কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

শিবাংশু দে

 

নিম-সময়ের জর্নাল




 

শিল্পযাপন, অহমিকা ও সৃজন কবিয়াল

----------------------------------------------------

এমন এক একটা সময় আসে, যখন মানুষ ঠাহর করতে পারে না, সে ইতিহাসের ঠিক কোন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আমাদের সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী বর্গ, অর্থাৎ পেশাদার রাজনীতিকরা, যাই করেন তাকে 'ঐতিহাসিক' বিশেষণে দাগিয়ে দেন। সেই সব সিদ্ধান্তের পিছনে কোন সর্বনাশ লুকিয়ে আছে তার কোনও পরওয়া না করেই। সেই বিক্রমাদিত্যের যুগ হোক বা আজকের অন্য এক 'আদিত্যে'র আমল, সবই তো ‘স্বর্ণযুগ’। কিন্তু রামা কৈবর্ত বা হাশিম শেখের আদত অবস্থা একই থাকে। বহিরঙ্গের ঠুনকো বদলটিকে যদি ধরে নেওয়া হয় এহ বাহ্য। আমাদের মতো একান্তভাবে গুরুত্বহীন, তাৎপর্যহীন মানুষদের প্রাণযাপন বা শিল্পযাপন কি আদৌ কোনও অর্থ রাখে? তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম গরম করা কি নিতান্ত সময়ের অপব্যবহার?

আমাদের দেশে 'ধর্ম' আবহমান কাল ধরেই ছিলো একটা সংস্কৃতি যাপন। সারাদিন খেটে খাওয়া মানুষ হয়তো দিন শেষে ক্লান্ত মনটাকে গুছিয়ে নিতে কীর্তন গাইলো অথবা জলসায় আলিম-ফাজিল মানুষদের থেকে কিছু সদালোচনা শুনলো। অথবা কোনও পরবের দিন নতুন জামা, খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে ব্রাহ্মণ বা শেখ-সৈয়দদের থেকে শোনা অবোধ্য, জটিল প্রপঞ্চগুলি। যা শুধু শোনার জন্য। বোঝা নিষ্প্রয়োজন। মানলেও হয়। না মানলেও তা কখনও 'বোঝা' হয়ে উঠতো না। এই সব প্রসঙ্গের বাইরে ‘ধর্ম’ মানে তো স্রেফ শালগ্রামশিলা। এক কোণে রাখা চন্দন-সিঁদুর-বেলপাতার বুড়ি ছুঁয়ে থাকা পাশপোর্ট।  পরপারের হিসেবনিকেশ করতে লাগে।

কিছুদিন ধরে এদেশে 'ধর্ম' একটা প্রাণযাপন হয়ে উঠছে। যেন কপালের উপরে উল্কি দিয়ে আঁকা একটা কয়েদির নম্বর। অনন্ত সম্ভাবনাময় মানুষের সব পরিচয়কে ছাপিয়ে, সব সাফল্য-ব্যর্থতা, অর্জন তুচ্ছ করে ঐ নম্বরটিই তার যেন তার একমাত্র পরিচয়। একটা ভোটার কার্ড। তার অন্তিম পারানির কড়ি। শিল্প, সৃজনশীলতা, ক্ষুধা, পরিতৃপ্তি, সার্থকতা, যুদ্ধযাপন, সব কিছুই  চুলোয় ​​​​​​​যাক। ‘শুধু রবে অন্ধ পিতা, অন্ধ পুত্র তার’। 'ধর্ম' ই তখন কালান্তক যম। মানুষকে স্রেফ 'ভোটার' বানানোর যন্ত্র। মানুষের ধর্ম, মনুষ্যত্বের অন্তর্জলী, মন্দিরে মন্দিরে শুরু হয়ে যায়। যেটুকু  বিবেক বা শিল্পচেতনা এখনও বেঁচে আছে ভিতরে কোথাও, তা কীভাবে মিলবে এই বিষাক্ত অপ্রত্যয় অপচয়ে??

আমাদের দেশগাঁয়ে জনা দুয়েক লোক'কে জজেও মানে। তাঁদের একজন বলেছিলেন 'খালিপেটে ধম্মো হয় না।' আরেকজন স্বভাবসিদ্ধ চারুভাষে একটা কথা বলেছিলেন অনেকটাই একরকম। সেটা ঠিক কা'কে বলেছিলেন, তার একাধিক দাবিদারের নাম আমার মতো মূর্খের কাছেই একাধিক আছে। প্রমথ বিশী, অমিয় চক্কোত্তি বা সিতুমিঞা, যে কেউ হতে পারেন। তা কথাটা ছিলো, এঁদের মধ্যে কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, শিল্প কা'কে বলে বা মানুষের সৃজনশীলতার শিকড়টি কোথায়? এরকমই কিছু একটা হবে। কবি তখন উদাসচোখে জানালা দিয়ে একটা কুয়োতলার দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রশ্নকর্তা যখন দ্বিতীয়বার জিগ্যেস করলেন তখন কবি সেই দিকে নির্দেশ করে বললেন, ঐ দ্যাখো শিল্প। তিনি বুঝতে না পেরে একটু থতোমতো। তখন কবি বললেন, দেখতে পাচ্ছো ঐ লোকটি বালতি করে জল নিয়ে যাচ্ছে। তা'তো দেখাই যাচ্ছে। তারপর ভরা বালতিটা থেকে জল যে উপচে পড়ছে সেটা দেখতে পাচ্ছো? হ্যাঁ, তাও পাচ্ছি। ঐ উপচে পড়া জলটিই সৃজনশীলতা। মানুষের সব সৃষ্টি ওখান থেকেই আসে। এযুগের 'রাজনীতি' বাজিকরদের জলপাত্র ভরা শুধু বিষ। সেটাই তাদের একমাত্র অর্জন। ক্ষমতার দখলের নির্ভুল চাবিকাঠি। নির্লজ্জ দাপটে তাদের অহমিকার গরল ছলকে পড়ে। মানুষের বেঁচে থাকার ফসলগুলি জ্বালিয়ে দেয়। 'শিল্প'? ওরে শিল্প কোথায় পাবি?

একটি মাতৃসঙ্গীত আছে। "সারাদিন মা ঘুরেফিরে, দাঁড়িয়ে জীবননদীতীরে, হিসাবনিকাশ করে শেষে, তোর চরণই সার জানিলাম।" এটা ভক্তের অনুভূতি। আমাদের মতো বহু মানুষেরই এসব নসিব হয়নি এখনও। আর হয়তো হবেও না। কিন্তু অবিকল এই ভাবটা'র সামনে এসে দাঁড়াই, যখন কবির একটা গান প্রথম থেকে শেষ, শেষ থেকে প্রথম, পড়ি, গা'ই, বিড়বিড় করি। শিল্প কী, সৃজনশীলতা কী, জীবন লইয়া কী করিব? কিছু সদর্থক দিকনির্দেশ  এক টুকরো কবিতাটি আমাদের এনে দেয়। এই যে সারা চরাচর জুড়ে এতোজন মিলে নিজেদের ধ্যানধারণা, অভিজ্ঞতা, মনন, বিশ্বাস নিয়ে নানা রকম আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে কিন্তু প্রত্যেকেই প্রত্যেকের থেকে কিছু লাভ করছেন। যাঁরা গ্রহণে ইচ্ছুক, তাঁরা সম্পন্ন হবেন। যাঁদের আত্মগরিমা অধিক, তাঁরা যদি গ্রহণে অনিচ্ছুক হ'ন, তবে বঞ্চিত হবেন। এটা শুধু আমার বিশ্বাসই নয়, প্রত্যয়ও বটে।

আমরা সবাই গানটি শুনেছি। কিছুটা সমান্তরাল পাওয়া যাবে জীবনানন্দের 'বোধ' কবিতায়।

 

তোমারি     ঝরনাতলার নির্জনে

মাটির এই   কলস আমার ছাপিয়ে গেল কোন্ ক্ষণে॥

রবি ওই        অস্তে নামে শৈলতলে,

বলাকা       কোন্ গগনে উড়ে চলে--

আমি এই    করুণ ধারার কলকলে

নীরবে        কান পেতে রই আনমনে

তোমারি     ঝরনাতলার নির্জনে ॥

দিনে মোর   যা প্রয়োজন বেড়াই তারি খোঁজ করে,

মেটে বা      নাই মেটে তা ভাবব না আর তার তরে

সারাদিন      অনেক ঘুরে দিনের শেষে

এসেছি       সকল চাওয়ার বাহির-দেশে,

নেব আজ    অসীম ধারার তীরে এসে

প্রয়োজন     ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে

তোমারি     ঝরনাতলার নির্জনে  

আবহমান কাল ধরে মানুষের শারীর অস্তিত্ব বা জীবনকল্পকে আমাদের দেশে মাটির কলসের সঙ্গে তুলনা করা চলে আসছে। এই কলসটি নিতান্ত ভঙ্গুর, যে কোন সময়েই তার শেষ মূহূর্ত চলে আসতে  পারে। কিন্তু যতক্ষণ তা অভগ্ন  রয়েছে, তা'কে ঝরনাতলায় নিয়ে গিয়ে শুধু পরিপূর্ণ করে রাখাই শেষকথা নয়। সতত আমাদের লক্ষ্য থাকে তা যেন উপচিয়ে পড়ে। সেটাই আমাদের সৃজনশীলতার শ্রেষ্ঠ পাঠ। আপাতসরল শব্দমালার প্রতিটি অক্ষরের মধ্যে গভীর ব্যঞ্জনা বিকীর্ণ হতে থাকে। এ ​​​​​​​কোনও বাংলাপরীক্ষা খাতায় ‘ব্যাখ্যা লিখহ’ গোছের ঘষা ইয়ার্কি নয়। শেষ চার লাইন, 'সারাদিন অনেক ঘুরে দিনের শেষে, এসেছি সকল চাওয়ার বাহিরদেশে...' তুমুল ঘোরাঘুরিময় জীবন আমাদের, যেখানে আমরা  শুধু চেয়ে যাচ্ছি, দেহি, দেহি। এভাবে কোথায় পৌঁছোনো ​​​​​​​যায় দিনের শেষে? সে তো সকল চাওয়ার 'বাহিরদেশ'। আমাদের  সব বহির্মুখী পার্থিব চাওয়া সেখানেই শেষ। আর কোনও প্রয়োজন জেগে ​​​​​​​থাকে ​​​​​​​না ​​​​​​​তার ​​​​​​​পর। না ধর্ম, না জিরাফ।

অন্য কবিকে উত্যক্ত করে যায় তাঁর মুদ্রাদোষ।

 

"...সব কাজ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়,

সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময়

শূন্য মনে হয়,

শূন্য মনে হয় …"

এই অনুভূতির ​​​​​​​এই ​​​​​​​স্তরে আমাদের  দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়  দুটি পদের শব্দমালা,

"...নেব আজ অসীম ধারার তীরে এসে

প্রয়োজন ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে..."

প্রয়োজন ছাপানো যে ধন, তাই আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের শিল্পসত্ত্বা। একজন বলছেন 'খালি'পেটে ধম্মো হয় না। এই খালিপেট শুধু শরীরে নয়, মনেও। শরীরের পেট দুবেলা পূর্ণ হলেও 'ধম্মো' আসে না। তার জন্য মনের পেটটাও ভরে থাকা দরকার। প্রত্যেক মানুষের শেষ 'ধম্মো'ই তো সৃজনশীলতা। ‘পূর্ণপ্রাণে চাবার যাহা, রিক্ত হাতে চাসনে তারে’। মানুষ ভরে ওঠে নিজের শ্রমে, রিক্ত হয় তুচ্ছ অহমিকায়। একজন শিল্পী'র মন হাজারদুয়ারি। হাজারদিক থেকে সেখানে রোদ, জল, অক্সিজেন, ক্লোরোফিল এসে ভাসিয়ে দিয়ে যায়। তাই তাঁরা সৃষ্টি করতে পারেন। ভবিষ্যতের মানচিত্র এঁকে দিয়ে যা'ন। আমাদের মতো নিষ্ফল অহমিকার পোকা'দের জন্য রয়েছে 'ধর্মে'র সংকীর্ণ ছিদ্র। আলোহীন, মেধাহীন নরকগহ্বর। হয়তো এজন্যই আজ এদেশে বিধাতা ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নসিব করেন না।

সব জানালা খুলে দাও, আরো আলো আসুক... মৃত্যুর আগে কবি গোয়্যেথের শেষ কথা। আমরা না হয় সব শেষ হয়ে যাবার আগেই এ কথা বলা শুরু করে দিই। নিজের স্বার্থে, সবার স্বার্থে।


2 কমেন্টস্: