কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

দ্য ক্লাউড

 


(ত্রয়োদশ পর্ব)       

আগুনের দিকে ধাবিত যাত্রীগন দেশের সাধারণের কেউ না। তারা কোনদিনই গণতান্ত্রিক দেশের জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা এবং জনগণের-ই একমাত্র প্রণম্য হতে পারে না।

সেদিন বাবু দিঘির পাড় থেকে নিমচাঁদ দাগা তার নিজের বাড়িতে আদর করে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন প্রিয় বন্ধু ও স্বজন মনসুর আলিকে। সেদিন অনেক কথার মধ্যে উননিশো তেষট্টি / চৌষট্টি সাল, গুজরাটের গোধরা, এমনকি লম্বুর দোকানের সামনের সেই ভয়ঙ্করতম দিনটিও উঠে এসেছিলো তাদের কথাবার্তার মধ্যে। মনসুর বলেছিলো, আমি যে সরকারি বি টি কলেজে শিক্ষকতা করি, জানি না রে নিমচাঁদ, সেই কলেজের পড়ুয়াদের দাদু বা দাদু স্থানীয় মানুষদের কেউ কেউ আজকের এই শিক্ষককে সেদিন সংখ্যালঘু বলে পিটিয়ে অচৈতন্য করে রাজপথে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো কি-না! তবে তোর মতো সনাতনী বন্ধু না থাকলে আজ হয়তো বা আমার হিং ব্যবসায়ী দাদুর নাতি একজন শিক্ষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতোই না!

জাতীয় পতাকা মানে, পৃথিবী। জাতীয় পতাকা মানে, মা। জাতীয় পতাকা মানে, আত্ম অহমিকা। জাতীয় পতাকা মানে, স্বদেশপ্রেম। এসবই ছিলো দুই বন্ধুর মধ্যে সেদিনের কথোপকথন।

মনসুর বললো, আমি সেদিন তোদের দুজনকে বলেছিলাম, তোরা পালিয়ে যা। এরপরের জার্নিটা যদি বলিস আমাকে।

হ্যাঁ, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলাম। বিয়ে মানে দুই আত্মার মিলন। রেবেকা উযোয়ার ভালোবাসার বন্ধনে হয়ে গেলো রেবা। তবে রেবা কিন্তু পুরোপুরি দাগা হতে চেয়েছিল! আর তার জন্য যৎপরোনাস্তি চেষ্টাও চালিয়ে গিয়েছিল। এই যেমন আমাদের অয়েল মিলের জন্মদিনে পুজোর জোগাড় থেকে শুরু করে পুরোহিতের সাথে সহযোগিতা করা, ইত্যাদি কাজগুলো নিজের হাতে তুলে নিতে ওর যে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা!

মিলের এমনই এক জন্মদিনের দিন, রেবেকা যখন সকাল সকাল স্নান করে শুদ্ধ পট্টবস্ত্র পড়ে ডালি ভর্তি করে বাগানের ফুল নিয়ে আমাদের বাড়ির মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলো, ঠিক তখন-ই আমাদের দোতলা বাড়ির ছাদের একটা কর্নার থেকে লোহার একটি ভারি বস্তু এসে সরাসরি ওর মাথায় এসে পড়লো। এরপর…

মনসুর আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো, এরপর?

নিমচাঁদের সংযোজন - হাসপাতালের মর্গে আমি ওকে অনেক আদর করে বলেছিলাম, রেবেকা, আমরা হিন্দু হয়েছি। আমরা মুসলমান হয়েছি। কিন্তু আমরা আমাদের দেশের সংবিধানকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে সঠিক সনাতনী নাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি। রেবেকার কথামতো আমি ওর দেহ মেডিক্যাল কলেজে দান করে দিলাম।

ত্রিফলা নিম্নচাপ আকাশকে কুচকুচে কালো মাখিয়ে রেখেছে। এই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, তো আবারও রোদের চিকচিক ভাব। উৎপল চিত্রকর কবরস্থানে মৃতদের স্মরণ করলো। এই এক ওর ভাব। দিনের শুরুতে ও দিনশেষে ও এমনভাবেই যারা মৃতদেহ থেকে মাটি হয়ে গেছে, উৎপল তাদেরকে স্মরণ করে। আসলে সে ভারতের মাটিকেই স্মরণ করে। তাই উৎপলের কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে পার্থিব জগতের লোকেদের জীবনগাথা অনেকটাই মাটিমাখা। তাল তাল মাটি। মাটিতেই মিশে যাওয়া মানুষ, আবার কখনও বা মাটি থেকে তৈরি হওয়া নবজাতক - এ-সবই উৎপলের চিন্তার ফসল হিসেবে জীবন্ত বীজের থেকে অঙ্কুরিত হওয়া একটি দুটি পাতা গজানো গাছ হয়ে যায়।

অন্ধকার হয়ে গেলো। সন্ধ্যার আকাশের গিঁট ছিঁড়ে অপার্থিব দৃশ্যগুলো দামী বস্তুর মতো মাঝেমধ্যে জ্বলে উঠছে। এই আলো ভীষণ দুর্মূল্য। এই আলো রসনার জন্য কাজে লাগে।

মনিরত্না ভরদ্বাজ ফিরলো তার বর্তমানে। মাতৃহৃদয় উথলাচ্ছে ভাতের হাঁড়ির ভেতরে। ফ্যানের গন্ধ ম্ ম্ করছে। মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার দিন বাবলুর মা তাকে খেয়ে যেতে বলে পিছুডাক ডেকেছিল। সে বলেছিল,  এই তো, যাবো আর আসবো। এরপর মৃতদেহ হয়ে বাবলু যখন মায়ের কাছে ফিরে এসেছিল, তার অনেক আগেই তার আত্মা চলে গিয়েছিল মনিরত্না ভরদ্বাজ নামে এক অশরীর মায়ের কাছে। আর ঠিক ও-ই সময়ই মনিরত্না সন্ধ্যার আকাশের গিঁট ছেঁড়া আলো জ্বেলে ভাত রাঁধতে বসেছিল।

শরীর ত্যাগ করা যায়। কিন্তু মন? সে-তো চরম গতিসম্পন্ন বাতাস! বাতাসের প্রাণ আছে। প্রাণ মানে ভীষণ শক্তির উপাসনা। প্রাণ-ই তো প্রাণের সন্ধান করে! তাই প্রাণ কখনও বা বইতে বইতে শরীর বিহীন শরীরের মনিরত্নাকেও মনেপ্রাণে মানুষ করে তোলে।

আজ নিমচাঁদের কোথায় যেন যাওয়ার কথা। কিন্তু কোথায়? কিছুতেই মনে করতে পারছে না মনিরত্না। বহুদিন বাদে আজ আকাশে একফালি তরমুজের মতো চাঁদ উঠেছে। বাবলু সেই চাঁদকে তুলে গুঁজে দিলো তার অশরীরী মাথার নীচে। বাবলুর মুখময় জোৎস্না ফটফট করছে। স্নিগ্ধ সুষমায় ভরা নিশ্চিন্ততা, যেন, সব কাজ শেষে ঘুমন্ত ঘুঙুর, যার আরও বেজে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু কোনো এক সময়ের ঘন্টা কোথা থেকে এসে বললো, নাচ থামাও...

আর ঠিক সেইসময়ই গভীর ঘুমের দেশে চলে গেলো সীমাহীন মহাকাশ।

(ক্রমশঃ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন