কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

তপনকর ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


বৃত্তটা বড়ো হচ্ছে

তারপর কী হল, জানতে চেয়ে, উত্তর না পেয়ে সুধন্য অবাক হয়ে ভাবছিল, বিমল কি শুনতে পায়নি? এত কাছে গায়ে গা না ঠেকিয়ে যে দূরত্ব, সেখান থেকে বিমলের শুনতে না পাবার কথা নয়! তবে কি ইচ্ছে করেই বিমল উত্তর দিচ্ছে না!

কিন্তু এমন তো হবার কথা ছিল না! যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে বিমল তৈরি থাকে। ঠিক বা ভুল, ভালো লাগুক বা না লাগুক, তার কিছু এসে যায় না, উত্তর সে দেবেই। উত্তর দেওয়ার মধ্যেই তার শান্তি। তার স্বস্তি। যখনই সে উত্তর দেয়, ঠিক উত্তর হয়তো নয়, কথার পিঠে কথা অথবা মন্তব্য, বিমল দ্রুত এবং তৎক্ষণাৎ বলে ফেলে বা বলে ফেলতে পারে, এবং যারা শোনে চমকে যায় অথবা বিরক্ত হয়। কেউ কেউ হয়তো বিমলের মুখ ঘুষি মেরে মুখ ফাটিয়ে দেবার আক্রোশে রাগে ফুটতে থাকে। বিমলকে কেউ সহ্য করতে পারে না। বিমলকে কেউ ভালোবাসে না। বিমলের উপস্থিতি অস্বস্তিকর। তার জন্য অন্যদের মনের শান্তি বিনষ্ট হয়। মানসিক স্থিতি এলোমেলো হয়ে যায়।

একটা সময় ছিল, যখন বিমল মানেই ছিল নর্দমার পাঁক বা নোংরা ঘাঁটার অনুভূতি। সেইসব দিন পার করে এখন যে সময়, সেই সময়ের চাপে অনেক কিছু সহ্য করার ফাঁকে অনেকদিন হল সেইসব অপছন্দ বা অশান্তি বা দুর্দশা বা কষ্ট, যেভাবে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেনে নেওয়া, তারই মধ্যে নর্দমার  পাঁকের গন্ধ নাকে এলেও খুব বেশি তীব্র মনে হয় না। এখন যে কেউ বিমলের সঙ্গে একই ঘরে, একই সোফায় বা চেয়ারে পাশাপাশি অথবা এক বিছানায় আন্তরিক সময় কাটাতে পারে। যদিও সে এখনও অনেকের কাছেই অসহনীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত, এঁটো বাসনের মতো ইচ্ছে করলেই ছোঁয়া যায়, শুধু একটু পরিষ্কার করে নেওয়ার অবকাশ চাই, যা একসময়ে অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। সেই অভ্যাস থেকেই  সুধন্য জানতে চেয়েছিল, তারপর কী হল?

একটু আগে বিমল যা বলেছিল…

১) চমকানোর সব আইটেম যখন হাতের মুঠোয়, আরও বেশি যৌবনের লোভে সিংহের অন্ডকোষে সাত তাড়াতাড়ি কামড় বসাতে গিয়ে, চামড়া ছাড়ানোর পর বাঘ, সিংহ, শিয়াল, কুকুরের ভেদাভেদ করতে না পেরে ছোট পকাই ভুল করে শিয়ালের অন্ডকোষ কামড়ে ধরেছিল। অনেকক্ষণ, যতক্ষণ না শিয়াল তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছে, আরে গাধা, আমি সিংহ নই, শিয়াল।

পঞ্চাশ বছর আগে হলে, এই কথার জন্য বিমলকে পরিত্যাগ করা হত। আর তিরিশ বছর আগে হলে, বিমলের কথা বলার ভঙ্গির জন্য ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে রাস্তায়, তেমন তেমন ক্ষমতা থাকলে বিমলের নাক মুখ ফাটিয়ে হাসপাতালে, আঘাত কম হলে ওষুধের দোকানের পিছনে বসা ডাক্তারের ছয় বাই ছয় খুপরিতে।

সেই তিরিশ বছর আগের সময় থেকে এখন যে ভাবে সময় এবং সময়ের সঙ্গে মানুষ, মানুষের ঘর বাড়ি, তাদের সম্পর্কে থাকা অন্য মানুষেরা, তাদের বাপ, দাদা, মা, ঠাকুমা, বোন, আত্মীয়রা, বন্ধু শত্রু, পরিচিত, অপরিচিত সবাই খোলনলচে বদলিয়ে যে চেহারায়, কখনো মনে হয় প্রগতিশীল, তো কখনো চরম প্রতিক্রিয়াশীল -- সেই প্রেক্ষিতে বিমলকে আর অশ্লীল মনে তো হয়ই না, বরং বেশি বেশি করে  একজন অন্যস্বরের মানুষ হিসেবেই তার স্বীকৃতি।

বিমলের বর্ণনা এখন সরাসরি বা গোটা গোটা নয়, একবার শুনে বোঝা যায় না এমন কিছু — এড়িয়ে যাবার উপায় নেই এমন কিছু — যা হালকা উত্তেজনা ও কৌতূহল জাগায়। সবার উপরে সে কিছু বলতে চায়। যাদের কথা কেউ বলে না, সে তাদের কথা বলতে চায়।

বিমল কি এই প্রথম আমার কথার উত্তর দিল না? — সুধন্য নিজেকে প্রশ্ন করে। বিমলের দিকে তাকায়।

চুপচাপ বসে থাকা বিমলের চোখ খোলা জানলার বাইরের অন্ধকারে, কখনো বা ঘরের দেওয়ালের জমাট বাধা প্রতিরোধে।

দৃষ্টি তার যেখানেই থাকুক, তার কথা তো বন্ধ হবার নয় — সুধন্য ভাবে।

এখন তো সে মূল স্রোতে। ধীরে ধীরে একটা জায়গা করে নিয়েছে। নিশ্চয়ই সে আগের থেকে অনেক স্বস্তিতে। সেই কারণে আরো কিছু শুনতে চেয়ে সুধন্য প্রশ্ন করেছিল, তারপর?

একটু আগে বিমল আরো যা যা বলেছিল…

২) হাতের মুঠোয় যার পৃথিবী, সেই ছোট পকাই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এ কী শুনছে সে! শেষ পর্যন্ত শিয়ালের অন্ডকোষ! সিংহের মতো গর্জন করে উঠলেও পকাইয়ের গলা থেকে বের হল হুক্কাহুয়া…, সঙ্গে সঙ্গে দূর দূরান্ত থেকে হাজার হাজার হুক্কাহুয়া…

গর্জন সে আগেও করেছে। সম্ভ্রম জাগানো, ভয় পাওয়ানো সেই গর্জন। ইচ্ছে করলে যখন খুশি ছোট পকাই গর্জন করত।

ছোট পকাই আরো জোরে সিংহের বাপ দাদা চোদ্দপুরুষের সমবেত গর্জন গলায় এনে চেষ্টা করল। কিন্তু কয়েক লক্ষ হুক্কাহুয়া দূর থেকে —  আরও দূর দূরান্ত থেকে — একযোগে কান ফাটানো সেই ডাক ছোট পকাইকে অবাক করে দিল।

একশো বছর আগে বিমল গাছের সঙ্গে কথা বলত। সূর্যের আলো ঢোকে না এমন অরণ্যে বৃক্ষের গুঁড়িতে শরীর এলিয়ে সে তার কথা বলত। অরণ্যের বাইরের মানুষেরা তার কথা বুঝতে পারত না।

সেই সব মানুষের সঙ্গে সে কখনো কথা বলেনি। আরও দুশো বছর আগে, মানুষের সঙ্গে কথা বলার অপরাধে তার পূর্ব পুরুষেরা উজার হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে বিমল গাছ, পাথর আর জলের সঙ্গে কথা বলত। কখনো পাখি বা জঙ্গলের পশুদের সঙ্গে কথা বলত।

 বিমল আরো যা যা বলেছিল…

(৩) ছোট পকাই বুঝে যায় কিছু একটা কেলো হয়েছে। ভালোমন্দ বিবেচনায় তার সেরা জিনিস খাবার অভ্যাস। বছরের পর বছর সেরা মাল ভোগ করার অধিকার সে অর্জন করেছে। সিংহের অন্ডকোষ ভোগ করার অধিকার তার জন্মগত। সিংহের যৌবন সে পেল না। তার শরীরে তখন শিয়ালের যৌবন। কন্ঠে হুক্কাহুয়া। সিংহ তো এরকমই… যা হোক ভেবে নিয়ে হাঁটতে গিয়ে পকাই দেখে, সে হাঁটতে পারছে না, বসার চেষ্টা করেও বসতে পারল না। এমনকী দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতাও তার নেই। কী করবে বুঝতে না পেরে সে একটা ঝোপের খোঁজ করতে শুরু করল।

যতবার বিমল তার কথা শেষ করেছে, সুধন্য বলেছিল, তারপর! বিমলও শুরু করেছিল পরের অংশ। কিন্তু এই শেষবার, সুধন্যর প্রশ্নে সে কথা বলেনি। উত্তর না দিয়ে সে থাকেনি কখনো, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বিমল একটানা, একনাগাড়ে এবং ক্লান্তিহীন। এমনও হয়েছে, টানা দু'দিন বিমলের কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে সুধন্য বলেছিল, আজ এই পর্যন্ত। তখন হয়তো গভীর রাত, বিমল চলে গিয়েছিল, অথবা কোনদিন — ঘুম পাচ্ছে, অনেক তো হল — বলার পরে বিমল নিঃশব্দে চলে যেত। সুধন্য কোনদিন বিমলকে বলেনি, এত রাত! কোথায় যাবে? এখানেই থেকে যাও।

আজ, নীরবতা  ভেঙে বিমল বলেছিল, তোমার এখানে একটু ঘুমোব!

সুধন্য চমকে উঠেছিল। বিমল যদিও সহ্যের মধ্যে অনেকদিন, এখন আর অস্বস্তি হয় না, ওর সঙ্গে সময় কাটানো যায়, তবু এক বিছানায়…

বিমল বলেছিল, অনেকদিন ঘুমাইনি।

সুধন্যদের সেই কবে থেকে ইচ্ছে, বিমল তাদের মতো হোক। ধীরে ধীরে সহ্যের দিকে এগিয়েছে বিমল।

খাটের নক্সাকাটা চাদরে বিমল ঘুমিয়ে আছে। সুধন্য দেখে, বিমলের দু'হাত দুটি বর্গক্ষেত্রে। একটা  পা একটা ত্রিভুজের উপরে। আর একটা পা সরলরেখার উপর লম্ব ভাবে। চাদরের মাঝখানে একটা বৃত্ত। বিমলের শরীরের আড়ালে ঢাকা সেই বৃত্তটা আস্তে আস্তে বড়ো হচ্ছে।

আজ সারারাত সুধন্য জেগে থাকবে। বিমল এতদিনে মূলস্রোতে। বৃত্তটা বড়ো হতে হতে কাল সকাল। ততক্ষণ তাকে জেগে থাকতে হবে। একটা মাত্র রাত।

এটা একটা খেলা। এই খেলায় হারজিত নেই। ফলাফল নেই। শুধু খেলে যেতে হয় আর অপেক্ষা।

এর জন্য সুধন্য ক্লান্ত হয় না। সে তার ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন। খেলার নিয়ম কানুন তার মুখস্থ।

দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু সুধন্য টের পায়, বৃত্তটা বড়ো হচ্ছে।

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন