পত্রিকা সমালোচনা / পাঠ প্রতিক্রিয়া
‘কালিমাটি’ / সংখ্যা ১১১ / বিষয়: সত্তর দশক / পৌষ ১৪৩১ / সম্পাদক: কাজল সেন ও পূর্ণেন্দুশেখর মিত্র
(সম্পাদকীয়
বক্তব্যঃ ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১১১তম সংখ্যার আলোচ্য বিষয় ছিল সত্তর দশক। মোট কুড়িটি
প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনে প্রকাশিত লেখাগুলির
আলোচনার জন্য আলোচক প্রথম কিস্তিতে (মে) বেছে
নিয়েছিলেন প্রথম সাতটি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। দ্বিতীয় কিস্তিতে (জুন) তিনি আলোচনা করেছেন
পরবর্তী পাঁচটি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। বাকি আটটি প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিষয়ে
আলোচনা প্রকাশিত হলো বর্তমান জুলাই সংখ্যায়।)
পরের রচনার বিষয় চলচ্চিত্র। সত্তর দশক নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ। মূল ধারার পাশাপাশি এই সময়ে তৈরি হয়েছে মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’, ‘কোরাস’, ‘পদাতিক’, ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’র মত চলচ্চিত্র, যা খুব নিশ্চিতভাবেই সত্তর দশকের ফসল। কিন্তু এই প্রবন্ধে লেখক অমিতাভ নাগ এরকম কোন আলোচনা বা মূল্যায়নের পথে হাঁটেননি। তিনি বেছে নিয়েছেন সত্তর দশকের দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ধর্মীয় ছবি -- একটি বিজয় শর্মা পরিচালিত হিন্দি চলচ্চিত্র ‘জয় সন্তোষী মা’ (১৯৭৫), অন্যটি সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় ও বরেন চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ভক্তিমূলক বাংলা চলচ্চিত্র ‘বাবা তারকনাথ’ (১৯৭৭)। দুটি ছবিই তুমুল জনপ্রিয় -- প্রথমটির কল্যাণে সপ্তাহে সাতদিনের মধ্যে শুক্রবারটি চিরস্থায়ী ভাবে সন্তোষী মায়ের দখলে চলে গেছে, আর দ্বিতীয়টির দৌলতে ঝাঁকে ঝাঁকে বাঁক কাঁধে প্রতি বছর তারকেশ্বর যাওয়া বাৎসরিক ক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। এমনকি তার জন্য নির্দিষ্ট পোশাক বিধিও তৈরি হয়ে গেছে। তারকেশ্বরের অর্থনীতির সাথে ‘বাবা তারকনাথ’ ছায়াছবিটি এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত (যেমন জয়শলমির আর ‘সোনার কেল্লা’)। তবে লেখকের উদ্দেশ্য চিত্র-সমালোচনা নয়। বরং এই দুটি ছায়াছবি সামনে রেখে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্ণ-রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। ফলত তাঁর এই প্রবন্ধের শীর্ষক ‘রাজনীতি-ধর্মে ‘ভদ্রলোক’-এর সংশয় : ’৭০-এর দুটি সিনেমা’। বলা বাহুল্য বিষয়টি যথেষ্ট স্পর্শকাতর, এবং স্বল্প-আলোচিতও বটে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ণ-রাজনীতি বুঝতে লেখক পৌঁছে গেছেন বিশ শতকের গোড়ায়, বঙ্গভঙ্গের সময়ে, কারণ তখনই বাঙালি, হিন্দু (উচ্চবর্ণ) ‘ভদ্রলোক’ বুঝতে পেরেছিল তারা সংখ্যালঘু। বস্তুত দেশভাগের ফলে গরিষ্ঠ সংখ্যক মুসলমানের ওপারে থেকে যাওয়া এঁদের বরং স্বস্তিই দিয়েছিল। মনে রাখতে হবে যে মুসলমানদের একটা বড় অংশই ছিল রায়ত বা অন্যান্য নিম্নবর্গীয় মানুষ। লেখকের এই অভিমত পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া শক্ত। কারণ কোন এক প্রতিবেদন বলছে মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ নয়, বরং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমের জেলাগুলির ভোটই বঙ্গভাগের পক্ষে রায় দিয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে লেখক নিশ্চয়ই আদত পশ্চিমবঙ্গবাসী ‘ভদ্রলোক’-দের কথাই বিবেচনা করেছেন। কারণ পূর্ববঙ্গের স্বল্পবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত জমিদার নির্বিশেষে শিক্ষিত বাঙালিকে দেশভাগের ফলে যে বিপুল পারিবারিক বিপর্যয় ও সামাজিক অবনয়নের শিকার হতে হয়েছিল তাতে তাঁদের আনন্দিত হবার সম্ভাবনা অল্প। বামফ্রণ্টের আমলে বর্ণ রাজনীতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে শুধুমাত্র (অর্থনৈতিক) শ্রেণিচরিত্রকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ধরে নেওয়া হয়েছে কেবলমাত্র ধনী ও দরিদ্র ছাড়া আর কোন শ্রেণী বিভেদ নেই। কথাটা আংশিক সত্য, তবে পুরোটা নয়। এটা ঠিক যে ভারতের অন্য যে কোন অঞ্চলের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে জাতপাতের সমস্যা নেই বললেই চলে। ফলে অন্যান্য অঞ্চলের জাতপাতের রাজনীতির হুবহু অনুসরণ এখানে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু বাঙালির ‘শ্রেণীচরিত’ অত্যন্ত কড়া। সেখানে ‘ভদ্রলোক’ ও ‘না-ভদ্রলোক’-এর মধ্যে বিপুল পার্থক্য। স্বাভাবিকভাবেই যাবতীয় সিদ্ধান্তের রাশ ‘ভদ্রলোক’-দের হাতে। অন্যদিকে ভূমিজ রাজনীতি ও আন্দোলন স্বীকৃত মূলধারার ইতিহাসে থেকে গেছে প্রান্তিক। রাহুল দাশগুপ্তর প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এ নিয়ে এই প্রতিবেদনে আলোচনা করা হয়েছে। তবে এখানে লেখক বিষয়টিকে নিয়ে এসেছেন আতসকাচের তলায়, ব্যাখ্যা করেছেন বর্ণ রাজনীতির প্রিজমের মধ্য দিয়ে। তাঁর অভিধায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই “ ... ‘ভদ্রলোক’-এর স্বার্থ সুরক্ষিত রেখেছে সুচতুরভাবে”। এরই সাথে তিনি যোগ করেছেন সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট এবং নিয়ে এসেছেন সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ। তাঁর মতে ষাটের দশকে বিভিন্ন সমস্যায় বিপর্যস্ত কংগ্রেস “সমস্ত উত্তর ভারত জুড়ে বর্ণ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ফাটলকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল”। পরে বিজেপি ও শিবসেনা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এর পাশাপাশি বলিউডের “কিছুটা অবচেতন, কিছুটা নিম্নগ্রামের সচেতন” ‘নরম হিন্দুত্ব’ এবং আর. এস. এস-এর ‘কঠিন হিন্দুত্ব’ বম্বের (অধুনা মুম্বই) “অহিন্দু-অমারাঠি মানুষদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল”। এই প্রতিবেদন থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক ভারতের এখনকার তাবৎ সাম্প্রদায়িক সমস্যার মূল নাটের গুরু আদতে কংগ্রেস; বিজেপি ও শিবসেনা নেহাৎই তার অনুসরণকারী। ভারতের তাবৎ বর্ণ হিন্দু ‘ভদ্রলোক’ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির সুবাদে প্রত্যক্ষ (সচেতন) বা পরোক্ষ (অবচেতন বা অর্ধ-চেতন) ভাবে এই সাম্প্রদায়িকতার সমর্থক। আর স্পষ্টভাবে না বললেও বলিউডের ‘নরম’ এবং আর. এস. এস-এর ‘কঠিন’ হিন্দুত্বের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আঁতাতের সম্ভাবনা সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। লেখকের প্রতিবেদন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন না হলেও সম্ভবত অতি সরলীকরণে আক্রান্ত। স্বাধীন ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার সোচ্চার উপস্থিতি এবং কালক্রমে তার প্রায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য, যা আজ আমরা দেখতে পাই, তার সূত্রপাত রাজীব গান্ধীর কয়েকটি হঠকারী সিদ্ধান্ত (শাহবানু মামলা, বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির) আর ভোটের অঙ্ক মেলাতে (এবং কংগ্রেসকে হারাতে) এ দেশের বাম ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলির ‘দু বাহু বাড়ায়ে’ অতি দক্ষিণপন্থী দলটিকে দেশের রাজনীতির মুক্তাঙ্গনে নিয়ে আসা -- প্রধানত এই দুইটি কারণে। তার আগে কিছু নিজস্ব জনভিত্তি থাকলেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভারতের মূল ধারায় এর আগে কখনই কল্কে পায়নি। বম্বের দৃঢ়মূল, সুসংঘটিত, প্রায় সরকারী ব্যবস্থার প্রতিস্পর্ধী অন্ধকার অপরাধ জগৎ, এবং ’৯২-এর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে শুরু করে ২০০৮ সালের কাসভ-কাণ্ড পর্যন্ত বম্বের উপর উপর্যুপরি জঙ্গি আক্রমণ সাধারণ মানুষের মনে যে সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছিল তা একটা বড় কারণ সেখানে শিবসেনা আর বিজেপির ক্রমান্বয়ে উত্থানের। তার সবটাই বোধহয় বর্ণহিন্দু ‘ভদ্রলোক’-এর নিম্নকোটির উপর স্বাভাবিক অসূয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ‘গ্যাঙ্গস্টারিজম’-এর প্রাদুর্ভাব, যার উল্লেখ লেখক করেছেন, তার একটি কারণ বলিউডে প্রচুর মাফিয়া অর্থের বিনিয়োগ। পূর্ব পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশ থেকে হাজারে হাজারে চলে আসা উদ্বাস্তু শরণার্থীরাই হোক, বা শিবসেনা-বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান -- এর যে কোনটিকেই যদি লেখক বম্বের কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ হিসাবে প্রতিপন্ন করতে চান, তাহলে যথাবিহিত পরিসংখ্যান ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। এটাও মনে রাখা দরকার পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের উদ্বাস্তু সমস্যা বা সত্তর দশকের মরিচঝাঁপি, আর তার ঢের পরের (মূলত অর্থনৈতিক) অনুপ্রবেশ -- এই দুটি ঘটনার চরিত্র পুরোপুরি এক নয়। প্রবন্ধের এই অংশের শিরোনাম ‘সত্তরের দশক’ হলেও অধিকাংশ ঘটনাই আশি বা নব্বই দশক, বা তারও পরের। ফলে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। লেখকের মতে ষাট ও সত্তর দশকের অসহনীয় আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের পথে ঠেলে দিয়েছিল। তারই ফল বলা যায় আলোচ্য চলচ্চিত্র দুটি । আবার তারা এক অর্থে সেই পুনরুজ্জীবনের অনুঘটকও বটে। লেখক লক্ষ্য করেছেন ২০১১ সাল পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মুসলমান ও প্রান্তিক হিন্দুদের “পশ্চিমবঙ্গের দৈনন্দিনতায় অন্তর্ভুক্তির” প্রয়াস ও তার ফলে বর্ণহিন্দু বাঙালি ‘ভদ্রলোক’-এর কল্যাণে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির লক্ষ্যণীয় উপস্থিতি। শেষোক্ত ঘটনাটির পিছনে অবশ্য বিরোধী রাজনীতিতে বামেদের অনুপস্থিতিও অনেকাংশে দায়ী। বাংলা চলচ্চিত্রকেও লেখক বিচার করেছেন বর্ণহিন্দুত্বের আতসকাচের তলায়। তাঁর মতে “পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিনেমায় সেইভাবে মুসলমান বা হিন্দু নিম্নবর্ণের পরিচালক বা অভিনেতা দেখা যায়নি। তাই, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, সিনেমার আখ্যানেও তারা কমবেশি অবহেলিত”। তিনি এও মনে করেন, “...বাঙালি হিন্দু ‘ভদ্রলোক’ তার জায়গা ধরে রাখতে কখনো ব্যবহার করেছে রাজনীতি, কখনো ধর্ম, কখনো-বা জনপ্রিয় গণমাধ্যম, যথা – সিনেমা”। লেখকের প্রতিবেদন এক প্রায়-ঐক্যবদ্ধ, প্রায়-সমসত্ত্ব, বাঙালি ‘ভদ্রলোক’ গোষ্ঠীর আভাস দেয়, যদিও বাস্তবে শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে এহেন একতা বিরল। মনে রাখা দরকার বাঙালির শ্রেণীচরিত্রে ‘ভদ্রলোক’ ও ‘না-ভদ্রলোক’-এর মধ্যে মূল পার্থক্য শিক্ষা ও পেশার। অর্থনীতি প্রাসঙ্গিক, তবে একমাত্র নির্ণায়ক নয়। আর খাঁটি ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব নিতান্ত প্রান্তিক, যদিও পেশার নির্বাচনে পরিবারের ভূমিকা যথেষ্ট। তাছাড়া এ পোড়া পশ্চিমবঙ্গে ‘রাজনৈতিক জাতিভেদ’ অত্যন্ত প্রবল। কত প্রাণ যে এ জন্য বলি হয়েছে তার পরিসংখ্যান বোধহয় কেউই রাখেন না। এসব কিছু মাথায় রাখলে খাঁটি ‘বর্ণহিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক’-এর সংজ্ঞা ও ভূমিকা অনেকটা আবছা হয়ে আসে। এহ বাহ্য, একই যুক্তিতে ‘জয় সন্তোষী মা’ নারী শক্তির উত্থান আর নব্বইয়ের দশকে ‘রূপবান কইন্যা’-র বিপুল জনপ্রিয়তা বাঙালি ভদ্রলোক’-এর মাটির কাছে ফিরে আসার আকুতি বলে গণ্য হতে পারে কি? ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘গঙ্গা’, ‘বাঘিনী’, ‘ঢুলী’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, এই ছায়াছবিগুলি ব্যতিক্রম, না ‘ভদ্রলোক’-এর চাতুর্য? আর শেষপর্যন্ত এখনকার পুরোপুরি নগরকেন্দ্রিক বাংলা চলচ্চিত্রে ‘প্রায় খলনায়ক’ বাঙালি ‘ভদ্রলোক’ কীভাবে তার শ্রেণি-সংকটকে ফুটিয়ে তুলতে পারে, লেখকের সাথে সাথে আমাদেরও তা দেখার কৌতূহল রইল।
পরের দুটি প্রবন্ধ, যথাক্রমে কাজল মুখার্জির ‘সত্তরের নাটকের সাত সতেরো’ এবং সুপর্ণা ভট্টাচার্যের ‘আগুনের দিনলিপি’ দুটিরই বিষয় সত্তর দশকের নাটক। কাজল মুখার্জির প্রবন্ধ এক লহমায় মন ভালো করে দিল, মনে পড়িয়ে দিল বেশ কিছু প্রিয় নাটক। প্রথমেই তিনি তুলনা করেছেন সেই সময়ের বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে পশ্চিমবঙ্গের। লেখকের মতে সত্তর দশক এক ক্রান্তিকাল, যখন সারা পৃথিবী জুড়েই দিকে দিকে চলছে ছক ভাঙার লড়াই। আর তা শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, রয়েছে সামাজিক প্রশ্নও। ছাত্রদের লড়াই, কালো মানুষের লড়াই, লিঙ্গসাম্যের লড়াই -- চরিত্র আলাদা হলেও সবই ছিল চলতি স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে। সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে সত্তর দশক সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক লড়াইয়ে। সেখানে সামাজিক স্থিতাবস্থা নিয়ে কোন প্রশ্ন করা হয়নি। তবে বাংলা নাটকে সেই রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিঘাত ছিল বিপুল, ঘটে গিয়েছিল বিরাট পালাবদল। লেখক বাংলা নাটকের শুরুর যুগকে গিরিশচন্দ্রর আর তার পরের যুগকে শিশির ভাদুড়ীর নামে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ষাট ও সত্তর দশকের নাটকগুলিকে এরকম কোন বিশেষ নামে অভিহিত করা যাবে না। সঙ্গত কারণেই রাজনৈতিক নাটকের সংখ্যা ছিল বেশি, তার কারণ প্রতিবাদী বাঙালির দায়বদ্ধতা। কিন্তু সেই বৃত্তের বাইরেও আরো বহু রকমের নাটক অভিনীত হয়েছে, রয়েছে বিদেশী নাটকের অনুবাদ বা ‘কিমিতিবাদী’, অর্থাৎ অ্যাবসার্ড (‘অসম্ভব’) নাটকও। রয়েছে পার্টিজান পলিটিক্সের কারণে দলীয় নির্দেশ মেনে চলা নাটক, আবার তার বাইরে বেরিয়ে এসে স্বাধীন চিন্তার স্ফুরণ। নাট্য আন্দোলন শুধু কলকাতাতেই আবদ্ধ থাকেনি, তা ছড়িয়ে পড়েছে মফস্বলেও। সেখানে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করেছে উল্লেখযোগ্য কিছু সার্থক নাটক। শুধু নাট্যকার বা অভিনেতারাই নন, রয়েছেন নাটকের কলাকুশলীরাও। পর্যালোচনার শুরুতেই রয়েছেন উৎপল দত্ত ও তাঁর নাট্যগোষ্ঠী ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ (পরে ‘পিপল্স্ লিটল থিয়েটার’, বা ‘পি. এল. টি.’)। এঁরা দিয়ে গেছেন একের পর এক কালজয়ী নাটক। ‘কল্লোল’, ‘অঙ্গার’, ‘তীর’, ‘টিনের তলোয়ার’, ‘ব্যারিকেড’-- এই নাটকগুলি বাংলা নাটকে ইতিহাস তৈরি করেছিল। নৌ-বিদ্রোহ নিয়ে লেখা নাটক ‘কল্লোল’ কংগ্রেস সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তারপরেও নাটক চলেছে পুরোদমে। বাণিজ্যিক পত্রিকার বিজ্ঞাপন-বয়কট উপেক্ষা করে পোস্টার পড়েছিল “কল্লোল’ চলছে চলবে”। ‘অঙ্গার’ নাটকে বিখ্যাত আলোকশিল্পী তাপস সেন মঞ্চে দেখালেন কয়লাখনির দুর্ঘটনা। ‘পি. এল. টি.’-র নাটক ‘টিনের তলোয়ার’, বাংলা রঙ্গমঞ্চের শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি। এতে ব্যবহৃত হল ঘূর্ণায়মান মঞ্চ। প্রথমে দলীয় বাধ্যবাধকতা মেনে চললেও পরে উৎপল দত্ত বেরিয়ে এসেছিলেন সেই আমলাতন্ত্র থেকে। বিদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা নিয়ে মঞ্চস্থ করেছেন বহু নাটক -- যেমন ‘অজেয় ভিয়েৎনাম’, ‘কঙ্গোর কারাগারে’, নাৎসি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘প্রফেসর মামলক’, রোজেনবার্গ দম্পতির বিচারের প্রতিবাদে ‘২০শে জুন’, আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে নাটক ‘মানুষের অধিকার’। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ একসময়ে বাংলা নাটকের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। পরেও তিনি মঞ্চস্থ করে গেছেন একের পর এক নাটক। ‘দেবী গর্জন’ তাঁর বিখ্যাত নাটক। তাছাড়াও রয়েছে ‘মরা চাঁদ’, ‘গর্ভবতী জননী’, ‘হাঁসখালির হাঁস’, ‘লাশ ঘুইর্যা যাক’। ইউরোপ থেকে আসা নাটককে দেশীয় ঐতিহ্যের ভূমিতে রোপণ করেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। সত্তর দশকের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর ভ্রাতৃঘাতী রাজনীতির নাটক উৎপল দত্তর ‘ব্যারিকেড’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’, থিয়েটার ওয়র্কশপ প্রযোজিত কবি মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের কিমিতিবাদী (অ্যাবসার্ড, বা ‘অসম্ভব’) নাটক ‘রাজরক্ত’, ‘রূপান্তরী’-র প্রযোজনায় জোছন দস্তিদারের ‘পদ্য গদ্য প্রবন্ধ’, ‘ক্যালকাটা পিপলস আর্ট থিয়েটার’-এর ‘কলকাতার হ্যামলেট’। শেষোক্ত দলটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ‘রাংতার মুকুট’, ‘রানা প্রতাপের সংগ্রামের ইতিহাসের কিহু টুকরো’। এই দলটি পি. এল. টি.-র রাজনৈতিক ধারা অনুসরণ করেছিল। ‘রাজরক্ত’ ভারতের অন্যান্য অনেক ভাষায় অনুদিত ও অভিনীত হয়েছিল। সর্বগ্রাসী ক্ষমতাতন্ত্রের হাতে শৃঙ্খলিত বিদ্রোহী যৌবন বারবার নিহত হতে থাকে। ‘রাজরক্ত’ নাটকে এই ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে সত্যেন মিত্র একদিন সত্যই নিহত হয়ে গেলেন বরানগরের গণহত্যায়। “বাংলা নাট্যজগতের ইতিহাসে প্রথম শহিদ নাট্যশিল্পী সত্যেন মিত্র”। ‘নক্ষত্র’ গোষ্ঠীর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হতে থাকে বেশ কিছু কিমিতিবাদী নাটক, যেমন মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘ক্যাপ্টেন হুররা’, ‘কণ্ঠনালীতে সূর্য’, বা নভেন্দু সেনের ‘নয়ন কবিরের পালা’। অনেকের সমালোচনার মুখে পরলেও নাটকগুলি সেই সময়ের “এক আশ্চর্য রূপায়ন”। মনোজ মিত্র নিয়ে এলেন সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একগুচ্ছ নাটক -- ‘সুন্দরম’ অভিনীত ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘থিয়েটার ওয়র্কশপ’ অভিনীত ‘চাক ভাঙা মধু’, ‘নরক গুলজার’, ‘অশ্বত্থামা’। প্রথম দুটি নাটকে মাটির গন্ধ, তৃতীয় নাটকটি জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত প্রহসনের মোড়কে একটি কল্পনাটক বা ফ্যাণ্টাসি, আর উল্লিখিত শেষ নাটকটিতে রয়েছে মহাকাব্যীয় গাম্ভীর্য। বারবার ভুল হত্যায় বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত অশ্বত্থামার যৌবন খুঁজে পেতে চায় একটি সঠিক হত্যা। ইতিমধ্যে পি. সি. যোশির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ’ (আই. পি. টি. এ.)। সেই সময়ের অনেক অগ্রগণ্য নাট্যকার যোগ দিয়েছিলেন এই মঞ্চে। পরে পি. সি. যোশীর অপসারণের পর প্রকৃত সৃষ্টিশীল মানুষেরা এই সঙ্ঘ ত্যাগ করেন। শুরু হয় “বাংলা নাট্য ধারার এক নতুন অধ্যায় ... গ্রুপ থিয়েটারের যুগঃ। ‘নান্দীকার’ (ও পরে ‘নান্দীমুখ’)-এর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় জোর দিলেন বিদেশী নাটকের অনুবাদে, বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেন ব্রেখ্ট, আর্থার মিলার, চেকভ, তলস্তয়, এমনকি ‘মুসোলিনির সমর্থক’ পিরানদেল্লোর নাটকও। তাঁদের অনুবাদে নাটকগুলির বাংলা রূপান্তর ঘটেছিল। বাংলায় ব্রেখ্টিয় চর্চায় খামতি না থাকলেও ব্রেখ্টিয় এলিয়েনেশন তত্ত্বের প্রথম সার্থক প্রয়োগ ঘটালো অরুণ মুখোপাধ্যায় রচিত ও ‘চেতনা’ নাট্যদল প্রযোজিত ‘মারীচ সংবাদ’ । তবে বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের পথিকৃৎ ছিলেন বাংলা নাট্যজগতের অন্যতম উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র ও তাঁর নাটকের দল ‘বহুরূপী’ । কোলাহলের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি একের পর এক আত্মানুসন্ধানের নাটক মঞ্চস্থ করে গেছেন। শম্ভু মিত্রর অন্যতম (এবং এখনো পর্যন্ত বাংলা নাট্যজগতে বিরল) কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটককে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া। ইবসেনের ‘পুতুল খেলা’ ও ‘দশচক্র’, সোফোক্লিসের ‘অয়াদিপাউস’, রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ ও ‘ঘরে বাইরে’, বাদল সরকারের ‘পাগলা ঘোড়া’ ও ‘বাকি ইতিহাস’, বিজয় তেণ্ডুলকারের মরাঠি নাটকের অনুবাদ ‘চুপ, আদালত চলছে’ -- তালিকাটি যথেষ্ট দীর্ঘ। সেই সময়ে নাটকগুলিকে ‘নবনাট্য আন্দোলন’ নাম দেওয়া হয়েছিল। শম্ভু মিত্র নিজে নাম দিয়েছিলেন ‘সৎনাট্য আন্দোলন’। আর সবার শেষে শম্ভু মিত্রের নিজের লেখা নাটক ‘চাঁদ বণিকের পালা’। বাংলার নিজস্ব ট্র্যাজিক নায়ক চাঁদ বণিক। শঙ্খ ঘোষের মত বোদ্ধারা নাটকটিকে রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটকের শিরোপা দিয়েছেন। আর এঁদের পাশাপাশি যিনি সেসময়ের বাংলা নাটকের মঞ্চ জুড়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন তিনি হলেন বাদল সরকার। তাঁর ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ ভারতবর্ষের নাট্যজগতের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন, দিকনির্দেশক। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে নানা ভাষায়, নানা প্রতিষ্ঠিত নাট্যকারেরা এই নাটকটির অভিনয় করেছিলেন। বাদল সরকারের একের পর এক নাটক যখন মঞ্চ কাঁপাচ্ছে, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন ধারার নাটকের। থার্ড থিয়েটার, তথা তৃতীয় নাটক হিসাবে পরিচিত এই নাটকে মঞ্চ থাকে না, থাকে না মঞ্চসজ্জা বা অন্য কোন উপকরণ। শুধুমাত্র কণ্ঠস্বর ও নিজের/নিজেদের শরীরকে সম্বল করে ফুটিয়ে তুলতে হয় নাটকের দৃশ্য। ‘মিছিল’, ‘ভোমা’, ‘স্পার্টাকাস’, ‘গণ্ডী’-- দর্শক ও অভিনেতাদের মধ্যেকার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে তৃতীয় নাটক পৌঁছে গেল সাধারণ মানুষের আরো কাছে। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ‘মিছিল’ নাটকটির। ’৭৪ সালে কার্জন পার্কে পুলিশের লাঠির ঘায়ে নাট্যদর্শক প্রবীর দত্তের মৃত্যুর প্রতিবাদে কার্জন পার্কেই অভিনীত হয়েছিল এই নাটক (দ্র. অশোক চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ)। সেই অভিনয়ে কয়েক হাজার দর্শক অংশ নিয়েছিলেন। প্রবীর দত্তকে লেখক উল্লেখ করেছেন “বাংলা নাটকের ইতিহাসে প্রথম শহিদ” হিসাবে। মফস্বলের নাটকের দলগুলির মধ্যে বালুরঘাটের ‘ত্রিতীর্থ’ নাট্যদলের মৌলিক নাটক ‘ডাঙা নাই’, ‘জল’, ‘দেবাংশী’, ‘বিহন’, ইত্যাদি উল্লেখের দাবী রাখে। ছিলেন বিভিন্ন জেলার আরো অনেক নাট্যকার। পূর্ণাঙ্গ নাটকের পাশাপাশি ছিল একাঙ্ক নাটক। পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও বহু জায়গায় অভিনীত হত সেসব নাটক, প্রতিযোগিতাও হত। সরকারী অপশাসন ও অত্যাচারের প্রতিবাদে এই নাটকগুলিই ছিল জনতার প্রতিবাদ। গ্রুপ থিয়েটারের পাশাপাশি পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে (পাবলিক থিয়েটার) তখন অভিনীত হচ্ছে ‘বারবধূ’। প্রবল জনপ্রিয়তার সাথে সাথে অস্লীলতার দায়ে কঠোর ভাবে সমালোচিত হয়েছিল সেই নাটক। এলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রথমে অনূদিত নাটক ‘রাজকুমার’ ও ‘বিদেহী’, পরে নিজের লেখা মৌলিক নাটক ‘নাম জীবন’ মঞ্চস্থ করে পেশাদারী নাটকের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন তিনি। লেখক আক্ষেপ করেছেন আরো অনেকের নাম আলোচনায় না আনতে পারার জন্য। তবু যথাসম্ভব পূর্ণাঙ্গ একটি আলোচনা তিনি পেশ করেছেন এখানে। তবে নাম উল্লেখ করলেও আলোচনা থেকে বাদ পড়েছে কেয়া চক্রবর্তীর মত উজ্জ্বল মঞ্চ উপস্থিতি, বাদ পড়েছে ‘আন্তিগোনে’-র মত নাটকও -- পাঠক হিসাবে এটাই বড় আক্ষেপ। তারপরেও লেখককে সাধুবাদ জানাতে হয় স্বল্প পরিসরে সুসংহত ভঙ্গীতে আধুনিক বাংলা নাটকের নির্ণায়ক ধারাগুলি চিহ্নিত করে দেওয়ার জন্য।
সুপর্ণা ভট্টাচার্যের ‘আগুনের দিনলিপি’ প্রবন্ধে নাটক একই সাথে প্রতিবাদের হাতিয়ার ও সরকারি দমনের চাঁদমারি। সেই দিক দিয়ে এটি আগের প্রবন্ধের পরিপূরক। তাঁর লেখায় উল্লিখিত হয়েছে সেই সময়ের অনেক প্রতিবাদী নাটক ও নাট্যকর্মী আর পাশাপাশি তাঁদের উপর লাগাতার পুলিশি হামলা, সরকারী পোষা গুণ্ডাদের আক্রমণ, এমনকি হত্যার বিবরণ। বারে বারেই তাঁর লেখায় স্পষ্ট হয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই সময়ের নাট্যকর্মীদের একের পর এক প্রতিবাদী বিপ্লবী নাটক মঞ্চস্থ করে যাওয়া। রয়েছে সাংবাদিক, কবি, অন্যান্য সংস্কৃতিকর্মীদের সরকারের হিংস্র আক্রমণের সামনে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর কথা। আক্ষেপ করেছেন লেখিকা, আজকের দিনে সবাই যখন বিকিয়ে যেতে ব্যস্ত তখন সেদিনের সেই সাহস, সেই প্রত্যয় কত দুর্লভ। সেই সমস্ত নাটক শিল্পসৌকর্যে বেশি দূর এগোতে না পারলেও প্রতিবাদী নাটকের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে জায়গা করে নিয়েছে। সমস্ত প্রবন্ধটির ভরকেন্দ্র নকশালবাড়ি আন্দোলন আর তার সাথে জড়িত লেখিকার তীব্র আবেগ। স্বাভাবিকভাবে লেখাটি শুরু হয়েছে নকশালবাড়ি দিয়েই। জয়া মিত্রকে উদ্ধৃত করে লেখিকা জানাচ্ছেন নকশাল আন্দোলন আদতে ছিল গ্রামভিত্তিক আন্দোলন কিন্তু তার তাত্ত্বিক নেতৃত্বের রাশটা চলে গিয়েছিল শহুরে মধ্যবিত্তের হাতে। এ দুয়ের ‘বিরাট ফারাক’ আন্দোলনকে দুর্বল করেছিল। আবার যেভাবে জীবনকে বাজি রেখে হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তারও নজির স্বাধীন ভারতবর্ষে আর নেই। এই মূল্যায়ন পূর্ববর্তী প্রবন্ধলেখক রাহুল দাশগুপ্তর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদিও লেখিকার পরবর্তী মন্তব্য উল্লিখিত প্রবন্ধলেখকের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। ‘কালবেলা’ উপন্যাসটিকে তিনি চিহ্নিত করেছেন “নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা মাস্টারপিস” হিসাবে। উপন্যাসের রচয়িতা সমরেশ মজুমদারকে উদ্ধৃত করে লেখিকা জানাচ্ছেন, নকশাল আন্দোলনের একটা বড় ফল পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের মানসিকতার বদল, তাঁদের ঘর ছেড়ে পথে পা বাড়ানো, অন্তত তার প্রস্তুতি। বিশেষভাবে ‘পশ্চিমবঙ্গীয়’ মেয়েদের কথাই এখানে বলা হয়েছে, কারণ পূর্ববঙ্গীয়, তথা ‘বাঙাল’ মেয়েরা দেশভাগের পর অনেক আগেই পথে পা বাড়িয়েছিলেন বাঁচার তাগিদে, রুজি রোজগারের প্রয়োজনে। আর এজন্য সাবেক বনেদী পশ্চিমবঙ্গীয় পরিবারে তাঁদের অনেক কটূক্তি ও গালমন্দও সইতে হয়েছে। এই প্রবন্ধের আর একটি বৈশিষ্ট্য, এই সব প্রতিবাদী নাটকের মঞ্চস্থ হবার এবং সেই সাথে সম্পর্কিত বিশেষ বিশেষ ঘটনার সন-তারিখ যথাসম্ভব উল্লেখ। ফলে লেখাটি পাঠকের সামনে একটি কালধারা (টাইমলাইন) এঁকে দেয়। সেদিক দিয়ে শিরোনামে ‘দিনলিপি’ শব্দের ব্যবহার সার্থক। সঙ্গত কারণেই এই সব নাটকের সালতামামি অনেকটাই বাদ গেছে আগের লেখাটিতে। কারণ এদের ভাষা বেশির ভাগ সময়েই ছিল উচ্চকিত, প্রচারধর্মী, তাৎক্ষণিকতায় আক্রান্ত। সাহিত্যমূল্যে নয়, প্রতিবাদের মূল্যে এইসব নাটকের গুরুত্ব অপরিসীম। লেখিকার ‘দিনলিপি’ শুরু হয়েছে ষাটের দশকের শেষে, ১৯৬৭ সাল থেকে। এপ্রিলে লেখা হয় চারু মজুমদারের অষ্টম দলিল। মে মাসে হাতিঘিসায় গ্রেপ্তার হন আত্মগোপনকারী নেতারা, পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেশ কয়েকজন। শাসকের চোখে চোখ রেখে পোস্টার পড়ে, “...মঞ্চ হোক সর্বহারার মুক্তির খামার। রাইফেল আর কলমের সখা”। জুন মাসে, রাস্তায়, মঞ্চস্থ হয় অমল রায়ের ‘ভারতের ভিয়েৎনাম’। একই সময়ে অভিনীত হতে থাকে মনোরঞ্জন বিশ্বাসের ‘একমাত্র অস্ত্র’, জোছন দস্তিদারের ‘জীবনের গান’, নাট্যকার অনল গুপ্ত লেখেন নাটক ‘রক্তের রং’। ’৬৭ সালের শেষের দিকে অভিনীত হয় উৎপল দত্তের লেখা ‘মৃত্যুর অতীত’ ও ‘তীর’ (দ্র. জয়িতা ভট্টাচার্য ও কাজল মুখার্জি)। শুরু হল নাট্যকর্মীদের উপর পুলিশি দমন। বাদ গেলেন না অন্যরাও। ভাঁটা পড়ল সৃজনশীলতায়। তারপর এল ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। ’৬৯ সাল থেকে লেখা হতে লাগল প্রতিবাদী নাটক। মঞ্চস্থ হল মনোরঞ্জন বিশ্বাসের ‘ঝড়ের কাছাকাছি’, শৌভিকের প্রযোজনায় ‘এ আমি চাইনি’ ও ‘পোস্টার’, পি. এল. টি.-র ‘রাইফেল’ ও ‘শোন রে মালিক’, চারণদলের ‘লাল লন্ঠন’। শেষোক্ত নাটকটি অভিনীত হয়েছিল মিনার্ভায়, সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, আর প্রথম নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন দিল্লীর প্রবাসী বাঙালিরা। ‘৭০ সালে বিশ্বরূপায় অভিনীত হল মনোরঞ্জন বিশ্বাসের ‘আবাদ’। মঞ্চস্থ হতে থাকল শৌভিকের ‘শেষ পৃথিবী’ ও ‘শেষ বিচার’, পি. এল. টি.-র ‘বর্গি এল দেশে’, থিয়েটার ওয়র্কশপের ‘চাই হৃদয় চাই’ । খুন হয়ে গেলেন গীতিকার-কবি শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, সমীর মিত্র, তরুণ কবি সুদেব চক্রবর্তী। ’৭১-এ মঞ্চস্থ হল ‘রাজরক্ত’ (দ্র. কাজল মুখার্জি)। নিহত হলেন গণনাট্য বেলুড় শাখার নাট্য সংগঠক অধ্যাপক সত্যেন্দ্র চক্রবর্তী, ‘অরণী’ পত্রিকার সম্পাদক তিমিরবরণ সিংহ (এবং ‘রাজরক্ত’ নাটকের সত্যেন মিত্র, এই প্রবন্ধে অনুল্লেখিত; দ্র. কাজল মুখার্জির প্রবন্ধ)। তিমির তখন বহরমপুরের জেলে বন্দী। কবি শঙ্খ ঘোষ প্রিয় ছাত্রের মৃত্যুতে লিখেছিলেন দুটি সংহত, সুতীব্র কবিতা। মঞ্চস্থ হতে থাকে ‘কেননা মানুষ’, ‘গারদ’, ‘খাঁচা’, ‘কমরেড’, ‘অবরুদ্ধ ইতিহাস’ ও আরও অনেক নাটক। হত্যা করা হল থিয়েটার ওয়র্কশপের নাট্যকার-অভিনেতা-সাংবাদিক সরোজ দত্ত, জোড়াবাগান নাট্যশিল্পী শঙ্কর দত্ত ও কল্যাণ দত্তকে। ’৭২ সালে আক্রান্ত হতে থাকল সংবাদ ও সংবাদপত্র। অভিনয় পত্রিকা, স্টেটসম্যান, সত্যযুগ দৈনিক পত্রিকা, দর্পণ, বাংলাদেশ, গণশক্তি, ছোট ছোট গ্রামীণ পত্র-পত্রিকা -- হামলা চলে পত্রিকার দপ্তরে, পুড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে পত্রিকা। বন্ধ করে দেওয়া হয় রবীন্দ্র সদনে পি. এল. টি.-র নাটক ‘টিনের তলোয়ার’ কোন স্পষ্ট কারণ ছাড়াই। আর এই সব ডামাডোলের মধ্যেই মঞ্চস্থ হতে থাকে নাটক -- রূপদক্ষের পরিচালনায় মনোরঞ্জন বিশ্বাসের নাটক ‘পদাতিক’, থিয়েটার লাইকের প্রযোজনায় ‘পৃথিবীর কণ্ঠস্বর’, সরোজ রায়ের রাজনৈতিক নাটক ‘পতাকার রং লাল’ ও ‘প্রতিবিদতিৎসা’, শৌভিকের ‘শববাহকেরা’। শেষের নাটকটি করার জন্য গৌতম মুখার্জিকে আক্রান্ত হতে হয়। এই সব কিছুর প্রতিরোধে “সংগ্রামী নাট্যকর্মীরা সমবেতভাবে একটি শক্তিশালী মোর্চা গঠন করেন”। ’৭৩ সালে রবীন্দ্র ভট্টাচার্য লিখিত যাত্রিক নাট্যসংস্থার চারটি নাটক আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত হয় চন্দন সেনের ‘ঝড়ের খেয়া’। এই সব আক্রমণে পুলিশের পাশাপাশি ছিল প্রশাসনের মদতপুষ্ট গুণ্ডাবাহিনী। ফলে যে কোন আক্রমণে প্রশাসন ছিল নির্বিকার। তার পরেও বহু জ্বলন্ত নাটক অভিনীত হতে থাকে। শুধু কলকাতায় নয়, কলকাতার আশেপাশে, এমনকি দূরের মফস্বল শহরগুলিতেও। ’৭৪ সালে রাজনৈতিক নাট্যকর্মী প্রবীর দত্তকে সবার সামনে পিটিয়ে হত্যা করে পুলিশ, যার বিস্তারিত বিবরণ আমরা্ আগেই পেয়েছি (দ্র. অশোক চট্টোপাধ্যায়ের ও কাজল মুখার্জির প্রবন্ধ)। তবে এখানে লেখিকার প্রতিবেদন আরো বেশি ব্যক্তিনিষ্ঠ -- অনেক খুঁটিনাটি ঘটনা তিনি তুলে এনেছেন লেখার পাতায়, যা পাঠককে নাড়া দেয় আরো বেশি। ’৭৫ সালে জারি হল জরুরি অবস্থা। বাড়ল নাটকের ওপর হামলা। তবু প্রতিবাদী নাটকের জোয়ার ঠেকানো গেল না। সে ধারা অব্যাহত ছিল আশির দশক পর্যন্ত। তবে বাইরের আঘাতের পাশাপাশি অন্য বাধাও ছিল। প্রতিবাদী নাটকের বাস্তবমুখী কর্কশ ভাষা ও উপস্থাপনা পরিশীলিত সুধীজনকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ফলত নাটকগুলি উপর মহলের কাছে ব্রাত্যই থেকে গিয়েছিল। তাদের অভিনয় হত খোলা আকাশের নীচে“সাধারণভাবে, সাধারণ মানুষের জন্য”। আবার জ্বলন্ত, ক্ষুধার্ত সেই সময়ে ‘মল্লিকা’, ‘জনপদ বধূ’, ‘অনন্যা’, ‘বারবধূ’-র মত পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের লঘু, বিনোদনমূলক নাটক ও তার বিপুল জনসমাগম ত্যক্ত করত অনেক সচেতন, লড়াকু মানুষকে। প্রতিবাদী নাট্যকারদের মধ্যেও বিভাজন ছিল। ঋত্বিক ঘটক সম্পাদিত ‘অভিনয় দর্পণ’ পত্রিকায় উৎপল দত্তর ‘তীর’ নাটকটিকে প্রচারসর্বস্ব ও দুর্বল বলে সনাক্ত করেছিলেন পবিত্র সরকার, প্রশংসা পেয়েছিল শুধু নির্মল গুহ ও তাপস সেনের মঞ্চসজ্জা। আবার শূদ্রকের সমালোচনায় বহুরূপীর ‘পাগলা ঘোড়া’-য় শম্ভু মিত্রের ‘কাব্যিক, রোমান্টিক’ অভিনয় নিন্দিত হয়েছিল আর শম্ভু মিত্র নিজে ‘সাব্যস্ত হয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ‘শত্রু শিল্পশিবির’-এর সাহায্যকারী হিসাবে। অন্য আর এক সমালোচনায় তিনি হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অজিত বসু, দীপা মুখোপাধ্যায়, গীতা চৌধুরী, ঝড়ু সিং, কালিপদ দাসদের মত ‘বিদ্রোহের থিয়েটারের নির্মাতাগণ’-কে ‘বিপ্লবী বিকাশ’-এর ঐতিহাসিক মান্যতা দিয়েছেন আর সেই তুলনায় উৎপল দত্তের নাটকগুলিকে ‘বিপ্লবী ঐতিহ্যবিলাস’-এর চাইতে বেশি কিছু মনে করেননি। যেভাবে পরবর্তীকালের মাইলফলক হয়ে ওঠা নাটকগুলিকে “আতসকাচের নীচে ফেলে চুলচেরা বিশ্লেষণ” করা হত এবং তার পরেও নাট্যকাররা যে পেশাদারী সহিষ্ণুতা দেখাতেন তাঁদের প্রতি তা লেখিকাকে চমৎকৃত করেছে। প্রবন্ধের শেষে এসে লেখিকা সেই সময়ের প্রধান প্রধান নাট্যগোষ্ঠী ও নাটকের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর তার সূচনাবিন্দু হিসাবে বেছে নিয়েছেন ‘নবান্ন’ নাটকটি। কারণ তখন থেকেই নাটকে “বাংলার ভয়ংকর দিন, মুমূর্ষু জীবনের কাহিনী বলা শুরু হল”। ক্রমশ গণনাট্যের ধারায় যোগ হতে লাগল ‘ছেঁড়া তার’, ‘দুঃখীর ইমান’, ‘রাহুগ্রাস’, ‘সাঁকো’, প্রভৃতি নাটক। মনোজ মিত্র চমকে দিলেন তাঁর ‘চাক ভাঙা মধু’ দিয়ে। বিজন ভট্টাচার্যের ‘মরাচাঁদ’, ‘দেবীগর্জন’, ‘গোত্রান্তর’, বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’, যেমন বাংলা গণনাট্যের ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে তেমনি আঙ্গিকে দাগ কেটেছিল নান্দীকারে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ফুটবল’, ‘আন্তিগোনে’, ‘চেতনা’-য় অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘জগন্নাথ’। ব্রেখ্টিয় আঙ্গিকে মায়া ছড়িয়েছিল নান্দীকারের ‘তিন পয়সার পালা’, বা ‘ভালোমানুষ’ নাটক দুটি। আবার আঙ্গিক-সর্বস্বতায় দর্শক ক্লান্ত হয়ে পড়লে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছিল শম্ভু মিত্রর ‘দশচক্র’ বা শূদ্রকের ‘অমিতাক্ষর’। মোহিত চট্টোপাদ্যায়ের ‘মহাকালীর বাচ্চা’, শম্ভু মিত্রর ‘গ্যালিলিও’, তৃপ্তি মিত্রর একক অভিনয়ে বহুরূপীর ‘অপরাজিতা’ চমকে দিয়েছিল সেকালের দর্শককে। এছাড়াও ছিল “সংস্কৃত নাটকের বঙ্গীয়করণ”। যেমন নান্দীকারের ‘মুদ্রারাক্ষস’ এবং বহুরূপীর ‘মৃচ্ছকটিক’। আপাতদৃষ্টিতে প্রবন্ধের এই অংশের সাথে আগের প্রবন্ধের কিছুটা সমাপতন থাকলেও অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু নাটকের উল্লেখ এখানে রয়েছে যা আগের প্রবন্ধে অনুপস্থিত। তবে এই প্রবন্ধের অন্যতম প্রধান প্রাপ্তি, প্রেসিডেন্সি জেলের রাজনৈতিক বন্দীদের নাটক ও সংস্কৃতিচর্চা। কবি সমীর রায়কে উদ্ধৃত করে লেখিকা জানাচ্ছেন, ’৭৩ থেকে ’৭৫-এর মধ্যে রাজনৈতিক বন্দীরা মঞ্চস্থ করেছিলেন বেশ কিছু নাটক যার অধিকাংশই নিমাই ঘোষের লেখা। ’৭৬ সালে অভিনীত হয় শান্তনু গুহর ‘তরজা’। সমীর রায় নিজেও বন্দী ছিলেন এই জেলে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রতি সপ্তাহে একদিন করে নিয়মিত মহিলা বন্দীদের নাটক -- নাহলে গান, বা কবিতা। তাঁরা নিজেরাই লিখতেন ছোট ছোট নাটক। রাজনৈতিক বন্দীদের নাটক দেখা নিষিদ্ধ ছিল। তাই ভোরবেলা, লক-আপের দরজা খোলার ঠিক আগে, “মহিলারা সামনের উঠোনে নাটক শুরু করতেন”, যাতে সাধারণ মেয়ে বন্দীরাও দেখার সুযোগ পান। পড়তে পড়তে বোঝা যায়, নাটক শুধু বিনোদন নয়, পণ্য তো নয়ই -- তা এক যাপন, লড়াইয়ের হাতিয়ারও বটে। লেখিকা তাঁর প্রবন্ধের ইতি টেনেছেন কালীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর নাটক ‘অশনি সংকেত’-এর একটি সংলাপ উদ্ধৃত করে, যা এক লড়াইয়ের কথাই বলে -- মগজটাকে সশস্ত্র করার লড়াই। সম্ভবত সেটাই সবচেয়ে বুনিয়াদি লড়াই।
পরপর দুটি প্রবন্ধ সত্তর দশকের বাংলা নাটক সম্বন্ধে বিস্তৃত এক ধারণা তৈরি করে দিয়েছে, কিন্তু বাদ গেছে নাটকেরই সমগোত্রীয়, বস্তুত তার অগ্রজ, যাত্রার কথা। ‘তরুণ অপেরা’-র শান্তিগোপালের ‘কার্ল মার্কস’ দেখার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মনে পড়ে। সত্তর দশকে যাত্রার জগতে এক বিরাট ব্যতিক্রমের আখ্যান রচনা করেছিলেন শান্তিগোপাল ও তাঁর ‘তরুণ অপেরা’। প্রচলিত ধারার বিপরীতে গিয়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন আধুনিক পৃথিবীর এক একটি চরিত্র ও ঘটনা। প্রতিটি পালাই প্রবল জনপ্রিয়। মনে রাখতে হবে, নাটক মূলত নাগরিক, এমনকি মফস্বল হলেও। যাত্রা সেখানে আরো গভীরগামী।
পরের তিনটি প্রবন্ধের বিষয় প্রযুক্তি। প্রথমেই এসেছে তৃষ্ণা বসাকের প্রতিবেদন ‘উত্তাল সত্তরে প্রযুক্তির প্রথম প্রতিশ্রুতি’। লেখিকা শুরু করেছেন নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে আর শেষে রয়েছে তাঁর স্বরচিত নাতিদীর্ঘ কল্পবিজ্ঞানের একটি কবিতা। আর এই দুই কবিতার মাঝখানে ধরা আছে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় যে বিস্ময় সেই তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের প্রথম উন্মেষের একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনশ। কারণ সত্তর দশকই হচ্ছে সেই সময় যখন আজকের এই বিপুল সম্ভাবনা প্রথম পাখা মেলেছিল। এখনকার যন্ত্রগণক, বা কম্প্যুটারের শুরুটা ধরা যেতে পারে ১৯৪৬। ডাইনোসরের মত বিশাল আকৃতির সেই সব কম্প্যুটারের মূল উপাদান ছিল ভ্যাকুয়াম টিউব। ষাটের দশকে অভিজাত বাঙালির বৈঠকখানায় সাজিয়ে রাখা বিশাল আকারের বেতারযন্ত্র, বা রেডিওরও সেই একই গল্প। তারপর এল ‘ট্রানজিস্টার’, সিলিকনের ছোট্ট টুকরো, যা দিয়ে ভ্যাকুয়াম টিউবের বদলে বর্তনী, অর্থাৎ সার্কিট তৈরি হতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যে আই. সি., অর্থাৎ ইণ্টিগ্রেটেড সার্কিট প্রযুক্তির কল্যাণে এক টুকরো সিলিকনের উপর আক্ষরিক অর্থেই ‘আঁকা’ হতে লাগল একগুচ্ছ বর্তনীচ। ক্রমেই সেই টুকরো, বা ‘চিপ’-এর ধারণ ক্ষমতা বাড়ল, অভিজাত ঘরের গ্রাম্ভারি ‘রেডিো’ খুদে হয়ে ‘পকেট ট্রানজিস্টার’ হল, আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে ১৯৭১ সালে প্রথম তৈরি হল ‘মাইক্রোপ্রসেসর’-এর প্রযুক্তি -- নাম ইনটেল 4004, ১৯৭৪-এ উন্নততর ইনটেল 4040 (তথ্যসূত্র : গুগলদাদা; শুরু হয়ে গেল গুরুসামান, লঘুসামান (হার্ডওয়্যার, সফ্টওয়্যার)-এর ঘোড়দৌড়। পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যসফল ‘পিসি’ বা পার্সোনাল কম্প্যুটার জন্ম নিল ১৯৭৪ সালে, যার অন্যতম উপাদান ইনটেল 8080 (৮০৮০)। আর এইভাবেই সেদিনের সেই ডাইনোসরাস ছোট হতে হতে পুঁচকে এক নেংটি ইঁদুরের চেয়েও ছোট হয়ে আজ আমাদের ‘করতলে আমলকীবৎ’। এদিকে পঞ্চাশের দশক থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল মানুষের মহাকাশ অভিযান। সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন, ‘গজদন্তমিনারবাসী’, প্রায় কল্পবিজ্ঞানের মত সেই প্রকল্পের হাত ধরেই যোগাযোগব্যবস্থার পালে লাগল ঝোড়ো হাওয়া। ১৯৬৬ থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এ এসে আলাদা আলাদা জায়গায় অবস্থিত আমেরিকার চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তাবৎ কম্প্যুটারকে বেঁধে ফেলা হল একই যোগাযোগের জালে, নাম হল আরপানেট (ARPANET)। সেদিনের সেই একরত্তি চারা ক্রমে ক্রমে ডালপালা ছড়িয়ে এখন ভূবনজোড়া আন্তর্জাল, বা ইণ্টারনেট -- যার পোশাকি নাম ওয়র্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, সংক্ষেপে www। ভারতবর্ষে অবশ্য তার সগৌরব আগমন আশির দশকে, স্যাম পিত্রোদার হাত ধরে। লেখিকা তাঁর প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন সহজভাবে, আপাত এক হালকা চলে, বিশেষজ্ঞের কচকচির মধ্যে না গিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন বিশেষ বিশেষ ঘটনাপঞ্জী এমনভাবে যাতে সাধারণ পাঠকের আগ্রহ থাকে। তবে প্রযুক্তির অগ্রগতি বোঝাতে একবার বর্গ মিমি, আর একবার বর্গ ইঞ্চির ব্যবহার বিভ্রান্তিকর। তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত অনেক ব্যক্তিনাম এবং পরিভাষা সাধারণ জ্ঞানের আওতায় চলে এলেও ‘আর্কিটেকচার’ বলতে এখানে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে, তা অবিশেষজ্ঞ কারুর পক্ষে বোঝা হয়তো কঠিন হতে পারে। তবে সব মিলিয়ে ঝরঝরে প্রতিবেদনটি বেশ উপভোগ্য। মন কেড়েছে লেখিকার দুটি কবিতাই। তাঁকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই।
পরের প্রতিবেদন অভিজিৎ মিত্রর ‘সত্তরের ইসরো : মহাকাশ বিজয়ের স্বপ্ন ও বাস্তব’। প্রতিবেদনের শুরুতেই লেখক স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে সত্তর দশক সম্বন্ধে তাঁর কোন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই। আর তারপর তিনি সেই সময়ের একটি সংক্ষিপ্ত চালচিত্র উপস্থিত করেছেন। ব্যক্তিগত স্মৃতি বা দায়বদ্ধতা নেই বলেই তাঁর উপস্থিত করা চালচিত্রটি অন্য অনেকের তুলনায় অনেক বেশি নিরপেক্ষ। সেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ছবি যেমন আছে (যা এর আগের অনেক প্রবন্ধেই আমরা পেয়েছি), তেমনি অবসরের দিনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে কুপিয়ে খুন করা, হুগলির অধ্যক্ষ অথবা অন্যান্য নানা পেশার মানুষকে (ডাক্তার, উকিল, ইত্যাদি) হত্যার তাণ্ডবও বাদ পরেনি। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত দিনগুলিতে ওপার বাংলা থেকে উৎখাত হয়ে আসা শিক্ষক ও শিল্পীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মানবিকতাও। আর এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে ভারত সরকারের মহাকাশ বিভাগ (ডিপার্টমেণ্ট অফ স্পেস, সংক্ষেপে DOS)-এর আওতায় ইসরো (ইণ্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ, সংক্ষেপে ISRO)-র কর্মকাণ্ড শুরু। লেখকের মতে ইসরোর পিছনে সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনতার সামনে এক গঠনমূলক ভাবমূর্তি তুলে ধরা, যাতে তার নখ-দাঁত বার করা চেহারাটা কিছুটা হলেও আড়ালে চলে যায়। আরো উদ্দেশ্য ছিল ইসরোর দৌলতে জনসংযোগের যে বিপুল ক্ষমতা হাতে আসবে তাকে ব্যবহার করা। ইসরোর প্রদীপে সলতে পাকানোর কাজ অবশ্য শুরু হয়েছিল আরও আগে, সেই ষাটের দশকে। তখন মহাকাশচর্চা পরমাণু দপ্তরের অধীনে ছিল। কারণ সরকার তখন ক্ষেপণাস্ত্র (মিসাইল) প্রযুক্তি আয়ত্ত করে এক পরমাণু শক্তিধর ‘বাহুবলী’ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। এইভাবেই লেখক উপস্থিত করেছেন পর্দার আড়ালে ইসরোর জন্মরহস্য। মহাকাশ চর্চায় ভারত পাশে পেয়েছিল এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতম, বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে। আর তারই সাহায্যে, ১৯৭৫ সালে উৎক্ষিপ্ত হয় ভারতের প্রথম নিজস্ব উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’। দু’টাকার নোটে সেই ছবি ছাপা হয়ে পৌঁছে গিয়েছিল আপামর জনসাধারণের কাছে। এরপর লেখক ইসরোর আরো কিছু সাফল্যের খতিয়ান দিয়ে প্রতিবেদনটি শেষ করেছেন ২০২৩-এ চন্দ্রযান ৩-এর সফল অভিযান দিয়ে। প্রতিবেদনের শেষে লেখক স্বীকার করেছেন তিনি ইসরোর সাফল্যে গর্বিত, তবু ইতিহাসের সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ। এখানে বোধহয় পাঠ প্রতিক্রিয়া হিসাবে কয়েকটি কথা যোগ করা চলে। প্রথমত, বিশ্বের কোন দেশেই মহাকাশচর্চা বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের বিষয় নয়, তার পাশে অতি অবশ্যই সামরিক উদ্দেশ্য (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) রয়েছে। আর তা শুধু ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য নয় -- সুবিস্তৃত, সুগভীর গোয়েন্দাগিরির জন্যও বটে। ফলে আজকের দুনিয়ায় পৃথিবীর কক্ষপথে নিজের দেশের ‘চোখ’ (পড়ুন ‘উপগ্রহ’) বসানো দেশের কর্ণধারদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। দ্বিতীয়ত, ইসরোর জনসংযোগের কতটুকু বা কতখানি রাজনৈতিক সুবিধা কোন কোন সরকার পেয়েছে তা হয়তো গবেষণার বিষয়, তবে আবহবিজ্ঞান আর বিপর্যয় মোকাবিলায় দেশকে তা কয়েক শ’কদম এগিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব উপকূলে, যেখানে প্রতি বছর ঝড়ে বহু মানুষের অসহায় মৃত্যু সাধারণ ভবিতব্য ছিল। তৃতীয়ত, আজকে ইসরো যত উজ্জ্বল গৌরবের পালকই হোক না কেন, শুরুর দিনগুলো কিন্তু এমন ছিল না। পরপর ব্যর্থতা, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, বিরূপ সমালোচনা, এসবই তখন ইসরোর নিত্যসঙ্গী। সেই অবস্থাটাকে রাজনৈতিক সুবিধা না বলে দায় বলে ধরে নেওয়া বেশি সহজ। হয়তো নিজেদেরই কোনো স্বার্থে, হতে পারে কোন গোপন গভীর স্বার্থেই, ইসরোকে কিন্তু বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল -- যার সুফল ভোগ করেছে উত্তর প্রজন্ম। চতুর্থত, এ. পি. জে. আবদুল কালামের ডাক নামই ‘মিসাইল ম্যা্ন’, কাজেই তিনি যে মিসাইল তৈরি করতেই চেয়েছিলেন সেটা কোন অবাক হওয়ার ব্যাপার না। পঞ্চমত, অতি তিক্ত সত্য এই যে বাঘকে ধান খেতে বললে লাভ হয় না। তা না হলে অগ্নিযুগের বিপ্লবী থেকে, নকশাল আন্দোলন হয়ে, অধুনা কালের মাওবাদী পর্যন্ত, এভাবে বারে বারে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার দরকার হত না। ১৯৯৮-র ঘাউড়ি ক্ষেপণাস্ত্র আর প্রাচীন প্রতিবেশী ‘ড্রাগনদাদা’-র অস্ত্রসম্ভার হিসেবে ধরলে স্রেফ প্রতিবেশীর শুভবুদ্ধির ওপর ভরসা করে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকাটা সঙ্গত হত কি?
পরের প্রতিবেদন সুকোমল ঘোষের ‘এ কোন অধ্যায়’, এই সংকলনের সংক্ষিপ্ততম রচনা। বিষয় ভারতে পরমাণু শক্তির চর্চা, এবং প্রতিবেদনটি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে পোখরানের প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটেছিল ১৯৭৪ সালে। অর্থাৎ সত্তর দশকে এসেই ভারত প্রথম পরমাণু শক্তিধর হয়েছিল। প্রতিবেদনের শুরু বাদল সরকারের ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ নাটকের একটি উদ্ধৃতি, যা ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দিনে পরমাণু যুদ্ধের ভীতি মনে করিয়ে দেয়। লেখক এরপর স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারতে যে যে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে তার একটা তালিকা দিয়েছেন। প্রথম বিস্ফোরণের পর ভারতের ঘোষিত নীতি ছিল ‘শান্তিপূর্ণ কাজে পরমাণু শক্তির ব্যবহার’। পরে ১৯৯৮ সালে পোখরানে দ্বিতীয় বিস্ফোরণের মাধ্যমে ফিশন ও ফিউসন (‘অপারেশন শক্তি’), দুই ধরনের পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রযুক্তিই ভারতের হাতে এসে যায় এবং ভারত সম্পূর্ণভাবে নিজেকে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে। লেখক ফিশন ও ফিউসন প্রক্রিয়ার মূল নীতি ব্যাখ্যা করেছেন, ভারতের প্রযুক্তিগত সাফল্যের জন্য গর্ব প্রকাশ করেছেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে বোধ করেছেন আশঙ্কা। মনে করিয়ে দিয়েছেন হিরোশিমা নাগাসাকির বীভৎসতা এবং প্রতিবেদনটি শেষ করেছেন ‘ত্রিংশ শতাব্দী’-র আর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। স্পষ্টতই লেখক পরমাণু শক্তি ব্যবহারের বিপক্ষে। লেখক কোন পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের উল্লেখ করেননি এবং ভারতের ফিউসন গবেষণার কোন উল্লেখও এই স্বল্প আয়তনের প্রবন্ধে জায়গা পায়নি। তবে পূর্ববর্তী লেখকের মত ইনিও ভারতকে শুরু থেকেই পরমাণু বোমা বানানোয় উৎসাহী দেশ হিসাবে সনাক্ত করেছেন। অবশ্যই এই অভিধা ভারতের তৎকালীন ঘোষিত অবস্থান থেকে ভিন্ন। এ ব্যাপারে মন্তব্য (পক্ষে বা বিপক্ষে) করার মত উপযুক্ত তথ্য আমাদের মত সাধারণ পাঠকদের ভাণ্ডারে নেই। তবে চেরনোবিলের বিপর্যয়ের পর এমনকি ‘শান্তিপূর্ণ কাজে পরমাণু শক্তির ব্যবহার’ নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়েই প্রশ্ন উঠে গেছে। তাই ভূবন জোড়া শক্তি সংকটের মোকাবিলায় পরমাণু বিদ্যুৎ আজ আর তত গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে এখনও পর্যন্ত সোনার হরিণ ফিউসন প্রযুক্তির গবেষণা, যা সফল হলে ঘুচে যাবে পৃথিবী জোড়া শক্তি সংকট, হাতে এসে যাবে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, তার থেকে দূরে সরে থাকা ভারতের জন্য দূরদৃষ্টির পরিচয় নয়।
এর পরের সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পায়েল চট্টোপাধ্যায়ের ‘সত্তর দশকের এক অনন্য নারী অভ্যুত্থান: চিপকো আন্দোলন’। লেখিকা এই আন্দোলনের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন ইকো ফেমিনিস্ট, অর্থাৎ পরিবেশ ও নারীর আন্দোলন হিসাবে। ‘চিপকো ’শব্দের অর্থ ‘লেগে থাকো’। “লেগে থাকাই তো বেঁচে থাকা…” (রবীন্দ্রনাথ, ‘স্ত্রীর পত্র’)। ১৯৭৩ সালে, বর্তমান উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় মেয়েরা প্রতিটি গাছকে জড়িয়ে থেকে ঠিকাদারদের হাত থেকে গাছগুলিকে বাঁচিয়েছিলেন, বন্ধ করেছিলেন গাছকাটা। এই আন্দোলন পরে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র উত্তর ভারতে। আন্দোলনের তীব্রতায় অবশেষে ১৯৭৫ সালে বন নিগম তৈরি ক’রে নির্বিচার গাছকাটা বন্ধ করতে আইন প্রণয়ন করা হয়। প্রবাদ বলে এই আন্দোলনের মূলে রয়েছে রাজস্থানের বিষ্ণোয়ি সম্প্রদায়ের উপকথা, যেখানে অষ্টাদশ শতকে অমৃতা দেবী নামে একজন এইভাবেই নিজের জীবন বাজি রেখে গাছ বাঁচিয়েছিলেন। প্রবন্ধের শুরু হয়েছে নাটকীয় ভঙ্গীতে, যা একই সাথে মেয়েদের অসহায়তা ও সঙ্ঘশক্তির কথা বলে। আসলে অরণ্য উৎসাদনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জনজাতি, আরো বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী। তাই এই আন্দোলনে মেয়েরাই চালিকা শক্তি। পরে সুন্দরলাল বহুগুণার নাম এর সাথে জুড়ে যায়। চিপকো আন্দোলন পরিবেশ রক্ষার, সবুজ বাঁচানোর আন্দোলন, পরিবেশের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকা অর্থনীতিকে বুঝিয়ে দেওয়ার, বুঝে নেওয়ার আন্দোলন, আবার আদ্যন্ত অহিংস এই আন্দোলন নারী-আন্দোলনও বটে। চিপকোর মত আরও অনেক আন্দোলন ক্রমশ জায়গা করে নেয় সবুজ বাঁচানোর অভিযানে, শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও। সত্তর দশকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন আজ একুশ শতকে পৌঁছে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক।
এই সংকলনের উপসংহারে রয়েছে অচিন্ত্য দাশের প্রবন্ধ, বা বলা ভালো স্মৃতিকথা, ‘সত্তরের দশক ও আমি’। প্রথমেই লেখক খোলসা করে দিয়েছেন যে সত্তর দশক শুরু হওয়ার সময়ে তাঁর বয়স ছিল আঠারো, অর্থাৎ সবচেয়ে আক্রান্ত হওয়ার বয়স। আর তাঁর তখনকার অবস্থান বিন্দু তাবৎ নকশাল আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র যাদবপুরে (অন্যটি ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ, নকশাল আন্দোলনের দুই প্রধান ‘এপিসেণ্টর’)। স্থান, কাল, পাত্রের এহেন সমাপতনের ফলে লেখকের ব্যক্তিগত চোখ দিয়ে দেখে নিতে পারি সেই সময়ের এমন কিছু ছবি যা তাঁর একান্ত নিজস্ব, অন্য কারো ভাবনায় জারিত নয়। সেদিন বিপ্লবের আদর্শ তাঁকে প্রাণিত করেছিল, কিন্তু বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা ধাক্কা দিয়েছিল শুভবুদ্ধিকে, কারণ বিদ্বেষ কোন পথ হতে পারে না। প্রতি মুহূর্তে তিনি প্রশ্ন করেছেন পদ্ধতিকে, পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা অযৌক্তিকতাকে। খুন হয়ে গেছে তাঁর প্রিয়বন্ধু, যে বিশ্বাস করত সাম্যবাদে, আর তার হত্যাকারী -- না, কোনও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নয়, তারই মত সাম্যবাদে বিশ্বাসী আর এক তরুণ। হয়তো তাদের দলীয় মতে কোন পদ্ধতিগত পার্থক্য ছিল -- শুধু সেইজন্য। খুন হয়ে গেছেন শ্রদ্ধেয়, পণ্ডিত এক মানুষ। আর এইসব শ্মশান-অভিজ্ঞতা তাঁকে অহিংসক হতে শিখিয়েছে। সাইরেনের শব্দ তাঁকে বুঝিয়েছিল যুদ্ধের ভয়াবহতা। উল্লেখ করেছেন ঝুম্পা লাহিড়ির ‘দ্য লো ল্যাণ্ড’ উপন্যাসটি। সেখানে অনেক বছর পরে দুই আপাত অপরিচিত নারী মুখোমুখি -- একজনের পুলিশ স্বামী, অন্যজনের বিপ্লবী প্রেমিক নিহত হয়েছিল নকশাল আমলে। রাষ্ট্র হোক বা বিপ্লব, বিরাট বড় এই সব তত্ত্ব বা ঘটনার অনেক আড়ালে চাপা পড়ে যায় নিতান্ত তুচ্ছ ব্যক্তি মানুষের ততোধিক তুচ্ছ বাঁচা মরার প্রশ্ন।
ক্রমে দশকের বয়স বাড়ে, লেখকেরও।
ছাত্রজীবন পার হয়ে তিনি পা রাখেন কর্মজীবনে, আর ভারত ঘটিয়ে ফেলে তার প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণ।
এই বিস্ফোরণকে ঘিরে যা কিছু প্রশ্ন, সংশয়, দোলাচল ও প্রাপ্তি তা স্পষ্ট হয়েছে লেখকের
স্মৃতিচারণায়। সেই তুলনায় এই বিষয়ে সুকোমল ঘোষের লেখা আগের প্রতিবেদনে এক প্রচ্ছন্ন
অননুমোদন ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই পরমাণু বিস্ফোরণ
সমর্থন করতে পারে না, এমন কি হয়তো শান্তির জন্য হলেও নয়। শুনেছি পৃথিবীর যেখানে যখন
পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, হিরোশিমা শহরের পক্ষ থেকে সেই দেশকে চিঠি লেখা হয়েছে
প্রতিবাদ জানিয়ে। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটার সাথে সাথে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির ‘শান্তিরক্ষা’-র
তাগিদে বিস্তর হৈ চৈ, ভারতকে ঠাণ্ডা করার কোমরবাঁধা উদ্যোগ, এইসব দাদাগিরি আর দ্বিচারিতা
দেখলে জাতিগত অহংবোধে ঘা লাগে বই কী! বলতে ইচ্ছা করে “বেশ হয়েছে, ভালো হয়েছে”। তার
পরেই প্রশ্ন ওঠে বোতল থেকে পরমাণুশক্তির জিন বেরিয়ে আসার পর পৃথিবীতে শান্তিকল্যাণ
রক্ষা করা যায় কী করে? এর একটা আজব উত্তর হল, পৃথিবীর সবচেয়ে পরমাণু শক্তিধর যে রাষ্ট্র
(পড়ুন ইউ. এস. এ.), সে যদি ক্রমশ আরো আরো শক্তিশালী পরমাণু বোমা বানিয়ে যেতে পারে তাহলেই
অন্য কেউ আর ট্যাঁ ফোঁ করার সাহস পাবে না। আর তার মানেই নিশ্ছিদ্র শান্তিকল্যাণ। আর
এর এক সহজ নিষ্কর্ষ হল -- নিজের মাথাকে যদি পরমাণু বোমা বা তজ্জনিত ব্ল্যাকমেইল থেকে
বাঁচাতেই হয়, তাহলে হাতে কিছু পরমাণু বোমা থাকা আবশ্যক। না হলে অন্য কোন পরমাণু শক্তিধরের
ছত্রছায়া বেছে নিতে হয়। চাকরির ইণ্টারভিউয়ে চক্র-আলোচনা, বা গ্রুপ ডিসকাশনে এইসব যুক্তি
আর প্রতিযুক্তিই উঠে এসেছে লেখকের স্মৃতিচারণায়। আর সেইখানে লেখকের মন্তব্য এতটাই যুক্তিসিদ্ধ
ও যথাযথ, যে প্রায় ভবিষ্যদ্বাণীর মত। কারণ বিদেশি সাহায্যের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্বনির্ভর
হওয়ার চেষ্টাটা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। আর সেই পথ ধরেই আসে আত্মবিশ্বাস, সাফল্য, নিজের
প্রকৃত সক্ষমতা যাচাই করার সুযোগ, এবং সর্বোপরি নিজের হাতে, সম্পূর্ণ নিজেদের চেষ্টায়,
নতুন এক প্রযুক্তি গড়ে তোলার আনন্দ। যেমন প্রথম বিস্ফোরণের পর সম্পূর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তিতে
গড়ে তোলা পরমাণু চুল্লি ‘ধ্রুব’। যেমন ১৯৯৮-এর দ্বিতীয় বিস্ফোরণের পর জি. পি. এস.-এর
ভারতীয় বিকল্প আই. আর. এন. এস. এস. (IRNSS, Indian Regional Navigational
Satellite System; দ্র. অভিজিৎ মিত্রের প্রবন্ধ)। এই তৃপ্তি, এই সাফল্য, এই স্বাধীনতার
বোধ, এই হল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এই দুটি বিস্ফোরণের।
লেখকের স্মৃতিচারণায় এসেছে জরুরি
অবস্থা, রেল ধর্মঘট। পূর্ণেন্দুশেখর মিত্রর সম্পূর্ণ প্রবন্ধটির নিষ্কর্ষ লেখক প্রকাশ
করেছেন দুটি বাক্যবন্ধে, “এক: ভারতীয় রেলের বিশালত্ব ও তার অবশ্য-প্রয়োজনীয়তা। দুই:
শ্রমিক সংগঠনের শক্তি”। অন্যদিকে জরুরি অবস্থার ভয়াবহতার একটি টুকরো ছবি -- ‘স্টেটসম্যান’
পত্রিকার সম্পাদকের পুলিশ প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে লণ্ডনে পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকে পত্রিকা
প্রকাশ করা। অনেক সময়ে অনেক তথ্যের তুলনায় এমন এক একটি ছবি মনের দরজায় পৌঁছয় অনেক সহজে।
সত্তর দশক লেখকের কাছে নিয়ে এসেছিল
সাহিত্য সংস্কৃতির এক বিপুল সম্ভার। জনপ্রিয় সাহিত্য, পুজোসংখ্যা, এসবের পাশাপাশি ছিল
‘লিটল ম্যাগাজিন’ -- যাকে লেখক তুলনা করেছেন “খোলা সবুজ প্রান্তরে একটি মুক্ত সাদা
ঘোড়ার মতো”। ছিল বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ আর ‘স্পার্টাকাস’-এর মত নাটক (ও পথনাটিকা),
সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, মৃণাল সেনের ‘ইণ্টারভিউ’ আর তপন সিংহের ‘সাগিনা মাহাতো’-র
মত ছায়াছবি। ক্রমে ক্রমে পা বাড়ালো নতুন প্রযুক্তি, ঘরে ঘরে দেখা দিতে লাগল দুরদর্শন,
বদলে যেতে লাগল বাঙালির সামাজিক জীবন। পেশাদার জগতের পরিবেশেও এল বদল। সত্তর দশক পর্যন্ত
“কলকারখানায় ... যাঁরা কাজ করেন তাঁরা কারখানা-অন্ত প্রাণ। যেন সেটা দ্বিতীয় ঘরবাড়ি”।
কাজের জগতের সাথে মানবিক আবেগের সেই সংযোগ ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকে। এই প্রবণতা শুধু
এদেশে নয়, লেখকের অভিজ্ঞতায় বিদেশেও। সময় এগিয়ে চলে। বদলে যেতে থাকে চারপাশ। বদলে যেতে
থাকেন লেখক নিজেও। তবু পিছন ফিরে তাকালে তিনি দেখতে পান সত্তর দশক “নিজের ভেতর ...
ঢুকে বসে আছে”। আর কোন সময়খণ্ড এমনটা নয়। বাইরের
জগতেও সত্তর দশক, যেন এক যুগসন্ধি। লেখকের একান্ত স্মৃতিচারণায় এই দশক তাই সবদিক দিয়েই
অনন্য।
১৯৭৫ ঘোষিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ হিসাবে। নারীবাদীদের জন্য, এবং বিশেষ করে আমাদের দেশের লিঙ্গ সচেতনতার প্রেক্ষিতে, যা একটা বড় ঘটনা। এ রাজ্যে নকশাল আন্দোলনের পাশাপাশি প্রতিবেশী বিহারে গান্ধীবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে ছাত্র-যুব আন্দোলন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলনের পথ ধরেই প্রথমে জরুরি অবস্থা ও পরে কেন্দ্রে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গে বঙ্গোপসাগরে মার্কিনী পরমাণু-যুদ্ধজাহাজের অনুপ্রবেশ, ভারত-সোভিয়েত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, ও পরিশেষে ভারত-পাকিস্তান সিমলা চুক্তি -- প্রত্যেকটিই উপমহাদেশ ও ভূ-রাজনীতির নির্ণায়ক ঘটনা। অর্থনীতির দিক দিয়ে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ একসময়ের বহু প্রশংসিত পদক্ষেপ। মধ্যবিত্ত মানুষকে তা অনেকখানি আর্থিক নিরাপত্তা দিয়েছিল। ছাপ ফেলেছিল গ্রামীণ অর্থনীতিতেও। ব্যাঙ্কের উপর সাধারণ মানুষের সেই বিশ্বাস ২০১৬ সালের নোটবন্দীর আগে পর্যন্ত অটুট ছিল। এই সব কয়টি বিষয়ই সম্পাদকরা আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের তালিকায় আরো ছিল দলিতসাহিত্য, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সত্তর দশকের শ্বেতসন্ত্রাস এবং শাসকশ্রেণীর মদতে কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার প্রচার। এর কোনটাই এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে পাঠকের মনে এই সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য প্রত্যাশা রইল। সত্তর দশকে আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল যার দিকে বর্তমান সম্পাদক মণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। যেমন ১৯৭১ সালে ভারতে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ করা, সত্তর দশকে ভারতে প্রথম কলকাতায় পাতাল রেলের কাজ শুরু হওয়া, আর ১৯৭৫ সালে বাংলার প্রথম রক-ব্যাণ্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র আবির্ভাব। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও সংকলনটিতে বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ ও বানান-বিভ্রাট থেকে গেছে। আগামী সংস্করণে সেগুলি সংশোধিত হবে বলে আশা করি। সর্বোপরি ‘কালিমাটি’ ও তার সম্পাদকদের ধন্যবাদ, এমন একটি সংকলন হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন