ধারাবাহিক উপন্যাস
অস্তাচল
শূন্যের থেকে এক কম
একটা ছুটন্ত হরিণের শিঙের উপর একটা সরিষার দানা যতক্ষণ থাকে, ঠিক ততক্ষণই মায়া সম্বরণ করেছিল তার দৃষ্টি। আর ঠিক সেই সময় জন্ম হয়েছিল শুকদেবের। তবে এ তো গেল সেই সময়ের কথা। এই সময়ে আবার একটা স্পার্ক, সেই মুহূর্ত যখন মায়া অস্থির, অনুপস্থিত। ঠিক সেটুকু সময়ের মধ্যেই আমাদের আহ্নিক একটা ভার্চুয়াল লুপের মধ্যে পড়ে গেল। তাই তার এই পড়ে যাওয়া চলতে থাকল অনন্তকাল ধরে।
এই হল কাহিনী যার কিরদার এখন গাড়ি
চালিয়ে চলে যাচ্ছে দু’নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে। যতদূর দেখা যাচ্ছে সামনে অনন্ত নীলাকাশ।
পিছনে গভীর সমুদ্রের ঢেউ। সে তার বাইকের লুকিংগ্লাসে দেখছে পিছনের রাস্তা ঢেউয়ের মতো
উথাল পাথাল করে তাকে এগিয়ে দিচ্ছে সামনের দিকে। তার গতি বেড়ে যাচ্ছে। বাকি কেউ নেই।
কোনও মানুষ নেই। কোনও শব্দ নেই। কানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া হাওয়া আর ইঞ্জিনের শব্দ।
কোথায় যাচ্ছে সে? কেনই বা যাচ্ছে?
কতদিন ধরে যাচ্ছে? কবে পৌঁছাবে?
শূন্য
স্মিতা একসময় বুঝতে পারল মিছিলের সামনেটা কেমন যেন নিষ্প্রভ। মিইয়ে যাওয়া বিস্কুটের মতো হতাশাগ্রস্ত। আগামী শুধু মৃত্যু, তার চেয়ে আত্মহনন অনেক বেশি সম্মানের। সে ধীরে ধীরে তার হাঁটার গতি কমাতে শুরু করল। যাতে পিছোতে পারে। যা কিছু হোক, এইবেলা মৃত্যু নয়। তার থেকে পিছন ফিরে যাওয়া অনেক ভাল। অথচ যতই সে পিছন দিকে এগোচ্ছে ততই যেন মিছিলের সব মানুষ তার দিকেই ঘুরে যাচ্ছে। কিন্তু সে এগোচ্ছে খুব ধীর গতিতে হলেও। তাহলে যারা তার দিকে ঘুরে যাচ্ছে তারা এগোচ্ছে না পিছচ্ছে?
এখন তার সামনে বিশেষ কিছু রাস্তা
আর খোলা নেই। খোলা নেই বলতে, রাস্তাই নেই। যাকে বলে জিরো পয়েন্ট। যেখানে এসে রাস্তা
শেষ হয়ে যায়। ফিরেই যেতে হবে। যখন সামনে আর যাওয়া যাচ্ছে না। জীবনের প্যারাডক্স উপহাস
করে তাকে বলছে, তাকে ছুঁতে গেলে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই সে তোমার জন্য পিছিয়ে আসবে। না
হলে এই শূন্য শূন্য দেহ।
এক
-তোমার নাম কী?
-স্মিতা।
-তোমার?
-আহ্নিক।
-তোমরা কি পরস্পরকে চেন?
-হ্যাঁ চিনি, কিন্তু!
কোনও কিন্তু নয়, চেনা বা না চেনার
মাঝের যে স্পেস রয়েছে সেখানে একটা প্রতীক ভেসে উঠেছে নিজে থেকে। সে প্রতীক যেন বলছে,
তোমাদের ছায়ারা অন্তত তোমাদের মতো মিথ্যেবাদী নয়। তাদের ঈমান এখনও বিক্রি হয়ে যায়নি।
তারা কাটমানির কাছে খুলে দেয়নি কাপড়চোপড়। বরং তারা অপেক্ষা করতে শিখেছে। শিকারের জন্য
অপেক্ষা। শিকারির মতো প্রতীক্ষা। যখন অন্ধকারে টোপ ঝুলে আছে একটা গর্তের মাঝে।
-স্মিতা তুমি কি ঝাঁপাবে সেই টোপটা
ধরার জন্য?
-না, আমি অপেক্ষা করব।
-আর আহ্নিক, তুমি?
-আমিও প্রতীক্ষা করব, নিষ্প্রভ
আলোয় কখন জ্বলে ওঠে শিকারের চোখ।
-তারপর?
স্মিতা আর আহ্নিক একসাথে উচ্চারণ
করল, ঝাঁপাব।
নিভে গেল ঘরের আলো, স্মিতার গা থেকে ঝরে পড়া সদ্য স্নানের জল ভিজিয়ে দিল আহ্নিককে। সে আহ্নিককে আর আহ্নিক স্মিতাকে বলপূর্বক আদর করল মিনিট কুড়ি। কিন্তু চরম মুহূর্তের ঠিক কিছুটা আগে দু’জনেরই খেয়াল হল তারা হয়তো কিছু বেআইনী কাজ করে বসেছে। তাই ছিটকে গেল দুটি দেয়ালের দিকে দু’জন। তাদের দেখে মনে হল, তারা দু’জনেই রেপ ভিক্টিম। দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে ঘৃণা আর লোভ নিয়ে। অথচ ঘৃণা এবং লোভ পরস্পর বিপরীতমুখী। তাই নিজের প্রতি লোভ আর অন্যের প্রতি ঘৃণা, নাকি উল্টোটা কেউই বুঝতে পারল না।
তবে এটা তো গেল ঘটনাটা। বিগ ব্যাঙের প্রাক মুহূর্তটা কেমন ছিল?
একটা নিস্তব্ধ ঘর ছিল। যে ঘরটা স্মিতা আর আহ্নিককে মুখোমুখি বসিয়ে শুধিয়ে যাচ্ছিল এইসব কথা। যখন স্মিতা প্রায় পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে বসেছিল ঘরে। এই তো কিছুক্ষণ হল সে খবর পেয়েছে বিকাশ এখন আর তার সাথে থাকতে পারছে না। সে তার হিসাবনিকাশ নিয়ে সরে পড়েছে অন্য এক রঙের দলে। তার কাছে সামান্য সময় রয়েছে নিজেরটা গুছিয়ে নেওয়ার। যদিও সময় যখন সঙ্কুলান হয় তখন সময় কাটে তিরের বেগে। অথচ সে দেখছে, তার লুব্ধ চোখের হাসি কেমন যেন ধরা পড়ে গেছে আহ্নিকের কাছে। সে কি তবে আহ্নিকের হাসিকান্নার জন্য কাঙাল?
যদিও সেই ফাঁকা ঘরটা আবার প্রশ্ন করছে, তোমরা কি পরস্পরকে চেনো?
-হ্যাঁ, আমরা চিনি নিজেদের। আমরা আমাদের ভিতরের মানুষটাকে চিনি বলেই তো বসে আছি। না হলে কেন এখানে আসতে গেলাম! আমি স্মিতা যখন জন্ম নিয়েছিলাম তখন থেকেই যেন আমার নাড়ির কোনও একটা সুতোয় গিঁট পড়ে গিয়ে ছিল, এই আহ্নিকের সাথে।
-আর আমারও তেমনই মনে হয়। সেই সুতোয়
যে কটা গিঁট রয়েছে তার সব পাস-ওয়ার্ড আমার চোখের মণিতে আবদ্ধ। যখন আমার চোখের দিকে
তাকাবে স্মিতা, তখনই তার নাভিমূল থেকে একটা ডাক আসবে। সে হয়তো বলবে, আহ্নিকদা তোমার
এইসব টাকাপয়সা দিতে হবে না।
স্মিতা আবার আহ্নিকের দিকে তাকাল, আর আহ্নিক দেখতে থাকল। আগে মানুষের এক একটা সিঁড়ির ধাপ উঠতে যেমন সময় লাগত, তেমন পড়ে যেতে যেতেও মানুষ এভাবে হারিয়ে যেত না। এখন সত্যি হারিয়ে যাওয়া উপরে ওঠার মতোই স্বাভাবিক। অবশ্য শহরের সব রাস্তা যখন পঙ্কিল হয়, তখন পায়ে কাদা লেগে যাওয়া স্বাভাবিক। সেও সেভাবেই প্রোমোটারির নানা সমস্যায় জড়িত। একটা বিল্ডিঙের অর্ধেকটা উঠে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সবকটি ফ্ল্যাট বুক হয়নি। অথচ কালেকশন যা ছিল, শেষ হতে চলেছে। এখন তার একজন ফাইন্যান্সার চাই। চাই লোকাল পার্টির সাপোর্ট। কারণ সে জানে মন্দার বাজারে তার মতো ছোট প্রমোটারের একটা বিজনেসকে টিকিয়ে রাখা কতটা কঠিন কাজ। তাও সে ভাবল একবার কি জিজ্ঞাসা করা যায়, কি রে স্মিতা কেমন আছিস? তারপর ভাবল, সে কি আর তুই করে কোনও দিন ডাকতে পারবে? এখন তো সে নেতার বউ। যদিও, থাক সে সব কথা অন্য সময় হবে।
না এখন তেমন কোনও ডাক কিন্তু শোনা গেল না। বরং তার বিপরীতে স্মিতা আহ্নিককে বসিয়ে চলে গেল ঘরের ভিতরে। যেন কী এক কাজ তার রয়ে গিয়েছে। এখনই করা দরকার হয়ে পড়েছে। তবে অন্যকিছু না, সে স্নানে ঢুকেছিল। কেন জানি না হঠাৎ তার মনে হল তার সারা গা জুড়ে ঘামের বিশ্রী গন্ধ।
তারপর জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করল তার সারা আত্মা দিয়ে। যেন আহ্নিকের হাসিকান্না তাকে ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে কোনও এক অনন্তের খোঁজে। অথচ সে অনন্ত তার শরীরেই রয়েছে। আর আহ্নিক বসে বসে টিভিতে ম্রিয়মাণ কিছু পশুপাখির ছবি দেখতে দেখতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে উঠে যেতে চাইছে, তখনই ঘর আলো করে ফিরে এলো স্মিতা। গায়ে তখন স্নানের জল গড়িয়ে পড়ে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে।
-তোমরা হয়তো পরস্পরকে চেন, কিন্তু
তোমাদের এই পরিচয় অসম্পূর্ণ।
-আমরা সেটা জানি। কিন্তু মানি না।
-হ্যাঁ, আমরা সেটাই মানি যেটা মানতে
বলা হয় উপর থেকে।
-কেন, বুকের ভিতর থেকে কি মানতে
বারণ আছে?
-বারণ নে্ই, তবে এক সংস্কার আছে
আমাদের।
-ঘণ্টা আছে তোমাদের।
ঠিক একদম ঠিক, কোথাও একটা ঘণ্টার
শব্দ শোনা গেল, বা একটা টিকটিকির ডাক। কেউ হয়তো সত্যি বলছিল, বা কেউ হয়তো মিথ্যা। তবে
দুজনেই ভাবছিল, তাদের মিথ্যা অন্যের কাছে ধরা পড়ে গেছে। তাই আর লুকিয়ে লাভ নেই। বরং
ও যদি একবার জানতে চায়, নিজেরটা খুলে দেখান যাবে। এই অনৈচ্ছিক অন্তর্বাসের জাল থেকে
নিজেকে মুক্ত করে দেখান যাবে উলঙ্গ সত্য।
স্মিতা ভাবছিল, সত্যি হল এখন আর
এই পার্টির হাত পা ধরার কোনও দরকার নেই, যখন তার হাত থেকে সব পাওয়ার চলে যেতে বসেছে।
বিকাশ এখন আর তার সাথে নেই। তাই তার বদলে কিছুটা যদি ভোগ করা যায়।
অন্যদিকে আহ্নিক ভাবছিল, সত্যি
বলতে গেলে, যখন তার আর্থিক অবস্থা এতটাই করুণ যে মেয়ের স্কুলের ফি দেওয়াও কঠিন হয়ে
যাচ্ছে, তখন এমন পজিশনের নারীকে খুশি করে যদি মানিয়ে নেওয়া যায়?
এই সত্য আর মিথ্যার জালে জড়িয়ে
দু’জন এক আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করল। আলো আর অন্ধকার একসাথে না এলে দিন কখনও পূর্ণ
হয় না। ঠিক এই সময় দরজায় শব্দ হল। শব্দ এমন যেন কেউ দরজা ভেঙে দিতে চাইছে। বাইরে কি
বিকাশ এসেছে? অথচ বিকাশের তো এখন আসার কথা নয়। সে তো দিল্লীতে, কাল সকালে ফ্লাইট, এখন
তার আসার কোনও উপায় নেই। তাহলে এত জোরে কে বাইরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে? দুজনে দুজনের
দিকে আবার তাকাল তির্যক দৃষ্টিতে। কে আগে দরজা খুলবে? নাকি কে পরে দরজা খুলবে? যে আগে
দরজা খুলবে সে ভিক্টিম, নাকি যে বসে থাকবে সে ভিক্টিম? তাহলে অ্যাকিউজড কে? যখন দুজনেই
জানে, তারা একটা বিষম সময়ের মধ্যে আটকে পড়ে আছে।
এখন যদি সেই ঘরটাকে প্রশ্ন করা হয়, তুমি কাকে কোনদিকে রাখবে? এখানে কে অভিযুক্ত আর কে ক্ষতিগ্রস্ত? সে বলবে, স্মিতা বা আহ্নিক কেউই অভিযুক্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত নয়, বরং আমি নিজে এই দোষে দুষ্ট। কেননা যখন তারা দুজনেই এখানে এসেছিল প্রশ্ন করেছিলাম, কী চাও এখানে? তারা উত্তর দিয়েছিল, মৃত্যু। অথচ কেউ সত্যি বললে তাকে মৃত্যু দেওয়া আমার ক্ষমতার বাইরে। আবার কাউকে চাহিদা মতো কিছু না দেওয়াটাও অনৈতিক। তাহলে এবার?
দরজার বাইরে আঘাত হয়েই চলল। যেন
কেউ এক নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরালে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। হয়তো কিছু বলতে চাইছে যা বোঝা
যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর স্মিতা ইসারা করল আহ্নিককে, সে যেন উঠে বাথরুমে চলে যায়। স্মিতা
দরজা খুলল।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন