সমকালীন ছোটগল্প |
চোর
বছর শুরুর প্রথম উইক-এন্ড। জীবনের
মনে আজ খুব ফূর্তি। এই শনি আর রবি মিলে ও অন্তত ৫০টা মানিব্যাগ আনতে পেরেছে। বেশিরভাগ
হয় সদরঘাট পিকনিক স্পট থেকে অথবা রমনাবাগান চিড়িয়াখানা থেকে অথবা ইদিলপুর দামোদরের
বালিয়াড়ি থেকে। অবশ্য একটা আছে সদরঘাট ব্রীজের মাথা থেকে। একজন লোক উদাস চোখে ডুবন্ত
সূর্যের দিকে তাকিয়েছিল – চশমা, কাঁচাপাকা দাড়ি, ফর্সা, মাথায় টাক, ডেনিম ব্লু শার্ট
আর ডেনিম ব্লু জিনস্। ভারী ট্রাকগুলো যাবার সময় ব্রীজ কেঁপে উঠলেও ওর কোন ভ্রুক্ষেপ
ছিল না। ফুটপাথে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেই নিয়েও না, সম্পূর্ণ উদাস কেউ একজন। ওর পকেট
থেকে মানিব্যাগটা মেরে মনে হয়েছিল, গ্রুপে মানিব্যাগ হাতানো সহজ, কিন্তু একা একটা লোকের
পকেট থেকে এভাবে টাকার ব্যাগ তুলে নেওয়া বাহাদুরি তো বটেই। সেজন্য স্পেশাল হিসেবে ঐ
মানিব্যাগটা আলাদা করে রাখা আছে।
জীবন পকেটমার। অপরের পকেট মেরে
ওর জীবিকা চলে। অবশ্য শুধু পকেটমার বললে ভুল বলা হবে। জীবন একজন শিল্পী। ওর বাপ ঠাকুর্দা
পটে ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করত। আজকাল সেইসব দিন আর নেই। তাই জীবন পটের ছবি আঁকতে
জানলেও বাধ্য হয়ে পকেটমার হয়েছে। পকেটমারিতে চুরি ডাকাতির মত রিস্ক নেই। ধরা পরে গেলেও
বেশি মার খেতে হয় না, বাবা মায়ের চিকিৎসা চলছে বলে কাঁদতে শুরু করলেই পাবলিক দয়াপরবশ
হয়ে ছেড়ে দেয়। যাইহোক, এতশত না ভেবে জীবন আজ একটু স্কচ খাবে। নতুন বছরের শুরুতে পকেটমারির
হাফ সেঞ্চুরি উৎসব পালন করবে। ছোটুকে কি ব্রান্ড আনতে দেবে, সেটাই ভাবনা চিন্তা চলছে।
এক পেগ বিপি আর কয়েকটা চিকেন পকোড়া।
‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’-এর সঙ্গে মুখে দিলে আমেজ আস্তে আস্তে কোথায় চড়বে, বোঝা যায়! একপাশে
ছোটু বসে ঐ ৫০টা মানিব্যাগের ভেতর থেকে টাকা বের করছে, এক জায়গায় জড়ো করে রাখছে, মানিব্যাগগুলো ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলছে।
জীবন দেখছে, ভাবলেশহীন, আবারো একে একে পেগ। বেসামাল হবার আগের মুহূর্তে জীবনের মনে
হল, ব্রীজের মাথার সেই লোকটার মানিব্যাগে কী আছে আজ দেখা দরকার। অতএব ওর আলাদা করে রাখা মানিব্যাগ টান মেরে নামানো হল।
দেখা যাক কী আছে ভেতরে। তারপর নাহয় উৎসব পালন করা যাবেখন। মানিব্যাগটা একটু অন্যরকম।
চামড়ার ট্যানটাও অদ্ভুত, আবার ওপরে একটা শিংওলা হরিনের জলছাপ। ভেতরে ফাঁকা, কিছু কয়েন,
দশ টাকার নোট আর একটা তুলট কাগজে হাতে লেখা চিঠি। ‘কি কঞ্জুস রে ভাই মালগুলো? কিছু
বড় নোট মানিব্যাগের মধ্যে রাখতে এদের কলজেয় কি ফোস্কা পড়ে?’ জীবন হাতের পেগ শেষ করে
চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করল।
*****
রাজরানী,
আমার রাজরানী,
শুধু আমার রাজরানী,
জানি না তোমায় পুরোপুরি আমার বলে
কবে ডাকব। কীভাবে। আদৌ তুমি শুধু আমার হবে কিনা। কাগজে কলমে কোন অধিকার নেই। অদৃশ্য ইথারের দাবি আছে, ভালবাসার, মন
চুম্বকের। দাবি আছে, আমার মত আর কেউ তোমায় ভালবাসেনি, বাসবেও না। সেই দাবি থেকেই পোস্টম্যান
বিহীন হেমন্তের এই আবছা চিঠি।
বছর শুরুতে জেদ ধরে মোবাইলের ওপারে
তোমার মুখ দেখে দিন শুরু করার পর মনে হল, তোমায় একটা এলোমেলো চিঠি লিখি। লোভ হল, তুমিও আমায় যদি একটা প্রেমপত্র
লেখো! সেই ২৫ বছর বয়সে কে যেন একটা প্রেমপত্র দিয়েছিল, তারপর আজ অব্ধি, এই চুল পাকা
আধা টাক, মাইরি বলছি, আর একটাও পাইনি। প্রপোজাল পেয়েছি, প্রেমপত্র না। আজ হঠাৎ কে
যেন নাড়া দিল - আমার রাজরানী, কই, আমায় তো আজ অব্ধি চিঠি লিখল না! আমিও কি লিখেছি?
মুঠোফোনের এপার ওপার। রোজ। শব্দের
চাদর, ইমোজি, রাগ, চুমু, গান, ছবি। গুগল কি হিসেব রেখেছে? কে জানে! কিন্তু কখনো সখনো
ভাললাগার মাঝে কোথাও একটা হালকা মন খারাপের ছোঁয়া রেখে যায়। কিছু স্মৃতি, কিছু মেদুরতা।
সদ্য ওল্টানো একপাতা আগে লেখা ঝোঁকা হওয়া কা আজ ভি...
ডিসেম্বরের ২১ থেকে ২৩, তিনটে মেদুর
বিকেল। দুটো মন আর দুটো শরীর পাশাপাশি। রাজা আর রাজরানী। মাঝের ফাঁকটা সেই ২০২১ থেকে
কমতে কমতে এখন মনে হয় শূন্য। শুধু বয়স ধাপে ধাপে। এমনকি বুলিয়ান সেটটাও বুঝিনি।
ওয়ান প্লাস ওয়ান= টেন। বুঝলাম যখন তোমার চুলের গন্ধটা হঠাৎ ডিসেম্বর ২৪ থেকে মিস
করতে শুরু করলাম। মাথায় বুলিয়ে দেবার একটা হাত মিস করতে শুরু করলাম। গোলাপের পাপড়ির
মত দুটো ঠোঁট, যেখানে চুমু খাবার পর, তোমার দিব্যি, পৃথিবীর সব নেশা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে
করে। যে ভরাট বুকের উপত্যকায় মুখ রেখে জড়িয়ে মৃগনাভির গন্ধে আচ্ছন্ন আমার দিনদুপুর,
আমার আশ্রয়, বুঝলাম নেই। পরের এক সপ্তাহ, আমার মন খারাপের এক সপ্তাহ, তোমায় না পাওয়া
আমার অস্থির এক সপ্তাহ, আশা করেছিলাম তুমি একবার এসে আমায় বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরবে,
বলবে, এই তো তোমার রাজরানী। বলনি।
তবুও ইচ্ছে হয়, তোমায় দিয়ে রোজ
সকাল হোক, তোমায় জড়িয়ে রাত আসুক। মাঝের ২৪x৬০x৬০ আর কেউ না, একমাত্র তুমি। ভাললাগা
কিছু বই, যেগুলো তোমায় দুহাতে বেড় দিয়ে পড়ে শোনাব। সঙ্গে রবিঠাকুরের কয়েক লাইন...
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা, তুমি আমারি তুমি আমারি...।
মা যখন মাঝে মাঝে বলে, তুই সাধু
হয়ে যা, তুই সংসার করতে পারবি না, সংসার তোর মত বোকা গাধার জন্য নয়, এজন্যই তোকে
ছেড়ে একে একে সবাই চলে গেছে... তখন ইচ্ছে হয় বলি, চেঁচিয়ে বলি, ভালোবেসেছি, খুব
ভালোবেসেছি রাজরানীকে, সেই ভালোবাসার কোন দাবি নেই? কিন্তু পারি না। আসলে, তুমি নিজেই
এখনো দোলাচলে, তাহলে দাবি কার কাছে করব? তুমি হেসে বলবে, কর্তব্য। আমি বলব, ফাঁকা মায়ার
টান। এও জানি, তোমার ছেলে তোমার বইপত্রের জায়গা ঘাঁটে, সেজন্য তুমি এই চিঠি সঙ্গে
রাখবে না। লুকিয়ে রাখার রিস্ক নেবে না। আমার এই এক ঘন্টা ধরে যত্নে লেখা চিঠিটাও কুচিয়ে
ছাদের ওপর হাওয়ায় ভাসিয়ে দেবে। আমার ছোট ছোট সেন্টিমেন্টগুলো তুমি ধরে রাখতে পারো
না। ফলে মায়ের কথার প্রতিবাদ করতে পারি না, চুপ হয়ে যাই।
আসলে কি জানো তো, লোভ। ফল্গুর মত
গোপনে বয়ে চলা এক লোভ। রাজরানীর সঙ্গে জীবনের বাকি দিনগুলো সংসার করার লোভ। যখন তুমি
চা পড়ে ফোস্কা হয়ে যাওয়া পায়ে আস্তে আস্তে ভোলিনি লাগিয়ে দাও, বুকের ফাইব্রোসিস
কতটা বাড়ল দেখার অছিলায় গাড়ির মধ্যে বুকে হাত বুলিয়ে দাও, দাড়ি কামাতে গিয়ে কেটে
যাওয়া ঠোঁটের নিচটা আলতো চুষে যত্নে বোরোলিন ঘষে দাও - ঐ লোভ আমায় পেয়ে বসে। জানি
না তুমি বিশ্বাস করবে কিনা, কিন্তু এভাবে কেউ কোনদিন রাজাকে দেখভাল করেনি। যে যে নারী
রাজার শরীরে হাত রেখেছে, তারা কেউ তোমার মত হৃদয় ছুঁতে পারেনি।
তিন বছর ধরে একটা গান মাঝে মাঝে
মনে আসে, হারিয়ে যায়। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে তোমায় পাইনি, বাহির পানে
চেয়েছিলাম আমার হৃদয় পানে চাইনি ... এবার হৃদয় পানে চেয়েছি, সত্যি বলছি, হৃদয়
ছাড়া আর অন্য কোথাও তাকাই না, অন্য কিছু চাই না। কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন, সে যদি
বছরের পর বছরের অত্যাচারগুলো অসভ্যতাগুলো মেনে নিয়ে আজো মাদার ইন্ডিয়া হবে বলে আমার
অপছন্দের জায়গায় চেপে বসে থাকে, আমার দেওয়া স্বাধীনতার চাবি হেলায় ফিরিয়ে দেয়,
আজো রাজার দিকে চোখ তুলে চাইতে গিয়েও নামিয়ে নেয়, রাজার হাত দুটো জোর করে চেপে ধরতে
গিয়েও সরিয়ে নেয়, রাজার ভালবাসার দাবি দেখেও মৌন হয়ে যায় - তখন রাজা তার রাজ্যপাট
ছেড়ে, ইচ্ছে হয়, নির্বাসন ঢের ভাল। সেই যে গানটা, সুমনের গান... কবি যে কোন চুলোয়
যাবে কেউ জানে না কেউ জানে না, কবি যে কোন চুলোয় যাবে কেউ জানে না...
তুমি জানো, রাজরানী? এতগুলো বছর
পরেও, তুমি কি বোঝো না, রাজার জীবন মরন চাবিকাঠি শুধু তোমার বুকের মধ্যে লুকোনো আছে?
ইতি,
তোমার রাজা।
*****
চিঠিটা শেষ করার পর থেকে জীবনের
কপালে ভাঁজ পরে গেছে। এ তো চিঠি নয়, নিজের হৃদয় খুলে নিজের হাতে রেখে কারো প্রতি নিঃশেষে
আত্মসমর্পণ। কে এই রাজা? রাজরানী? জীবনের ভেতরের শিল্পী সত্ত্বা যেন আরো অস্থির। আরো বেসামাল। ও দেখতে পাচ্ছে চিঠির মধ্যে দিয়ে এক
রাজা যেন ভালবাসার পট এঁকেছে। এই চিঠি তো ফিরিয়ে দিতে হবে, যার জিনিষ, তাকেই। নইলে
যে বিশাল বড় অপরাধ হয়ে যাবে। দুটো জীবন ওলট পালট হয়ে যেতে পারে। গোটা মানিব্যাগ ঐ
কটা জিনিষ ছাড়া ফাঁকা। কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর নেই। জীবন চোখ বুজে ভাবতে শুরু করে।
সেই ডেনিম শার্ট টেকো লোকটার স্পষ্ট মুখ ওর আজ খুব দরকার, খুব।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন