কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২১

সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

শিবাংশু দে

 

নমো বিষ্ণু




বিষ্ণুপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ওরফে 'বিষ্ণুদা' ছিলেন জামশেদপুরের ‘বিধান রায়’ ডাক্তার ব্রহ্মপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মেজছেলে। তিনিও পেশায় ডাক্তার। ঘটনা হলো গত শতকে চারের দশকে আমার বাবা ও তিনি ইশকুলে এক বছর উপর নিচে পড়তেন। বাবা আর-ডি-টাটা, বিষ্ণুদা কে-এম-পি-এম। বাবার থেকে বয়সে এক বছর বড়ো হলেও তাঁকে আমি সার্বভৌম 'বিষ্ণুদা' নামেই সম্বোধন করতুম। যেমন আমার বাবা'কে আমার বন্ধুরাও 'সত্যেনদা' বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতো।

বিষ্ণুদা ছিলেন অত্যন্ত সম্পন্ন, সুমার্জিত, 'সম্ভ্রান্ত' একটি পরিবারের সন্তান। বলতে গেলে জামশেদপুরের এক নম্বর বাঙালি পরিবারের সদস্য। আমাদের শহরে এমন পরিবারের লোকজন সেকালে 'কমুনিস' হতো না। কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে গিয়ে বিষ্ণুদা কমুনিস হয়ে গিয়েছিলেন। নাক-উঁচু, সম্পন্ন বঙ্গীয় আভিজাত্যের মাথায় বাড়ি মেরে বিষ্ণুদার আপনজন ছিলেন শহরের শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান মুখ কমরেড আবদুল বারি, কমরেড কেদার দাস। অবিভক্ত কমুনিস পার্টির স্তম্ভরা।

কলকাতা বিষ্ণুদাকে কমুনিস করেছিলো। কলকাতা বিষ্ণুদাকে তাঁর ঘনিষ্টতম কমরেড পূরবী বসুর খোঁজও এনে দিয়েছিলো। আটাত্তর সালে চিরবিদায় নেওয়া পর্যন্ত পূরবী মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিষ্ণুদার ক্যাপটেন। বিষ্ণুদা ছিলেন আমার পিতৃপ্রতিম। কিন্তু পূরবীদি ঠিক মাতৃপ্রতিম মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সবার কমরেড। বন্ধুস্থানীয়। এই দম্পতির পড়াশোনার স্তর ছিলো বিশেষ উঁচু। তার সঙ্গে ছিলো সমকাল ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ ও সাহিত্যের মূল্যায়ণ করার গভীর দক্ষতা। লেখালেখি বিশেষ করতেন না বটে, কিন্তু এঁদের সঙ্গে শুধু কথা বলে গেলেই বহু কিছু 'জানা' হয়ে যেতো। বাবা ইশকুলের বন্ধুদেরও 'তুমি' করে কথা বলতেন। কারও সঙ্গে 'তুই-তোকারি' করতে দেখিনি তাঁকে। তবে বিষ্ণুদার সঙ্গে হাইট। পরস্পর নাম ধরে ডাকতেন, তবে সম্বোধন করতেন 'আপনি'। বিষ্ণুদা-পূরবীদি আমাকে জ্ঞানবয়স থেকে চিনতেন। নিঃশর্ত ভালোবাসতেন। বিষ্ণুদা রাজনীতির জগতের মানুষ হলেও আমাদের শহরে অমন সুরুচিময়, স্মিতবাক, সদানন্দ ব্যক্তিত্ব আমি আর দেখিনি। বাবার কথা মনে রেখেই বলছি। কারণ বাবা 'রাজনীতি'র লোক ছিলেন না।

এঁদের দুজনকে নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন লোকে। হয়তো আমিও বলবো। তবে এখন নয়।

সাহিত্যসংস্কৃতি-জাত কাজকর্মের সূত্রে বিষ্ণুদা আমাকে ছোটোবেলা থেকেই চিনতেন। সামাজিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয় পরবর্তী কালে। জামশেদপুরের কুখ্যাত ১৯৭৯ সালে এপ্রিল মাসের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শেষ হবার কয়েকদিন পর যেদিন কারফিউ তোলা হয় কিছুক্ষণের জন্য, সেদিন আমি চাইবাসা থেকে বাড়ি ফিরছিলুম। সাকচি পেট্রোল পাম্পের পাশে দেখি বিষ্ণুদা দাঁড়িয়ে। চিরাচরিত সাদা বুশ শার্ট, হাল্কা ধূসর ট্রাউজার্স। আমাকে দেখেই বললেন, তোমাকেই খুঁজছিলাম। বলি, সে কী? আমি তো অনেকদিন হয়ে গেলো চাইবাসায় থাকি। তিনি বলেন, তবু ভাবছিলাম, যদি দেখা হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে আছি। গাড়িঘোড়া নেই। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি এলো। দুজনে মিলে চললুম। টেলকোর শেষপ্রান্তে যেখানে মুসলিম মানুষজনকে সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রায় একটা খোলা জেলখানার ব্যবস্থা করেছিলো সরকার। তাঁদের নানা সমস্যা শোনার জন্য একটা মিটিং ডাকা হয়েছিলো। আমাদেরও গন্তব্য সেখানে। কারফিউ নামার আগে পর্যন্ত মিটিং চললো। পূরবীদি গত হয়েছেন কয়েক মাস আগে। তখনও বছর পুরায়নি।

আমি তখন পাটনায়। ১৯৯৯ সালের জুন মাস। কারগিলে বিষম যুদ্ধ বেধে গেছে । রাঁচি এসেছিলুম একটা সরকারি কাজে। মাঝে শনি-রবিবার। ভাবলুম একবার জামশেদপুরে বাড়িতে ঘুরে যাই। ভাই তখন সেখানেই। তখনও দেশে 'মোবাইল-যুগ' আসেনি। শনিবার সন্ধেবেলা বাড়ি আসতেই ভাই বলে, তোমাকে ধীরাজদা খুঁজছিলেন। আমি একটু অবাক। ধীরাজদা মানে শহরের সর্বজনপরিচিত ধীরাজ জানা। তিনি তো জানেন আমি বহু দূরে থাকি। তবে ধীরাজদার পক্ষে এ জাতীয় খাপছাড়া প্রশ্ন  আমরা  অতি স্বাভাবিকই মনে করি। আমি ভাইকে বলি, বলেছেন কি কেন খুঁজছেন? আমাকে আরও চমৎকৃত করে সে বলে, বিষ্ণুদা তোমাকে খুঁজছেন। বোঝো? বিষ্ণুদাও তো বহুদিন হলো জামশেদপুর ছেড়েছেন। কলকাতায় আছেন। হয়তো জানেনই না, আমিও বহুদিন পাটনায়।

আমার রোববার সন্ধের মধ্যে রাঁচি ফিরে যাবার ছিলো। কিন্তু যাওয়া হলো না। শেষ বিকেলে বেঙ্গল ক্লাবে গিয়ে দেখি বিষ্ণুদা পৌঁছে গেছেন। আমাকে দেখেই বললেন, এইতো, শিবাজি পৌঁছে গেছে। ধীরাজ বললো তুমি কোথায় যেন থাকো এখন। আসতে পারবে না। আমি বললাম পারবে, পারবে। নিশ্চিন্ত এখন। তারপর একেবারে তাঁর পাশে বসিয়ে বললেন, জানো তো? আজকের সভা কেন ডাকা হয়েছে? আমি বলি, কিছুই জানি না। ওহ, ঠিক আছে। আজকের বিষয় হলো যুদ্ধবিরোধী জনমত তৈরি করা। তুমিই মুখ্য বক্তা। আমিও বলবো, তবে তোমার কথার সূত্র ধরে। স্টেজে শতরঞ্চি পেতে বসার জায়গা। একটু একটু করে নানা জন আসছেন। প্রায় সবই চেনা মুখ। হাসি বিনিময় হচ্ছে অনেকের সঙ্গে। বাবার বাল্যবন্ধু সৌরীন্দ্রনাথ বসু, আমাদের সৌরীনকাকু, আলো-কাকিমা এলেন। তাঁদের কন্যা শ্রীলাও এলো। বন্ধু অলক, আরও অনেকে।

সাড়ে ছটা নাগাদ বিষ্ণুদা কানে কানে বললেন, কয়েকজনকে বলতে বলবো। মিনিট পাঁচেক করে। তার পর তুমি, মিনিট পনেরো। শেষে সময় থাকলে আমি কিছু ক্ষণ। অনেকেই বললেন। যুদ্ধবিরোধী আবেগ বিশেষ ভাবে ফুটে উঠছিলো সবার কথায়।  কয়েকটা নির্বিকল্প শয়তান ছাড়া কেউ যুদ্ধ চায় না। তবু যুদ্ধ হয়। আমাদের মতন উলুখাগড়ারা মারা যায়। খুব আকর্ষণীয় ছিলো আলো-কাকিমার সঙ্গে নিয়ে আসা অরূপের চিঠি পড়া। অরূপ, মানে তাঁর ছোটোছেলে ডাক্তার, মেজর অরূপরতন বসু তখন কারগিল পাহাড়ে যুদ্ধের লাইনে ট্রেঞ্চে বসে আহত সৈন্যদের অপারেশন করছে। নানা বিধিনিষেধ পেরিয়ে বাংলায় সে মা-কে চিঠি লেখে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। নির্মম যুদ্ধের নিষ্ঠুর প্রলয়। সীমান্তের দুদিকেই যারা মারা যাচ্ছে, তারা কেউ যুদ্ধ বাধায়নি। তারা রাজনীতি করে না। তারা জানে না যুদ্ধ করে কী পাওয়া যাবে? শুধু মরে যাবার জন্য তারা দলে দলে লড়ে যাচ্ছে। অজানা, অচেনা 'শত্রু'দের সঙ্গে। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রই মানবিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত অপমানের নরক। তবু মানুষ যুদ্ধ করে। রাজনীতিক যুদ্ধব্যবসায়ী আর অস্ত্রকারখানার দালাল ছাড়া সবার জন্যই মরণান্ত বিপর্যয় এই কৃত্য।

এসব নিয়েই বললুম খানিক। তার পরেই আমার কথার সূত্রে সারা পৃথিবীতে 'কামানের খাদ্য' দরিদ্র মানুষের ট্র্যাজেডি নিয়ে বিষ্ণুদাও কিছু বললেন তাঁর অননুকরণীয় তীব্র, অথচ শান্ত বাগভঙ্গির বাহনে। বাড়ি ফেরার সময় তাঁর কাছে অনুমতি চাইলুম। তিনি বললেন, জানতাম এই কাজটা তোমাকে দিয়েই সব চেয়ে ভালোভাবে হবে। হয়েও গেলো। কলকাতা আসো না? এলে নিশ্চয় যোগাযোগ কোরো। তার পর তাঁর সেই বিখ্যাত স্নিগ্ধ হাসি। সেটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা।

(বন্ধু অলকের দৌলতে এই ছবিটি দেখে পঁচিশ বছর আগের এতো কথা মনে পড়ে গেলো।

ছবিতে রয়েছেন, বাঁদিক থেকে, শৌভিক দে, অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী, বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়, শিবাংশু দে।)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন