কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

অম্লান বোস

 

ঘষা কাচের জানলা দিয়ে





আয়োজনটা শুরু হয়েছিল মাঝরাত্তির থেকেই - যখন ঝুমঝুম রাতের কোলে সবাই দুরন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কয়েক ঘন্টার জন্য নিশ্চিন্তে বিরতির রেখা টেনেছে। তখনই, অন্ধকারে সবার চোখের আড়ালে, স্তূপের ওপর স্তূপ সাজিয়ে নিজের খুশীমতই কাজলকালো আর হাল্কা ধোঁয়াটে ওড়নাতে সারা আকাশটাকেই বদলে দিল প্রকৃতি জননী। তার ফলাফল হল - ঠিক যে মুহূর্তে আমি ফুটি ফুটি ভোরের নরম আলোর সঙ্গে ছুটির অলস আমেজ গায়ে মুড়ে চায়ের পটটা নিয়ে ইউ  টিউবের রথে রবিশংকরের গুণকলির ঝালার সংগে উধাও হবার চেস্টায়, তখনই পৃথিবী ভাসিয়ে নামলো রূপোর ছুঁচ! নিমেষে আকাশ, বাতাস, গাছপালা, উল্টোদিকের দোতলা বাড়ি, আমার টবের চারাগুলোর উঁকিঝুঁকি আর বাহারী পাতার ঝিরঝিরানি, সবকিছুই ঐ পর্দার আড়ালে নিরুদ্দেশ। মহাকাশের যুগান্তের বেদনা বাঁধ ভেঙ্গে ঝরঝরিয়ে আমার চোখের সামনে দিয়ে দুরন্ত স্রোতে সামনের নালাতে ঘূর্ণীর তোড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দেখছি, দেখছি আর ভাবছি। ঐ ঘূর্ণির অতলস্পর্শী টান অদম্য আকর্ষণে কখন যে আমার মনটাকেও মনের অতলে তলিয়ে নিয়ে আছাড় মারলো কয়েকটা বছরের পর্দার পেছনে, বুঝতেই পারলাম না। নিজের অজান্তেই পৌঁছে গেলাম ৪০-৫০ বছর আগের এই আগস্টেরই কাকভোরের শিরশিরানি মুহূর্তে - ঘুমঘুম ভোরের আবছা অন্ধকারে ভবিষ্যতের জ্বলজ্বলে আশা সারি দিয়ে চোখের সামনে নাচছে। জামশেদপুর এ্যাথলেটিক ক্লাবের মাষ্টার দাদাদের উত্তেজনাময় নেতৃত্বে তেরঙ্গা ঝান্ডা নিয়ে ছায়া ছায়া  কাকডাকা ভোরে কেমন বুক ফুলিয়ে কুচকাওয়াজ! পি রোড, কিউ রোড়ের গাছের ঘেরাটোপ ধরে লাইন করে এন রোড দিয়ে গড়িয়ে নেমে, আলোছায়ার মোড়া অহংকারী খরকাই নদীর পাড় ছুঁয়ে জে এ সি ক্লাবের ফুটবল মাঠে ফিরে আসা। পতাকা উত্তোলন, জাতীয়সঙ্গীত, মুগুরখেলা, পিরামিড, দৌড়ঝাঁপ এবং ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম প্রদর্শনী, তারপর প্রধান অতিথির স্বাধীনতা সংগ্রামের কথকতা। গত তিন চার সপ্তাহ আগে থেকেই প্রচন্ড তোলপাড়, প্রথমসারিতে ঐ বিশাল তিনরঙ্গা  পতাকাটা কে ধরবে, ড্রাম আর বিউগলের দলে কারা? উফ… কী শিহরণ, কী উদ্দীপনা - মনে পড়লে এখনও বুকটা ফেঁপে ওঠে, রক্তে লাগে দোলা। আমরা স্বাধীন, দেশ নাকি স্বাধীন, মানেটা যদিও ঠিক ধরতে পারতাম না তখন, তবু বুকের অন্দরমহলে উপছে পড়া চাপটা কিন্তু ব্যাকুল করতো আমাকে। রোজ কাগজে গান্ধী, সুভাষ, জওহর, বল্লভভাই, বিধানের সাদা খদ্দরের টুপি পরা ছবি আর ভবিষ্যতের আশার বাণীর স্বর্ণালোকে ঝলমলে বক্তৃতা। তখন যেদিকে তাকাই তিনরঙের বন্যা। কাগজে, গাড়িতে, রাস্তাঘাটে, ল্যাম্পপোস্টে এমন কী সন্দেশেও দেখেছি ঐ তিনরঙের স্তর, নাম তার ‘জয়হিন্দ সন্দেশ’। ঐ ‘জয়হিন্দ’ শব্দটাতে প্রচন্ড অহঙ্কার ঝরে পড়তে দেখেছি বড়দের মধ্যে, কেউ কেউ আবার নেতাজীর ঢঙে কপালে হাত ঠেকিয়ে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে পড়তেন। জানলাম আমার দেশ, আমার মাটি, আমার ভারত কী - জয়তু ভারতবর্ষ আমার। বন্দেমাতরম, মা তুঝে সেলাম, আমি তোমায় ভালবাসি।

দেশ প্রায় পঞ্চাশ বছরের উথালপাথাল ঢেউ ভেঙ্গে এগিয়েছে অনেকটা রাস্তা, ফুলবিছানো, কাঁটাবেঁধানো পথ পার হয়ে, ঝড় ঝাপটা সামলিয়ে এগিয়ে চলেছি, কিন্তু আমরা বোধহয় বজ্রগম্ভীর বুক ফুলিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপানো সেই মন্ত্রটাই গেছি ভুলে, যে মন্ত্রের টানে একসময়ে লক্ষকোটি মানুষ একযোগে, একই লক্ষ্যের দিকে ছুটেছে - সেই বীজমন্ত্র আজ উধাও। সেরকম বীরদর্পে উদাত্ত, জলদগম্ভীর আত্মবিশ্বাসে অটল কন্ঠস্বরের আহ্বানই বা কোথায়? কোথায় গেল আবছা ভোরের শঙ্খধ্বনি আর ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা’, ‘হও ধরমেতে ধীর’, ‘চল কোদাল চালাই’, ‘ধনধান্যে পুস্পে ভরা’ গানের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার?

কার ছায়া আমায় ছুঁয়ে যে যায়

কাঁপে হৃদয় তাই রে,

গুণগুণিয়ে গাই রে…

কথাগুলো মনে পড়ার কারণ - গত সোমবারেই ছিল ১৭ই অগাস্ট, প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র সুকর্ণ, পঞ্চশীলের ইন্দোনেশীয়ার স্বাধীনতা দিন। কাজের আর  পদমর্যাদার খাতিরে এদেশীয়দের সঙ্গে একযোগে সামিল হয়েছিলাম উৎসবে, তাই আরও কাছের থেকে দেখলাম দেশকে শ্রদ্ধা জানাবার প্রণালী। এতবছর পরেও জাতীয় দূরদর্শনে মাসের প্রথম থেকেই লাল সাদার (পতাকার রং) প্রবল আবির্ভাব, প্রতিটি গাড়ির ভেতরে বা বাইরে ছোট ছোট পতাকা, সাতদিন আগে থেকেই কাজের মেয়ে আর নিশিরক্ষীদের বাড়ি বাড়ি বেন্ডারা (পতাকা) তোলার মুখর তাগিদ - হোক না সে বিদেশী রাস্তাঘাটে, আকাশছোঁয়া উদ্ধত অফিসবাড়ির মাথায়, ওভারব্রিজ আর টোলরোডের ধারে ধারে, হোটেল, দোকান, রেস্টুরেন্টে, ক্লাবে, স্কুল কলেজে ঐ লাল সাদা আর ‘দীর্ঘায়ূ’র প্লাবন (হ্যাঁ বাহাসা ইন্দোনেশীয়াতে একই মানে - দীর্ঘায়ূ)। চাঞ্চল্য পাড়ায় পাড়ায়, ওদের সমাজ  উন্নয়ণের দপ্তরগুলোতেও। আমাদের পাড়ায় সেদিন আবার সরকারী নিদানে ৫০০টা চাল নুন তেলের প্যাকেট সুন্দরভাবে গোছা বেঁধে বিলি করা হল, আশেপাশের গ্রামবাসীদের সঙ্গে খেলাধূলো, পুরস্কারের ট্রফি, মসজিদের ফান্ডে যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য করা - সবই চললো নিয়মমত, কোথাও উৎসাহের ভাঁটা বা অশান্তির ছিটেফোঁটাও দেখলাম নাশ। পতাকা তোলার ব্যাপারটাও রাজসিক। যেভাবে একজন অমাত্য প্রোক্লেমেশানটা পড়ে পঞ্চশীলের নীতি ঘোষণা করে বা তিনজন সৈনিক পা মিলিয়ে এসে নীতিগত শৃঙ্খলার সঙ্গে শ্রদ্ধাভরে আলগোছে পতাকা নিয়ে আসে, সেটা চোখজুডানো দৃশ্য। পতাকা তোলার সময় সমবেত প্রতিটি মানুষের ডানহাত যেভাবে অনিবার্য আবেগে কপালে ঠেকানো থাকে ঋজু শরীরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, এতে ছেলেবেলা থেকেই ঐ ধীরে ধীরে আকাশ  ফুঁড়ে উঠতে থাকা দুরঙা ঝান্ডাটিকে মাথায় করে রাখার শিক্ষার প্রবৃত্তি আপনা থেকেই রক্তের মধ্য মিশে যায়। যাঁরা আমার থেকে বেশী জানেন বা বোঝেন, তাঁরা এই ব্যাখ্যাটা অবশ্য সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলিত নিয়মানুবর্তিতার চাপের সঙ্গেই জড়াবেন জানি। দেখলাম এই ৫৩ বছরের উত্থান পতনেও এই দেশাত্মবোধে ভাঁটা পড়েনি একটুও। বরং গত বছরের চরম অর্থনৈতিক অধ:পতনে আর অন্ধকার রাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্হিতির ঘূর্ণিঝড়েও অটুট আছে। বাইরের কৃত্রিম চাপে সেটা কি এত দীর্ঘস্হায়ী হওয়া সম্ভব?

নেতাদের জন্যেই হোক বা নিজেদের বিভ্রান্তমনের তাগিদেই হো, আমরা এদের স্বাধীনতা দিবসের ঠিক দুদিন আগে আমাদের রক্তস্রোতে অর্জিত স্মরণীয় দিনটাকে আবেগ দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে বোধহয় ভুলে গেছি। আমাদের কচিকাঁচাগুলোকে হয়তো আমরা মা-বাবা, কাকা, জ্যেঠা, মামারা আবার  একমুখো করে তুলতে পারি। যখন সুমাত্রার মেডান শহরে ভারতীয় দূতাবাসে প্রথমবার আমাদের প্রাণের রঙ তিনটিকে অন্যদেশের আকাশে সগর্বে তরঙ্গায়িত হতে দেখেছিলাম, সেই মুহূর্তে আমার বুকে সুনামির অসহ্য চাপটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দু চোখ ফাটিয়ে বাষ্প হয়ে বেরিয়ে এসেছিল - হয়তো সেই সুদূর ছোটবেলার চাপা স্রোতটাই উত্তাল, উদ্দাম হয়ে উঠেছিল তখন। এখন কম্পিউটার, ইন্স্টাগ্রাম আর মঙ্গলগ্রহ বিজয়ের যুগের কঠিন আবর্তের আবেস্টনীতে দেশের মাটি বা পতাকা নিয়ে একটু ভাবাবেগ অনুপ্রাণিত করতে পারলে জোয়ারটা ছোটদের মধ্যে ভবিষ্যতে ফুলে ফেঁপে উঠবেই। আমরা তো বৈদ্যুতিন মিডিয়ামের খুবই ভক্ত। এই হাতে পাওয়া সহজ পথটা বেয়ে জাকার্তার আমরা ক’জন কি একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি বিশ্ব জোড়া ভারতীয় প্রাণগুলিকে একটা সূতোয় বাঁধতে? ‘জয়হিন্দ’ বজ্রধ্বনি দিয়েই শেষ করা যাক না প্রত্যেকটি ই-মেইল, মেসেজ বা নিজস্ব মেসেঞ্জারের বয়ান। পারব না আমরা  সেই বিস্মৃত যৌবনের বন্যাটা বিজ্ঞানের ছাঁচে ফেলে সারা পৃথিবীর ঈর্ষাভরা শ্রদ্ধা আদায় করতে? জাকার্তা থেকেই শুরু হোক না মালা গাঁথার কাজটা!

আমাদের সব চাহিদা আর আবদার তো মায়ের কাছেই। সেই সিংহবাহিনী মা’ই তো আবার এসে গেলেন শরত আলোর সোনার পথে, শিউলী ঝরা গন্ধ বেয়ে আমাদের জীবন আলোয় ভরাতে। মা’কেই বলি আমাদের পথ দেখাতে। দূরে, বহুদূরে যে জ্বলজ্বলে ভবিষ্যতটা ঝলসাচ্ছে, ওটা তো স্হির, নিষ্কম্প অনড় - আমরাই শুধু দোলাচলে অস্হির। আমাদের জন্যেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত ঐ নিষ্কম্প শিখ। দরকার শুধু দুশো কোটি হাত আর একশো কোটি হৃদয়কে এক  ধাতুতে গালিয়ে নিয়ে এক উদগ্র কামনার বারুদের আত্মপ্রকাশ, এবং অবশ্যই  ‘হম হোঙ্গে কামিয়াব’!  

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন