কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

কাজল সেন

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৪


চিঠি


যেহেতু তাঁর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেটে বয়সের কোনো কারচুপি ছিল না, তাই তিনি ঠিক ষাট বছরেই অবসর গ্রহণ করেছেন। যেদিন  তাঁর চাকরি জীবনের শেষদিন, সেদিনই সহকর্মীরা ফেয়ারওয়েলের আয়োজন করেছিলেন। অনেক সুখ দুঃখের স্মৃতিচারণা ও মিষ্টিমুখের পাশাপাশি তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, অবসর জীবন তিনি কীভাবে অতিবাহিত করবেন, এসম্পর্কে কিছু ভাবনা-চিন্তা করেছেন কিনা! উত্তরে মৈত্রবাবু যা বললেন, তাতে উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, আমি চিঠি লিখব। সারাদিন চিঠি লিখব। সাদা কাগজে ফাউন্টেন পেনের তরল নীল কালিতে।

-সে কী! আজকাল কেউ কাগজ-কলমে চিঠি লেখে নাকি? ওসব তো বিগত শতাব্দীর ব্যাপার! এখন তো ইমেল, মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার,  ফেসবুকের যুগ। তা সারাদিন কাকে কাকে চিঠি লিখবেন?

-কেন! আমার কত চেনা-জানা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। আপনাদেরও লিখব।

মৈত্রবাবুর মনে পড়ে, কলেজে পড়াকালীন তিনি সহপাঠিনী তটিনীর প্রেমে পড়েছিলেন। নামটা তার স্বভাবের সঙ্গে দারুণ মানানসই ছিল। কিন্তু শুধু প্রেমে পড়লেই তো আর হয় না, প্রেম নিবেদনও করতে হয়। কিন্তু মৈত্রবাবুর তখন এমন কিছু কলিজার জোর ছিল না যে, কথাটা মুখে বলেন। অগত্যা মরিয়া হয়ে তিনি চিঠি মানে প্রেমপত্র লিখতে বসেছিলেন। আর লিখতে বসেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর সুপ্ত প্রতিভা। সাধুভাষায় লেখা সেই চিঠিতে মৈত্রবাবুর  সাহিত্য প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। শব্দালঙ্কার, অর্থালঙ্কার, বিশেষণ, বিশেষণের বিশেষণে তটিনীর প্রতি তাঁর প্রেমের অসাধারণ কাব্যিক বর্ণনা তিনি  করেছিলেন! কিন্তু চিঠিটা সরাসরি দিতে পারেননি তটিনীর হাতে, বরং একটা বইয়ের কভারের ভেতর চিঠিটা রেখে এক বন্ধু মারফৎ পাঠিয়েছিলেন তটিনীর কাছে। তটিনী সেই চিঠি সম্ভবত পড়েছিল, কিন্তু তারপর দুর্ভাগ্যক্রমে তা হস্তগত হয়েছিল তটিনীর বাবার। আর ঠিক পরের দিনই কলেজ চত্বরে মৈত্রবাবুকে ক্যালানোর জন্য হাজির হয়েছিল তটিনীর দুই দাদা। পড়িমরি করে দৌড়ে সেবার নিজেকে অক্ষত রেখেছিলেন মৈত্রবাবু।

প্রথম চাকরিটা পেয়ে ঘর ছেড়ে অনেকটা দূরে উড়িষ্যার একটা শহরে চলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। স্টেশনে গাড়িতে চড়িয়ে দেবার জন্য বাড়ির সবাই এসেছিল। ট্রেন ছেড়ে দেবার আগের মুহূর্তে সে কী কান্না মা, দাদা, বৌদির! ছোটবোনটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আর বাবা নিঃশব্দে বারবার রুমালে মুছে নিচ্ছিলেন চোখের জল। তারপর থেকে নিয়মিত চিঠি লেখা শুরু মৈত্রবাবুর। বাড়ির সবাই আলাদা আলাদা চিঠি লিখে একই খামে ভরে ডাকটিকিট সাঁটিয়ে পোস্টবক্সে ড্রপ করত। চিঠি পৌঁছাতে পৌঁছতে কখনও কখনও দশ থেকে পনের দিন লেগে যেত। আবার সবার চিঠির উত্তরে মৈত্রবাবু যে চিঠি লিখতেন তা পৌঁছাতে আবার দশ থেকে পনের দিন। কিন্তু চিঠি লেখা ও প্রাপ্তির কী যে আনন্দ আকর্ষণ ও উত্তেজনা ছিল, তা একমাত্র ব্যক্ত করতে পারে মৈত্রবাবুর সুপ্ত সাহিত্য প্রতিভা।

একদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে একটা খামের চিঠি পেয়েছিলেন। খামের ওপর হাতেলেখা ঠিকানাটা একেবারেই অপরিচিত। অবাক হয়ে খামটা খুলতেই একটা ছোট্ট চিঠি। ‘আমি আগামী বুধবার রাত দুটোয় পৌঁছে যাব। আমাকে রিসিভ করতে তুমি স্টেশনে অবশ্যই থেকো’। তটিনী।  

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন