেনে যায়। শুধু শরীর না, আমার মনও দুর্নিবারের আয়ত্তে। আমার আকাঙ্ক্ষা, বাসনা, কামনা সব তার কাছে ছবির মতো স্পষ্ট।

 

দুর্নিবারের মন: এরপর কী লাভ বেঁচে থেকে?

আমার মন: কিন্তু আমাকে তো বাঁচতেই হবে!

দুর্নিবারের মন: তোর থেকে আমার ভালোবাসা অনেক খাঁটি।

আমার মন: জানি।

দুর্নিবারের মন: তুই আমার শরীর থেকে বেরিয়ে যা।

আমার মন: আমি তো ইচ্ছে করে তোর শরীরে ঢুকিনি। এটা হয়ে গেছে। বেরোনোর রাস্তা আমি জানি না।

রাজু বলল, ম্যাডাম, টস করতে বলেছেন। যে জিতবে, সে বেঁচে থাকবে। এখন দয়া করে আপনারা আলাদা হয়ে যান।

দুর্নিবার রাজি হয় পারমিতার সঙ্গে কথা বলতে। এতগুলো টাকা পারমিতা কোথা থেকে পাবে! তার মনের এই প্রশ্নে আমিও সায় দিই। সত্যিই তো, এতগুলো টাকা…

সে বলে, চল, পারমিতার মুখ থেকে শুনি, সে কী চায়!

শোবার ঘরে ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। হাজার ওয়াটের আলো, কিছুই স্পষ্ট নয়। ঘরের মেঝে, খাট, বিছানা, ঘরের দেওয়াল, জানলা - সব অস্পষ্ট। এই ঘরে কোথায় পারমিতা!

দুর্নিবারকে জিজ্ঞাসা করি, কোন উত্তর পাই না। চিৎকার করে বলি, কী হল, উত্তর দিচ্ছিস না কেন? কথা বলছিস না কেন?

আমার সব প্রশ্ন, সব কথা উত্তরহীন হয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরছিল। ঘুরতে ঘুরতে হাওয়ায় মিশে যাচ্ছিল। হাওয়া ঠান্ডা হতে হতে হিমশীতল, তার ছোঁয়ায় আমি কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। আমার দুটো হাঁটুর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়, তার মধ্যে  না-থামা পায়ের কাঁপুনি, ক্রমাগত— দাঁড়িয়ে থাকলেই পড়ে যাব…

দুর্নিবারকে বলি, একটু বসব। দুর্নিবার সাড়া দেয় না। আমি এগোবার চেষ্টা করি। এক পা, দু’পা করে ঘরের এদিক থেকে অন্যদিকে হেঁটে যাই। দুর্নিবার নেই! আমার থেকে দুর্নিবারের, নাকি দুর্নিবার থেকে আমার এই মুক্তি! কিন্তু আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি  গলায় জোর এনে সজোরে ডাকি, দুর্নিবার, পারমিতা…

টলতে টলতে বসার ঘরের সোফায় কোনরকমে বসে পড়ি। খোলা দরজা দিয়ে শোঁ শো শব্দে  হাওয়া ঢুকছে। আমি উঠতে চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। সোফার নরমে ডুবে যেতে যেতে শুনতে পাচ্ছিলাম, কারা যেন এগিয়ে আসছে। ভারি বুটের শব্দ, একতলা থেকে দু'তলায়…

তিনতলায় আমার এই ঘরের কাছাকাছি শব্দগুলো আসার আগেই আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। মনে পড়ে যাচ্ছিল, অনেকদিন ঘুমোইনি। এবার ঘুমোতে হবে। একটানা, অনেকক্ষণ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন