কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

স্মৃতিকণা সামন্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


শিশিরের শব্দ

প্রতিবারের মতো এবারও পদ্মফুল ফুটে ওঠা দেখা হল না। মিতুপিসি বলেছিল একদম আনকোরা ভোরে আসতে হয় ফুলের কাছে। শিশির যত ঘন হয়ে ঝরবে, ঝিরঝির হাওয়ায় শিরশিরে কাঁপন লাগবে গায়ে, নীল অন্ধকার ভেঙে একটু একটু করে লালচে হলুদ আলো গলে গলে পড়বে জলের ওপর, ঠিক তখনই ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলবে পদ্মকুঁড়ি। এসময় কথা বলতে নেই, শব্দহীন পৃথিবীতে দেবতারা হেঁটে যায় জলের উপর।

লাল পদ্মের বুটিদার কালো, টলটলে দীঘি। জলের বুকে কুয়াশা থমকে থাকে। ছোট্ট ডিঙ্গির লগি ঠেলে এঁকেবেঁকে বিলি কাটতে কাটতে চলে যায় আবছায়া কেউ দীঘির জলে। পেকে আসা ধানের ক্ষেতে ঘুরপাক খায় সোঁদাগন্ধ। ডিঙি বোঝাই করে পদ্মফুল তুলে আনে রতন বাগদি... লাল, সাদা। সবুজ ডাঁটি এলিয়ে থাকে, গা বেয়ে টুপটাপ জল।

তেমন ভোরে আসা হল না কোনদিনই। চোখ খুললেই আলো এসে পড়ে খাটের বাজুতে, হাওয়ার কাঁপন পাখিদের ডাক বয়ে আনে নরম বালিশে। একটু কান পাতলেই উঠোনে ব্যস্ত পায়ের শব্দ। ঘুমঘুম চোখে বারান্দায় নেমে এলেই সোনারঙ ধানক্ষেত, শীষের উপর লুটোচ্ছে বুলবুলি ফিঙে, হলুদরঙা রোদ মাখছে দেদার। জানলার গ্রিল বেয়ে নকশাকাটা রোদ আসে বারান্দায়।

সকালের আলোর গন্ধ, পুজোর গন্ধ ভৈরবী তানে মিলেমিশে গুড় জ্বাল দেওয়ার গন্ধে এসে থামে তালপুকুরের ধাপে। দেড় বিঘৎ রুই ঘাই মেরে যায় জলে। ভ্যাটের নাড়ু , টানা নাড়ু, খই নাড়ুরা গড়িয়ে যায় মস্ত বারকোষের গায়ে।

ষষ্ঠী আসে। বেলিতলার সন্ধ্যায় গমগম করে ওঠে মন্ত্র। কোশাকুশি তৃণাঙ্গুরী স্বর্ণাঙ্গুরী এগিয়ে দেয় কেউ। ক্যাপ বন্দুকের টুপটাপ ফুটফাট আওয়াজ আসে। বাঁশিতে তখন বোধনের সুর।

সপ্তমী, অষ্টমী পেরিয়ে নবমীর রাত আসে নরম, আবছা হয়ে। রাতের দরজায় থমকে থাকে দশমীর ভোর। ঝুজকো অন্ধকার ভাঙে তিল তিল আলো। উঠোনের ঝাঁকড়া আমগাছের মাথায় তখনও জমাট কুয়াশা। চিকন সবুজ পাতায় ছোপ ছোপ জল, ওরই আড়ালে আবডালে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ওড়ে চড়ুইয়ের ঝাঁক।

"রাই জাগো রাই জাগো শুকসারি বলে

কত নিদ্রা যাও গো রাধে শ্যাম নাগরের কোলে..."

কিচকিচ কিচকিচ... কে এলে গো? চড়ুইগুলো উঁকি দেয়।

"গেরস্তের জয় হোক মা!" গাল ভর্তি করে হাসে কেষ্ট বৈরেগী। গলায় কাপড়ের খুঁটটা জড়িয়ে হাতজোড় করে ঠাকুমা।

"জয় হোক বাবা!"

পায়ের পাতায় শিশির, কুটিকুটি ঘাস, ঝুরোঝুরো মাটি। কেষ্টদাসের মাথায় চূড়ো করে বাঁধা ঝুঁটি, গলায় কণ্ঠী, গায়ের নামাবলীটা চাদরের মতো জড়ানো। কপালে রসকলির দাগ।

গেরস্তের দরজায়, হাটে, মাঠে ভোর ভোর নাম বিলোতে আসে কৃষ্ণদাস বৈরাগী। এ তল্লাটের আনাচে কানাচে ধর্ম্মরাজের থান, বাশুলীর মন্দির। মানত করে লোকে, পূজো দেয়। পাড়ায় পাড়ায় শিব, বিষ্ণু, বাসুদেব। গেরস্তের কুলদেবতা নারায়ণ। বংশের বাঁধা বামুন নিয়ম করে ফুলজল দেয়। পালেপাব্বনে ধুমধাম হয়, লোকজন আসে গাঁ ঝেঁটিয়ে।

কেষ্টদাসকে দেখে হাতজোড় করে স্বপন ভটচাজ, এ বংশের কুল পুরোহিত। খানিক পরেই দেবীর বিসর্জন। তিনদিনের পালন শেষে চ্যাংমাছ পোড়া খেয়ে, হলুদ জলে নেয়ে, তেল সিঁদুরের সোহাগরঙে ভাসতে ভাসতে দেবী ফিরে যাবেন কৈলাশে। হুড়মুড়িয়ে জলে ঝাঁপ দেবে ছেলের দল, আর সন্তান কামনায় সদ্য বিয়েওলা মেয়ে, বউ। ঘটের ডাব, কলাছড়া পোয়াতি বউটির হাতে দেবে স্বপন পুরোহিত। বিসর্জন ফুরোলে ভেসে ওঠা টুকটাক শোলার গয়না কুড়িয়ে দে ছুট দেবে কটা দস্যিছেলে, প্রশ্রয়ের হাসি হাসবে বুড়ো গোকুলদাদু। অপরাজিতার শেকড় বাজুতে বেঁধে, কপালে ভস্মের টীকা আর শান্তিজল নিয়ে পায়ে পায়ে ঘরে আসবে গেরস্তের কত্তা গিন্নী আর আধবুড়োর দল।

ঠিক তখনই আসে বুধন আর তার লোকজন। গড় হয়ে প্রণাম করে ফাঁকা হয়ে যাওয়া দেবীর পাটে। আলতা বুলিয়ে রঙ করা ছোট ছোট লাঠিতে ঠকঠক আওয়াজ তুলে মন্ডপজুড়ে ঘুরে ঘুরে নাচে ওরা। লোক জড়ো হয় ওদের চারপাশে। নাচ সারা হলে একখিলি পান, একথান সিঁদুর আর একটা টাকা মন্দিরের দাওয়ায় নামিয়ে রাখে বুড়ো ওস্তাদ বুধন।

কাঠিনাচের দলটা এবার ঘুরবে ঘরে ঘরে।

"বোল, সপ্তমী অষ্টুমী মাগো দুগ্গা পূজা করে

বোল, সোনার পিতিমে উঠুক প্রতি ঘরে ঘরে

বোল... হো হোই "

হলুদ, বেগুনী, সবুজ, লাল শাড়িগুলো ঘাঘরা হয়ে উড়ে বেড়ায় উঠোন জুড়ে। ঠক ঠক ঠক ঠক আওয়াজটা ওঠে নামে দ্রুত তালে। আট থেকে বারোর ছেলেগুলোর কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম, কপালে গালের ওপর চন্দনের ছোটছোট ফোঁটা গলে গলে পড়ে, গলে যায় ঠোঁটের সস্তা লিপষ্টিক।

-গান কে লেখে বুধন?

-সে আজ্ঞে, আমার ঠাকুদ্দা'র খাতা ছিল একখান। ঠাকুরদা লিখে নাই সেসব। তারও আগে সব লিখা।

-খাতাখান দেখাবে বুধন?

কেষ্টদাস বৈরেগীর ঘরের পাশ দিয়ে যে নামোপাড়ার মাঠ তারই আল ধরে, ধানের শীষ ছুঁয়ে বুধন ডোমের পাড়া। মাটির দাওয়ায় তালপাতার চাটাই, ছানাপোনা সমেত মোরগগিন্নীর সংসার। দলের নাচের সাথে ঢাক বজায় বুধন, ওস্তাদ ঢাকি।

কবেকার সে কথা। সাহেবরা তখন কোথায়! রাজার লোক ছিল ওরা। বুধনের দশপুরুষ নাকি বিশ পুরুষ আগের জমানায় বাপ দাদার ডরে কাঁপত মহুয়া শালের জঙ্গল। ঝমঝম করে হেঁটে যেত ওরা। কাঁসর ঝাঁঝর মৃদঙ্গের বোলের সাথে ছমছম করে বেজে উঠত ডোমসর্দারের ঘুঙুর, ঝিকিয়ে উঠত কোমরে বাঁধা তলোয়ারখান। বুড়ি ঠানদিদি ছড়া কাটে-

"আগে ডোম বাগে ডোম ঘোড়া ডোম সাজে

ঢোল ঝাঁঝর মৃদং বাজে।"

সামনে ডোম, পাশে ডোম হেঁটে যায়, ঘোড়ায় যায় ডোম। ভারী ঘুঙুরের ডুঙ ডুঙ শব্দ ভেসে যায় লালমাটির দেশে। স্বরসঙ্গতির টানে ঠানদি দুলতে দুলতে ঝিমোয় আর বিড়বিড় করে- আগাডুম বাগাডুম...

মালো পাড়া, ঢালী পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হয়েছে বুধন, বড় হতে হতে বুড়ো হয়েছে। যুদ্ধবাজ বাঙালীর নাম বুধন ডোম, দল ঢাকী।

ঝাঁকড়া চুলের মাথা ঝাঁকিয়ে সন্ধিপুজোর ঢাক বাজায় যে দল সে তখন আর বছরভর ধেনো মদের নেশায় বুঁদ হওয়া মানুষটা লয়। বিনবিন রক্ত ছোটে ওর শিরায় শিরায়, ফুলে ওঠে কপালের রগ, গলার পেশী। দলের রক্তে ভর করে ওর পূর্বপুরুষের জিন। খ্যাপা অসুরের মতো ঢাকটাকে বাজাতে থাকে দল।

"সবেগে পতিতা দেবী ঘাতয়ন্তী মহাসুরা"...গমগম করে স্বপন ভটচাজের গলা। চন্ডমুন্ড বধের নেশা তখন দলের চোখেমুখে, মিশমিশে কালো শরীরে। যুদ্ধের বোল ওঠে দলের ঢাকে, বেহুঁশ মাতালের মতো দল নাচে আর বাজায়, বাজায় আর নাচে... ডিং না না, ডিং না না, ডিং না না... ড্যা ড্যা ড্যাং ডিং ডি ডিং ডিং... ধ্যাং ধ্যাং ধ্যাং...

পুজো ফুরিয়ে এলে দল আর বুধন বসে ঝিমোয়, একসাথে বিড়ি টানে। জঙ্গলের পাতা পড়ার খোঁজখবর নেয়। যুদ্ধবাজ মনিষ্যিগুলানের চাষআবাদে মন বসে কই? জমি নাই জিরেত নাই, বছরভর নাই নাই দিন।

সে আরও কয়েকশ বছর আগের কথা। রাজ্যটাকে আউলা বাউলা করে ছাড়ল নদের নেমাই। রাজা হাম্বির বৈষ্ণব দীক্ষা নিল। আচায্যি চিনিবাস (শ্রীনিবাস) কী যে মন্তর দিল রাজার কানে, গোপাল সিংহয়ের জমানা অব্দি শুধু নামগান, কেত্তন আর চোখের জলে ধুলোয় গড়াগড়ি সব। সেনাদল বিদেয় হল। যুদ্ধ ভুলতে লাগল বুধনের বাপ ঠাকুদ্দা। সমাজের ঠেলায় নামতে নামতে নিচু থেকে নিচুতলায় চলে গেল দল আর বুধন ডোমের বাপ ঠাকুদ্দা। হাতের লাঠিগুলো নিয়ে নাচতে নাচতে শুরু হল যুদ্ধযুদ্ধ খেলা, গান বাঁধল, দল বাঁধল। কেউ কেউ পালিয়ে গেল উড়িষ্যা, বিহার, আসাম। ফিকে, আরও ফিকে হয়ে এল যুদ্ধের স্মৃতি।

-জয় গৌরহরি!

উঠোনের মুরগির ছানাগুলো চিকচিক করতে করতে ছুটে পালায়।

-এস গো কাকা।

চালে গোঁজা তালপাতার আসনটা বিছিয়ে দেয় বুধন। তালগাছের খুঁটিতে হেলান দিয়ে উবু হয়ে বসে কৃষ্ণদাস। হাঁটুদুটো ওর চিবুক ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায়। তুবড়ানো স্টিলের প্লেটে একটা খইলাড়ু আর ঘটিতে জল দেয় বুধনের মেয়ে। ওর বউ গলায় কাপড়ের খুঁট জড়িয়ে গড় করে, দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বৈরাগী ঈশ্বরে নিবেদন করে দেয় প্রণাম।

সন্ধ্যা নামছে। পাতলা কুয়াশা বিছিয়ে আছে ধানক্ষেতে, হাওয়ায় শীতের আগাম খবর। গেল শীতে দ্বারকা ঘুরে এসেছে কেষ্ট বৈরাগী, দেশদুনিয়া বলতে আর গেছে পুরী, বেন্দাবন গাঁয়ের আরও দশজনের সঙ্গে, ট্রেনেবাসে চেপে।

—বুইলি বুদনা, ই লাচ তোর একার লয় রে! দারোকায় দেখেছি এমন।

—বলো কী গো কাকা? আমাদের দেশগাঁয়ের খাটিলাচ ওই হোথা?

অবাক হয় বুধন।

—তবে আর কইচি কী? আর কী ডাগর ডাগর সব বিটিছাঁ লাচছে রে! সব যেন রাধা এক একখানি। জয় রাধে!

—সেসব দূরের দেশ কি আর আমরা দেখব গো? এই তুমি বলো, তাই শুনি।

—আর খাটি'র দাপট দেখলুম বাপ বেন্দাবনে; দোল পরবে। তবে তোর এই লাচের মতো দাপট কুথাও লাই।

বিষ্ণুপুর রাজার চাকরি গেছে, ডাকাতির দল গড়েছে বুধন, দলের পূর্বপিতামো। বীরভূম থেকে মল্লভূমের শাল মহুয়ার জঙ্গল থম মেরে থাকে ঠ্যাঙাড়েদের ভয়ে। নতুন বউয়ের পালকি থামিয়ে গয়না কিম্বা জমিদারির রাজস্ব হাপিস হয়ে যাচ্ছে লালমাটির নিশুত রাতে। ঘুম উড়ে গেছে ব্রিটিশ সরকারের। ক্রিমিন্যাল ট্রাইবের তকমা ঝুলছে গলায়। দল কে দল গা ঢাকা দিচ্ছে উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে। রক্তে তিরতির বইছে যুদ্ধের বাজনা। সে বাজনায় যুদ্ধের ডাক। হান্টার সাহেব তাঁর annals এ লিখলেন দল, বুধনের সেইসব পূর্বপুরুষের কথা।

ছোট হয়ে আসে বুধনের চোখ। ঝিম ঝিম ঘোরলাগা চোখে ফুটে ওঠে দলের টানটান পেশিওলা চেহারাটা। দুগ্গা মন্দিরের আটচালায় তেরছা হয়ে পড়ে আলো, আকাশে একাদশীর চাঁদ। হ্যাজাকের ঘ্যাসঘ্যাস শব্দ এখন ঢিমে লয়ে ঢুলছে।

"উঠি গো বাপধন। গৌরের সেবার সময় হল।"

বলতে বলতে এগিয়ে যায় কেষ্ট বৈরাগী। ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে আবছা হয়ে আসা শরীরটা যেন হেঁটে চলে কতকাল। দলঢাকি, বুধন ডোম বসে থাকে অনাদি অনন্ত সময় হয়ে।

দীঘির জলে গুবগুব ডুব দেয় অন্ধকার। জল টলটল পদ্মপাতায় আলোর ফোঁটা রঙ বদলায়। দেখতে দেখতে কুয়াশায় ঢেকে যায় দীঘি, ধানক্ষেত আর দূরের লাল রাস্তা। শিরশিরে হাওয়ায় শীতের খবর আসে।

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন