![]() |
কবিতার কালিমাটি ১৪৭ |
কাফকা ও স্মৃতির বারবেল
আমরা নদীর পাশে হেঁটে চলেছি, জলে ভেসে চলে নিঃশব্দ স্মৃতির বারবেল। ভলতাভার স্রোতে ব্যারক ফ্যাসাড ও শতাব্দীর ক্লারিনেট ধূপছায়া রং মিশিয়ে দিচ্ছে।
চার্লস ব্রিজ পেরিয়ে আমরা পুরনো শহরের দিকে চলে
যাই, একটি স্টারবাক্সে বসে কফি খাই। ল্যাপটপ হাতে বসে থাকা তরুণীটি হয়তো তার বন্ধুকে
ইমেইল করছে কিংবা প্রস্তুত করছে প্রতিবেদনের খসড়া।তাকে নিয়ে বাহ্যত কারো কৌতূহল নেই।
আমি লক্ষ্য করি, যখন সে থেমে যায়, তার ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে—তার কপালের রেখা ভাষার
আরক শুষে নিতে থাকে।
ব্রিজের ওপর এক চাইনিজ শিল্পী দ্রুত ছবি আঁকছিল,
তার আঙুল স্বপ্নাচ্ছন্ন। সে কি তরুণীটির পোর্ট্রেট এঁকেছে? তরুণী কি চায়নি তার চিত্রিত
চুলে জেগে ওঠুক ডোরা ডিয়ামান্তের অলকশ্রী।
আমাদের মাথার ওপর অনেক স্ট্যাচু ঝুঁকে ছিল, তাদের
নিশ্চলতার সংকল্প অর্থহীন নয়। দর্শকের মন্তব্য শোনার জন্য তারা উৎকর্ণ। তাদের ছায়ার
আহ্বানে আমরা এগোতে থাকি।
প্রাগ ক্যাসেলে ব্রোঞ্জ-যুবকের পুরুষাঙ্গ তার শরীরের
বর্ণের তুলনায় উজ্জ্বলতর। অ্যান্টিমডার্নিস্ট কী বলতে পারে তা নিয়ে আমরা কথা বলি। উজ্জ্বলতার
জন্মক্ষুধা অস্বীকার করা যায় কি?
এ শহরের রাত মূলত আলোর বিভ্রম সৃষ্টি করে। নিয়ন
সাইন কাচের জানালায় উজ্জ্বল রং ঢেলে দেয়, স্ট্রিট ল্যাম্প ফাটলধরা ফুটপাতে স্বর্ণকুচি
ছড়ায়, আর ধীরগামী ট্রামের আলোয় দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় উদ্বদ্ধ নির্বেদ। পর্যটকের লেন্সে
ধরা পড়ে নৈশিক জীবনের সৌন্দর্য যা ক্লেদ ও যন্ত্রণায় পূর্ণ। অবশ্য বিয়ার হলগুলোয় মানুষের
মুহূর্তিক আনন্দের ভেতর জেগে ওঠে ঐতিহ্য-উষ্ণতা।
অসমাপ্ত বাক্যে পূর্ণ গুহার ক্ষুদ্রত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকে কাফকার ঘর। ঝুঁকে পড়া দেয়ালগুলোয় জেগে আছে তার অবসন্ন স্বর। প্রাগের পথে হাঁটতে
হাঁটতে পরিচিত ব্যক্তির পিঠে চড়ে তিনি কি বিমূর্ত ভূমণ্ডলে হারিয়ে যেতেন?
গোল্ডেন লেনের প্রতিবেশীরা হুল্লোড়ে মেতে থাকতো।
দরজার ফ্রেমে প্রতিফলিত হতো কোনো যুবকের শিসসংকেত। যেখানে কর্সেট শুকাতে দেওয়া হতো,
সেখানে আজ চড়ুইয়ের চঞ্চলতা।
দাঁড়কাকের রয়েছে বিশেষ প্রজ্ঞা। কাফকার মাথায়
ঝাপটা মেরে সে ভীতি সঞ্চার করেনি, ব্রহ্মাণ্ডের পথসূত্রকে স্বচ্ছ করে তুলেছে।
প্রাগ পেরিয়ে আমরা যখন ড্রেসডেন পৌঁছাই অ্যালবা তীরবর্তী বৃহৎ ভবনগুলো উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছিল। ভস্মস্তূপ থেকে জেগে-ওঠা এ শহর নদীজলে ধুয়ে ফেলেছে সমস্ত ছাইপাঁশ। অ্যালবার জলের স্বচ্ছতা কি মানুষের পরিচ্ছন্নতার প্রতীক?
কোথাও ধ্বংসের চিহ্ন নেই। বৃক্ষ ও বাগানের পাশে
ঘনীভূত হয়ে থাকে ফ্রেয়ার নিশ্বাস। অনাত্মতার প্রকৃতি খুঁজতে গিয়ে সাতটি ভাষায় লিখিত
একটি ক্যাফের মেনু পেলাম। হয়তো অনেক ভাষার দীপ্তি পদ্মদলকে মোহনীয় করে তোলে।
বার্লিন প্রাচীরের রূপ বদলে গেছে।শিশুরা প্রাচীরের
ছবি তোলে, তাদের হাসি জানান দেয়, অজ্ঞতাও আনন্দের মোক্ষম উৎস। তাদের প্রতিটি ছবির কেন্দ্রে
থেকে যায় একটি অদৃশ্য ফাটল।
প্রাচীরের খণ্ডাংশ নানা চিত্র, মুরালে পূর্ণ। কাঁটাতারের
ওপরে উৎকীর্ণ সূর্যের উদয়। এ সূর্যের সাথে পশ্চিমাকাশের সম্পর্ক নেই; তার কাছে পড়ে
থাকে অন্ধকারের উৎপাটিত অধিমূল।
ভাঙা প্রাচীরের গ্রাফিতি কি নদীজলে ভাসে? হয়তো
সে দৃশ্য কারও দৃষ্টিতে পড়েনি। তবে রঙ লেগে আছে ব্রিজে, জোলো বাতাসে জেগে আছে শব্দের
জীবন।
বারবার সীমান্ত পেরোনোর পর আমরা জিজ্ঞেস করি না—আমরা
কোথায় রয়েছি? বরং জিজ্ঞেস করি—এ স্মৃতিস্তম্ভগুলোর চোখে আমাদের কী রূপ ভেসে ওঠে? কেউ
নির্নিমেষে না তাকালে ভাস্কর্য কী ভর্ৎসনা করে?
নিদ্রার পদ্মভূমি পেরিয়ে
নিদ্রার পদ্মভূমি পেরিয়ে আমি ব্যালান্স হুইলের নিয়ন্ত্রণহীন কালে প্রবেশ করি। কুয়াশাচ্ছন্ন মাঠে উড়তে উড়তে পিতামহীর ইশারায় ধানগন্ধী উঠোনে নেমে পড়ি—ধানের উজ্জ্বলতার ভেতর পূর্বপুরুষের পরিচয় জেগে ওঠে।
আমার পিতামহ বিষকাটালির রাজত্বের ভেতর গরু খুঁজছেন।
হারিকেনের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার পরনের শুভ্র মার্কিন। তিনি সময়কে দাঁড় করিয়ে
রেখেছেন বলে গোয়ালঘরের খড় থেকে ভেসে আসে গোমূত্রের গন্ধ।
টিনের চালে বৃষ্টির তালচেতনা স্পষ্ট হলে ব্যাঙের
আনন্দচিৎকার ভেসে আসে। পিতামহ গরুর জন্য দড়ি পাকাতে থাকেন, তার হাতের ক্ষিপ্রতায় উটকুন
গৃহস্থালির প্রতীক হয়ে ওঠে।
বৃষ্টি থেমে যাবার পর রাত জলাশয়ে রূপান্তরিত হয়;
তীব্রতর স্নানাকাঙ্ক্ষা নিয়ে অসংখ্য টুকরোয় ভেঙে পড়ে চাঁদ। জলে ডুব দিয়ে তারা অরিয়লের
পাখা মেলে উড়ে যায়।
আমি ভবিষ্যতের প্রকৃতির কাছে গিয়ে দেখি উড়ুক্কু
মাছের প্রভাবে বদ্বীপের সমস্ত মাছ উড়তে শিখেছে। তারা পদ্মপুকুরের ওপর চক্রাকারে ওড়ে,
জলপোকা অনুসরণ করে তাদের ছায়া।
আমি আমগাছের ছায়ার অনুবর্তী হই। গাছের মগডালে উঠে
আমি পৃথিবী নিরীক্ষণ করি। কচি কলাপাতায় পৃথিবী একটি আখ্যান ঢেকে রাখে যার পাঠোদ্ধার
জরুরি।
কবিতার দীর্ঘ বাক্য পাঠ করতে করতে ঝড় আসে। তালপত্রে
প্রতিধ্বনিত শব্দাবলি গরুকে হতবিহ্বল করে তোলে, জাবরকাটা থেমে যায়। শব্দের শক্তি ব্রহ্মপুত্রের
স্রোতে সুস্থিরতা বয়ে আনে।
ঝড় আমাকে উড়িয়ে শৈশবের স্কুলমাঠে নিয়ে যায়। অসংখ্য
পদ্মে আবৃত মাঠের নির্জনতা; পদ্মদলে বেজে ওঠে আকাশের বাঁশি। এখানে শরণার্থীর পদধ্বনি
আর বিমর্ষতা সৃষ্টি করে না; সমস্ত স্মরণরেখা কেবল সৌধ নির্মাণ করে।
মাঠের পাশে আখের খেত। আলপথে যেতে যেতে টেপারি আর
ধুতুরা মুক্ত ভূগোলের ঐশ্বর্য তুলে ধরে। উল্টোদিকে বয়ে চলে নদী; তীরবর্তী বাঁশবনে ভেসে
বেড়ায় সে সব প্রৌঢ়ার গান যারা কখনো গ্রাম ছাড়েনি।
আমার ঘুমন্ত শরীর কোথায় পড়ে আছে স্মরণ করার চেষ্টা
করি। এক সন্ধ্যায় একটি হৃদয় ও কিছু প্রত্যঙ্গ পদ্মমাঠে নেচে উঠেছিল। আমি বারবার ফিরে
যাই সে সান্ধ্য প্রদেশে । আমার চেতনা ভোরের মোরগ-ডাকের জন্য অপেক্ষমাণ।
আমার পথের নির্দিষ্ট মানচিত্র নেই। একজন নাবিক
আমাকে জানায়, বাতাস এখন অনুকূল। আমি কি লোরালাই পাহাড়ে যেতে চাই যেখানে প্রতিধ্বনিত
হচ্ছে জলদেবীর গান?
আমি এমন এক ভূখণ্ডে যেতে চাই যেখানে কোনো যুদ্ধ
নেই, যেখানে পদ্মবর্ণ বাতাস ছুঁয়ে যায় আষাঢ় রঙের পত্রপল্লব। আমি জেগে উঠে দেখতে চাই
একটি মাঠ যেখানে মুথোঘাস জেনেছে আকাশের ভাষা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন