কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

রঞ্জনা ব্যানার্জী

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৪


ইভনিং ইন প্যারিস

 

শম্পার খুশি উপচে পড়ছিল, “ইভিনিং ইন প্যারিস!” হাতের মুঠোর চেয়ে খানিক বড় বোতলটা। অদ্ভুত নীল রঙ। কোবাল্ট ব্লু। শম্পা দাম জিজ্ঞেস করতেই অনিন্দ্য বলেছিল, “অরিজিন্যাল এন্ড ভিন্টেজ। যা ভাবছ তাকে দশ দিয়ে গুণ দাও। ‘বুজোয়া’ আর এই পারফিউম বানায় না”। শম্পা খুব সাবধানে একফোঁটা ঘষে দিলো তাঁর কব্জিতে। গন্ধটা নাকে লাগতেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিল।  

সারারাত ছটফট করেছেন। ভোররাতে দুইচোখ এক হলো। ঘুম যখন ভাঙল তখন শম্পা-অনিন্দ্য দুজনেই অফিসে। এত বেলা অব্দি শুয়েছিলেন!

ওদের লিভিং-রুমের দেয়াল-জোড়া ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। সন্ধ্যার পরেও ঘরময় ফিকে আলো ছুঁয়ে থাকে অথচ আজ কেমন মেঘলা চারদিক, ভেতরটা তাঁর হাহাকার করে ওঠে।  

তিনি জানালার পাশে দাঁড়ান। ধূসর মেঘেরা উঁচু বাড়িগুলোর মাথায় হাল্কা টোকা দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কোথাও একটা কাক ডাকল। কী আশ্চর্য! এখানে কাক আছে! খালিচোখে আবছা লাগে সব। চশমাটা কোথায় যে রাখলেন! সুজিত বলত, “ভুলো মন”ফের সেই সুবাস ঘূর্ণী তোলে মনে। সিংগাপুর থেকে ফেরার ঠিক তের  দিনের মাথায় দুম করে সুজিত মরে গেল!   

অফিসের ট্যুরে কত জায়গায় যে যেত সুজিত! একাই। ব্যস্ততার জন্যে সময় পেতো না মোটেই। এয়ারপোর্ট থেকেই তড়িঘড়ির কোনো স্যুভিনর নিয়ে ফিরত। সেইবারই প্রথম এনেছিল দুলজোড়া। লাল মলমলের পাউচের ভেতর ঝিলমিল একজোড়া রুবি! হাতে হাতে দেয়নি। লাগেজ খালি করতে গিয়ে পেয়েছিলেন। বিকেলে সুজিত ফিরলে কানে পরে দেখিয়েছিলেন। সুজিত চোখ কুঁচকে বলেছিল, “তর সইলো না?”  

কদিন পরেই এক অনুষ্ঠানে পরবার জন্য দুলজোড়া আর খুঁজেই পেলেন না। কোথায় যে রাখলেন! সুজিত বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “ভুলো মন, কিছুই সামলে রাখতে পার না!”   

ঘর অন্ধকার কেন?” শম্পার ডাকে সংবিৎ ফিরল। কী আশ্চর্য! দরজা খোলার আওয়াজ টেরই পেলেন না!

“তুমি ঠিক আছ?”   

“কাক ডাকছে”। বিষণ্নতা ঝরে পড়ে তাঁর গলায়।  

 তাই? যে বার্চবনটা দেখছ - কাকদের পাড়া ওটা। কদিন পরে সন্ধে হলেই কান ঝালাপালা করবে” শম্পা পাশে দাঁড়ায়, দাঁড়ায় অনিন্দ্যের দেওয়া সেই ভিন্টেজ সুবাসও।  

সুজিতের মৃত্যুর পরে সেবারই প্রথম ওদের অফিসে গিয়েছিলেন। স্মরণসভা। ওরাই ডেকেছিল। ফেরার সময় মিস রিটার সংগে পরিচয় করিয়ে দিলো কেউ। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিলেন মহিলা, “আই এম স্যরি উনি অবাক হয়ে দেখছিলেন মিস রিটার কানের লতি কামড়ে দুলছে দুলজোড়া। ওর শরীরের সুবাস লেপ্টে গিয়েছিল তাঁর শরীরেও। বাড়ি ফিরে সাবান ঘষে ঘষে শরীরের চামড়া তুলে ফেলেছিলেন। ভেবেছিলেন সব ভুলেছেন। অথচ গতকাল একবিন্দু সুরভির ছোঁয়ায় বিস্মৃতির সেই আড়াল ভেঙে গেল।

শম্পা ডাকল, “ঐ দেখ!”

তিনি দেখলেন, একঝাঁক কাক বার্চবনের আঁধারে মিলিয়ে যাচ্ছে আওয়াজ তুলে। চোখ বেয়ে জল গড়ায় তাঁর, সুজিত ঠিকই বলেছিল - উনি সামলে রাখতে পারেননি কিছুই।   

অবাক শম্পা জড়িয়ে ধরে তাঁকে, “কী হয়েছে মা?”

গন্ধটা ফের মিশে যাচ্ছে শরীরে!  

তিনি অঝোরে কাঁদতে থাকেন। 


2 কমেন্টস্: