কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

         

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


 

(৪৫)       

পরে হৃদয় বিশ্রুতকে বলেছিল, এই বেশ ভালো হয়েছে। দুই উদার হৃদয়ের মিলন। ব্যর্থতা সাঁঝকে শেষ করে দিচ্ছিল। প্রথমে অনির্বেদ। ওর ভালোবাসা খাঁটি ছিল। কিন্তু প্রতিভা ছিল সীমিত। অতলান্তের ভালোবাসা খাঁটি ছিল না, কিন্তু প্রতিভা ছিল। কোনওটাই ধোপে টিকল না। শ্রমনণকে ও এমনি এমনি ভালোবাসেনি...

হ্যাঁ এটাই ঠিক জায়গা। বিশ্রুত বলেছিল। ব্যর্থ মানুষকে সম্মানের সঙ্গে নিজের জীবনে গ্রহণ করতে পারে, প্রতিষ্ঠা দিতে পারে, এমন মানুষ এই দুনিয়ায় খুব বেশী নেই...

শ্রমণ ইতিমধ্যে ভালোবাসায় ডুবে গেছে।

আর সাঁঝ দিয়েছে ওকে একটা সোনার হার। শ্রমণের টাকা ফুরিয়ে এসেছে। তাই সাঁঝের এই উদারতা। হারটা অবশ্য ও ফিরিয়ে দেবে।

আবার সেই হার! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদয়।

হ্যাঁ আবার। বিশ্রুত বলে। তুই একদিন এই হার গ্রহণ করেছিল না? শ্রমণও করেছে। সারাজীবন শ্রমণ কাকে অনুসরণ করতে চেয়েছে জানিস? কাকে নিজের মডেল বানিয়েছে? কার থেকে জীবনের সমস্ত অনুপ্রেরণা খুঁজতে চেয়েছে? তুই। ও তোর মতো প্রেমিক হতে চেয়েছে। তোর মতো সৃষ্টিশীল হতে চেয়েছে। তোর মতো ঝড় হতে চেয়েছে। বেপরোয়া, উদ্দাম, রোম্যান্টিক, নাছোড়, প্যাশনেট, জেদী, ত্যাগী। মনে মনে তুই হয়ে উঠেছিস ওর গুরু। আবার তুইই হয়ে উঠেছিস ওর প্রতিপক্ষ। তোকে ও অস্বীকার করতে চেয়েছে প্রাণপণ। নিজের মতো হতে চেয়েছে। যখন পথ খুঁজে পায়নি আবার ফিরে এসেছে তোরই কাছে। প্রেরণার জন্য। বিহান ঈর্ষার জ্বালায় তোর প্রতিপক্ষ হয়েছে। শ্রমণ হয়েছে মহত্বের প্রেরণায়। দুটো আলাদা ব্যাপার। ওরা ভেবেছে স্তাবকতা। আসলে শ্রমণও নিজের মতো করেই তোর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। মহত্বের ট্র্যাকে তোর ঠিক পাশে পাশেই ও দৌড়ে চলেছে।

আরও একজন আছে সেই ট্র্যাকে। তুই তাকে চিনিস। হৃদয় বলে।

তাই নাকি? কে সে? বিশ্রুত জানতে চায়।

হৃদয় তাকিয়ে থাকে বিশ্রুতর দিকে। চোখ ফেরাতে পারে না।

 

স্বপ্ন

Realism is not about how things are real but how things really are.

Jean Luc Godard

উদ্ভাস উঠে দাঁড়ায়। দোতলার বারান্দা। সামনে সমুদ্র। হাতে প্লাস্টিকের একটা ফুল। সেদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে ডাকে হৃদয়।

বল।

ফুলের বাগানকে বাঁচাতেই হবে। তোকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। সামনে থেকে। তুই আমার নেতা। আমার পথপ্রদর্শক। আমি তোর সঙ্গে থাকব। তুই তো একা নোস। আমি আছি। আমি তোকে সাধ্যমতো সাহায্য করব।

কাকে সাহায্য করবি তুই? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদয়। আমি এখন একটা ছায়ামূর্তি। কেউ দেখতে পায় না আমায়। আমি তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই। তারা আমাকে চিনতে পারে না। সবাই ব্যস্ত। সবার কাজ আছে। সবাই ছুটে চলেছে। আলো এখন আর আমার ভালো লাগে না। অন্ধকারেই স্বস্তিবোধ করি। নিজেকে আমি লুকিয়ে ফেলেছি।

তুই ফিরে আয় হৃদয়।

সে হয় না। আমার ফুলের বাগান এখন শুধু ছাই আর পোড়াগন্ধ। কেউ বেঁচে নেই। কিছুই বেঁচে নেই। বন্ধুরা সব প্রতিপক্ষ হয়ে গেল। একটা সময়। একটা স্মৃতি। একটা প্রেরণা। সব কিছুর মৃত্যু হয়েছে। ফুলের বাগান এখন ধ্বংসাবশেষ। আমরা সবাই বুকের ভেতর সেই ধ্বংসের এক একটা টুকরো বয়ে নিয়ে চলেছি। আমাদের আত্মায় এখন শুধু বারুদের গন্ধ। আমি বুক ভরে শ্বাস টানতে চাইছি। বাতাসে কোনও ফুলের গন্ধ নেই। কোথায় ফিরব আমি?

একজন বৃদ্ধ মানুষকে আমি চিনতাম। সে আমাকে তোদের ফুলের বাগানের কথা বলেছিল। প্রতি মাসে সে নিজের  সঞ্চয় থেকে কিছু কিছু করে টাকা পাঠাত।

তুই তাকে চিনতি? সত্যি? আমি তাকে একবারই দেখেছি। একটি মেলায়। আমি একাই ছিলাম আর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। উনি আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। তারপর গোটা দিনটা আমার হয়ে নিজেই সামলে ছিলেন। সেদিনই ফুলের ব্যাপারে আমি ওর অতুলনীয় নিষ্ঠা দেখেছিলাম। তারপর থেকে ফোনেই কথা হত। উনি আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। আমিও ওঁকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

যে রাতে তোদের ফুলের বাগানটা পড়ে গেল, সেদিন ভোরে সে এসে দাঁড়িয়েছিল সেই পোড়া বাগানের সামনে। একদৃষ্টে তাকিয়েছিল। সেই বিহান বলে ছেলেটা সে এসে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। তার দুহাত ধরে আগ্নেয় আর অতলান্ত। তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় সমুদ্রের ধারে। তারপর তিনজনেই তাকে বালিতে ফেলে শাসিয়ে বলে, আর কখনও যেন এখানে না দেখি। বৃদ্ধ আমাকে বলেছিল। খুব কষ্ট পেয়েছিল সেদিন।

হৃদয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর জানতে চায়, কেন ওরা অমন করল?

ওরা বলেছিল, তুই আমাদের কে? কেন এখানে এসেছিস? বৃদ্ধ বলেছিল, ফুল আমার ভালো লাগে। ফুলের বাগানও। আর হৃদয় তো বলেই, সে-ই ওর এবং ওর ফুলের বাগানের আত্মীয়। ওরা তিনজন একসঙ্গে হেসে উঠেছিল খুব জোরে। তারপর বলেছিল, এসবই হৃদয়ের কারচুপি। ফুলের বাগানটা ও গোঁজামিল দিয়ে চালাচ্ছে। এখানে থাকতে গেলে যৌবন লাগে। মগজ লাগে। গভীরতা লাগে। শুধু টাকা থাকলেই হয় না। তুই কোনওদিনই আমাদের কেউ হতে পারবি না। বৃদ্ধ তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠেছিল, এবার বুঝেছি, ওই ফুলের বাগানে কারা আগুন দিয়েছে। ওরা আবার হেসে উঠেছিল। তারপর বলেছিল, জানতে চাস তার নাম? হৃদয়। নিজের হাতে আগুন দিয়েছে সে। সে-ই সমস্ত সর্বনাশের মূল। বৃদ্ধ শান্ত গলায় বলেছিল, হৃদয় কোনওদিন আমাকে পর ভাবেনি। সবাইকে সে আপন করে নিতে জানত। সবাইকে সে স্বপ্ন দেখাতে জানত।

অরা পরে মিলিয়ে যাওয়ার আগে বলে যায়, সেটাই তো ওর ফাঁকি। ফাঁকি দিয়ে ও মহৎ হতে চাইছিল। আমরা আমাদের মেধা আর শ্রম উজাড় করে দিচ্ছিলাম। আর ও তোদের মতো বাতিল লোকজনকে প্রশ্রয় দিচ্ছিল। গোটা দুনিয়ার কাছে নিজের কৃতিত্ব দেখিয়ে বাহবা কুড়োচ্ছিল। আমরা ওকে শাস্তি দিয়েছি।

উদ্ভাস সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটতে থাকে। একবছর হৃদয়পুর দ্বীপে কোনও ফুল জন্মায়নি। তারপর গত দশ মাসে গড়ে উঠেছিল এই ফুলের বাগান। একটা অলৌকিক ঘটনা। উদ্ভাস আবার বলে, চাকরি করতে আর ভালো লাগে না হৃদয়। শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। একটা ফুলের বাগান না হলে চলে? কোথায় যাবো আমরা? কোথায় যাবে আমাদের মতো মানুষ? আদর্শ ছাড়া, স্বপ্ন ছাড়া, প্রেরণা ছাড়া মানুষ বাঁচে? কী অর্থ থাকে তখন জীবনের?

একপাশে এসে দাঁড়ায় বিশ্রুত। বলে, ঠিক বলেছিস? কোথায় যাবো আমরা?

অন্য পাশে এসে দাঁড়ায় শ্রমণ। বলে, হৃদয় বলতো সম্পর্ক তখনই টেকে, মজবুত হয়, অর্থপূর্ণ হয়, যখন তার কোনও উদ্দেশ্য থাকে।

বিশ্রুত বলে, তুচ্ছ, মামুলি কোনও উদ্দেশ্য নয়। মহৎ কোনও আদর্শ যে উদ্দেশ্যের প্রেরণা। হৃদয় বলত, এমনি সম্পর্ক রেখে কী হবে? শুধু ফূর্তি, আনন্দ, শস্তা লেনদেন। আমাদের কাজ করতে হবে। অনেক কাজ। কাজের প্রয়োজনেই আমরা মিলিত হয়েছি। সেই জন্যই আমাদের সম্পর্ক।

শ্রমণ বলে, ফুলের বাগান আমাদের একটা পরিচয় দিয়েছে। স্মৃতি দিয়েছে। সম্পর্ক দিয়েছে। মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছে আমাদের জীবনে। একে আমরা অস্বীকার করতে পারি না।

পরিচয়! উদ্ভাস বলে ওঠে। একটা পরিচয় চাই আমাদের। এই ইউনিফর্ম? পুলিশের চাকরি? এটা কোনও পরিচয় নয়। এই পোশাক আমি গায়ে দিলে তবে বেতন পাই। দাসত্বে স্মারক এটি। কিন্তু এই কি যথেষ্ট? এই ইউনিফর্ম গায়ে চাপালেই নিজেকে আমার অন্য একটা লোক বলে মনে হয়। আমি যেন নিজের অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। নিজের কাছেই আমার নিজের আর কোনও ওজন থাকে না। একটা গুরুত্বহীন, গড়পড়তা লোকে পরিণত হই। আমি বই পড়ি। সিনেমা দেখি। ভাবি। ফুলের কাছে ছুটে ছুটে যাই। একটা সমান্তরাল জীবন চাই। কবের থেকে চেষ্টা করছি আমি। একটার পর একটা চেষ্টা। জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হবে। বাতাসে কোনও ফুলের গন্ধ নেই। একটা ফুলের বাগানই পারে।

ডায়েরির পৃষ্ঠায় চোখ রাখে উদ্ভাস। একটা কথোপকথনে চোখ আটকে যায়।

আগ্নেয় – তুই চিন্তা করিস না। বল এখন আমাদের কোর্টে।

বিহান – মানে?

আগ্নেয় – আমরা সরে এসেছি। আমরা ছাড়া ওর চলবে?

বিহান – ঠিক বলেছিস। দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্ম বোঝে না। এইবার বুঝবে আমরা ওর কী ছিলাম।

অতলান্ত – আমাদের ওপর ও কতটা নির্ভরশীল ছিল। আর আমাদের ছাড়া কতটা দুর্বল হয়ে গেছে।

আগ্নেয় – ও আশা করে আছে আমরা ওর কাছে ফিরে যাবো।

অতলান্ত – ওকেই আমাদের কাছে আসতে হবে। ভিক্ষা চাইতে। আমরা তখন ওকে ফিরিয়ে দেবো।

তিনজন একসঙ্গে – হাঃ হাঃ হাঃ। ওকে আমরা একঘরে করে দিয়েছি। একঘরে। ও এখন একটা নন-এন্টিটি। ওর সঙ্গে এখন একটা পোকার কোনও তফাত নেই। এবার বুঝুক ব্যাটা, কত ধানে কত চাল।

দূরে ক্যাথিড্রেলের ভেতর থেকে একটা গুলির শব্দ আসে।

বিশ্রুত আর শ্রমণ বলে, যাই ওকে একটা নৌকায় শুইয়ে দিয়ে আসি।

উদ্ভাস জিপে ওঠে। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে, তাহলে তোরাই?

হৃদয় খুব কষ্ট পাচ্ছিল। আমরাই ওকে বললাম। আর কোনও উপায় ছিল না।

ঠিকই করেছিস। উদ্ভাস বলল। আমরা সবাই একটা অর্থহীন জীবন কাটাচ্ছিলাম। সেই জীবনটাকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছিল ও। খুব চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সময়টাই খারাপ। একটা গোটা প্রজন্ম একে অপরকে টেক্কা দিতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেল। ফুলের একটা বাগান। সেখানেও রেষারেষি। ঠেলাঠেলি। খাওয়াখায়ি। হৃদয় কোনও সম্মানই পেল না। ওকে সবাই মিলে ঠেলে দিল আস্তাকুঁড়ে। এই আমাদের দেশ। চারপ[শের এই অর্থহীনতা। কী করত হৃদয়? কী ভাবে বাঁচত? যা কিছু মহৎ, যা কিছু সুন্দর, তার প্রতিই ছিল ওর আকর্ষণ। অথচ কী কদর্য আর ঘৃণ্যই না হয়ে উঠেছিল সব কিছু। সবার জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছিল যে মানুষটা, সবাই মিলে তার জীবনটাকেই অর্থহীন করে দিল। ও নিজেও আর বাঁচতে চায়নি। হৃদয়ের মতো ছেলে কি আর একটা পোকা হয়ে বাঁচবে? আর পোকারা সব ডানা মেলে উড়বে ওর চারপাশে? এই নিষ্ঠুর কৌতুকের চেয়ে এই বরং অনেক ভালো হল। ঠিকই করেছিস তোরা।

দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল উদ্ভাসের জিপ। পাশেই রাখা হৃদয়ের ডায়েরি। আর তখনই সেই দৃশ্যটা দেখল উদ্ভাস। সমুদ্রের জল হঠাৎ যেন পুকুরের মতোই শান্ত হয়ে গেছে। আর সেই জলের ওপর ভাসছে অজস্র, অসংখ্য, রঙবেরঙের ফুল। কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই। যতদূর চোখ যায়, ফুলে ফুলে ভরে গেছে গোটা সমুদ্র। আর সেই  সমুদ্রের ওপর আলতো করে শোয়ানো আছে হৃদয়ের শরীর। জলের স্পর্শে মৃদু মৃদু দুলছে সেই শরীর। চোখদুটো খোলা। সোজা তাকিয়ে আছে ছায়া ছায়া আকাশে ছড়িয়ে থাকা তারাদের দিকে। মুখে একটা আশ্চর্য শান্ত ভাব। বাতাসটা হঠাৎ ফুলের গন্ধে ভরে গেছে। বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যায় উদ্ভাস।

(সমাপ্ত)

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন