কবিতার কালিমাটি ১৩৬ |
বিভাময়
পুকুর পাড় পিছলে পড়লো আঁচলে। সারা শরীর কেঁপে
উঠতেই দু-হাতের ছায়ায় আবদ্ধ হয় লজ্জা। সুচিত্রার শরীরে লুকোনো মাদল। জলে ঢেউ উঠে
কিছুদূর গিয়েই হারিয়ে গেল। সুচিত্রা হিতাহিত ভেবে নিজের আলোয় দেখে নিল নিজেকে। মোমের শরীর নিয়ে খেলা, তোমার মতোই কি অন্য
পুরুষও এমন হয়? নানান জিজ্ঞাসা উঠে আসে জলে। হাজার ওয়াটের বাতিটা মাথায় জ্বলছিল।
হঠাৎ ঠাণ্ডার অনুপ্রবেশে এলোমেলো হয়ে থমকে গেল, সব আয়োজন।
আমি এখন কোথায়? কীভাবে এখানে? কেন? এমনি এক একটা জিজ্ঞাসা উঠে আসে। মাথাটা হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চেপে ধরি। তারপর হাত ঢুকিয়ে ঘাম মুছি। সব যেন ফাঁকা হয়ে গেল।
আজ ১৮ বছর, প্রতাপ আমাকে এভাবে একা ফেলে গেছে। এই অপূর্ণতা, এই অর্ধেক অংশ নিয়ে বয়ে যেতে হবে কিছুটা উদ্বায়ী ও বাকিটা ঢেউ খেলে খেলে। সব হা-পিত্যেশ রোদে শুকোচ্ছে। শূকনো পাতা, এঁটো ঘুচিয়ে দুমুঠো সাদা ভাত। স্বপ্ন দেখি শুধু ভোগের শরীরে ভরা নদী, দুদিকে বাঁধ, বড় বড় নির্মাণকাজ চলছে। নির্মাণ করি তোমার ছায়া, গন্ধ আর সব মিলিয়ে যায় আমার ছায়ায়। শীতলতম ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে বট। অত্যন্ত গভীর, তোমার চোখের মতোই। ছল ছল যৌবনে নদী এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে।
অসমম্ভব একটা তাগিদ, এই তাগিদেই হয়তো মানুষ বাঁচে, সব মানুষ না কিছুকিছু। এই কিছু কিছুর ভেতরেই আমার বসবাস। বসবাস মানে ঘর, সংসার, সীমানা। সীমানা মানেই যতদূর চোখ যায় ঠিক ততদূরে এঁকে ফেলা একটা মানচিত্র। মানচিত্রের মাঝেই আমার কেন্দ্রবিন্দু বরাবর, একটা অক্ষরেখা তৈরি হয়েছে আকস্মিক। আমাকে কেন্দ্র করে কিছু কি ঘূর্ণায়মান? আমিই তো ঘুরপাক খাই, ঘুরে বেড়াই কখনও তোমার দরজা আবার অনেক বন্ধ দরজার কড়া নেড়ে। দরজা মানেই চারিদিক আবদ্ধ, আর একদিক দিয়ে বেরিয়ে পড়া বোঝায়। সবকিছু কি জানতে পারি? কিছুটা না জানাই ভালো। এই দুঃখের মাঝেও তাই আনন্দ খুঁজি, জোনাকি হয়ে ঝরে পড়ি অন্যের আনন্দেও। সহযোগী হই কিছুটা সময়।
প্রতাপ মানেই আগুন, আগুন হল পুড়ে যাওয়া, আর পুড়তে পুড়তে কখন অন্তর্লীন হয়ে পড়া। আগুন মানে কি শুধুই ধংস? সৃষ্টিও হতে পারে। তাই ভালোবাসা মানেই প্রতাপ। অন্য সবই কিছুক্ষণের ভালোলাগা। আমি তো ক্ষণে ক্ষণে পলে পলে বাঁচি অন্যকেও বাঁচাই। বাঁচতে হলে তুমিও এসো নির্জন দুপুরে ঐ, ঐ যে , ওই পুকুরের পাড়ে - আগুনে পোড়া অথচ কত শান্তি! আমার... ঐ আঁচলে...
জলন্ত মোমবাতির মতো জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাওয়া। এসো শান্ত হবে, জল যেমন ঠাণ্ডা হতে হতে কঠিন বরফ হয়ে যায়। তোমার দিকে যতবার গিয়েছি চুম্বক হয়েছি আমি। লাট্টুর মতো তুমিও নিজের অক্ষে পাক খেয়ে আমার শরীরে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েছ কতবার।
এখন আমি দরজা বন্ধ করি। কারণ, আমার কোথাও পাঁচিল নেই। সীমানা আছে, যতদূর চোখ যায় ঠিক ততদূরে একটা মানচিত্র। মানচিত্রের ভেতর অনেক দ্বেষ, দেশ-বিদেশ। ধর্ম বর্ণ জাত-পাত তোমার আমার সবার ঠিকানা। মেয়ে শরীরের ঠিকানা হয়। পুরুষের ঠিকানা নেই কোনো। আসলে পুরুষের কোনো শরীর হয় না, নৌকা বা জাহাজের মতো যখন যেখানে খুশি নোঙর করা। কাঠের অবয়ব, একটা বস্তুমাত্র। ওরাও বস্তুর মতোই আমার কাছে। ললিপপ যেমন ছোটবেলায়। তেমনই ঐ পুরুষও আমার হাতে। যখন যে রং পছন্দ তুলে নিই, গলেও যায় অনায়াসে। সব পুরুষের ঠিকানা আমার মতোই কোনো না কোনো শরীর।
বর্ষার অন্ধকারে জঙ্গল আরো ঘন হয়। ঘনীভূত অন্ধকার লাবণ্য হয়ে ছড়িয়ে পড়ে গাছপালার ভেতর। পুরুষের ভেতরেও এমনই অন্ধকার লুকিয়ে থাকে, তাই প্রতিনিয়ত সে আলো খোঁজে, খুঁজতে খুঁজতে অন্ধকারে ডুবে যায় আবার। ডুবতে ডুবতে ভরাডুবি, এসময় পুরুষ তোমাকে করুণা করি। কোনো কিছুই ধারণ করতে শেখনি তুমি। পোশাকের ভেতর সভ্যতা লুকিয়েছে আগুন। নারী হল পরিপূর্ণ অবয়ব, একটা পূণ্য শরীর। সহনশীল সভ্যতার ধারক বাহক। তুমি হীন থেকে ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে থুথু হয়ে যাচ্ছো নর্দমায়, দেখলে করুণা হয়।
আমাকে ছুঁয়েও শরীর হতে পারবে না, কারণ তুমি তো শরীরহীন, ধারণ করতে পারো না, যা পারো সেটা পাশবিকতা আর অভিনয়। একথা কেন আসছে সেটাও বলবো, তা না হলে কেউটের ছোবল খেতে হবে, সেটা না হয় খেলাম। এই নিন্দার ভাগে তুমিও আছো, ভেব না তুমি আলাদা, আসলে তোমারও শরীর নেই। যার শরীর নেই তার মাথাও নেই, আর মাথা না থাকলে বিবেক কোথায় বাস করবে। নারী মুক্তি চায়, আসলে পুরুষের মুক্তির প্রয়োজন, নারী তো মুক্তি দেয়।
মুক্তি শব্দেরও মন্ত্রবল আছে, উচ্চারণেই খুলে যায় সব দরজা। দরজা থাকলেই সেখানে দেওয়াল থাকবে, আবার না থাকতেও পারে। আগে থাকতো এখন বলতে পারবো না। কারণ এই দরজা দিয়ে পুরুষই যাতায়াতে অভ্যস্ত। ঝিনুকের ভেতর জমে থাকে মুক্ত, কী আশ্চর্য অথচ, নারীদেরও ঠিক এভাবেই বন্দি করে রেখেছে পুরুষ, নিজের ভোগ ও সুবিধায়। আসলে আমরা মেনে নিয়েছি, তবু যুগ যুগ ধরে ওরা কৌশলে বেঁধে রেখেছে আমাদের। একই পুরুষ কখনো পিতা, দাদা আবার সন্তান, আসলে সব পুরুষই কোনো না কোনো মহিলার সন্তান, সাধারণ ভাবে কেউ একথা ভাবেন না, অথচ এভাবে ভাবাটাই সহজ সরল। মহিলা মানেই মা, মা হওয়া নিছক নয়, মহত থেকে মহত্তর কাজ। এই শব্দের ভেতর মহিমা বাস করে। মহিমার ভেতর মা আছেন, আর মহি শব্দের অর্থ পৃথিবী। পৃথিবী মাটি জল বাতাস আগুন সবকিছুতেই মায়ের অবদান। মা মানেই নারী, আর নারী হল শরীর। যাকে অস্বীকার করা যাবে না।
প্রতাপকে আমি আজও ভালোবাসি, ঠিক আগের মতোই। কেন যে ওভাবে চলে গেল জানি না। এও জানি না পুরুষ ছাড়া কেন এই অপূর্ণতা। আসলে শরীর সর্বস্ব হয়ে পড়েছি, পুরুষ সঙ্গে থেকে। শরীর নিরাকার খোঁজে, আর আত্মাও নিরাকার। আবার, ঠিক নিরাকার - আকার খোঁজে, নিরাকার আত্মা। তাহলে, আত্মায় হয়তো পুরুষ, মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যায়। গা গুলিয়ে ওঠে। কনসিভ করলে ঠিক যেমন। আত্মারও বোধহয় দুটি ভাগ, শুদ্ধ আত্মা ও প্রেতাত্মা। প্রেতাত্মারাই হয়তো ঐসব - একাজ ওকাজ কু-কাজ করে বেড়ায়। আর ওদের বৃদ্ধি হয়েছে সমাজে, তাই এই উশৃঙ্খলা। এভাবেই মনকে বোঝালাম আপাতত। আর আমি তো চরিত্রহীনা, তাই আপনারা আমার কথা মানবেন কেন? আর আমি একবারও নিজেকে ভালো বলে উপস্থাপন করার চেষ্টাও করিনি। আমি যেমন ঠিক তেমনি বর্ণনা দিয়েছি নিজের। এরপরও যদি কেউ আসতে চান বিছানায়, দরজা খুলে ঘুমোলাম, তবে - বিনিময়টা অবশ্যই নগদ। জেনে রাখবেন, পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে রাখি না বিষধর। শুধু শরীরে শরীর ছুঁয়ে অবলীলায় ডুবে যায় লাবণ্যময় এক অন্ধকার...
ছুঁয়ে গেল এক লাবণ্যময় আলো
উত্তরমুছুন