ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে
ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে আজও যে গানগুলো
রাজার মুকুট হয়ে পড়ে রয়েছে বাংলা সঙ্গীতের উজ্জ্বল আকাশে, সেই গানই তো আমাদের সম্পদ।
অলঙ্কার। বর্ষা আসলেই যে গান বিরহের মতো আজও বেজে ওঠে মণিকোঠায়, এক আত্ম-বেদনার ঝড়
তোলে।
‘শাওন রাতে যদি
স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে
নয়নে বারি ঝরে’
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের রোমান্সের কথা মনে করিয়ে দেয়। মান্না দের কন্ঠে সেই গান এক শ্রাবণ মেঘের ভেলায় ভেসে ভেসে আমাদের কোনোও একাকী হৃদয়ের বীণার তন্ত্রীতে বেজে ওঠে। প্রেমের উষ্ণতা জেগে উঠতেই যে গান হৃদয়ের বীণার তন্ত্রীতে বেজে ওঠে, প্রখর গ্রীষ্মে যে সুর প্রকৃতির এক চরম তীব্রতাকে কী সুন্দর ও নিদারুণভাবে প্রকাশ করে, সেই গানই তো বারবার মনে করিয়ে দেয় বাংলা গানের বিশেষ করে আধুনিক বাংলা গানের সেই জনকের কথা প্রজন্মের পর প্রজন্ম যাকে আজও ভালবাসার রাজপ্রাসাদে রাজা করে রেখে দিয়েছে, তিনি হলেন মান্না দে। শুধু নাম নয়, যিনি এক প্রতিষ্ঠান। শুধু গান নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সংগীতশিল্পী। শুধু বাংলা নয় - হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটি সহ নেপালি, আসামী, মাগধী সহ্ প্রায় ২৪টি ভাষায় গান গেয়ে যিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলার সংগীত জগতকে। আট থেকে আশি যার গানে মুগ্ধ হয়েছে বরাবর। আজও সেই গান যুগোপযোগী ও প্রাসঙ্গিক। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎকে, সংগীতের মধ্যে দিয়ে যিনি আলোকিত করেছেন একের পর এক গান দিয়ে, তিনি আমাদের বাংলার গর্ব। বাংলাগান তথা হিন্দি গানের বেতাব বাদশা মান্না দে। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি। সংগীত জগতে অসাধারণ অবদানের জন্য ভারত সরকার তাকে ১৯৭১এ পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেন। ২০০৫এ পদ্মবিভূষণ, ২০১৭তে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে অভিষিক্ত হন তিনি। ২০১১তে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান বঙ্গবিভূষণ প্রদান করা হয। এই পুরস্কার, সম্মান ছাড়াও গোটা ভারতবাসীর হৃদয়ের রাজপ্রাসাদের বাংলা গানের সম্রাট হয়ে আজও বেঁচে আছেন তিনি।
কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের হাত ধরেই মুম্বাইতে আসা ১৯৪২ সালে। সেখানে শুরুতেই কৃষ্ণচন্দ্র দের অধীনে সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন এবং তারপর শচীন দেব বর্মনের অধীনে দীর্ঘ সময় কাজ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে পরিচিত হন তৎকালীন স্বনামধন্য সুরকার ও গীতিকারদের সঙ্গে। ‘তামান্না’ ছবিতে গায়ক হিসেবে তার প্রথম অভিষেক ঘটে। ‘মশাল’ ছবিতে শচীন দেব বর্মনের গীত রচনায় একক গান তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। এরপর 'আমর ভোপালি’ ছবিতে গান গেয়ে ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর মর্যাদা পান। বাংলার সীমানা পেরিয়ে হিন্দি গানের জগতে এক অনন্য নাম হয়ে ওঠে মান্না দে। কিশোর কুমারের সাথে 'ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোরেঙ্গে’... শোলে ছবির সেই বিখ্যাত গান আজও তরুণ প্রজন্মকে দুলিয়ে দিয়ে যায়। পাশাপাশি লতা মঙ্গেসকারের সাথে দ্বৈত সংগীতে ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ - 'শঙ্খবেলা’ ছবির সেই চিরকালীন রোমান্টিক গান, শ্রোতার হৃদয়কে আলোড়িত করে। বাংলার ঐতিহাসিক গানগুলির মধ্যে আরও একটি সেরা গানের তকমা পেয়েছিল ‘কফি হাউসের সেই আড্ডা’ স্মৃতির স্মরনী বেয়ে যে গান বহু মানুষকে তার যৌবনের উদ্দিপ্ত সময়কে মনে করিয়ে দেয়। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে কণ্ঠ দিয়েছিলেন মান্না দে ১৯৮৩ সালে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখায় অসংখ্য গান গেয়েছিলেন তিনি। বিরহ বেদনার গান তাঁর কণ্ঠে যেন প্রাণ পেতো। আর একটি অনবদ্য গান ‘ও আমার ছোটবোন…বড় আদরের ছোটবোন’। আসলে
সব ধরনের অনুভূতির গানের সঙ্গেই
ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। সাবলীল গায়কী, ভঙ্গি এবং বাচনশৈলীতে তিনি এক একটি গানকে প্রাণ
দিতেন। সেই সময়ের গীতিকার সুরকার সংযোজকরা মিলে তৈরি করতেন যেন ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ।
স্বনামধন্য সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর লেখায় বারবার স্বীকার করেছেন, মান্না দের দরদী কন্ঠের কথা এবং মানুষ হিসেবে তিনি কতটা উন্নত ছিলেন। বলেছেন, এক বড় মাপের মানুষ এবং মেজাজে মজলিসী মানুষ ছিলেন মান্না দে। 'গানের গল্প ও গল্পের গান’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, “একটা গান তোলাতে গেলাম, সিল্কের লুঙ্গি ও আর একটা চকচকে শর্ট পড়ে প্রবেশ করলেন ঘরে। হাতে প্যাড ও কলম। শুরুর সংলাপ বললেন, অভিজিৎবাবু কী খবর? ভূমিকার মেজাজে এমন কোনোও ভাব আদৌ নেই যে আমরা কোন একটি ছবির গান রেকর্ডিং-এর কারণে মিলিত হয়েছি। সংগীত জগতের মানুষদের কী খবর, কে কীরকম আছে, জুনিয়াররা কেমন গাইছেন, বাংলা গানের অবস্থা কীরকম? দেশের অবস্থা, সামাজিক পটভূমিকা কেমন? সবটা নিয়েই আলোচনা করতেন তিনি। আবার লুঙ্গি পরে বাজার করতে যাওয়ার মেজাজি সাবেকি বোধটাও তাঁর ছিল। মান্না দে ছিলেন তার অন্যতম কারিগর"।
গোটা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি, ফিল্ম
ইন্ডাস্ট্রি এই নামটার সঙ্গে আজও এবং চিরকাল এভাবেই জড়িয়ে থাকবে।
ভাবতে অবাক লাগে এক জীবনে এত ধরনের,
এত রকম অনুভূতি মিশ্রিত গান গাইলেন কী করে! রাগাশ্রয়ী গান থেকে বাংলা আধুনিক, রোমান্টিক
গান, পপঘেঁষা গান, স্যাটায়ার গান, কাওয়ালি থেকে ভজন, নজরুলগীতি থেকে দ্বিজেন্দ্রগীতি যেমন গেয়েছেন, তেমনি
‘বাজে গো বীণা’র মত অনুভব ঝংকৃত গান ও 'জীবনে কী পাবো না'র মত বাংলা পপগান মাতিয়ে
রেখেছে আজও গানের ভুবন। বর্তমান সময়ের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের মুহূর্তেও মান্না দের কণ্ঠে উচ্চারিত গান
আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা হয়ে রয়েছে। কারণ সুচারু
কারুকাজের নান্দনিক বুননের মারফত
যে ছবিটি তিনি বাংলা গানের ক্যানভাসে এঁকেছেন, তাঁর রক্ষণশীলতার কারাগার থেকে মুক্ত
ঐতিহ্য সংগীতের সহজ স্বচ্ছ বিচরণ চলমানতার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত।
বিশেষ করে ছায়াছবির গানের দৃশ্যকে
তিনি সজীব করে তুলেছেন। জীবন্ত হয়ে উঠতো এক একটি গান তাঁর কন্ঠে। যেরকম – “বড় একা
লাগে"… এই গানটি আমরা বারবার শুনেছি। বিষণ্ণ নির্জনতা রাতের আঁধার যখন ঘনিয়ে
আসে হৃদয়ে, তখন এই গানটি আমাদেরকে সেই নির্জনতার সঙ্গে একাত্ম করে দেয়। অথবা “কাহার
বা নয় দাদরা বাজাও”… এই গান যেন মাহফিলের রাতের আঁধার, অথবা "আজ রাতে আর যাত্রা
শুনতে যাব না"র মত গানের দৃশ্যের কথা ভাবনা আর সেইসঙ্গে মান্না দের গাওয়া গানের
মধ্যেকার সেই নাটকীয়তা, আমাদের হৃদয়কে একেবারে নিংড়ে নিয়েছে। মুম্বাইয়ে বছর সাথে
লড়াইয়ের পর যে গানটি দিয়ে তিনি পাদপ্রদীপের আলোতে এসেছিলেন, সেটি হল 'মশাল' ছবির
"উপর গগন বিশাল"...। প্রথম দিকে তিনি ধ্রুপদী ঢঙে বেশ কিছু গান গেয়েছিলেন,
যা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর হলেও, কমার্শিয়াল ভ্যালু খুব একটা ছিল না, বা সেভাবে কমার্শিয়ালি
কেউ ততটা গুরুত্ব দেননি। তখনকার সংগীত পরিচালকদের মধ্যে অনেকেই মনে করতেন, মান্না দে
লাইফ রোমান্টিক গান গাওয়ার পক্ষে ততটা উপযুক্ত নন। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বা মানসিকতাকে
পেরিয়ে তিনি এগিয়ে গেছেন। আর এভাবেই চলতে চলতে রাজ কাপুরের কন্ঠে প্রচুর প্লেব্যাক
করেছেন। যার মধ্যে আছে "পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া হ্যায়"র মতো রোমান্টিক
নাম্বার।
তবে সাফল্য আসা সত্ত্বেও, পাঁচের দশকে মহাম্মদ রফি কিংবা কিশোরকুমারের মতো কম্পোজার প্রিয় তিনি হয়ে উঠতে পারেননি।। সংগীত পরিচালক নওশাদ একসময় বলেছিলেন, মান্না দের ভয়েজ নাকি ড্রাই। তাই তিনি তাঁকে নিয়ে কাজ করতেন না। সেই সময়টা এমন ছিল যখন দেবানন্দ থেকে শুরু করে দিলীপকুমার পর্যন্ত সকলেই নিজেদের গলায় রাফি সাহাবের গানই পছন্দ করতেন। এমনকি কম্পোজাররাও নায়কদের ইচ্ছাই পূরণ করতেন। অথচ একই সময়ে শচীনদেব বর্মন মান্না দে’কে দিয়ে একের পর এক অসাধারণ গান গাইছেন – “তু পেয়ার কা সাগর হ্যায়", “ওর কাঁহা জায়ে হাম", “অ্যায় মেরে পেয়ারে ওয়াতন” -
মান্না দের কন্ঠে এইসব গান শুনে
শ্রোতারা পেয়েছিলেন অন্য গন্ধ, অন্য স্বাদ। এই গানগুলিকে কোন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন মান্না দে, সে তো বলার অপেক্ষা
রাখে না। মান্না দের গান যদি অধিক জনপ্রিয় হয়ে থাকে কোনো অভিনেতার লিপে, তিনি হলেন
বলরাজ সাহানি। “অ্যায় মেরি জোহরা জবী”, “তুঝে সুরাজ কঁহু ইয়া চান্দা", “তু পেয়ার
কা সাগার হ্যায়” - সবকটি গানই ছিল বলরাজের চরিত্রের লিপে। শুধু নায়ক নয়, মান্না
দেকে দিয়ে চরিত্র অভিনেতার কণ্ঠে জনপ্রিয় গান গাওয়ানো শুরু করেছিলেন আর ডি বর্মন।
‘ভূতবাংলা’, ‘চন্দন কা পালনা’, ‘পড়োশান’ ছবিতে দুর্দান্ত কম্পোজিশনে মান্না দে’কে
যে সমস্ত গান দিয়েছিলেন, তা হিন্দি ছবির ইতিহাসের চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। কল্যাণজি-আনন্দজি,
লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল হিন্দি ছবিতে যে ট্রেন্ড এনেছিলেন, পরে সেই ট্রেন্ড অনুসরণ
করেছিলেন মান্না দে স্বয়ং। শোনা যায় 'উপকার' ছবিতে "কসমে ওয়াদে পেয়ার বফা
সব"… গানটি গাওয়ার অনুরোধ নিয়ে কল্যাণজি-আনন্দজি গিয়েছিলেন কিশোরকুমারের কাছে।
কিন্তু কিশোরকুমার স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, এই গানটির প্রতি সঠিক বিচার যদি কেউ করতে
পারেন, তাহলে তিনি মান্না দে। কিশোরের কথা শুনে মান্না দে’কে দিয়েই এই গানটি গাওয়ান
সুরকার যুগল। পরের গল্প তো ইতিহাস হয়ে গেছে। তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গানগুলির
মধ্যে আজও এই গানটি সেরার সেরা হিসেবে বিবেচিত
হয়। পরের দশকগুলিতে তিনি মূলত বর্ষীয়ান অভিনেতাদের কন্ঠ হয়ে থেকে গিয়েছিলেন। যদিও
এসবের মধ্যেই ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের 'আনন্দ’ ছবিতে তিনি কণ্ঠ দিয়েছিলেন। রাজেশ খান্নার
লিপে মান্না দের গাওয়া অবিস্মরণীয় সেই গান
প্রজন্মের পর প্রজন্ম গেয়ে চলেছেন। ততদিনে কিশোরকুমার কন্ঠের ম্যাজিক সারা দেশকে আচ্ছন্ন
করে রাখে। সংগীত পরিচালকেরা কিশোরকে নিয়েই কাজ করতে বেশি উৎসাহী ছিলেন।
সেরকম সময় মান্না দে স্তম্ভের
মতন নিজের অহংকারকে বাঁচিয়ে কাজ করে গেছেন। আবার বাংলার ক্ষেত্রে তিনি হয়েছিলেন সম্রাট,
আট থেকে আশির মন জয় করেছিলেন মান্না দে। সেইসঙ্গে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে মান্না দে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জুটি। এমনিতেই মানুষ
বাইপোলার জুটি পছন্দ করে। সত্যজিৎ-ঋত্বিক। আশা-লতা। শক্তি-সুনীল। উত্তম-সৌমিত্র। শম্ভু
মিত্র-উৎপল দত্ত। সেরকমই মান্না দে-হেমন্ত মুখোপাধ্যয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যদি হন
বাংলা গানের আষাঢ়, মান্না দে তবে শ্রাবণ। দুজন দুই মেরুর গায়ক। বাঙালি ধুতি পড়ুক
বা জিন্স পরুক দুজনেই বাঙালির হিরণ্ময় জলসাঘর। তালপাতা থেকে সিলিংফ্যান হয়ে বাঙালির
ঘর, সেটা তো নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেল। কিন্তু মান্না-হেমন্তের বাইপোলার নুন হলুদে মিশে
গেছে। ঠিক যেভাবে চৈত্র মিশে যায় বৈশাখে।
পঞ্জিকা মিশে যায় মোবাইলে। বিরাট কোহলি মিশে যায় খাবার টেবিলে। বব ডিলান লালন ফকিরে।
এঁরা দুজনেই সেভাবে মিশে গেছেন বাংলায় আর বাঙালির রক্তের শিরায় উপশিরায়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন