কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২১

সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

সুতপা মুখোপাধ্যায়

 

মেয়েদের লেখায় মেয়েদের কথা - জ্যোতির্ময়ী দেবীর এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা

 

 


‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ উপন্যাসটিকে জ্যোতির্ময়ী দেবী উৎসর্গ করেন সকল যুগের সকল দেশের অপমানিতা লাঞ্ছিতা নারীদের উদ্দেশ্যে। ইতিহাসের ভাঙ্গাগড়ার নানা কান্ড হয়ে ওঠে পুরুষের লড়াইয়ে। সেখানে মেয়েদের জায়গা কোথায়? মহাভারতের স্ত্রীপর্ব থেকে বীরের বীরগাথা ---- মেয়েদের চোখের জল, লাঞ্ছনার যে ইতিহাস তা কোথাও লেখা হল কি? কখনও কোন যুগে।  পুরুষের আত্মম্ভরিতার যে অনাবশ্যক লড়াই ইতিহাসের পাতা জুড়ে থাকে সেখানে মেয়েদের কোন জায়গা হল না। সেই অনাবশ্যক লড়াইয়ের আগুন, রক্ত কিন্তু তছনছ করল মেয়েদের। সেটা লড়াই বলে স্বীকৃত হল না কোনোদিন। সে হয়ে থাকল কলঙ্কিত অধ্যায়, যাকে চাপা দিতে হয় – যাকে সমাজ সংসারের একটা ক্ষত হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়। এমনই রক্তাক্ত প্রশ্নগুলি আমাদের সামনে জেদি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে কখনও কোনসময়আমাদের আপাত নিরীহ জীবন নাড়া খেয়ে যায় আর একবার। আমরা অনেক কিছু লুকিয়ে রাখি সুখী যাপনের অজুহাতে। জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ আমাদের রক্তাক্ত অধ্যায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

দেশভাগ ও দাঙ্গা—বাঙালি জীবনকে তছনছ করে দেওয়া সে অধ্যায়। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র সুতারার আপাত শান্ত স্বচ্ছল জীবনে এক সন্ধ্যের আগুন আর মানুষে মানুষে হানাহানির কারণে আমূল বদলে যায়। বিবাহিত দিদি, মা, বাবা হারিয়ে যান সুতারার জীবন থেকে । হারিয়ে যায় তার আজন্মলালিত চেনা ঘরবাড়ি, তার চারপাশ। দাঙ্গাবিদ্ধস্ত বাড়িটি থেকে তাকে উদ্ধার করে আনে বাবার সহকর্মী বন্ধু তমিজকাকার পরিবার। তমিজকাকার মেয়ে সাকিনা তার সহপাঠী সখী। অতি আদরে তমিজকাকার পরিবার তাকে কাছে টেনে রাখে। সুতারা দাদাদের কাছে কলকাতায় ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়। কিন্তু তমিজকাকা চিঠিতে দেখেন দাদাদের কোন আগ্রহ নেই সুতারাকে নিয়ে। বরং সুতারাকে ঘরে ফেরালে লোকে কি বলবে তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। এদিকে শিক্ষিত মানুষদের কাছ থেকেই তমিজুদ্দিনের কাছেও চাপ আসতে থাকে যাতে তিনি সুতারা কে হিন্দু রিলিফ ক্যাম্প এ পাঠিয়ে দেন। তমিজুদ্দিনের স্ত্রী সাকিনার মায়ের একটি প্রশ্ন উপন্যাসকে তার নির্নায়ক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়, যে প্রশ্ন নারীর ইতিহাসের ভিত রচনার একটি অতি গুরুত্বপুর্ণ জায়গায়। ‘তোমাদের দেশভাগ চাই, ঝগড়া করবে করো। আমাদের মেয়েদের মান-ইজ্জত-শরীর নিয়ে এত লাঞ্ছনা কেন? এ কি তোমাদের ধর্ম বলে? কোরানে আছে? তোমরা এত সব শিক্ষিত – গাঁয়ের উকিল মোক্তার মাস্টার—কেউ কারুকে কিছু বলছ না কেন?’ -- মেয়েদের শরীর আর তার সঙ্গে জড়িয়ে রাখা মানসম্ভ্রমের ধারণা --- ইতিহাসের সব লড়াইয়ে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম না হলে যেন কোন দাবি কোন লড়াই সম্পুর্ন হয় না। সেখানে মেয়েদের ভূমিকা গৌণ, অথচ সমস্ত অন্যায়ের দায়ভাগী হয়ে যায় শুধু মেয়েটি। তাই দাদার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে বৌদির মায়ের কাছে প্রথম লাঞ্ছনার ধাক্কা খায় সুতারা। তাকে যারা রক্ষা করেছিল, প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল, আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিল তাদের ঘরে পরিস্থিতির চাপে পড়ে কদিনের বসবাসে সে তার পরিচিত সমাজের কাছে হয়ে ওঠে অচ্ছুৎ। “কোন ঘরে বসবে, কার কাছে বসবে, কথা কইবে, বুঝতে পারে না। দাদারা বৌদিরা বাড়ির সকলেই তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলেকিন্তু সে যেন বাড়ির লোক নয়। কারুর আপনারও লোক নয়’’ -- এই গভীর যন্ত্রণা থেকে যে অন্বেষণ তাই উন্মোচিত থাকে উপন্যাসের পরতে পরতে। সে খাবার সময় জল পরিবেশন করতে গেলে দৌড়ে আসেন গৃহিণী। সহমর্মীতা দেখান বৌদির বাবা। বাড়ির বয়স্ক মহিলারা আড়ালে আলোচনা করেন হিন্দু সমাজে এমন মেয়েকে ফিরিয়ে নেওয়ার নিয়ম নেই। পরিবারের মধ্যে কখন যেন ‘সুতারা সমস্যা’ প্রধান হয়ে ওঠে। কলকাতা কিছুটা শান্ত হয়েছে দাঙ্গার পর এই অজুহাতে দাদা সনৎ পরিবার নিয়ে নিজের পাড়ায় ফিরতে চাইলেও তাকে সাবধান করা হয় সুতারার বিষয়ে। জ্যোতির্ময়ী লেখেন “এই অটল সমাজের মন কোনো অপহৃত লাঞ্ছিত মর্যাদাচ্যুত মেয়ের দুঃখে কখনও টলেনি।’’ কিভাবে যেন পরিকল্পিত হয়ে যায় সুতারাকে বোর্ডিং এ পাঠাবার বিষয়টি, সুতারার অজ্ঞাতে। উপন্যাস খুব সুক্ষ্ম মোচড় দেয় আমাদের মননের গভীরে --- “ সনৎ মনে মনে মুক্তির নিশ্বাস ফেললো। কিন্তু চুপ করেই রইলো। সুবোধ, সুধীরও নীরব। বিমল বললে, ‘এখনকার মতো এ ব্যবস্থা ভালোই হবে। তারপর পাশ করুক, তখন দেখা যাবে। কি দেখা যাবে—তা বিমল, সনৎ, অমুল্যবাবু কেউই জানে না। অতএব এখনকার মতো মস্ত সমাধান হ’লো আপাতত। টাকা দিয়ে বোর্ডিং এ রাখা।’’ বৌদির বাবা, অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিজের মেয়ের ঘর বাঁচাবার জন্য এই ব্যবস্থা করেও দুঃখিত হয়েছিলেন সুতারার জন্য। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগে, “নিজের ঘরের ঘটিবাটি না সামলে কে কবে পরের জন্য, বিশেষ করে একটি কুটুম্ব মেয়ের জন্য উদ্বেগ ভাবনা বহন করেছে? স্বয়ং রামচন্দ্রই স্ত্রীর জন্য পারেন নি। চকিতে মনে পড়ে যায়, কই জনক রাজাও তো সীতার জন্য এগিয়ে আসেন নি!” তবুও ব্যবস্থা হয়ে যায় সুতারার নির্বাসনের।

অভয় বাণীর ঘোষণাও হ’য়ে গেল। এদিকে বিভক্ত ভারতবর্ষেও রাজকীয় সমারোহে স্বাধীনতার সংবিধানের ভূমিকা সংরচনা ও সংগঠন হচ্ছে।’ দেশের আরও লোকের মত তমিজুদ্দিনেরও মনে হল রক্তগঙ্গার স্রোত বুঝি থামল। ভিটেমাটি ফেলে আর এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে এদিকে পালাতে হবে না। সাকিনা ভাবে আবার ফিরে আসবে সুতারা। কিন্তু সাকিনার দেশ কী? কাকে বলে দেশ? সেই প্রশ্ন উঠে আসে উপন্যাসের শরীর থেকে। ‘জিন্নাসাহেব রাষ্ট্রপতি হ’য়ে দাদা আজিজের মনে প্রশ্ন থেকে যায় সুতারাকে সত্যিই গ্রহণ করবে তো পরিবার।’ ‘‘দু- বাড়ির বাগান--- আম, জাম, কাঁটাল, নারিকেল, সুপুরিবনের আড়াল  থেকে সুতারাদের অর্ধদগ্ধ বাড়ির দেয়ালগুলি, আধ- ঝলসানো গাছগুলি একটু একটু দেখা যাচ্ছিল। আবার পাতা গজিয়েছে গাছে এতদিনে। দুটি পুকুর, বাগান, গোয়াল আর খালি জমিতে এই ক’মাসে জঙ্গল হয়ে গেছে। তমিজুদ্দিন সাহেবের ভয়ে কেউ এসে বাসা বেঁধে থাকতে পারেনি।’’ সাকিনা ওরা আসবে কিনা জিজ্ঞেস করাতে আজিজ বলে দেশ যখন, আসবে নিশ্চয়। অথচ কেমন করে বদলে যায় মানচিত্র অনেকের অজ্ঞাতেকাঁটাতারের বেড়া এসে রক্তাক্ত করে দেয় হৃদয়।

গান্ধীর মৃত্যু মিশনারি বোর্ডিংটিকেও গভীর শোকে মুহ্যমান করে তোলে। তবুও মেয়েরা নিজেদের মধ্যেই প্রশ্ন তোলে, দেশভাগ তিনি চাননি । আবার মেনেও নিলেন। সুতারা নিজেকেই প্রশ্ন করে, ‘তবে কে চাইল এই লাঞ্ছনা, বিপর্যস্ত নিরীহ জীবনের রক্তাক্ত স্বাধীনতা? কারা স্বাধীন হল?’ এ প্রশ্ন তো বহুজনের, এ প্রশ্ন তো অপমানে যন্ত্রনায় লাঞ্ছিত সব কালের মেয়েদের। তাদের অপমানের বিনিময়ে কাদের স্বাধীনতা এল?  কারা বিনা দোষে ঘর হারাল? ঘর যে হারায় মেয়েরা , অন্যের অন্যায়ের দায়ভাগী যে হয় মেয়েরা তা তো ইতিহাসের পাতায় তেমন করে লেখা হয় নি কোনোদিন। সুতারার মত আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসা মেয়েদের কথাও কোথাও লেখার কথা মনে রাখেন না ইতিহাসের নির্মাতারা। তবু মহিলা লেখকের লেখায় থেকে যায় তারা, যেমন করে সুতারা কে রাখলেন জ্যোতির্ময়ী তাঁর উপন্যাসে। সুতারা ভালভাবে ম্যাট্রিক পাশ করে বাড়ির আহ্বানের জন্য বসে থাকে। কিন্তু তার তো আর কোন বাড়ি থাকে না। নানা অজুহাতে দাদারা এড়িয়ে চলে।  তাকেও ছুটিতে বোর্ডিং এ থাকতে হয়। বোর্ডিং খোলাও থাকে ‘দেশত্যাগী বিপর্যস্ত পলাতক আশ্রয়চ্যুত অনাথ কিছু মেয়েদের জন্যেই।’ দেশভাগের ইতিহাসে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বুভুক্ষু মানুষ আসছে, বা ট্রেনের মাথায় গাদাগাদি ভিড়ের ছবি মানবতার গভীর অবনমনের ইতিহাসের ছবি হয়ে রয়ে যায় আমাদের যাপনেকিন্তু তার বাইরেও যে কিছু ছবি ছিল, যেগুলি ইতিহাস ধরে রাখেনি বা ধরার কোন চেষ্টা করে নি --- সেই রকম কিছু ছবি থেকে যায় আমাদের সাহিত্যে। সেই ঘর থাকতেও ঘর হারা লাঞ্ছিত মেয়েদের ছবি আমরা কোথায় পেতাম যদি সাহিত্য তাকে না জায়গা দিত!

বর্ণহিন্দু সমাজে লাঞ্ছনা ও পীড়নের ভয়ঙ্কর চেহারা তুলে ধরেছেন জ্যোতির্ময়ী তাঁর উপন্যাসে। শিক্ষিত ভদ্র পরিবারেই কেমনভাবে একটি নির্দোষ মেয়ে নীরবে যন্ত্রণার শিকার হয়েছে সুতারা তার উদাহরণ। পিতৃতান্ত্রিক সেই সামাজিক অবস্থানে মেয়েরাই কেমন  করে হয়ে ওঠে পীড়নের মুখ তা সুতারার বৌদি বিভার মা এর মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন উপন্যাসকার। এই পীড়ন মানতে পারে নি বিভা, তার বোনেরা আর ভাই প্রমোদ। শুভার বিয়েতে আমন্ত্রণ শুভাই করে সুতারাকে। বোর্ডিং থেকে বিয়েতে এসে নীরবে ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনার শিকার হয় সুতারা। সে হয়ে ওঠে ঝঞ্ঝাট – পাকিস্তানি উদ্বাস্তু ঝঞ্ঝাট। তার উপস্থিতি হিন্দুর জাত নষ্ট করে। অতএব সে সকলের সঙ্গে বসে খাওয়ার অধিকার হারায়। “প্রতিদিনের খাবারঘর আজ অনাবশ্যক একটা জায়গা। সেইখানে প্রতিদিনের মতো একটি পিঁড়ি পেতে এক গ্লাস জল না কলাপাতায়, মাটির গেলাস নয়- কাঁসার থালায় গেলাসে খাবার ও জল সাজিয়ে দিয়েছে। বউদির বোনেরা, নিজের বৌদি বিভা, এবং কয়েকজন গিন্নিবান্নি, মাসি-পিসি, জেঠিমা, খুড়িমার দল সমারোহ করে লুচি, পোলাও, মাছ, মাংস, শাকভাজা, বেগুনভাজা থেকে চাটনি, মিষ্টি, রাবড়ি অবধি সাজিয়ে খাওয়াতে বসলেন ...... সুতারা খাবারের স্তূপে হাত দিয়ে চারদিক চাচ্ছিল। খেতে হবে? হ্যাঁ, খেতে হবে। সে ছবি থেকে যায় আমাদের সাহিত্যে। সেই ঘর থাকতেও ঘর হারা লাঞ্ছিত মেয়েদের ছবি আমরা কোথায় পেতাম যদি সাহিত্য তাকে না জায়গা দিত!

বর্ণহিন্দু সমাজে লাঞ্ছনা ও পীড়নের ভয়ঙ্কর চেহারা তুলে ধরেছেন জ্যোতির্ময়ী তাঁর উপন্যাসে। শিক্ষিত ভদ্র পরিবারেই কেমনভাবে একটি নির্দোষ মেয়ে নীরবে যন্ত্রণার শিকার হয়েছে সুতারা তার উদাহরণ। পিতৃতান্ত্রিক সেই সামাজিক অবস্থানে মেয়েরাই কেমন  করে হয়ে ওঠে পীড়নের মুখ তা সুতারার বৌদি বিভার মা এর মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন উপন্যাসকার। এই পীড়ন মানতে পারে নি বিভা, তার বোনেরা আর ভাই প্রমোদ। শুভার বিয়েতে আমন্ত্রণ শুভাই করে সুতারাকে। বোর্ডিং থেকে বিয়েতে এসে নীরবে ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনার শিকার হয় সুতারা। সে হয়ে ওঠে ঝঞ্ঝাট – পাকিস্তানি উদ্বাস্তু ঝঞ্ঝাট। তার উপস্থিতি হিন্দুর জাত নষ্ট করে। অতএব সে সকলের সঙ্গে বসে খাওয়ার অধিকার হারায়। “ প্রতিদিনের খাবারঘর আজ অনাবশ্যক একটা জায়গা। সেইখানে প্রতিদিনের মতো একটি পিঁড়ি পেতে এক গ্লাস জল না কলাপাতায়, মাটির গেলাস নয়- কাঁসার থালায় গেলাসে খাবার ও জল সাজিয়ে দিয়েছে। বউদির বোনেরা, নিজের বৌদি বিভা, এবং কয়েকজন গিন্নিবান্নি, মাসি-পিসি, জেঠিমা, খুড়িমার দল সমারোহ করে লুচি, পোলাও, মাছ, মাংস, শাকভাজা, বেগুনভাজা থেকে চাটনি, মিষ্টি, রাবড়ি অবধি সাজিয়ে খাওয়াতে বসলেন ... সুতারা খাবারের স্তূপে হাত দিয়ে চারদিক চাচ্ছিল। খেতে হবে? হ্যাঁ, খেতে হবে। সে ছুটিও নিয়েছে। কিন্তু এরা সবাই তো বলছে চলে যেতে হবে। ন’টার মধ্যে। কাকে সে জবাব দেবে জানে না।’’ দেশভাগের যন্ত্রণার এই দিক গুলো ইতিহাসে গোপন থেকে যায় বা তাকে গুরুত্বহীন করে রাখা হয়। ব্যক্তিসত্ত্বার অস্তিত্ব কীভাবে প্রতি মুহুর্তে বিপর্যস্ত হয় সামাজিক নিঃশব্দ নিপীড়নের মাঝে তা আমরা বুঝতেই চাই না নিপীড়ন ব’লে। সেখানেই সাহিত্য এগিয়ে আসে । তার দর্পনে বিম্বিত হয় সে সব এড়িয়ে চলা কথা যা খুব নীরবে রক্তাক্ত করে ব্যক্তি মানুষের জীবন যা আসলে আর একা ব্যক্তি মানুষের যন্ত্রণা হয়ে থাকে না। সে হয়ে ওঠে না লেখা ইতিহাস। একটা সময়কাল। একটা সমাজের অন্ধকার দিক।

সুতারার বাড়ি থাকে না । তার পরীক্ষার ভাল ফল এ, বৃত্তি পাওয়াতে দাদারা, দিদির শ্বশুর সকলেই ভীষণ খুশি হয়। কিন্তু কেউ আর তাকে বাড়ি ফিরতে বলে না। তার ফেলে আসা দেশের থেকে ডাক আসে। তমিজ কাকা, আজিজ, সাকিনা, সাকিনার মা সবাই চান সুতারা এসে কিছুদিন থেকে যাক কারণ আর তো গোলমাল নেই। “ না, গোলমাল নেই। কিন্তু বলতে বলতেই কোথায় একটি কোন কোণে দপ করে একটা আগুন জ্বলে ওঠে।“ স্মৃতি আমাদের অস্তিত্ব নির্মাণ করে। তাকে তো মুছে ফেলা যায় না অতো সহজে। অন্তত যে আগুনের পথ পেরিয়েছে তার স্মৃতিতে রয়ে যায় সেই পথে ফেলে আসা অনেক কিছু, আপাত নিরীহ শান্ত জীবন তাকে ভুলতে দেয় না। কেউ কেউ বুঝে যায় তার ঘর আর তৈরি হওয়ার নয়। সুতারা বোঝে। দিল্লিতে অধ্যাপনা করতে গিয়েও বোঝে ঘর তার জুটবে না। “ আপাতত দাদাদের আর টাকা দিতে হবে না। এবং ভাবতেও হবে না তার কথা। তবে সে কি স্বাধীন হয়ে গেল? মেয়েরা কি স্বাধীন হয়? ...... অকারণে লাঞ্ছিতা, উৎপিড়ীতা, উপেক্ষিতা, পরিত্যক্তা নারীর সবকালের মেয়েদের প্রতিনিধি হয়ে উঠছে যেন সে মনে মনে।’’ – তাকে সাকিনার মা আহ্বান জানান, ফিরে গিয়ে মুসলমানের ঘরে ঘর বসাতেহয়ত নিজের ছেলে আজিজ এর কথাই ভেবেছিলেন তিনি। সুতারা সাড়া দিতে পারে না। সেই আগুনলাগা সন্ধ্যে সে ভুলতে পারে না। কিছু দেওয়াল কোথাও রয়ে যায় অদৃশ্য হয়ে আমাদের অবচেতনে। তাকে ভাঙতে কেটে যায় কয়েক শতাব্দীকাল। কিম্বা  তাকে ভাঙ্গাই হয়ে ওঠে না আর। আবার সেরকমই দেওয়াল একটু একটু করে ভাঙবার কালও আসে। হিন্দু স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারে দাপুটে গৃহিণীর বিপরীতে গিয়ে বিভার ভাই প্রমোদ মনঃস্থির করে সুতারাকে বিবাহ করার। সুতারার সঙ্গে দেখা করে সে প্রকাশ করে তার ইচ্ছা। সুতারার মনেও কোন আশা ছিল বোধহয় একটা ঘরের, নির্ভার নিশ্চিন্ত। সে চোখের জলে ভেসে জানতে চায় তাকে প্রমোদ করুণা করছে না তো। উপন্যাস শেষ হয় একটি মেয়ের সংসার গড়বার স্বপ্ন নিয়ে। “কিছু ভাববার ভরসা নেই। সহসা মনে হলো স্কুল-কলেজের অধ্যাপিকা সুতারা দত্ত আজ আর সে নয়। এ যেন আর একজন কে কিশোরী কোনো মেয়ের মতো কিসের স্বপ্ন দেখছে! তেমনি বারবার মনে কিসের ভয় হচ্ছে—যদি স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। তার চোখে জল আসে। সহসা মনে হলো শান্ত স্নিগ্ধ যে অন্ধকারটা তার ঘর ভরে ছড়িয়ে রয়েছে, সেটা একটা যেন কার চোখের গভীর দৃষ্টি। যে দৃষ্টি তাকে বলছে, ‘আমি তোমার ভার নিলাম সুতারা, তোমাকে নিলাম।’’

ইতিহাসের এক অন্ধকার সন্ধিক্ষণে উপন্যাসের শুরু। শুধু হিন্দু ক্যাম্প বা মুসলমান ক্যাম্পেই উদ্বাস্তু মেয়েরা ছিল না। তারা ছিল স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের চৌহদ্দিতেও। ছিল তাদের কাছের মানুষ, থাকবার মতো জায়গা। তবু যে তাদের কিছুই ছিল না—এ উপন্যাস তার এক দলিল। এমন বহু অত্যাচারিত মেয়ে আর জায়গা পানি পরিবারে, তাদের বিনা কোন দোষে। লড়াইয়ের মর্যাদা দূরে থাক, তাকে অপমান ও লাঞ্ছনার ভারে নুইয়ে দিতে কুণ্ঠিত ছিল না সমাজ। কারণ মেয়েদের শরীর- সে যে বড় পবিত্র জিনিস। সেই পবিত্রতার দায় মেয়েরা বইতে বইতে পেরোচ্ছে আজও সেই আগুনপথ। আর চল্লিশের দশক কেন, আজও মেয়েদের সার্থকতা যে মাতৃত্বে আর সংসারে, সেই ধারণার দ্বারা প্রবলভাবে চালিত হয় সমাজ।  তাই শত লাঞ্ছনার মধ্যেও সুতারা কে একটা সংসার দেওয়ার কথা ভোলেন নি ঔপন্যাসিক – সে আর্থিকভাবে সফল ও স্বনির্ভর হলেও।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন