প্রসঙ্গ : তরুণ মজুমদার ৫
‘ভালোবাসার বাড়ি’
সেই
২০০৬-এ ‘ভালবাসার অনেক নাম’-এর এক যুগ পর, ২০১৮-য় স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে আমাদের
বিয়ের রজত জয়ন্তী উপলক্ষে নন্দনে যাই তরুণ মজুমদারের ছবি দেখতে।
ছবি
শুরুর অল্পক্ষণের মধ্যেই মনে-প্রাণে দোলা লাগিয়ে দেয় দুই বোনের গান
আর নাচঃ ‘ফাগুন তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান’! কিছুক্ষণের ব্যবধানে এল
ভাগ্যের প্রথম আঘাতঃ প্রৌঢ় বাবার পাটকলে কেরানীর চাকরিটি গেলো, প্লাস্টিকের
দাপটে পাট এখন লুপ্ত প্রজাতির দলে। ছোটবোন সঙ্গে-সঙ্গে বলে, “তাহ’লে কাল থেকে আর
ইস্কুল যাব না। মাইনের খরচটা তো বাঁচবে!” তাই শুনে বড়বোন বুলি (বল্লরী) বোনের হাতে
তুলে দেয় বিজ্ঞাপনের কাগজ, যা ছোট গিয়ে দেয় পাড়ার সহৃদয় চায়ের দোকানের মালিকের
হাতে, ‘এখানে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের গান শেখানো হয়।’ এর পরেই প্রেক্ষাগৃহ মুখর করে ‘নূপুর বেজে যায় রিনি রিনি’! চোখের
পাতা ভিজতে শুরু করেছে। এই জন্যেই তো তরুণবাবুর ছবি দেখতে আসা! নূপুরনিক্কণ শেষ
হতেই ‘ওগো নদী আপন বেগে’। পাড়ার বখাটে ছোকরার দলও এসে জোটে, জানলা / দরজা দিয়ে উঁকি মারে, তাদের নেতা একটু চ্যাংড়ামি করে সিনেমা
দেখার প্রস্তাবও টিকিটসহ জানলা দিয়ে ছুঁড়ে মারে। পরে অবশ্য বুলি এবং চা-কাকুর কঠোর
শাসনে সে পাড়া ছাড়তে বাধ্য হয়!
ইতিমধ্যে
বুলির অবস্থাপন্ন বান্ধবী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বুলির চাকরীর জন্যে। প্রথমে একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা (সিনেমার গানের অডিশন দেবার পর লম্পট পরিচালক / প্রযোজকের কুপ্রস্তাব) হয়, তারপর ‘ভারত মাতা’ ভ্রমণ সংস্থায়
কাজ। সেখানেই আমরা দেখি বুলিরই মতো হতভাগ্য কিন্তু প্রাণচঞ্চল স্বভাবকবি সহকর্মী (সে কি ১৯৮০র
দশকে ‘দাদার কীর্তি’র ছন্দোবাণী ক্লাবের কেউ?), যার মানসিকভাবে পীড়িত মা
বুলির মধ্যে খুঁজে পান তাঁর প্রয়াত মেয়েকে। বুলি তাঁকে শোনায় সেই মেয়েরই গানের
খাতা থেকে ‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে’। কানে বাজছে ‘প্রিয়তম হে জাগো জাগো জাগো’,
আর ক্যামেরা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দেওয়ালে টাঙানো কবিগুরুর ছবির সামনে। তরুণবাবু, আপনি
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ-ধন্য, এ নিয়ে আমার সেই ‘দাদার কীর্তি’ থেকেই কোন
সংশয় ছিলো না।
তরুণবাবুর
ছবি আর প্রেমের পথে (তুচ্ছ) বাধা আসবে না? বুলির বাবা আর তাঁর বাল্যবন্ধু মিলে
মেয়ের সম্বন্ধ করেছেন এক দাবিহীন কিন্তু উচ্চবিত্ত পরিবারে। ছেলে আবার বেশ পশ্চিমী
ভাবধারার। কাজেই সে কি আর ভালো হতে পারে (মনে করুন ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘আগমন’!
ব্যতিক্রম বোধহয় একমাত্র ‘আপন আমার আপন’?)? সে যাকগে, তরুণবাবুর পৃথিবীতে ছোকরা
স্রেফ হাওয়ায় উড়ে যাবে (‘ফুলেশ্বরী’, ‘দাদার কীর্তি’)। হবে মধুরেণ সমাপয়েৎ। ‘আলো’
বা ‘নিমন্ত্রণ’-এর মত নির্মম এই ছবি নয়।
কয়েকটি কথা। তরুণবাবু, গানের দিদিমণিদের কাছে কিন্তু শুধু ছোট মেয়েরাই নয়, ছোট ছেলেরাও গান শিখতে পারতো! আর ‘বাজিল কাহার বীণা’র মাঝখানে যন্ত্রানুসঙ্গ ‘আলো’র ‘শ্রাবণের ধারার মতো’ কে মনে করায় ঠিকই, কিন্তু এখানে মন ঠিক সেই ভাবে আন্দোলিত হয় না। ওটা বাদ দিলে ক্ষতি হতো না।
এত সুন্দর ইচ্ছাপূরণের গল্পে কিন্তু রূঢ় বাস্তব এসেছে – পাট-বনাম-প্লাস্টিক, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সামনে অনটনের অন্ধকার, কাজের জন্যে মেয়েদের লাম্পট্যের মুখোমুখি হওয়া, ঘরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মাকে রেখে ছেলের চাকরী টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা, পাড়ার ছেলেদের ‘সিন্ডিকেটে’ জড়িয়ে পড়া – সবই। কিন্তু সদয় বিধাতা (এক্ষেত্রে কাহিনীকার) শেষ অবধি মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে জয়ী হতে দেননি। যে ছেলে বুলিকে সিনেমা দেখার প্রস্তাব দিয়ে পাড়া থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, সেই ফিরে আসে সদর্পে। বিনা পয়সায় বেঁধে দেয় বুলির বিয়ের প্যান্ডেল। আর বুলির পাতানো কাকা বুলির ভালোবাসা আর তার অন্তরের বিশ্বাসকে সম্মান জানিয়ে ভেঙে দেন নিজের আনা ধনীর বাড়ির সম্বন্ধ। সবশেষে বুলি তার ক্ষুব্ধ বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে বিত্তশালীর অনুকম্পার পেছনে থাকে কতখানি অবজ্ঞা আর অসম্মান।
আমার চাকরীজীবনের প্রথম কয়েক বছর কেটেছে শ্যামাপ্রসাদ (সান্ধ্য) কলেজে। সেখানে বাংলা বিভাগের এক সহকর্মী কলেজের পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, “মাথার ওপর মহীরূহের মতো এখনো আছেন রবীন্দ্রনাথ।” নতুন করে ‘ভালোবাসার বাড়ি’ তা মনে করিয়ে দিল!
তরুণবাবু, আপনি সমালোচিত হয়েছেন এই ছবির জন্যে। কেন আপনি বদলে নিচ্ছেন না নিজেকে? কেন আপনার পৃথিবী এতটা সহজ!
বদলাবেন না আপনি। সেদিন নন্দনের ভীড় দেখে বুঝেছি আমার একার নয়, অনেকেরই আপনাকে বড্ড বেশী প্রয়োজন। প্রয়াত গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের একটি গানের লাইন তুলে বলি, আমাদের জীবন-মরুর অভিশাপে একটু সবুজ ছুঁইয়ে দিতে আর যে কেউ নেই!
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করলাম বড় পর্দায় দেখা তরুণ মজুমদারের ছবির বর্ণনা। সাম্প্রতিক অসুস্থতার পর তিনি আরোগ্য লাভ করেছেন। কামনা করি, তিনি সুস্থ থেকে আরও ছবি করুন।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন