কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩৭   




অনেকদিন পর আবার কলম ধরলাম। আসলে সিনেমার গলিত ধাতু নিয়ে কিছু লিখতে গেলে বাকি সব ভুলে সেই লেখার ভেতর পুরো ডুব মারতে হয়। দরজা বন্ধ রেখে, একাকীত্ব লালন করে, খাবারের থালা ‘স্টোন-কোল্ড’ বানিয়ে, দেওয়াল ঘড়ির ওপর চাদর ঢেকে মাঝরাত্তিরে সিনেমাগুলো আবার একে একে দেখতে হয় – যদি কোথাও ফাঁক রয়ে যায়, সেটা ভরাট করার জন্য। এবং তার জন্য অবশ্যই দরকার হয় কাজলদার মত এক দুঁদে সম্পাদকের যিনি প্রতি সপ্তায় একবার করে তাড়া মারবেন, লেখা কদ্দূর হল? সেই তাড়াটা মাঝে বেশ কিছুমাস না থাকার জন্য নিজের অ-লেখক সত্বাটা পেট্রলের দু’টাকা দাম কমার মত উপভোগ করেছি। তবে খারাপও লেগেছে যে কাজলদার মত এক দাদা ও সুহৃদ অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় পড়ে। অনেকদিন পর আবার কাজলদাকে সেই পুরনো সম্পাদক হিসেবে ফিরে পেয়ে এবং জীবনে আরেকবার সেই তাড়া ব্যাপারটা ফিরে আসার জন্য ভালই লাগছে।

যাইহোক, বেশি বকবক না করে লেখার প্রতিপাদ্যে ফেরা যাক। এবার দু’পর্বে আমরা ফিরে দেখতে চলেছি ইউরোপের শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের। টি-20 ক্রিকেটের মরশুম চলছে, সুতরাং ব্যাটার হিসেবে আমার কাজটা যে বেশ কঠিন সেটা বলাই বাহুল্য। এবং আমি কিন্তু পিচ দেখব না, সব সময় ধ্রুপদী খেলব না – লেখাটা দু’পর্বে শেষ করতে হবে, তাই আমার নির্বাচনেও মাঝে মাঝে ঝোড়ো শট দেখতে পাবেন, আগেই জানিয়ে রাখলাম।

আমি ইউরোপ থেকে মোট ১২টা নাম বাছব - ড্রেয়ার, ল্যাং, বুনুয়েল, অ্যান্তনিয়নি, বার্গম্যান, ফেলিনি, কিউব্রিক, গোদার, ত্রুফো, তারকোভস্কি, অ্যাঞ্জেলোপাউলোস ও হেনেকা। এবং আমার ১৩ নম্বর ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি (যদি বাছতে হয়): কুস্তুরিকা।

এদের মধ্যে আজ যাদের নিয়ে আমার আলোচনা, তারা - বুনুয়েল, অ্যান্তনিয়নি, বার্গম্যান, কিউব্রিক, ত্রুফো, তারকোভস্কি। সামনের পর্বে বাকিদের নিয়ে। ১২ জনের মধ্যে আজ এই ৬ জনকে কেন বাছলাম, একটু অপেক্ষা করুন, বুঝে যাবেন।

স্পেন/মেক্সিকোর পরিচালক লুই বুনুয়েল (১৯০০-১৯৮৩) মানেই সুররিয়েলিজম, সিম্বলিজম। আর তার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি। সঙ্গত কারণেই বুনুয়েলকে ব্ল্যাক কমেডির প্রা্ণপুরুষ বলা হয়ে থাকে। তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলোর লিস্টে রয়েছে – লস অলভিদাদোস (১৯৫০), রিহার্সাল ফর আ  ক্রাইম (১৯৫৫), ভিরিডিয়ানা (১৯৬১), এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল (১৯৬২), সাইমন অব দ্য ডেজার্ট (১৯৬৫), বেলে দে জুর (১৯৬৭), দ্য মিল্কি ওয়ে (১৯৬৯), ত্রিস্তানা (১৯৭০), ডিস্ক্রিট চার্ম অব বুর্জোয়া (১৯৭২), দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টি (১৯৭৪) ইত্যাদি। এই লেখার ৬ নম্বর পর্বে ‘এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল’ ও ১১ নম্বরে ‘ভিরিডিয়ানা’ নিয়ে লিখেছিলাম। ১২ নম্বর শুরু করেছিলাম বুনুয়েল আর দালির এক এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা দিয়ে - ‘আন চিয়েন আন্দালু’ (১৯২৯)। অর্থাৎ এক্সপেরিমেন্টাল বলুন বা আভাঁ-গার্ড বা আর্ট-হাউজ, বুনুয়েলের ছবি সব জায়গাতেই ফিট। এবং সিনেমা নিয়ে বিতর্কও ওনার পিছু ছাড়ে না। বুনুয়েলের ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমি কাফ্‌কার কোথাও যেন একটা মিল খুঁজে পাই। যাইহোক, বুনুয়েলের ছবি নিয়ে প্রাথমিকভাবে যা যা বলতে হয়, তা হল, ওনার ক্যামেরায় ডিপ ফোকাস এবং ছবির সঙ্গে মিউজিকের অদ্ভুত মিশ্রণ। এটাও বলা দরকার, বুনুয়েল ছিলেন খুব মিতব্যয়ি। প্রতি সিনের ডিটেলিং  করে রাখতেন, সেই ডিটেলিং থেকে নড়তেন না, যে যে শট নিতেন, তার প্রায় পুরোটাই ছবিতে ব্যবহার করতেন। এবং একেকটা ছবি উনি বড়জোড় এক মাসে শেষ করে দিতেন। এ বিষয়ে ওনার সঙ্গে হিচককের দুরন্ত মিল ছিল। আসলে ওনাকে সুররিয়েলিস্ট, আইকনোক্লাস্ট, প্রোভোকেচার, কনট্রারিয়ান, যাই বলা হোক না কেন, উনি আসলে ছিলেন একজন প্রতিবাদী। প্রতি ছবিতে নিজের মত করে সেই প্রতিবাদ ফুটিয়ে তুলেছেন। কোথাও গাঁটছড়া বাঁধেননি, দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরেছেন। ওনার নিজের ভাষায়, ‘In a world as badly made as ours, there is only one road - rebellion’।

ইতালির পরিচালকদের ভেতর বেশ কয়েকজন এই লিস্টে আসতে পারেন, কিন্তু মাইকেলেঞ্জেলো অ্যান্তনিয়নি (১৯১২-২০০৭)-কে আমি প্রথমেই রাখব ওনার ‘ধাঁধাঁর চেয়েও জটিল তুমি, খিদের চেয়েও স্পষ্ট’ টাইপ থিম এবং অনবদ্য ভিসুয়াল কম্পোজিশনের জন্য। মোট ১৬টা ছায়াছবি বানিয়েছেন, তার মধ্যে বিখ্যাত - দ্য অ্যাডভেঞ্চার (১৯৬০), দ্য নাইট (১৯৬১), দ্য একলিপ্স (১৯৬২), রেড ডেজার্ট (১৯৬৪), ব্লো-আপ (১৯৬৬), দ্য প্যাসেঞ্জার (১৯৭৫), আইডেন্টিফিকেশন অফ আ ওম্যান (১৯৮২)। ওনার ‘রেড ডেজার্ট' নিয়ে আমি ইতিমধ্যেই ১৩ নং পর্বে আলোচনা করেছিলাম। সেই ভিসুয়াল কম্পোজিশন। কারখানার শব্দ, ধূলো-ধোঁয়া, দূষণ আর নোংরা হয়ে যাওয়া নদীগর্ভ থেকে পুরো লাল সেলুলয়েড – সেখান থেকে উঠে আসছে নব্য-বাস্তবতার আরেক সংজ্ঞা। কিন্তু মজার ব্যাপার, শিল্পায়ন কিভাবে প্রকৃতিকে নষ্ট করছে, তা দেখানোর জন্য অ্যান্তনিয়নি এই সিনেমা বানাননি। উনি কল কারখানার ভেতর দিয়ে গদ্যময় পৃথিবী কিভাবে দর্শকের চোখে পদ্যময় করে তোলা যায়, সেই চেষ্টা করেছেন। ওনার কথায় ‘my intention was to translate the poetry of the world, in which even factories can be beautiful. The line and curves of factories and their chimneys can be more beautiful than the outline of trees, which we are already too accustomed to seeing’। আরো বলেছেন যে উনি এই সিনেমায় রং ও ক্যানভাসের যে সম্পর্ক আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, সেইমত প্রতি সিন একে একে উঠে এসেছে। পুরোটাই ধাঁধাঁর মত। বাইরে দেখছেন এক, ভেতরে দেখানো হচ্ছে আরেক। অন্য ছবিগুলোও দেখুন, প্রায় প্রত্যেক ছবিতেই কোন না কোন ব্যক্তিগত রহস্য, যা সমাধান করতে না পেরে চরিত্রেরা চলে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে, উধাও হয়ে যাচ্ছে, ভেঙ্গে পড়ছে। এবং ওনার ছবির আরেক বিশেষত্ব স্পেসের বিমূর্ততা। দ্য অ্যাডভেঞ্চার, দ্য নাইট, দ্য একলিপ্স, রেড ডেজার্ট, ব্লো-আপ – আপনি মন দিয়ে দেখলে বুঝবেন থ্রি-ডাইমেনশনাল স্পেস কিভাবে ফ্রেম থেকে ফ্রেমে বিমূর্ততা তৈরি করতে পারে। Senses of Cinema পত্রিকা ওনার ছবি সম্বন্ধে এক অনবদ্য ছোট্ট উক্তি করেছিল – ‘aesthetically complex, critically stimulating though elusive in meaning’। তাহলে?

পাঠক, যদি মনে থাকে, এই লেখার ১২তম কিস্তিতে বলেছিলাম, আমার চোখে আর্ট-হাউজ সিনেমার উজ্জ্বলতম পরিচালক সুইডেনের ইংমার বার্গম্যান ও ব্রিটেনের স্ট্যানলি কিউব্রিক। আমি আজো সেই কথায় এঁটে আছি, এবং এটাও বলব, এই লেখার ১২নং পর্বটা আরেকবার ঝালিয়ে নেবেন, ওখানে নব্য বাস্তবতার ভিত কিভাবে আর্ট-হাউজ থেকে এল, সেই নিয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য সিনেমার আলোচনা আছে। যাইহোক, ইংমার বার্গম্যান (১৯১৮-২০০৭) অনেক ছবি বানিয়েছেন, যার মধ্যে আমি বলব – সামার উইথ মনিকা (১৯৫৩), সেভেন্থ সিল (১৯৫৭), ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ (১৯৫৭), দ্য ভার্জিন স্প্রিং (১৯৬০), থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি (১৯৬১), পারসোনা (১৯৬৬), শেম (১৯৬৮), ক্রাইজ অ্যান্ড হুইস্পারস (১৯৭২), সিনস ফ্রম আ ম্যারেজ (১৯৭৪), অটাম সোনাটা (১৯৭৮), ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেক্সান্ডার (১৯৮২) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ওনার সিনেমাকে তকমা দেওয়া হয়েছে ‘profoundly personal meditations into the myriad struggles facing the psyche and the soul’ হিসেবে, আর ঠিক এখানেই একজন সমালোচক হিসেবে আমি আঠার মত আটকে যাই। এই ব্যাপারটা আমি আর কোনো পরিচালকের মধ্যে আজো পাইনি। যাইহোক, ওনাকে নিয়ে আজ বেশি কিছু আমার বলার নেই কারণ বিশদ আলোচনা আমি  ইতিমধ্যেই ২৮ নং পর্বে করেছি। হ্যাঁ, এটাই বলার, যতদিন না ওনার থেকেও গভীর মনস্তাত্ত্বিক কোনো পরিচালকের সিনেমা পাব, ততদিন আমার এক নম্বর ভোট ওনার দিকেই যাবে।

স্ট্যানলি কিউব্রিক (১৯২৮-১৯৯৯) আমেরিকা ছেড়ে ব্রিটেনে আসার পর যে যে মনে রাখার মত ছবি বানিয়েছেন - লোলিটা (১৯৬২), ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ (১৯৬৪), 2001: এ স্পেস ওডেসি (১৯৬৮), এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ (১৯৭১), ব্যারি লিন্ডন (১৯৭৫), দ্য শাইনিং (১৯৮০), আইজ ওয়াইড শাট (১৯৯৯)। কিউব্রিককে নিয়ে কিছু বলার আগে কিলার্স কিস (১৯৫৫) থেকে এক ছোট্ট ডায়লগ দিয়ে শুরু করি। যুবক-যুবতী। ‘Something’s happened. Do you know?’ ‘Yes, you kissed me.’ ‘Is that all?’ ‘That’s all I saw and I was watching all the time’। এখান থেকে ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ। অ্যালেক্সের সঙ্গে মন্ত্রী আর গার্ডের কথা। ‘What crime did you commit?’ ‘The accidental killing of a person, sir.’ ‘He brutally murdered a woman, sir, in furtherence of theft. Fourteen years, sir!’ ‘Excellent. He’s enterprising, aggressive, outgoing, young, bold, vicious. He’ll do.’। এখান থেকে কিউব্রিকের শেষ ছবি, আইজ ওয়াইড শাট। সাধারণ মুডে স্বামী-স্ত্রীর কথা। ‘But you know,  there’s one thing we need to do as soon as possible.’ ‘What’s that?’ ‘Fuck.’। এই হল কিউব্রিক। বিতর্ক যার সঙ্গী। তবুও অনবদ্য যার স্যাটায়ার। ধরতে না পারলে যা অবধারিত মাথার ওপর দিয়ে যাবে। এবং এর উল্টোদিকে 2001: এ স্পেস ওডেসি দেখুন। ব্রিটেন নিয়ে আলোচনার সময় আমি ইতিমধ্যেই এই মাস্টারপিস নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি। এক মনোলিথ দিয়ে শুরু, আরেক মনোলিথে শেষ। মাঝে ছত্রে ছত্রে বুদ্ধি আর সূক্ষ্মভাবে মানবসভ্যতা নিয়ে হতাশা। এখানেই কিউব্রিকিজম। ওনার নিজের ভাষায়, ‘you’re free to speculate as you wish about the philosophical and allegorical meaning of the film’। বোধহয় সব ছবির জন্যই সত্যি। শেষ ছবি বানানোর কয়েক সপ্তার মধ্যেই মারা গেছিলেন, নইলে আমার ইচ্ছে ছিল জিজ্ঞেস করতাম, মানসভ্রমণে এত সেক্সুয়ালিটি কেন?

যেদিন ফ্রান্স নিয়ে লিখেছিলাম, সেদিন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো (১৯৩২-১৯৮৪)-র একটা ছবি আমাদের আলোচনায় এসেছিল। 400 ব্লোজ। দর্শকরা জানেন, এই ছবি অন্য কারো নয়, ত্রুফোর নিজের কৈশোর। বলা হয়, বয়ঃসন্ধির এক কিশোরের মনস্তত্ব দেখাতে গিয়ে ত্রুফো এখানে নিজের মনস্তত্ব দেখিয়েছিলেন। নিজের বাবা অজ্ঞাত, সৎ-বাবা দয়া করে নিজের পদবী ব্যবহার করতে দিয়েছেন। কিন্তু ঐ অব্ধি। সৎ-বাবা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। দিদার কাছে মানুষ হতে হয়। সেদিনের জেলে বসে থাকা সেই কিশোর একদিন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো হয়ে ওঠেন শুধু সিনেমার প্রতি ভালবাসার জন্য। সমালোচক হিসেবে বিভিন্ন নামকরা পত্রিকায় লিখেছেন, ফ্রান্সের সৈন্যদলে নাম লিখিয়েছেন, ভাল লাগেনি বলে পালিয়ে আসতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল খেটেছেন, তারপর শ্বশুরের থেকে কিছু টাকা নিয়ে বানিয়েছেন 400 ব্লোজ। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। ওনার নামকরা ছবিগুলো মোটামুটিভাবে - 400 ব্লোজ (১৯৫৯), জুলস অ্যান্ড জিম (১৯৬২), অ্যান্টোইন অ্যান্ড কোলেট (১৯৬২), দ্য সফট্‌ স্কিন (১৯৬৪), ফারেনহিট 451 (১৯৬৬), স্টোলেন কিসেস (১৯৬৮), বেড অ্যান্ড বোর্ড (১৯৭০), টু ইংলিশ গার্লস (১৯৭১), ডে ফর নাইট (১৯৭৩), লাভ অন দ্য রান (১৯৭৯), দ্য লাস্ট মেট্রো (১৯৮০), দ্য ওম্যান নেক্সট ডোর (১৯৮১) ও কনফিডেন্সিয়ালি ইয়োরস (১৯৮৩)। ওনার বেশ কিছু সিনেমার চরিত্র অ্যান্টোইন যে উনি নিজে, সেটাও আমরা পরবর্তীকালে বুঝতে পারি। কিন্তু এইসমস্ত ছবির এক সাধারণ যোগসূত্র আছে – শৈশবের  উপস্থিতি। কেন, নিশ্চয় বলে দিতে হবে না! এবং ওনার সেরা সিনেমা, আমার মতে, ফারেনহিট 451, নিশ্চয় প্রাচীন বেদের জ্ঞান ঘেঁটে তৈরি হয়েছিল। এক ভবিষ্যত সমাজ, বই যেখানে নিষিদ্ধ - পুড়িয়ে ফেলা হয়, একেক প্রতিবাদী চরিত্র হয়ে উঠছে একেক বই। তারা একেকটা বই মনে রেখে সেটা বাকিদের সামনে আউড়ে চলেছে যাতে সেই বই তার মধ্যে বেঁচে থাকে। ভাবুন তো, ৩৫০০ বছর আগে, যখন ঋগ্বেদ তৈরি হয়েছিল, লেখা হত না, শুধু শ্রুতির মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ত। আবার দেখুন, ত্রুফোর পরের দিকের তৈরি ছবিতে, দ্য লাস্ট মেট্রো, নাৎসি অধ্যুষিত প্যারিসে এক অভিনেত্রী তার ইহুদী স্বামীকে থিয়েটারের নিচে লুকিয়ে রেখেছে। এবং রোজ সেই থিয়েটারে যাত্রাপালা হচ্ছে যাতে কেউ বুঝতে না পারে। কি অদ্ভুত জীবন ও শিল্পের প্রতি ভালবাসা। এবং পুরোটাই একেক প্রতিবাদী চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। সত্যজিৎ যে বলেছিলেন, সিনেমার কাজ হল সেলুলয়েডে জীবন ফুটিয়ে তোলা, সেটা আক্ষরিকভাবে বুঝতে গেলে ত্রুফোর ছবি দেখতে হবে, অনুভব করতে হবে। ক্যামেরাকে পেন হিসেবে ধরতে হবে। জীবন থেকে পালিয়েও কিভাবে জীবন ভালবাসা যায়, বুঝতে হবে। ত্রুফো মারা যাবার পর এক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘a director who, more than loving cinema, represented it. He was cinema. He was Francois Truffaut.’। সত্যিই, যথার্থ।

আন্দ্রেই তারকোভস্কি (১৯৩২-১৯৮৬) ঠিক সাতখানা পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা বানিয়েছেন, প্রথম পাঁচটা রাশিয়ায়, শেষ দুটো দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর। ইভান’স চাইল্ডহুড (১৯৬২), আন্দ্রেই রুবলেভ (১৯৬৬), সোলারিস (১৯৭২), মিরর (১৯৭৫), স্টকার (১৯৭৭), নস্টালজিয়া (১৯৮৩) ও দ্য স্যাক্রিফাইস (১৯৮৬)। সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যাচার সহ্য করেছেন, তবুও প্রতি সিনেমায় সাহসের স্বাক্ষর রেখেছেন। মস্কো ফিল্ম স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশনের সময় প্রথম যে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বানিয়েছিলেন, দ্য স্টিমরোলার অ্যান্ড দ্য ভায়োলিন (১৯৬০), তার থেকেই বোঝা গেছিল ভবিষ্যতে উনি কি ধরনের ছবি বানাতে চলেছেন। প্রতি ফ্রেমে কি করে সময়কে বন্দী বানানো যায়, সেই এক্সপেরিমেন্ট। যে কোন চরিত্রের আশেপাশে প্রকৃতির ফুটে ওঠা, বিশেষ করে মাটি, হাওয়া, আগুন আর জল নিয়ে তৈরি প্রকৃতি, তারকোভস্কির ছবির প্রথম ও প্রধান শর্ত। মানুষের পাশাপাশি জন্তু (প্রায়শই কুকুর) অনেকটা যেন ধাঁধাঁর মত চলে আসে। কোন প্লট নয়, বরং একেক ফ্রেমে তাৎক্ষণিক মুহূর্ত থেকে তৈরি হওয়া সিদ্ধান্ত দিয়ে সিনেমা এগিয়ে নিয়ে চলা, গদ্যময় পৃথিবীকে ওপরের উপাদান দিয়ে পদ্যময় করে তোলা – অনেকটা যেন অ্যান্তনিয়নিকে মনে পড়িয়ে দেয়।

প্রতি ফ্রেমে প্রা্ণবন্ত ছবি ছাড়াও তারকোভস্কির ক্যামেরার কাজের আলাদা করে তারিফ করতেই হয়। অভিনেতাদের ঠিক মুখের সামনে ক্যামেরা রেখে আস্তে আস্তে মুভমেন্ট, একটা ক্ষয়ে আসা ল্যান্ডস্কেপের সামনে ক্যামেরার ধীরগতি – সময়কে আপনা থেকেই থামিয়ে দেয়। লক্ষ্য করার বিষয়, উনি প্রায় প্রতি সিনেমায় লোকেশন হিসেবে বেছে নিয়েছেন গ্রাম্য ক্ষয়িষ্ণু পটভূমি। একটা সিনের ডিটেল বোঝাতে ত্রুফো যেমন ক্যামেরা আস্তে আস্তে জুম করে হঠাৎ ফ্রিজ করে দিতেন, তারকোভস্কি খুব ধীরে ধীরে ফ্রেমের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত অব্ধি ক্যামেরাটা চালু রাখতেন। ফলে পাসোলিনির মত ওনার ক্যামেরাতেও অদ্ভুত অদ্ভুত পোট্রেট ফুটে উঠত, দর্শকদের নিজের মত করে ভাবাতে বাধ্য করত। ওনার দুটো কল্পবিজ্ঞানের ছবি, সোলারিস আর স্টকার, ভাল করে দেখুন। বুঝবেন দুটোই আত্ম-সমীক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে। অনেকে যদিও সোলারিস-কে কিউব্রিকের স্পেস ওডেসির সঙ্গে তুলনা করেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বলব, সেটা ভুল। কারণ কিউব্রিকের স্যাটায়ার তারকোভস্কিতে নেই, আবার তারকোভস্কির  ফ্রেমের মাধ্যমে সময়কে সীমাহীন করার চেষ্টা কিউব্রিকে নেই। এরা সবাই আলাদা, নিজের মত, দলছুট। উদাহরণ হিসেবে তারকোভস্কির মিরর হাতের সামনে রাখুন। অটোবায়োগ্রাফি, কিন্তু প্রায় কবিতার মত,  স্ট্রিম অব কনসাসনেস দিয়ে সাজানো। মনে করে দেখুন, যেদিন রাশিয়ার ছবি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, এই ছবিকে আমার লিস্টে রেখেছিলাম। বলেছিলাম, নন-লিনিয়ার ন্যারেশন, ক্যামেরার কাজ। কালার, সাদা-কালো ও সেপিয়া, এই তিন ধরনের রং নিয়ে পরিচালক ফ্রেম থেকে ফ্রেমে খেলা করেছেন। আবার একই ব্যক্তিকে দিয়ে বিভিন্ন চরিত্র ফুটিয়েছেন। মানুষ আর পাশে সীমাহীন প্রকৃতি, এই ফ্রেমটা নিয়ে খেলতে খেলতেই তারকোভস্কি ছবি তৈরি করেছেন। ফলে আবহে বিঠোফেনের ‘ওড টু জয়’ বাজাই স্বাভাবিক, তাই না?

ওপরের প্রত্যেকেই দলছুট হয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করেছেন, এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে সিনেমাকে নিজের মত করে এক নতুন ভাষা দিতে চেয়েছেন, ক্যামেরার লেন্সটা দর্শকের চোখের সামনে না রেখে মাথার মাঝামাঝি রেখে দিয়েছেন, ভাবতে শিখিয়েছেন। ধ্রুপদ ও আর্ট-হাউজ সংজ্ঞা দুটো নিজের মত করে ভেঙেচুরে সাজিয়ে নিয়েছেন। তাই আজ এই ছ’জন। বাকিরা সামনের পর্বে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন