![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
সুডোকু
প্রবেশপথে ভীষণ ভিড় ছিল। লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবার ফুরসত নেই কারো। জমকালো রোদে ঘেমে ভিজে উঠছিলাম। তখুনিই হাত বাড়িয়ে দিল জোসেফ। ঢুকে পড়লাম আমি। একপলকা শীতোষ্ণ হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল।
জোসেফ পথ দেখিয়ে নিচ্ছে। উঁচু সিলিং। স্পাইরাল সিঁড়ি। জানালায়
রংবেরঙের কাচ বসানো চৌকো খোপ ফ্লোরে, দেয়ালে অদ্ভুত নকশা
করেছে। দেখে মনে হল আগেও এসেছি এখানে। অথচ জোসেফ বলল-এবারই প্রথম! হতেই পারে প্রথম,
এমন সিঁড়ি তো আর একটা নয় পৃথিবীতে!
পিছু নিয়েছি জোসেফের। প্রথম গন্তব্য নয়তলা। এই ভবনটি বেশ পুরনো
কায়দার। কিন্তু তাই বলে লিফট থাকবে না সে কী করে হয়!
আউট অব অর্ডার। শ্রাগ করল জোসেফ।
গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আমার। প্রথম তলা থেকে পরিদর্শন শুরু করা যেত
না? নিজের কানেই কেমন বোকা বোকা লাগছে কথাটা। ছেলেটা আমার
মুখ দেখতে পাচ্ছে না। নইলে দেখতে পেত কেমন আমসির মতো হয়ে যাচ্ছি এই দশ মিনিটে।
অতঃপর নয় তলায় অবতীর্ণ হলাম। এরচেয়ে একখানা হেলিকপ্টারে চেপে বসা
গেলে বেশ হত। একেবারে ভবনটির ছাদে এসে নামিয়ে যেত আমাদের। তারপর নাহয় রয়ে সয়ে
নামতাম!
অভ্যর্থনার ভদ্রমহিলাটি দরজার দিকে ইশারা করতেই এগুলাম আমরা।
সবুজ রঙের দেয়াল।
একজন অশীতিপর বৃদ্ধা পরিপাটি বেশে অপেক্ষায় ছিলেন আমাদের। পরনে
আটপৌরে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। কপালে ঢাউস লাল টিপ। গায়ে চন্দনের সুবাস। ঠাকুমার মতো
দেখতে। আমার ঠাকুমা গত হয়েছেন অন্তত চল্লিশ বছর আগে৷ আজকাল তার চোখমুখ আর মনেও পড়ে
না। ইনি দেখতে অবশ্য ছবির বইয়ের ঠাকুমার মত।
এ ঘরটায় প্রথম বৃষ্টির পর যে ভেজা মাটির ঘ্রাণ হয়, তাই যেন পেলাম! এদেশের লোক নাম দিয়েছে ‘পেট্রাইকর’, শুনতে বেজায় আজগুবি। মনে হল জানালার ওপাশে উঁকি দিলেই জোড়া কদম গাছ
দেখতে পাব। আসমানী নীল রঙের ফিনফিনে পর্দা। তার দু'পাশে
ঝুলছে বাবুই পাখির ঘর। দেয়ালের এদিক ওদিকে লাল-নীল-সবুজ ঘুড়ি। একেবারে বাংলার,
সিধেসাধা শেইপ যার, ফ্যান্সি কিছু নয়।
টেবিলে তিন চারটে অটোমেটেড লাটিম, তারা অনবরত ঘুরে চলেছে।
পাশেই তালপাতার চশমা আর বাঁশি। একটা জলের পাত্রে রুল টানা কাগজের নৌকা ভাসিয়ে
দিয়েছে কেউ। এসব দেখে অজান্তেই হাত তালি দিয়ে ফেললাম।
কী মিষ্টি একটা ঘুমপাড়ানির সুর বেজে চলেছে কখন থেকে! থালাভর্তি
সন্দেশ, সাজ বাতাসার খেলনা, চিড়ের
মোয়া। একসাথে এতসব দেখে আমার চোখ একেবারে চড়কগাছ। আমার হাবভাব দেখে ঠাকুমাও
মিটিমিটি হাসছেন। কনুইতে হালকা চাপ খেয়ে হুঁশ ফিরে এলো। জোসেফের দিকে তাকালাম।
বলল-বেরুবার আগে মন্তব্যের খাতায় দুয়েক লাইন লিখতে ভুলো না!
আমি সানন্দে হ্যাঁ সূচক মাথা দোলালাম।
অষ্টম তলায় নেমে এসে ফুরফুরে মেজাজে রাশ টানতে হল। একটু গম্ভীর
মতো মধ্যবয়সী ভদ্রলোক অপেক্ষায় ছিলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। কপালের ভাঁজ স্পষ্ট।
সূঁচালো নাক, তীক্ষ্ণ চোখ। ইনি সম্ভবত পঞ্জিকার তিথি না
মিলিয়ে হাসেন না। হাসির কাছাকাছি যে ভঙ্গি সেটুকুও সম্পূর্ণ আড়াল করে রেখেছে ভারী
গোঁফের রেখা। চশমার কালো ফ্রেম একেবারে মাস্টারমশাই। হাতে ওটা কি? লেজার পয়েন্ট, না কি যা ভাবছি তাই! গলা আরো
শুকিয়ে এলো।
দেয়ালে দেখতে পেলাম বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালা। বুঝতে পারলাম কারণ
ইংরেজি আর বাংলা রয়েছে। সব এলোমেলো করে রেখেছেন ইনি। যখন যাকে পাবেন তাকেই হয়ত
বলবেন- সঠিক অনুক্রমে বিন্যাস করো দেখি হে!
রবি ঠাকুরের সহজপাঠ, বিদ্যাসাগরের
আদর্শলিপি এইসব ছড়ানো রয়েছে টেবিলে। একটা দেয়ালের সিংহভাগ জুড়ে বিশাল বড়
ব্ল্যাকবোর্ড। সেদিকে তাকিয়ে রীতিমতো ভিড়মি খেলাম। পাটিগণিত, বীজগণিত আর পিথাগোরাসের উপপাদ্য গিজগিজ করছে। জোসেফের হয়ত সেসবের ঝোঁক
আছে। সে ওদিকেই গেল। আমি এলাম অন্যদিকে। এদিকটায় বোধ হয় বিজ্ঞান মেলার আয়োজন
হয়েছে। ব্যাটারি চালিত নৌকা, সৌরশক্তি চালিত বাতি এইসব
সাজানো।
মাস্টারমশাই বসে রয়েছেন আরেক প্রান্তে। তার টেবিলে দাবার গুটি
ছড়ানো। একবার মনে হল গিয়ে বসে পড়ি। তারপর নিজেকে সংযত করলাম। ইনি নিশ্চয়ই দাবা
খেলার ফাঁকে তেরোর নামতা মুখস্থ বলতে বলবেন।
মন্তব্যঘরে কী লিখেছি জোসেফ বেশ কয়েকবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে
চেয়েছে। হাত দিয়ে ঢেকে রাখায় সুবিধা করতে পারেনি। স্কুলের পরীক্ষায় এভাবেই বোধ হয়
নিজের উত্তরপত্রটা চারপাশের শ্যেনদৃষ্টি থেকে সামলে রাখতাম।
সপ্তমতলায় এসে বিষম খেলাম। এ তো আমার ঘর। টেরাকোটা রঙের সিলিং।
আর দেয়ালের গায়ে সেঁটে আছে সব চরিত্র কাল্পনিক। একদিকে শঙ্কু, ফেলুদা আর তোপসে। আরেকদিকে কিশোর, মুসা আর
রবিনের পাশে টিনটিন আর টেনিদা। একটা তক্তপোশে সাদা কালো চাদর পাতা। তার ওপর এদের
অভিযান সমগ্র। টেবিলে চোখ পড়তেই দেখলাম চল্লিশ ছুঁইছুঁই এক ভদ্রমহিলা ধোঁয়া ওঠা
গরম দুধের মগ রেখে বললেন -খেয়ে নি, বাবু। আর হ্যাঁ,
রাত জাগবে না।
আমি চাবি দেয়া পুতুলের মত ঘাড় নেড়ে বললাম- আচ্ছা!
বিছানায় বসে কতক্ষণ বইগুলো নাড়াচাড়া করলাম তার খেয়াল ছিল না।
জোসেফ তাড়া দিতেই উঠতে হল।
সিঁড়ঘর থেকে মনে হল কোথাও কেউ গাইছে- 'বুকের
মধ্যে বড়ে গোলাম'। হ্যাঁ, ছ’তলায়
এসেই সে গান স্পষ্ট হল। ঘরটা নীল রঙের। বিছানার চাদর, পর্দা
সব বরফ সাদা। তাতে নীল নীল ঘাসফুলের ছটা। আরামে গা জুড়িয়ে আসছে আমার। একটা চেয়ারে
জিন্স, শার্ট, সোয়াটার এইসব ডাঁই
করে রাখা। টেবিলের ওপর জীবন, পূর্ণেন্দু, শঙ্খ ঘোষের কবিতারা ছড়িয়ে আছে। আধখোলা ডায়েরিতে উঁকি দিলেই হয়ত দেখব
কেউ লিখে রেখেছে- 'প্রভু নষ্ট হয়ে যাই…'
বিছানায় পা ছড়িয়ে বসলাম। ডায়েরিতে মাধবীলতার জন্য বোধ হয় কবিতা
লিখছিল অনিমেষ। অথবা সবিনয় নিবেদন জানিয়ে কোনো আবেদন পত্র। দুটোই অসমাপ্ত।
হয়ত দেয়ালের বুক থেকে চে গেভারার হাতছানিতে সাড়া দেবে বলে যুবকটি
কবিতা বা চিঠিখানা ছেড়ে চলে গেছে। এ ঘরটার কোনো কোণেই আমি তাকে দেখতে পেলাম না।
একটা ইজেলে রাখা ঝকঝকে ক্যানভাস শুধু ভিনসেন্টের সানফ্লাওয়ারকে সতেজ রেখে দিয়েছে৷
এবারে বোধ হয় শ্রাবণী গাইছেন- 'আমার কাজের মাঝেমাঝে,
কান্নাহাসির দোলা তুমি থামতে দিলে না যে।'
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে এবার যাকে পেলাম তার নাম হয়ত মার্গারিটা।
প্রগাঢ় নীল চোখ তার। চোখ বুঝলেই দেখি ওর বাড়ির সাথে লাগোয়া উইলোর সারি, প্রবল ঝড়ে উড়ে যেতে যেতে যার পাতাদল তাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল।
তারপর চোখ মেলতেই দেখি সে আর নেই। আজানুকেশ বৃষ্টিতে ভেজা অন্য
কেউ জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একপাশ থেকে দেখতে মনে হল ওর নাম হয়ত আনন্দি,
যার কণ্ঠে 'ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস' শুনতে শুনতে যুবকটি ঘুমিয়ে পড়ত
রোজ।
একদিকে একচিলতে রান্নাঘর, যেমন থাকে
স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে। স্টোভে বসানো কেটলিতে সোনালি রঙের জলের বুকে চনমনে চা
পাতারা খাবি খাচ্ছে। প্লেটে ছড়ানো টোস্ট বিস্কুট আর একমুঠো নিমকি। আমি গিয়ে বসলেই
হয়ত আনন্দি এসে রজনীগন্ধার কাপে চা পরিবেশন করবে।
জোসেফকে এবার দেখতে পেলাম। মনে হল যেন এর মাঝে একযুগ পেরিয়ে
গেছে। বুকের ওপর দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে জোসেফ। চার্চের ফাদারের মত এখুনিই
মন্দ্রকণ্ঠে বলে উঠবে- তোমার যদি আরো কিছু বলার থাকে, বলে
হালকা হবার থাকে, তবে বলো। আমি তো রয়েইছি সব শুনব বলে।
ওর পিছু পিছু এলাম পরবর্তী ঘরে। এ ঘরটার নাম দেয়া যায় 'ভোর ভঁয়ো'। পরিচ্ছন্ন, তকতকে। দরজা খুলেছিল যিনি তার হয়ত সুতনুকা নাম। বাঁ চোখের নিচে গালের
ওপর তিল। সরু ঠোঁটে আন্তরিক হাসি ছড়ানো যার।
চারদিক দেখছি৷ ড্রেসিংটেবিলের আয়নাটা ঝকঝকে, মাথার ওপর একজোড়া পরি। দেয়ালে নবপরিণয়ের যুগল ছবি। সিলিং ফ্যানের
হাওয়ায় লেইস বসানো পর্দা, ডোর চাইম সব দুলছে।
সুতনকা সুর তুলে ডাকল- খাবে, এসো।
ধোয়া ওঠা ফুলকো ফুলকো ভাত। লাল টুকটুকে মাছের ঝোল। ঘিয়ে ভাজা
আলু৷ মনে হল কত জন্ম অভুক্ত ছিলাম।
জোসেফ এসে কাঁধে হাত রাখতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। ওর হাসি বলছে- এখানেও
সময় ফুরিয়েছে।
লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে। যাক বাবা রিপেয়ার হয়েছে তবে৷
জোসেফ গ্রাউন্ড ফ্লোরের সুইচ চাপল। আমি ভাবছি অন্য ফ্লোরগুলোর কথা, যেগুলো দেখা হল না। জোসেফকে বলতেই সুন্দর করে হাসল ছেলেটা। কিন্তু
কিছুই বলল না। আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে রইলাম। সাঁই সাঁই করে নিচতলায় নামিয়ে
দিয়ে গেল আমাদের। এক্সিটের দিকে হাঁটছি আমরা।
ওকে থামালাম। কিছু তো দেখা বাকি রয়ে গেছে। এ ভবনটা তো নয়তলা।
জোসেফ বলল- সেই তো, সবটুকু না দেখে চলে
যাওয়া কি ঠিক কখনো? সময় নাও। ভেবে জানাবে আমাকে।
মাথা দোলালাম, যন্ত্রচালিতের মতো।
তার আগে এটা পড়তে ভুলো না। জোসেফের মুখে ঝকঝকে, প্রশস্ত হাসি।
আমার হাতে সে আজকের ট্যুরের সামারিটা ধরিয়ে দিল। বাঁপাশের
লেখাগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। 'পাস্ট
হিস্ট্রি: সুইসাইড এটেম্পট।' জোসেফের হাতের লেখা চমৎকার। মুক্তোদানার
মতো অক্ষরে নিজের নামটা পড়তে আমার এতটুকু অসুবিধা হল না।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন