কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


এডিথের স্ট্রেন্জ গবেষণা

এক সময়ে আমি লোকাল ট্রেনের ডেইলি প্যাসেঞ্জার ছিলাম। সে অনেক বছর আগের কথা। তবে অনেক বছর ধরেই ছিল সেই ডেলি প্যাসেঞ্জারীটা। ডেলি প্যাসেঞ্জারীর কষ্ট যেমন আছে, তেমন আনন্দও অঢেল। কো-প্যাসেঞ্জাররা কিছুদিনের মধ্যেই আত্মীয় হয়ে উঠতো। এছাড়া আর একটা আকর্ষণীয় বিষয় ছিল লোকাল ট্রেনের হকারের দল। বিচিত্র তাদের পসরা, বিচিত্র তাদের হাঁকডাক। চা-ঝালমুড়ির মতো পসরাকে আমাদের খুব সাধারণ মনে হতো। কারণ নিত্য দেখতে দেখতে আমাদের কাছে তা তেমন বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু  বিদেশিদের কাছে সেটাই মহা আশ্চর্যের বিষয়। এডিথ জার্মান দেশের মেয়ে। ভারতে এসেছিল কী একটা গবেষণার জন্য। সেই গবেষণার সুত্র ধরে তাকে যেতে হবে ব্যান্ডেল। এক্জাক্ট লোকেশন ব্যান্ডেল চার্চ। তার যারপর নাই অবাক হওয়া দেখেই কথাটা বলছি।

এডিথের সাথে আমার পরিচয় ব্যাঙ্কে। সেখানে সে এসেছিল ফরেন কারেন্সি এক্সচেঞ্জ করতে। তখন ফরেন কারেন্সি এক্সচেঞ্জের পদ্ধতিটা এখনকার মতো সরল ছিল না। তাতে বেশ সময় লাগতো। ঐ কাজটা করার জন্য ওভারসিস ব্রাঞ্চ বলে আলাদা অফিস থাকতো। আমি এডিথকে এই কাজে সাহায্য করেছিলাম, যাতে ও টাকা তাড়াতাড়ি পেয়ে গেছিল। এবং তার ফলেই আমি তার একরকমের বন্ধু হয়ে গেছিলাম। তারপর যখন শুনলাম ওকে ব্যান্ডেল যেতে হবে এবং সেখানে যে কাজ তাতে তার মাসখানেক লেগে যাবে, আমি ওকে পরামর্শ দিলাম, হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে করে ব্যান্ডেল যেতে। এবং এও জানালাম, মান্থলি টিকিট করে নিলে খরচ অনেক কম পড়বে।

এইখানে বলে রাখা ভালো, সাহেব-মেম দেখলেই আমাদের মনে হয় ওরা সবাই ধনী। ওদের কাছে অঢেল  টাকা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এডিথ ধনী তো ছিলই না, উল্টে তার টাকাপয়সার টানাটানিই ছিল। কলকাতায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল YWCAতে। YMCAর মতো YWCA যে আছে তাই আমি জানতাম না। YMCA পুরুষদের জন্য আর YWCA মহিলাদের জন্য সস্তার আশ্রয়স্থল। এডিথ ওখানেই আশ্রয় নিয়েছিল। ওর পরিকল্পনা, ওখানে থেকেই নিজের গবেষণা চালাবে।

যাইহোক পরামর্শ দিয়েই আমার দায়িত্ব চুকলো না, এডিথকে সাথে নিয়ে আমাকে হাওড়া স্টেশন থেকে মান্থলি টিকেটটাও করিয়ে দিতে হলো। প্রথম কয়েকবার এডিথ এইসব কাজের জন্য আমাকে Thank you বলতো। পরে Thank youর বদলে অন্য কিছু একটা বলতো। সেটার উচ্চারণ এতদিন পরে এখন আমার আর স্পষ্ট মনে নেই। বোধহয় জার্মান ভাষায় ধন্যবাদ জাতীয় কিছু।

লোকাল ট্রেনে যাত্রার সম্পর্কেও আমাকেই ডেমনেস্ট্রেশন দিতে হলো। ঘোষণা ও বোর্ড দেখে কোন প্লাটফর্মে  কোথাকার লোকাল আসছে বুঝতে শেখানো। ঘোষণা শুনে ছুটে সেই প্লাটফর্মে পৌঁছানো। নামার প্যাসেঞ্জারের  হুড়োহুড়ি এড়িয়ে ট্রেনের কামরায় ওঠা। সিট দখল করা। সবকটাই এডিথের জন্য নতুন এবং কঠিন বিষয়।  সে সবই আমাকে এডিথকে হাতে কলমে শেখাতে হয়েছিলো। মুস্কিল হচ্ছে এই লোকাল ট্রেনযাত্রা আমার আর এডিথের জন্য সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। অর্থাৎ আমি সকালে হাওড়া আসবো আর বিকেলে হাওড়া থেকে ফিরব, এডিথ যাবে সকালে হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল, বিকেলে ব্যান্ডেল থেকে হাওড়া। তাই আমাদের পক্ষে  সহযাত্রী হওয়াটা অসম্ভব।

ঠিক হলো এক রবিবারে যেদিন আমার অফিস ছুটি সেদিন আমি হাওড়া স্টেশনে এসে এডিথকে নিয়ে ব্যান্ডেল লোকালে ব্যান্ডেল যাবো। আবার ফিরেও আসবো। এতে করে লোকাল ট্রেনযাত্রা ওর শেখা হয়ে যাবে। এডিথকে নিয়ে আমার এই উৎসাহকে অফিসের কেউই ভালো চোখে দেখছিল না। অনেকেই ঠাট্টা করছিল। বিশেষ করে এডিথের হাইট নিয়ে। আমার উচ্চতা পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি। এডিথের ছ ফুটের ওপরে। পাশাপাশি দাঁড়ালে ওর গোটা মাথাটাই আমার মাথা ছাড়িয়ে যেত। এডিথকে ঝুঁকে পড়ে আমার সাথে কথা বলতে হতো। ইংরেজি ছিল আমাদের কথাবার্তার মাধ্যম। আমার ইংরেজি ভাষার জ্ঞান চলনসই। এডিথেরও তাই। তবে ও সাথে সবসময় একটা মাঝারি সাইজের ডিকশনারি নিয়ে চলতো। মাঝেমধ্যে সেটাতে উচিত ইংরেজি প্রতিশব্দ দেখে নিয়ে কথা বলতো।

যাইহোক যা বলতে শুরু করেছি সেখান থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছিলাম। অবশ্য তার দরকারও ছিলো। তা না হলে ঠিকমতো ব্যাপারটা বোঝানো যেতো না।

সেদিন রোববার ব্যান্ডেল লোকালে চেপেছি। রবিবার বলে প্যাসেঞ্জারের ভিড় কম। বসার জায়গা জুটেছে। চা-ওলা এলে আমি এডিথকে চা খাওয়ার প্রস্তাব দিলাম। টিনের ভেতর জ্বলন্ত স্টোভ আর তার ওপরে চা ভরতি কেটলি। বিপজ্জনক এই ব্যবস্থাটা জরুরি, তা না হলে চা গরম থাকবে কী করে?

ওহ্! স্ট্রেন্জ! বলে এডিথ খচাখচ ক্যামেরা দিয়ে এই ব্যবস্থার ছবি তুলে নিলো। অথচ নিত্য দেখি বলে বিষয়টা আমাদের কাছে তেমন অবাক করা কিছু ছিল না।

এডিথের পরবর্তী স্ট্রেঞ্জ দর্শন ঝালমুড়ি। মুড়িভর্তি একটা টিনের মাথায় সার দিয়ে পরপর অনেকগুলো কৌটো বসানো। এক একটা কৌটোয় এক এক ধরনের মশলা। পেঁয়াজকুচি, লঙ্কাকুঁচি, ছোলাসেদ্ধ, শশাকুচানো। চানাচুর আর আচার। একটা কৌটোয় নারকেলের পাতলা পাতলা ফালি। গালায় দড়িবাঁধা একটা শিশির মধ্যে সর্ষের তেল। শিশির ঢাকনায় ছোটো ছোটো ফুটো করা। যাতে শিশি ঝাড়লে গলগল করে তেল না পড়ে অল্প স্বল্প তেল পড়ে। এরকম নানান ব্যবস্থা সহ গোটা একটা দোকান এবং সেই দোকানটা হকারের গলায় ঝোলানো। টিনের গায়ে পাক দিয়ে দড়ি বাঁধা। তাতে দুই সাইজের কাগজের ঠোঙ্গা গোঁজা।

আমি অনুরোধ করলাম, প্লিজ হ্যাভ ওয়ান।

- হোয়াট ইস দিস?

- পাফড রাইস। উইথ মেনি স্পাইসেস। ভেরি টেস্টি।

এডিথ রাজি হলো। আমি ঝালমুড়িওলাকে একটা ঠোঙ্গায় ঝাল দিতে নিষেধ করে দুটো ঠোঙ্গা বানানোর নির্দেশ দিলাম। তার দ্রুত হাতে টিনের কৌটোয় লম্বা হাতলের চামচ ঘুরিয়ে ঝালমুড়ি প্রস্তুত করা এডিথকে বিস্মিত করে দিল। গলায় ঝোলানো ক্যামেরা দিয়ে খচাখচ সে দৃশ্যের ছবি উঠলো। সঙ্গে অবিরাম মুখে 'ও মাই গড' জাতীয় কিছু উচ্চারণ। একটা কথা এখনো মনে আছে, গোটা সময় ধরে ঝালমুড়িওলা ঝালমুড়ি বানাতে বানাতে কৌটোর গায়ে চামচ ঠুকে ঠং ঠং আওয়াজ তুলছিল। এটা বোধহয় তার দোকানের প্রচার। সেটা শুনে এডিথ বলেছিলো, ওহ ইটস মিউজিক! স্ট্রেঞ্জ মিউজিক!

এডিথের ঠোঙ্গা ওর হাতে তুলে দিতে গিয়ে বললাম, ইন দিস প্যাকেট নো চিলি। দিস ইজ ইয়োরস। মাইন ইজ উইথ চিলি।

আমার দেখাদেখি হাতের মধ্যে মুড়ি তুলে মুখে দিল এডিথ। কিছু মুড়ি ওর আনাড়িপনায় গায়ের ওপর ঝরে পড়লো। কিন্তু ওর মুখভঙ্গি দেখে বুঝলাম জার্মান মহিলাটির বাঙ্গালীখানা ঝালমুড়ি খুব একটা মন্দ লাগছে না। এবার আবার এডিথের অবাক হওয়ার পালা। এবারকার স্ট্রেঞ্জ হলো খুব পাতলা করে কাটা নারকেল।

- ওহ্ স্ট্রেঞ্জ! হাও দে এবল টু কাট সো থিন স্লাইস! ইটস ইউনিক স্কিল!

এ বিস্ময় তো আমাদেরও। আমরাও তো জানি না কী কৌশলে ওরা এরকম পাতলা করে নারকেল কাটে!

এরপর আর একটা বিচিত্র আবদার করলো এডিথ।

- আই ওয়ান্ট টু হ্যাভ সাম ফ্রম ইয়োর প্যাকেট।

অর্থাৎ বিদেশিনীর ইচ্ছে হয়েছে আমার ঠোঙ্গার ঝাল দেওয়া ঝালমুড়ি খাবে। এ কী পাগলামো! কিন্তু জার্মান গোঁ বলে কথা। রাজি হত হলো। ঠোঙ্গাটা এগিয়ে দিলাম।

- নো নো। ইউ পুট ইন মাই মাউথ। দেয়ার উইল বি নো ওয়েস্টেজ।

বলে কী রে বাবা! কিন্তু এড়ানোর উপায় নেই। ফলে ওর মুখের নাগাল পেতে আমাকে উঠে দাঁড়াতে হলো। ঠোঙ্গা থেকে এক কোরক মুড়ি নিয়ে এডিথের উর্ধ্বমুখী হাঁয়ের মধ্যে সাবধানে দিতে হলো। দৃশ্যটা আমার এখনো মনে আছে। না, ঝালমুড়ির ঝাল তাকে বিব্রত করেনি। তবুও ফটাস জল এলে আমি দু বোতল ফটাস জলের অর্ডার দিলাম। ফটাস জল, সেটাও এডিথের জন্য খুব স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার। সবার জ্ঞাতার্থে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। বোতলের মধ্যে রঙ্গিন কোল্ড ড্রিঙ্কস। বোতলের সরু গলায় একটা কাঁচের গুলি আটকানো। ওটাকে ওপর থেকে ঠ্যালা দিলেই ফটাস করে আওয়াজ তুলে নিচে নেমে যায়। এরপর বোতল থেকে গলায় মিষ্টি মিষ্টি অল্প ঝাঁঝ পানীয় ঢেলে ঢেলে খেতে হয়। এখন দেখি না, কিন্তু একসময়ে লোকাল ট্রেনে খুব দেখা যেতো।

আরো একগুচ্ছ ফটাস জলের ছবি তোলা হলো। ব্যান্ডেল যেতে যেতে ট্রেনের কামরায় আরো অনেক ধরনের হকার উঠলো। এডিথের ছবি তোলাও জারি থাকলো। অবশেষে পৌছলাম ব্যান্ডেল। তারপর ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে রিক্সায় চেপে ব্যান্ডেল চার্চে যাওয়া। লম্বা মেম সাহেবের জন্য রিক্সার হুড তোলা সম্ভব হলো না। তবে শীতের রোদ গায়ে মেখে রিক্সাভ্রমণ মন্দ লাগলো না। রিক্সায় চাপা নিয়ে এডিথ কিন্তু তার মার্কামারা strange বলে উঠলো না।

ব্যান্ডেলের কাছেই থাকি, কিন্তু সেটাই ছিল আমার প্রথম ব্যান্ডেল চার্চে যাওয়া। নদীর তীরে অনেকটা এলাকা জুড়ে চার্চ। নির্মাণশৈলী দেখে চেনা যায় বহুকাল আগে ইংরেজ আমলের একেবারে সূচনাকালে এটার নির্মাণ হয়েছে। এই চার্চটির নির্মাণ নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। এডিথের গবেষণার বিষয় বোধহয়  সেটাই। এই চার্চটি নাবিকদের সুরক্ষা আর নিরাপদ জলযাত্রার জন্য নিবেদিত। তার চিহ্নস্বরূপ চার্চের সামনেই জাহাজের একটি উঁচু মাস্তুল দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। সেদিন রবিবার Suday prayeএর জন্য চার্চে লোকজন এসেছে। এডিথ কিন্তু সেই প্রেয়ারে যোগ দিল না। ও ঘুরে ঘুরে চার্চটা দেখছিল। ছবি তুলছিল। মাকে জানালো প্রেয়ারের শেষে এখানকার কতৃপক্ষের সাথে কথা বলে ও এখানকার মহফেজখানা আর লাইব্রেরীতে যাবে। উপযুক্ত ঐতিহাসিক দলিলের সন্ধান করবে। তার বিশ্বাস, সেরকম দলিল পাওয়া যাবেই। তারপর ও নিয়মিত আসবে নিবিড় অধ্যয়নের জন্য।

ওর পরিকল্পনা শুনে অবাক হচ্ছিলাম আমি। সুদূর জার্মানি থেকে তার একা একা এই কারণে আসাটা, আমার জন্য স্ট্রেন্জ ছিলো। তাও টাকাপয়সার টানাটানি নিয়ে। এটা যে ধর্মীয় টানে নয়, সেটা টের পেয়েছিলাম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এডিথের চার্চের সানডে প্রেয়ারে যোগ না দেওয়ায়। ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত হয়ে আমি বসে পড়লাম এক জায়গায়। সেখানে বসে চেয়ে রইলাম সামনে বয়ে চলা ধীর গতির হুগলি নদীর দিকে। এটি গঙ্গার শাখা নদী হুগলি। অনেকের বিশ্বাস, নাম পাল্টে এটাই আসল গঙ্গা। এখন ছোটো ছোটো নৌকা বয়ে  চলেছে। কিছু নৌকায় পালতোলা। কিছু নৌকা স্থির হয়ে ভেসে আছে। ওগুলো মাছধরার নৌকা। নদীতে জাল ফেলে বসে আছে। একদা এই নদীতেই বড়ো বড়ো জাহাজ চলতো। সুদূর ইওরোপ থেকে দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা সমুদ্র পেরিয়ে এই নদীপথে আসা যাওয়া করতো। সে সময় নানা বিপদ আপদের সন্মুখীন হতো। বিপদে পড়লে মানুষ ঈশ্বরের কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করে। সেজন্য দেবালয় স্থাপন করে। ব্যান্ডেল চার্চ সেরকমই একটা দেবালয়। আর তার অতীত ইতিহাস খুঁজতে জানতে বুঝতে এখন সুদূর জার্মানি থেকে ছুটে এসেছে এডিথ।

অনেকক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে অতীতচারণ করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে এক সময় এডিথ এসে আমাকে জার্মান ভাষায় কিছু একটা বললো। বোধহয় সরি জাতীয় কিছু একটা। এডিথ পরে আমাকে জানিয়ে ছিলো For expressing true feelings I use my father's taunge. আমরা যাকে মাতৃভাষা বলি সেটাই ওদের কাছে father's taunge. Mother landকেও ওরা Father land বলে। হয়তো সেটা ওদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বলে।

ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে কাজে আসা, সেটা করা গেছে। এবার বেশ কিছুদিন ওকে নিয়মিত এখানে আসতে হবে। তবে একা একা। সেটা ও পারবে।

ফেরার লোকালটা ব্যান্ডেল থেকেই ছাড়ে। সুতরাং জানালার ধার ঘেঁষে সিট নিয়ে বসা গেলো। হঠাৎ নজরে পড়লো এডিথের কপালে চিন্তার ভাঁজ।

- what happened?

- Nothing.

- Will you not share your worries with me?

- O.K. it's money. I don't have much left.

- may I?

- No. Certainly not.

আর কথা এগোয়নি।

ট্রেন চলা শুরু করলো। এবার প্রথম হকার এলো শীতকালীন খই আর খোয়া জড়ানো নলেন গুড়ের মোয়া নিয়ে, যার পোশাকি নাম জয়নগরের মোয়া। যদিও সে মোয়া তৈরি হয় যত্রতত্র। এটা নিশ্চিন্তে এডিথকে কিনে দেওয়া গেলো। কারণ এটাতে ঝালের সমস্যা নেই।

আমার আজকের খাওয়া হয়েছে চার্চের সামনের এক হোটেলে। মাছভাত। এডিথ সারাক্ষণ চার্চের ভেতরেই ছিল। সেখানকার কর্তৃপক্ষ তাকে কি খেতে দিয়েছে, কে জানে? নিজে একা একা খেয়ে নিয়েছি। তাই সংকোচ  বশতঃ ও কিছু খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করিনি। এখন সেই সঙ্কোচ দূর করতে দুটো মোয়া কিনে দিলাম। মোয়া দুটো সাগ্রহে খেলো। সঙ্গে মন্তব্য।

- Wow. So sweet!

এর পরবর্তী হকার এলো কমলালেবু নিয়ে। তার বিচিত্র সরস প্রচার, "খোসা ছাড়িয়ে খান জয়নগরের মোয়া"।

অর্থাৎ কায়দা করে জানিয়ে দেওয়া, তার কমলালেবুগুলো জয়নগরের মোয়ার মতো মিষ্টি। আমি তার এই চমৎকার রসিক প্রচারে মুগ্ধ হয়ে হেসে ফেললাম। এডিথকে তর্জমা করে হকারের সেই সরস মন্তব্যটি বুঝিয়ে দিলাম। এডিথ সঙ্গে সঙ্গে সেটা তার নোটবুকে নোট করে নিল। তার কাছ থেকে কমলা কেনা হলো। কমলার খোসা ছাড়িয়ে একটা কোয়া মুখে দিয়ে এডিথ হেসে ফেলল।

- cunning fellow. It's not that sweet.

পরবর্তী মজার হকার ছিল আঙুরওলা। তার হাঁকডাকও চমৎকার এবং স্বাস্থ্যসম্মত - "মাত্র পনেরো টাকায় একশ ভিটামিন সি-এর ক্যাপসুল"। এটাও এডিথকে তর্জমা করে বুঝিয় দিলাম।

- What an Witty fellow.

এটাও তার নোটবুকে নোট হলো।

এই সব মজাদার ব্যাপারে মেতে গিয়ে এডিথের অর্থনৈতিক worryটা ধামাচাপা পড়ে গেল। আমরা হাওড়া পৌঁছে গেলাম।

এরপর অনেকদিন এডিথের সাথে আর দেখা হয়নি। প্রায় মাসদেড়েক পরে এডিথ আমার অফিসে এলো আমার সাথে দেখা করতে। ওর এখানকার কাজ কমপ্লিট। এবার ও দেশে ফিরে যাবে। তাই আমার কাছে বিদায় জানাতে এসেছে। একমাসের জায়গায় দেড়মাস থেকেছে। তার এতোদিনের খরচ খরচা মেটালো কে? কিন্তু সে প্রশ্ন তো আর করা যায় না! মনের প্রশ্ন মনেই থেকে গেল।

এরপর এডিথ আমার ঠিকানাটা চেয়ে নিল। আমি জানি এরকম পরিচয় ঝটপট হারিয়ে যায়। তাই আমি ওর ঠিকানা আর চাইলাম না। মনখারাপ হলেও আমার জন্য সেটা ছিল The relationship ends there. কিন্তু মজার কথা হলো, বেশ কিছুদিন পরে, কতদিন সেটা এখন আর মনে নেই, আমার কাছে একটা বিদেশ থেকে বুকপোস্ট এলো। জার্মান ভাষার একটা ম্যাগাজিন। তার প্রচ্ছদটা আমার খুব চেনা। লোকাল ট্রেনের ঝালমুড়িওলার গলায় ঝোলানো তার স্ট্রেঞ্জ দোকানটি সহ। ঐ বইয়ের ভেতরে একটি আর্টিকেলের মাঝে সেরকমই আরো কয়েকটা ছবি। সবই লোকাল ট্রেনের হকারদের। এক টুকরো কাগজে আধা ইংরেজি আর আধা জার্মানিতে এডিথের নিজের হাতের লেখা কয়েকটা লাইন - সেটা Thank you very much দিয়ে শুরু।

পড়ে আমি যেটুকু মর্মোদ্ধার করতে পারলাম সেটা হলো এই - ছবিটবি সহ এই প্রতিবেদনটি এডিথের লেখা। এখানে থাকার সময়েই ও জার্মানির এই ম্যাগাজিনে ছবিটবি সহ লেখাটা প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলো। তারা সেটা ছেপেছে। এবং সে বাবদ এডিথকে বেশ খানিকটা টাকা অগ্রিম দিয়েছিল। যা কিনা তখন অর্থনৈতিক সংকটে পড়া এডিথের জন্য বিরাট সাহায্য হয়েছিলো। বলতে গেলে সে জন্যই এডিথ ওভার স্টে করে প্রজেক্ট কমপ্লিট করতে সক্ষম হয়েছে। খবরটা জেনে আমারও খুব ভালো লাগলো। আমি মনে মনেই এডিথের পাঠানো জার্মান ভাষার ধন্যবাদটা মনে মনে ফরোয়ার্ড করে লোকাল ট্রেনের Witty হকারদের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলাম।

এরপর অবশ্যি এডিথের দিক থেকে আমার কাছে আর কোনো কমিউনিকেশন আসেনি। এমনকি ওর মুল গবেষণাপত্রের খবরাখবরও না।

Certainly our relationship was small and temporary.

তবে আমার মাঝে মাঝে একটা কথা খুব মনে হয়। অতীত ইতিহাসের প্রতি এরকম তীব্র ডেডিকেশন নিয়ে কোনো ভারতীয় গবেষক বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যায় না কেন? তাঁরা দেশে দেশে গিয়ে খুঁজে বের করুক আমাদের অতীতের ধামাচাপা পড়া ঐতিহাসিক সত্যগুলো। বিশেষ করে থাইল্যান্ডের ওঙ্করবটের। বিশালাকার মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে না জানি কতো ইতিহাস লুকিয়ে আছে!

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন