কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


উত্তরপাড়া ও সময়-গহ্বর

 

আগে যেখানে থাকত, এখন সেখানে আসে আর যায়। ছুটিতে আসে আর ছুটি শেষে চলে যায়। ছোট শহর। রোজ কিছু মুখের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। বন্ধু নয় ঠিক, কথাও সেরকম নেই, কিন্তু  ঐ যাকে বলে মুখচেনা। তখন রোজ দেখত মুখগুলো ঠিক একইরকম, রোজরোজ একইরকম। সময় যেন ছিলই না মুখের ক্যানভাসে।

কাট টু নাও। আসা যাওয়ার মাঝে যেন কেবল সময় পড়ে রয়েছে। সময়ই আঁকছে মুখ। বদল তাই এত তাড়াতাড়ি! বছরে একদুবার আসলে সেই মুখচেনা লোকগুলোর সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা। কত বদলে গেছে মুখচোখ, হঠাৎ, না হঠাৎ নয়, কেমন প্রবল বুড়িয়ে গেছে অনেকে। অনেকের তো আর দেখাই মেলে না। যারা এখনো এখানে থাকে তাদের জিজ্ঞাসা করলে সেই সব না দেখা চেনামুখ সম্পর্কে একেকটা মৃত্যুসংবাদ ঠিক মিলে যায়। ও বাবার সঙ্গে বসে পুরনো পাড়ার থাকা না-থাকার খাতা খুলে ফেলে আর দেখা যায়, না-থাকা ভারী হয়ে উঠছে থাকার উপর।

ও কয়েকটা নাম না জানা লোকের কথা ভাবে। বাবা ওদের কথা ঠিক করে জানে না। বা জানলেও ওরা ঠিক কারা, বাবাকে বোঝানো মুশকিল। প্রাত্যহিক জীবনে এমন কত লোককেই না দেখি আমরা! তাদের হয়ত আমাদের জীবনে কোন কার্যকারিতা নেই, তাও ঐ দেখা আর দেখার স্মৃতি রয়ে যায়। উত্তরপাড়া এক প্রাচীন জনপদ। প্রজন্মের পরিবর্তন এভাবেই হয়ত হয়, হচ্ছে। নতুন থাকা, পুরনো থাকাদের ধীরে ধীরে নীরবে নিঃশব্দে না থাকা হয়ে যাওয়া। জীবনবাবুর গোল চক্করের খেলা চলতেই থাকে।

ও তাও মনে করবার চেষ্টা করে এমন কয়েকটা চেনামুখ যাদের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি কোনোটাই নিশ্চয়াত্মক নয় এখনো! তারপর একদিন শীতের সন্ধ্যায় ম্যাজিকের মত সেই লোকটাকে দেখতে পায় একটা গলির মুখে! চোখে চশমা, গায়ে চাদর। ঈষৎ এগিয়ে থাকার মত ভঙ্গিতে গলির মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে! ও কথা বলে না, লোকটা ওকে দেখতেও পায়না কিন্তু ওর লোকটাকে দেখতে পাওয়ার মধ্যে অনাবিল এক আনন্দ আছে যা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বৃদ্ধ মানুষটি আরো বৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। আধঘন্টা পর গলির মুখে ফেরত এসে আর লোকটাকে দেখা যায় না। ছিল তো নাকি ও কল্পনা করে নিল? লোকটার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে একটা মূর্তির মত ভাব ছিল। যেন আরব্ধ অন্ধকারে স্ট্যাচু খেলছে। এখন সে মূর্তি অন্ধকারে অন্তর্হিত। ছিল না ছিল না, কে বলতে পারে?

থাকে, সবই আসলে থাকে, বুঝলে হরিনাথ! না-থাকাও থেকে যায় কোথাও একটা। ওর দাদু, মানে বাবার বাবা, যেমন ধরে রেখেছিলেন উত্তরপাড়ার অতীত, সেরিব্রাল অ্যাট্রফির শেষদিন পর্যন্ত। মনে সময়গুলো গুলিয়ে এক হয়ে গিয়েছিল। তাই বাবু জয়কৃষ্ণ, ঘোড়সওয়ার ইংরেজ এবং পাড়ার বিখ্যাত মন্টি ডাক্তারকে প্রায় দেখতে পেতেন শেষ বয়েসে। ওদের কথা এমনভাবে বলতেন, যেন সবাই আছেন। অথচ জনপদের নানান রাস্তায় উত্তরপাড়ার কৃতী সন্তান হিসাবে তাদের ছবিতে মালা পড়ে গেছে বহুবছর। আর বলতেন, ওঁর বাবার, মানে আমার প্রপিতামহের মুখের ক্যান্সারে যন্ত্রণা পাবার কথা। উপনিবেশ, জমিদার, ডাক্তার আর বাবার শরীরে মারক রোগের যন্ত্রণা কোথাও কি এক হয়ে গিয়েছিল? 

মানুষের মুখে নাক, চোখ, কান আর মুখগহ্বর মিলিয়ে এতগুলো গর্ত। তা দিয়েই দেখা, শোঁকা, শোনা, বলা-- অর্থাৎ নানাভাবে সময়কে গিলে ফেলা। অথচ প্রপিতামহ সত্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের মুখে আরো একটা গর্ত করে দিয়ে গিয়েছিল কর্কটরোগ। সেই গর্ত যন্ত্রণার। সময়ের মুখে কর্কটকৃত এমন অনেক যন্ত্রণার গর্ত রয়েছে! ভালো করে দেখলে তার ভিতর না থাকা সব কিছুকেই বোধ হয় এখনো থাকতে দেখা যায়! কিন্তু সে দেখায় যন্ত্রণা আছে! অনিবার্য যন্ত্রণা!

উত্তরপাড়া এখন প্রায় কলকাতা! কতশত নতুন লোক! না-থাকাগুলো মুছে গেছে কর্কটকৃত দ্বিতীয় মুখগহ্বরের ক্ষণিকত্বে।   

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন