কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৬


'সুদিন, কাছে এসো'

 

এমন বাড়ি এখন বিলুপ্ত প্রায়। কাঠের ছোট একটা গেট খুলে লাল রঙের বারান্দা। বারান্দা লাগোয়া বসার ঘর। ঘরে একটা কাঠের কারুকাজ করা সোফা। গোটা চারেক নীচু মোড়া। কোণের দিকে একটা স্প্যানিশ গিটার। দেওয়ালে অসংখ্য ফ্রেম করা ছবি। আয়তাকার, বর্গাকার।এক যুবক আর এক যুবতীর যুগল ছবিই সব। মধ্যে একটি সবথেকে বড়ো মাপের ছবি, দুই মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা এবং যুবতীটি।

ঘর পেরিয়ে খাবার ঘর। সেখানে একটা খাওয়ার টেবিল। পাশেই শোওয়ার ঘর। সেগুন কাঠের খাট। একটা আলমারি, সেটি বাদাম কাঠের। বইয়ের আলমারিও আছে একটা। তার ওপর ছোট একটা টিভি। তুলিকা  একটু পরেই মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবু, তার মুখে হালকা অপার্থিব হাসি।

‘আর নেওয়া যাচ্ছে না অমলেন্দু! রাগ কোরো না। তুমি বলেছিলে, বদলটা মেনে নিতে শেখো। শিখে উঠতে পারলাম না’।

এসব তুলিকা নিজের মনেই বলে।

এরপর উঠে রান্নাঘরে যায়। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডাদুধ নেয়। কয়েক টুকরো বরফ। ছোট বাটিতে গরম জল করে। কফি আর সামান্য চিনি মেশায়। লম্বা কফিকাপে সব মিশিয়ে বাইরের ঘরে যায়। ঠাণ্ডা কফিতে চুমুক দিতে দিতে ছবিগুলো দেখতে থাকে।

মধ্যের ছবিটার কাছে স্থির হয়।

‘মা, অমলেন্দু কিন্তু টগবগে দুরন্ত এক যুবক ছিল মা। হারতে শেখেনি। আমাকে জিতে নেওয়ার কী উন্মাদনা ছিল, ভাবো!’

ছবির মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলার মুখের মৃদু হাসিটা কেমন যেন বিদ্রুপের হাসি। তুলিকা সেনের তাই মনে হয়।

‘বাবা, বাবা, বাবা আজ আসছি তোমার কাছে। তুমি কী যে ভালোবাসতে অমলেন্দুকে! কেমন ভরাট গলায় বলতে, ‘ইয়ংম্যান, তোমার নাম অমলেন্দু কেন? অমলকান্তি নয় কেন?’’

বাবার ছবিটা সবসময় বিষণ্ণ কেন লাগে তুলিকার!

‘অমলেন্দু, অমলকান্তি, অমল। আজ নির্বাচনের রেজাল্ট বের হয়েছে। তোমাকে দেখলাম টিভিতে। কেমন ধীরে ধীরে মোটা হয়ে যাচ্ছ। কত ফর্সা হয়ে গেছ। গালে জল পড়লে পিছলে যাবে, এতো মসৃণ। আবিরমাখা মুখ। আবিরের রঙটা কী ছিল বলো তো? কী যে ছিল! এতোগুলো তোমার আমার ছবি। দ্যাখো, সূর্যর লালরঙ, সমুদ্রের নীলরঙ, পাহাড়ের সবুজরঙ, বালির সোনালীরঙ, ঝর্ণার সাদারঙ কেমন আমাদের সব ছবিতে উজ্জ্বল, ঝকঝকে। শুধু তোমার আজকের আবিরের রঙটাই মনে করতে পারছি না’।

তুলিকার কফি শেষ হল। দিন বদলের ভাবনাটা তার মন থেকে বদল আর ইহজীবনে হল না। সব বদলে যাচ্ছে। সবাই বদলে যাচ্ছে। আর নিতে পারছে না তুলিকা। অমলেন্দু ব্লেড দিয়ে দাড়ি কাটত। তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ও কয়েক প্যাকেট ব্লেড বাথরুমে রয়ে গেছে। শ্লথ পায়ে দরজা থেকে বের হতে গিয়েই পিছন থেকে হঠাৎ গিটারের সুর শুনতে পেল। অমলেন্দু সোফার ওপর বসে গাইছে, ‘সুদিন কাছে এসো/ ভালোবাসি একসাথে সবকিছু’ গাইতে গাইতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার দিকে। দীঘল চোখের সরল মুখের অমলকান্তি।

তুলিকা ফিরে আসে ছবিগুলোর সামনে। ভেঙে পড়ে নিঃশব্দ আকুলতায়। তুলিকাই রোদ্দুর হবে। হবেই।

মায়ের হাসিটা আর বিদ্রুপ মনে হচ্ছে না! বাবার মুখটা কেমন ভরসার!


1 কমেন্টস্:

  1. গোগ্রাসে পড়ে নিলাম। আবিরের রঙ বদলের জায়গাটা যে কী গভীর অর্থবহ সত্য বন্নন। লেখার কথা কি বলি আর? তবেই পাঠক কিন্ত টুক করে সাথে কোল্ড কফির রেসিপি জেনে নিল😊😊

    উত্তরমুছুন