কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২১

সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

সুকান্ত পাল

 

সমকালীন ছোটগল্প


ঝুলন


দমদম স্টেশন থেকে অটোতে নাগের বাজারে রাত দশটায় এসে দেখি এয়ারপোর্টের অটো বন্ধ। কী কারণে যেন তাদের ধর্মঘট চলছে। বাস আছে অনেক। তেমন সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু মনে হলো এমনিতেই হাঁটা হয় না, তার মধ্যে এই গরমকালের রাতে মৃদু হাওয়া বইছে। বেশ ভালো লাগছিল। তাই ভাবলাম হেঁটে এইচ,এম,ভি গেট খুব জোর হলে মিনিট কুড়ির হাঁটাপথ। এমন কিছু নয়। তাই হাঁটা লাগালাম।

কাজীপাড়ার মোড় থেকে রাস্তার ফুটপাত জুড়ে সমাজের, দেশের উদ্বৃত্ত মানুষরা শুয়ে রয়েছে। পুরুষ, নারী, শিশু সবাই কেমন ওলোট পালোট ভাবে ঘুমিয়ে আছে। কোথায়ও ঘুমন্ত নারীর চিমসে উন্মুক্ত স্তনের বোঁটায় ঘুমন্ত শিশুর মুখে। কয়েকজন পুরুষের লুঙ্গি প্রায় বিপদ সীমা ছুঁয়ে উঠে আছে। একটু জোরে হাওয়া দিলেই হলো। কেউ কেউ তখনও সজাগ, আবার কোথায়ও এই গরমেও একটা চাদরের তলায় দু’দুটি শরীর অস্থিরভাবে লেপ্টে আছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, পৃথিবীতে আরো একটি পবিত্র প্রাণের আগমনের উৎসব চলছে।

ফুটপাতে এরকম ঘুমন্ত মানুষের বেড়া ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আর মনের মাঝে হাজার প্রশ্নের সাথে সাথে নিজেকেও কেন যেন দোষী সাব্যস্ত করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমার মন কি ভারাক্রান্ত? উত্তর আমার নিজেরও জানা নেই। না, কোনো দার্শনিক চিন্তার জালেও নিজের মগজ স্থিত নয়। তবুও এক ব্যাখ্যাহীন মানসিকতা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে সেন্ট্রাল জেল স্টপেজ পার করে অর্ডিন্যান্স কোম্পানির কাছে চলে এসেছি খেয়াল নেই। হঠাৎই একটা বিরাটী যাওয়ার ফাঁকা বাস আমার সামনে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। কন্ডাকটার চিৎকার করে বলল, দাদা যাবেন নাকি?

-- না, এই তো এসে গেছি।

আমার উত্তর শুনে কন্ডাকটার তার স্বাভাবিক ভাষায় একটা অতি তুচ্ছ গালাগাল দিয়ে ঘন্টি নাড়ল। বাস এগিয়ে গেল।

বুঝলাম ড্রাইভার থেকে শুরু করে কন্ডাকটার সবারই একটা দায়বদ্ধতার জায়গা আছে।‌ সেই জায়গা থেকেই ওরা আমার জন্য বাস থামিয়ে ছিল। ফলে কন্ডাকটারের বাক্যবান আমাকে এতটুকু আহত তো করলই না, উল্টে ওর প্রতি আমার কেমন যেন একটা মায়া হলো।

এইসব কথা ভাবতে ভাবতে কিছুটা এগিয়ে কঙ্কালসার জেসপ কোম্পানির গেটের কাছে আসতেই রাস্তার বড়ো বড়ো নিয়ন বাতির আলোয় চোখ পড়ল এক কালের নামকরা জমজমাট এবং বর্তমানে বন্ধ হয়ে যাওয়া জেসপ কোম্পানির ভিতরের প্রচুর জঙ্গলের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়ানো বেশ কয়েকটা দেবদারু, তেঁতুল, মহুয়া গাছের দিকে। বৈশাখের প্রথম দিক। বসন্ত চলে গেছে কয়েক দিন হলো। গাছে গাছে কচি পাতাগুলো রাতের বৈশাখী হাওয়ার সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। মহুয়া গাছের ডালের প্রায় প্রতিটি ডগায় কালো মতো অসংখ্য থলি ঝুলে রয়েছে। আমার পা থেমে গেল। ভালো করে দেখে বুঝতে পারলাম,  সারাদিনের খাবার অন্বেষণের কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে ঝুলে রয়েছে বাদুড়ের দল।‌‌ সবাই প্রায় নিশ্চুপ। দু একটি বাদুড় সামন্য নড়াচড়া করছে। হয়তো আড়মোড়া ভাঙছে। ঐ দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হলো গাছে ঝুলছে বাদুড় আর ফুটপাতে জীবনকে আঁকড়ে ঝুলে রয়েছে মানুষের দল। তুলনাটা মাথায় আসতেই মনে হলো আজ দুপুরে এসপ্লানেডে একটা জরুরি কাজে গিয়ে অন্তত চার চারটি রাজনৈতিক দলের মিছিলের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ফলে ফিরতে দেরি হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে সবাই সুবিধা মতো কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের লেজ ধরে ঝুলে রয়েছে। এই ঝুলে থাকাটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক, তালেবর ভিত্তিক। এই ঝুলে থাকাটা বোধহয় ভীষণ জরুরি!

হঠাৎই বুক পকেটে ফোনটা বেজে উঠল।

-- হ্যালো।

-- তুমি কোথায়? এতো দেরি কেন?

-- এসে গেছি। বলে ফোনটা কেটে দিলাম।

আমিও যে কোথায়ও না কোথায়ও ঝুলছি বুঝতে অসুবিধা হয় না। এই মায়াবী ঝুলনের খেলা যে সর্বজনীন!

 


1 কমেন্টস্: