কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

রুবী মুখোপাধ্যায়

 

রম্যরচনা


সিনিয়র সিটিজেন

এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। আপনি বন্দনা দেবীর অবস্থান জানতে চান? দেখুন উনি ওনার শোবার ঘরে টিভি-র সামনে জমিয়ে বসে আছেন। আপনি ভাবতে পারেন — এ বাবা, বয়স্ক মানুষ সন্ধে হতে না হতেই বোকা বাক্সের শিকার হয়ে গিয়েছেন? না মশাই না, উনি এই বয়সে ওনার ইতি কর্তব্য সব – সবটুকুই সমাধা করেই টিভি-র সামনে থানা গেড়ে বসেছেন। রাত দশটার আগে উঠছেন না। উঠছেন না বললে ভুল হবে! ঐ যে মিনিট দশেক অন্তর বিজ্ঞাপন বিরতি হয় না, তখন উনি টয়লেট সারা থেকে টাইম মাফিক মাইক্রো ওভেনে খাবার গরম করা ইত্যাদি সবই অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে সেরে ফেলেন। গোল বাধে যখন ওনার আমেরিকা প্রবাসী একমাত্র পুত্রটি তার সাপ্তাহিক দায়সারা ফোনটি করে মায়ের গলা শুনতে চায় আর কী!

প্রথম প্রথম বন্দনা গদগদ হয়ে পুত্রের রুটিন মাফিক ফোনে অত্যন্ত আহ্লাদিত হতেন বৈকি! ভাবতেন, না জানি ছেলের কত ফিকির মা বাবার জন্যে। কিন্তু  এখন বোঝেন, ওসব কিস্যু না। উইকএন্ডে বেড়াতে যাওয়ার আগে, সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে যে দুটো বুড়োবুড়ি ছেলের বার্তার জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে আছে, তাদের পুলটিশ দেওয়া। বৌমা মেয়েটা খারাপ না, তবে আদরে মানুষ বলে  আশা করে সবাই ওর জন্য ভাববে। ও কেন সকলের জন্য ভাবতে যাবে? — এমনই মানসিকতার অধিকারিণী বৌমা। কিন্তু আমার ছেলে? সে কেন সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটা সময়ে গলায় নির্দিষ্ট একটা বানানো আবেগ নিয়ে খবরাখবর করবে? আমাদের ভালবাসাটাও কি সাপ্তাহান্তিক? বেঁচে থাক বন্দনা দেবীর ‘শাশ-বহু’ সিরিয়াল।

এবার শুনতে পাবেন বাসববাবুর গলা খাঁকারি। — ‘কী গো! ব্রেক হতে আর কত বাকি?’ উত্তর নেই। ‘শোন, একটা ফোন আছে তোমার, ধরবে কি? না কি বলব, বাথরুমে গেছ? যত্তোসব!’ — ‘জানই তো সিরিয়ালের মাঝখানে আমি ফোন ধরি না, তবে! নিজেই জবাবটা না দিয়ে আমাকে ডাকছো কেন? খুব হিংসা না, নিজে পছন্দ করেন না বলে, আমিও কি সিরিয়াল দেখব না? ভেবেছোটা কি? ভাগ্যিস বিজ্ঞাপন বিরতি, তাই দু তিন মিনিটের জন্যেও কথা শোনানোর সুযোগটা বন্দনাদেবী ছাড়তে পারলেন না।

এমন করে সময় কাটে, রাত গড়ায়। টি.ভি. বন্ধ রেখে দুজনে টেবিলে খেতে বসেন। নিরামিষ তরকারি আর দুধ রুটির সঙ্গে ডিনারটি বয়সোপযোগী। কিন্তু বন্দনা দেবী রসেবশে থাকতে ভালবাসেন। তাই একটু আবডাল রেখে ছেলের দিয়ে যাওয়া প্রচুর আমেরিকান চকোলেটের স্টক থেকে দু’একটা ব্লাউজের ভেতরে রেখে, সময় বুঝে মুখে পুরে ভেন্ট্রিলক্যুজিমের এক্সপার্টদের মতো মুখ না নেড়ে ওগুলো শেষ করেন। এবার তাঁর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কারণ, এখন উনি স্বামীর সেবা নেবেন কি না! খানপাঁচেক ওষুধ পরপর খেতে হবে, তবে একটু গ্যাপ দিয়ে দিয়ে। তা ওগুলো হাতে হাতে জোগান দেওয়ার গুরুদায়িত্বটা উনি পতিদেবতার ওপরেই সঁপে দিয়েছেন। এরপর আছে মশারি খাটানো এবং সেটি গোঁজার পালা। প্রথমটা সহজেই সেরে ফেলে টুপ করে শুয়ে পড়েন বন্দনা। বাসব রাগ, বিরক্তি বিবমিষা সব একত্রিত করে তোষকের তলায় মশারির প্রান্ত শুদ্ধ হাত চালাতে থাকেন। আর মনে মনে বলেন, ‘ঘাপটি মেরে  শুয়ে থাকা বার করছি। যা নাক ডাকাটাই না ডাকবো আজ! বুঝবে ঠেলা! যথা চিন্তা তথা কাজ। বাসববাবুর নাক ডাকা শুরু, বন্দনাদেবীর রাত জাগাও শুরু। ভাবেন, বিদেশে তো নাক ডাকার কারণে ডিভোর্স পর্যন্ত হয়ে যায়! তা এ পোড়ার দেশে সে নিয়ম যে কবে চালু হবে – ততদিন কি আর বাঁচবো!

বাসববাবু দু এক মিনিট নাক ডেকে বেশ হাঁপিয়ে পড়েছেন, অভ্যেস নেই কিনা! এক চোখ টিপে গিন্নিকে দেখে নিয়ে বলেন, ‘এক গেলাস জল দাও তো! গলাটা শুকিয়ে  গেছে।’ বন্দনাদেবীর মনে কেমন একটা খটকা লাগে। যে মানুষটা নাক ডেকে দিব্যি ঘুমোচ্ছিলো, সে কিনা সটান জেগে উঠে জল চাইলো? ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে হচ্ছে। এই ‘খতিয়ে দেখার’ ব্যাপারটা বন্দনাদেবী হালে খবরের কাগজ থেকে দিব্যি শিখে নিয়েছেন। যা কিছু ঘটনা ঘটুক না কেন, সে হাতি কাদায় পড়ুক বা কাকে কান নিয়ে যাক, এ বঙ্গে আমলা, উকিল শাসন, প্রশাসন থেকে দুঃশাসন সব তরফই ‘খতিয়ে দেখে’ তবেই মতামত জানাচ্ছেন। বন্দনাদেবীরও পদ্ধতিটা বেশ পছন্দসই। তাই নাক ডাকার ব্যাপারটাকে খতিয়ে দেখতে তিনি অত রাতেও সরেজমিন তদন্তে নেমে পড়েন, আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই খানচারেক বাঘা বাঘা পয়েন্ট পেয়ে যান: (ক) যে মানুষটার নাক কোন দিন ডাকে না, তার নাক আজ কেন ডাকলো? (খ) রীতিমত জল খেয়ে যে মানুষটা শুতে গেলো, ঘন্টা কাটতে না কাটতেই তার কেন জল তেষ্টা পায়? (গ) উনি দাঁত খুলে শোন বলে, মুখ দিয়ে বিচিত্র সব আওয়াজ বার করেন, কিন্তু আজ তো সেটা করেন নি? হাতের নাগালে এতগুলো পয়েন্ট! বন্দনা মনে মনে হাততালি দিয়ে ওঠেন। নিজের বুদ্ধির ওপর এক পর্দা ভক্তিও চড়ে যায়। কোনমতে স্বামীর হাতে এক গ্লাস জল ঠেকিয়েই টুপ করে শুয়ে পড়েন। তারপর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করার জন্য যতটুকু সময় লাগা দরকার, সেটুকু সময় পার করে দিয়েই উঠে বসেন। আর দু হাত দিয়ে বাসববাবুকে ঝাঁকাতে থাকেন– ‘এই শোনো, শুনছো, ওঠো না, কেমন মানুষ রে বাপু! শিগগির ওঠো, দ্যাখো আমার বুকে বড্ডো কষ্ট হচ্ছে!’ ধড়ফড় করে উঠে বসে বাসববাবু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন আর যেন শুনতে পানএক দূরাগত ধ্বনি – ‘আমার পা’টা একটু টেনে  দাও তাড়াতাড়ি, ভীষণ শিরটান ধরেছে।’ হচ্ছিল ব্যথা বুকে, সে ব্যথা নেমে গেল পায়ে? কি জানি বাবা! উপায়ান্তর না দেখে রাত দুপুরে বাসববাবু, স্ত্রীর পদসেবাতেই মন লাগান, আর বন্দনা নিদ্রা দেবীর আরাধনায়।

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন