কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

শান্তিরঞ্জন চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

স্বর্গ এসেছে নেমে

 


(৩)

সংসারধর্মে অনভিজ্ঞ দুই নরনারী। কুন্তলা আর অনঙ্গ। মহাদেববাবু হাত উজার করে সাজিয়ে দিয়েছেন মেয়ের সংসার, তবু কোথায় যেন একটা কাঁটা খচখচ করে তাকে বিদ্ধ করে প্রতিনিয়ত। মহাদেব ঘোষালের জামাই কিনা পরের গোলামী করবে! এর মধ্যেই সনাতনবাবুর সঙ্গে জামাতার ভবিষ্যৎ নিয়ে একপ্রস্থ কথা সেরে ফেলেছেন মহাদেব ঘোষাল। সনাতনবাবু বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘মনে করবো কিরে? আমি তো দিন গুনছিলাম, কবে তোর কাছ থেকে প্রস্তাবটি আসবে। আমার তেলকল, তোর জামাইকে এমন কোন একটা কলের মালিক বানিয়ে দে, দেখবি দু চার বছরের মধ্যেই কেমন ভেল্কি দেখায়’।

মহাদেববাবু ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলেন বন্ধুর কাছে, ‘বল ভাই, আমার মেয়েটা সুখী হবে তো? আমি তো জানি আমার কুন্তলা জামাইয়ের নখের যুগ্যি নয়, তবু বাপের মন তো’! সনাতনবাবু আশ্বস্ত করলেন বন্ধুকে। ‘আরে আমার ছেলেটাকে তুই চিনিসনি এখনো। ওকে নিয়ে তোর কোন ভয় নেই। তোর মেয়েটাকে বল, সে যেন দেবতুল্য স্বামীটিকে হেলাফেলা না করে, পয়সাওয়ালা বাপের মেয়ে তো! গুমোর থাকতেই পারে’! একগাল হেসে বললেন মহাদেববাবু, ‘মা-মরা মেয়ে, শিক্ষাদীক্ষা তেমন দিতে পারিনি কিছু, তবে মানুষ করেছি রাজকন্যার আদরে। জেদটা একটু বেশি, রেগেও যায় হঠাত্ করেই, আর আমার  ভয়টা সেখানেই’। মহাদেববাবু বাবা। মেয়ের মনটিকে তিনি বিচার করবেন বাৎসল্যের  দৃষ্টিতে, সেটাই স্বাভাবিক। তিনি জেনেছেন, একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন জামাইয়ের বাবা। গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের কর্তা। যদি অকালে চলে না যেতেন তিনি তবে অনঙ্গ হয়তো একজন কেউকেটা অফিসার বা বড়সড় কোন ব্যবসার কর্ণধার হয়ে তার ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যেত। তার মেয়ে তো সেকথা জানে না। জানলেও তার এসে যায় না কোন। সে তার আপন জগতে মহারাণী। তুমি যে-ই হও না বাপু, মনে রেখো, আমি মহাদেব ঘোষালের একমাত্র সন্তান, বাবার বিশাল সম্পত্তির মালিকানা আমার হাতে, তাই আমার কথাই শেষ কথা। এখানেই যত ভয় মহাদেববাবুর। তিনি এও জেনেছেন, তার জামাই মাসে একবার অন্তত গ্রামের বাড়িতে যাবেই। তার মাস মাইনের বেশ কিছুটা অংশ সে গ্রামের মেধাবী ছাত্রদের জন্য ব্যয় করে। এখানে যদি দ্বন্দ্ব বেঁধে যায় জামাইয়ের সাথে তবে তো মেয়ে সোজা গিয়ে উঠবে বাপের বাড়ি। জেদ ধরবে, ঘর করবে না অমন লোকটার সাথে যে নাকি পরের মাথায় তেল ঢেলে বেড়ায়। সব কথা মন দিয়ে শুনলেন সনাতনবাবু, বললেন, ‘ওরে! তোর জামাই সর্বংসহ। তোর মেয়ে থাকুক না জেদ নিয়ে। ও বেটা সব সামলে নেবে, আর ওকে ছেড়ে বাপের ঘরে যাবে তোর মেয়ে? আরে! অনঙ্গ জাদু জানে। একবার ওর সাথে যে বাঁধা পড়েছে, সাধ্য কি তার ওকে ছেড়ে যায়। এটা তখনই সম্ভব যদি ও কখনো কুন্তলাকে ছেড়ে দিতে চায়’। চকিতে মহাদেব মুখ চেপে ধরে সনাতনের। চোখমুখে ত্রাসের প্রকাশ। আবার মহাদেব হাত দুটি জড়িয়ে ধরে সনাতনের। আশ্বস্ত হতে চায়, এমন কিছু যেন বাস্তবে না ঘটে।

এরপর কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। না, কুন্তলা রোম্যান্টিক হয়ে উঠতে পারেনি কোনদিন, এনিয়ে অনঙ্গ সান্যালেরও ক্ষোভ ছিল না কোন। তার শ্বশুরমশাই তাকে যে ইলেক্ট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি উৎপাদনের কারখানাটি গড়ে দিয়েছেন তা নিয়েই সময় কেটে গেছে কাজপাগল মানুষটার। এখানেই থেমে থাকেনি সে। একের পর এক চার চারটি ব্যবসার কর্ণধার এখন অনঙ্গ সান্যাল। ব্যবসায়ী মহলে তার আকাশছোঁয়া প্রতিপত্তি। তবে সে যাই হোক না কেন, ঘরে, মানে তার স্ত্রী কুন্তলার কাছে সে প্রথম দিনটিতে যা ছিল আজও তাই।  কুন্তলা রোম্যান্টিক না হোক  সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় বন্দী হয়েছে সে স্বামীর বাহুবন্ধনে। এ কথা গ্রামের পিসী মাসী কাকীদের গোপন আলোচনায় আড়ি পেতে শুনে মনে গেঁথে রেখেছিল কুন্তলা, সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম নারীর জীবনই বৃথা, এমন কি স্বামীর মন থেকেও সে দূরে চলে যায়, তাই বছর ঘুরতেই কোলে এল মনস্বিনী। মেয়ের মুখখানির দিকে  তাকাতেই কুন্তলার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল অভাবিত এক আলোর উদ্ভাস। বাপের মুখখানি পেয়েছিস তুই মা, দেখিস বড় সুখী হবি তুই। অনঙ্গের জন্য কেমন একটা ভাললাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল মনটা। মহাদেববাবুর মনটা তো আনন্দের ভরা কোটাল। নাতনীর জন্য বাজারের সেরা জিনিসপত্র কিনে হাজির সে। জ্যোতিষ ঠাকুরকে দিয়ে নামটা পর্যন্ত বের করে নিয়েছেন; মনস্বিনী। আহা! গালভরা নামটি কিন্তু কি মানে হতে পারে এটার তা তো জানা হয়নি। জামাই অনঙ্গও নামটি শুনে খুব খুশী, কিন্তু সেও কী মানেটা জানে? না, সেও জানে না তবে জেনে নিতে আর কতক্ষণ। সনাতনবাবুর কলেজপড়া মেয়ের ডিকশনারি দেখে নামের অর্থটি জানা হয়ে গেছে তার। মহাদেববাবুকে নামটির অর্থ বুঝিয়ে বললেন জামাই অনঙ্গ। মনস্বিনী মানে উদারপ্রাণা নারী, যে নারী মহান বা যে নারীর মন উদার। মহাদেববাবু মানে শুনে তো আহ্লাদে আত্মহারা। বললেন দেখতেও হয়েছে তোমার মত, মনটিও হবে তোমার মতই। এ মেয়ে যে সে মেয়ে নয়, দেখে নিও সবাই।

মেয়ে কোলে বসেছিল কুন্তলা। শ্বশুর জামাইয়ের সব কথাই কানে এসেছে তার। মেয়ে তার বাপের মত হবে এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। যেই শুনতে পেল মেয়ে উদার মনের হবে, সেখানেই যত আপত্তি কুন্তলার। মেয়ে বড় হয়ে না দানধ্যান করে সব উজার করে দেয়! অভাব কথাটা একেবারে সহ্য হয় না কুন্তলার। ওই শব্দটা গরীবদের জন্য। কুন্তলা দারিদ্র্য দেখেনি। ওই কথাটা ভয় ধরিয়ে দেয় মনে। স্থির করে নিয়েছে কুন্তলা, মেয়েকে এমন শিক্ষা দেবে যে একগাছি সুতোও যেন কেউ সরাতে না পারে। ভাগ্যদেবতা সম্ভবত নীরবে হাসলেন কুন্তলার ভাবনার ধরন দেখে।

দিনে দিনে বেড়ে উঠছে মনস্বিনী। মানেটা যত ভালই হোক ও-নাম উচ্চারণ করতে পারবে না কুন্তলা। সে তার সুবিধেমত একটি নাম তৈরী করে নিয়েছে, আদ্য আর অন্ত্য অক্ষর দুটি মিলিয়ে, মনি। কুন্তলা ওই প্রাথমিকের গন্ডিটি পেরিয়েছিল মাত্র। পড়তে মন চায়নি। মহাদেববাবুও ভেবেছেন, যেমন সাধারণ সকলে ভেবে থাকে, মেয়েদের পড়াশোনোটা এমন কী কাজে লাগে, তারচেয়ে ঘরকন্নাটা অনেক বেশী জরুরী শ্বশুরবাড়ির মন জয় করতে। কুন্তলা তাই মনি’র বানান নিয়ে মোটেই উৎকণ্ঠিত নয়। সে জানে ওই নামের পাথর অতি মূল্যবান, যেমন তার কাছে তার কন্যাটি। মহাদেববাবু একজন দাই নিযুক্ত করেছেন যাতে অনভিজ্ঞ কুন্তলা কোনরকম অসহায় বোধ না করে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সাধ মেটে না কুন্তলার। অনাস্বাদিত এক আনন্দে ভরে যায় কুন্তলার মন, সারাদিনের কাজের শেষে অনঙ্গ যখন পিতৃবাৎসল্যে দু’হাতে আলগোছে তুলে নেয় মনিকে, আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় পুতুলের মত নরম সুন্দর আত্মজাকে। আত্মতৃপ্তির সাথে সাথে একটা ভয় চিনচিন করে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত মনটা  জুড়ে। মেয়েরা ঘর আগলে রাখে। এ মেয়ে যদি বাবার মত পরের ভাল চায় তবে তো নিজের ঘর বাঁধা হবে না কোনদিন! অথচ বাপমুখী মেয়ে, সে তো বাপের চরিত্র পাবেই, এটাই বিশ্বাস কুন্তলার। অনঙ্গ নির্বিকার। সে যেন জেনেই বসে আছে, তার মেয়ে সকল জড়তা অতিক্রম করে আপন বিচারবুদ্ধিতে বলিয়ান হয়ে উঠবে। দু’হাত বাড়িয়ে বলবে, কে কোথায় আছ অনাথ আতুর, এই যে আমি, তোমাদের সকল ভরসার স্থল। কুন্তলার সকল প্রতিরোধ সত্ত্বেও মনস্বিনী হয়ে উঠবে অসাধারণ এক নারী।

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন