কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

সুপর্ণা বোস

 

সমকালীন ছোটগল্প


অপেক্ষা

সমুদ্র সৈকতের পাশে একটা কাঠের দরজা। কী অদ্ভুতভাবে সেই আয়তকার দরজাটা কোনো প্রাচীর অথবা ছাদ ছাড়াই দাঁড়িয়ে রয়েছে বালুময় সৈকতের একপাশে। জানি না সে কত যুগের ঝড় জল রোদের দাপটে প্রায় বেরং! তবু কাঠের ওপর খোদাই করা ফুলের পাপড়ির খাঁজে বিতত প্রেমের মত কিছুটা ফ‍্যাকাশে সবুজ থেকে গেছে! সে এক বিচিত্র  নির্মাণ! যেন কোনো ইনসোমনিয়াকের স্বপ্ন! দরজার ওপারে শুধু কালচে বালি!  নীল জল আর নীলকান্ত আকাশ!

বহু যুগের জমানো ব‍্যথার মত সমুদ্র বাতাসে বাজে তান্বুর। দরজাটা শান্ত হয়ে আছে অপরূপ ভঙ্গিতে। যেন মূর্তিমান নীরব প্রার্থনা। আজ পড়ন্ত সূর্যও  ভুলে গেছে সমুদ্রের জলে লাফিয়ে পড়তে। নার্সিসাসের মত কেবল নিজের ছায়ার দিকে চেয়ে আছে। সৈকতের বালির ওপর ঢেউ এসে লিখে যাচ্ছে জীবনের শ্লোক।

সেবার কৃষ্ণ সাগরের  সৈকতে এসে প্রথম এই দরজাটা আবিষ্কার করেছিলাম আমিই, -দ্যাখো, একটা দরজা! অথচ দেয়াল নেই! —বিস্ময়ে কথা আটকে যাচ্ছিল মুখে। তোমার চোখেও কত না বিস্ময়! তবু আমার ধরন দেখে হেসে ফেলেছিলে। সেই শীত-রোদের মত ঝলমলে হাসিটা। তখন প্রেমে ছিলাম আমরা, বুকের ভেতর ভোরের আলো জিরান দিত। কত কাঠখড় পুড়িয়ে তবে ছুটি কাটাতে এসেছিলাম সেই স্বপ্নের শহরে — নামটা এখন আর জরুরি নয়, কারণ স্মৃতির কোনো দায় নেই জায়গার নাম মনে রাখার, শুধু মুহূর্ত। সজীব মুহূর্তগুলো থরে থরে অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিল।

সেদিন দুজনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছিলাম দরজাটার সামনে বসে। তুমি বলেছিল, --এই দরজার ওপারে একটুকরো পৃথিবী বানাবো আমরা। সেখানে কেউ আসবে না। শুধুই তুমি আর আমি। তোমার চোখে স্বপ্নটা রীতিমত ধুকপুক করছিল। আমি আমার চোখের বাসায় তাকে আগলে নিয়েছিলাম।

আজ, এখন, অনেকগুলো বছর পর, ঠিক একই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। একাই। তুমি নেই। স্বপ্নের কিছু ঝরা পালক এখনো চোখের ভিতর পড়ে আছে। চোখ করকর করছে। জল আসছে। তোমার চলে যাওয়ার পর এটাই প্রথমবার। সমুদ্র কিন্তু বোঝে এই একাকিত্ব। শহর বোঝে না। যদিও শহরটা তেমনই আছে, হোটেলের বারান্দা। দিগ্বলয়ে থই থই জল আর সমুদ্র সৈকতের ওপর এই দরজাটা... এখনও ঠিক সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে!

মাঝে কত বাতাস পার হয়ে গেছে। ধুলিঝড়ে হয়ত দরজাটা হালকা দুলেও উঠেছে কতবার। আমাদের স্মৃতিগুলো ধুলোর ভেতর জেগে আছে। আমি অতি ধীরে দরজার গায়ে হাত রাখি। গরমকাঠ তেতে উঠেছে। যেভাবে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ত স্পর্শে! চুম্বনে আলিঙ্গনে! মনে আছে? সেদিন এখানে দাঁড়িয়ে  বলেছিলে, --যদি আমি আগে যাই, ঠিক এই দরজার ওপারেই অপেক্ষা করবো। জানবে, আমি এখানেই আছি। যাইনি কোথাও।

আমি তাড়াতাড়ি মুখ চেপে ধরেছিলাম তোমার, --নাহ্ কখনো বলবে না এমন কথা।

তারপর কী যে হল, তোমার হাতের পাতায় ঠোঁট ঘষতে ঘষতে বলেছিলাম, আর যদি আমি চলে যাই আগে?

শিশুর মত কেঁদে ফেলেছিলে তুমি, --না না আমায় একলা রেখে তুমি কোথাও যাবে না।

আমি কথা রেখেছি। আমি তো যাইনি তোমায় ছেড়ে আজও। বিরহ দিয়েই গড়ে নিয়েছি তোমার মূর্তি।

তন্ময় হয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। ঢেউয়ের ধ্বনি আর বাতাসের ভাঁজে এক নিঃশব্দ চিঠি যেন ভেসে আসে। অশ্রুধোয়া পাতার গায়ে মনে মনে হাত বোলাই। প্রতিদিন প্রথম রোদের অক্ষরে লেখা তোমার চিঠি আসে আমার কাছে।

দরজার হাতল ছুঁতেই খুলে যায়! সমুদ্রকে মনে হয় একটা প্রকান্ড বাথটাব। অজস্র শ্বেত টিউলিপের মত তোমার নগ্ন শরীর জুড়ে ঢেউ খেলা করে। দরজাটা হাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। আমার স্মৃতির হামামে শুধু স্নান পড়ে আছে। আমাদের সেই অপূর্ব বিলাসী সুগন্ধী স্নানের শেষে কড়া ব্রিউড কফির মত স্মৃতির তলানি!

সম্বিত ফেরে। কালচে বালি, নীল জল, আর অপার শূন্যতা। তবু জানি, এই শূন্যতার মধ্যেই তুমি আছ এক অনন্ত অপেক্ষা হয়ে। হট স‍্যান্ড কফির কাপে ফেনিয়ে ওঠে একাকী সময়।

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন