কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ৪




আমি যে শহরে থাকি তার নাম প্লিমাউথ (Plymouth)। বস্টন শহর থেকে  চল্লিশ মাইল দক্ষিণে। বন্ধু বান্ধবের বাড়ি যেতে গেলে প্রায় ঘন্টাখানেক গাড়ি চালাতে হয়। বন্ধুরা বলে আমার বাড়ি আসতে গেলে নাকি তাদের ভিসা করাতে হয়। অতলান্তিকের ধার ঘেঁষে বস্টনের এতটা দক্ষিণে বাড়ি কেনার কারণ হল আমার কর্মস্থল আরও দক্ষিণে। অতলান্তিক আর কেপ কড ক্যানালের মোড়ের মাথায় আমার কলেজ। আমার আপিস ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে কেবল নীল আর নীল। কোথায় যে সাগর গিয়ে আকাশে মিশেছে তা ঠাহর করা মুশকিল। বলাই বাহুল্য...

আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন

আজ ঐ চোখে সাগরের নীল

আমি তাই কি কাজ পাই কি

বুঝি এইবার চাকরি অমিল!

তা প্লিমাউথ থেকে বস্টন যে শুধু ভিসা করিয়ে গাড়ি চেপে যাওয়া যায় তা নয়, ট্রেনের ব্যবস্থাও আছে। সেটির নাম কমিউটার রেল। শহরতলীর সঙ্গে বস্টনের যোগাযোগ করার সরকারি ব্যবস্থা। ঋজু যখন হাইস্কুলে পড়ত তখন কাকভোরে উঠে দুটো ট্রেন বদল করে বস্টনে ইস্কুলে যেত। যেহেতু আমার রওনা হবার দিন ছিল একটা বৃহস্পতিবার, তাই ঠিক হলো যে পামেলা আমাকে মিটিংয়ের ফাঁকে লটবহর সমেত,  প্লিমাউথ কমিউটার রেল স্টেশনে নামিয়ে দেবে আর আমি সেখান থেকেই আমার যাত্রা শুরু করবো।

এইবারের যাত্রায় লটবহর ব্যাপারটা খুব হিসেবে কষে গোছাতে হল। একটা ছোট চাকাওয়ালা সুটকেস যেটা বেলের পানার মতো হড়হড়িয়ে গড়াবে। তার ভেতরে রয়েছে জিনস, শার্ট, জ্যাকেট, কয়েকটা বেয়াইবাড়ি স্পেশাল সালোয়ার কামিজ, প্রসাধনী টুকিটাকি, কুটুমবাড়ির উপহার সামগ্রী ইত্যাদি প্রভৃতি। পিঠে একটা ব্যাকপ্যাকে রয়েছে পাখি দেখার দূরবীন, জলের বোতল, ইলেকট্রিক কেটলি, চা পাতা, বিস্কুট, ফ্লাস্ক মগ, ফার্স্ট এড বাক্স। আর কাঁধে ক্রস করে ঝোলানো ছোট বটুয়ায় রয়েছে টাকা, ক্রেডিট কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বাড়ির চাবি, লিপস্টিক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর বঙ্গ জীবনের অঙ্গ, এক টিউব সুরভিত এন্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলীন। এমনভাবে জিনিসপত্র বাঁধা ছাঁদা হলো যাতে আমি একাই তিব্বতি শেরপাদের মতো মালপত্র নিয়ে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারি। পামেলা কম্যুটার রেলে  তুলতে এসে আমাকে টিকিটের খুচরো ধার দিয়ে চিন্তিত মুখে বলল, “খুব আনন্দ করে ঘুরে এস Banz। তবে কোথাও যদি একটুও বেগরবাই  দেখো তাহলে সোজা প্লেন ধরে ফিরে এস। তোমার ওই First girl syndrome  বিপদে পড়লে  একটু ভুলে যেও!”

“কোনো চিন্তা করিস না রে। আমার সঙ্গে মাথায় ছাতা ধরে থাকেন ছত্রধর। তুই কলকাতার আরো বড় বিপদ ঠিকঠাক সামলে আয়। গরমের ছুটির শেষে আবার দেখা হবে”।

পামেলা হাসতে চেষ্টা করল বটে, কিন্তু ওর চোখে ছায়া ফেলেছে চিন্তার মেঘ।

কম্যুটার রেলের জানালা দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে শহরের পর শহর। ওঠানামা  করছে মানুষজন। আমি মনে মনে ভাবছিলাম যে এদের ভেতর কেউই হয়তো প্রশান্ত মহাসাগরে তীরে যাবে বলে আজ বাড়ি থেকে বেরোয়ন! বস্টনের সাউথ স্টেশনে যখন নামলাম তখনও লেক-শোর লিমিটেড ছাড়তে ঘন্টাখানেক দেরি। কয়েকটা খাবার দোকান খোলা রয়েছে। অতিমারীর প্রকোপে সাউথ স্টেশন অনেকটাই ম্রিয়মান। ভেবেছিলাম হালকা স্যান্ডউইচ গোছের কিছু প্যাক করে সঙ্গে নেবো। ট্রেন সিরাকিউস পৌঁছবে রাত পৌনে দশটা নাগাদ। কিন্তু একটা পাকিস্তানী দোকানে চিকেন বাটার মশালা আর জিরা রাইস দেখে মন্দ মেয়ে হতেই হলো! দেখলাম দোকানি যত্ন করে তার সঙ্গে একটু শশা টমেটোর স্যালাড দিয়ে দিলেন। এছাড়া চায়ের সঙ্গে খাবার মতো নোনতা প্যাটিস আর মিষ্টি টার্ট  সঙ্গে নিয়ে নিলাম। বেয়াই বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে অত  রাতে পৌঁছে আর কিছু খাবো না। তাই বেশ একটা পেটচুক্তি খাবার ব্যাবস্থা করে উঠে পড়লাম লেক-শোর লিমিটেডে। যাত্রা হলো শুরু।

ট্রেনের কামরায় উঠে দেখলাম যে ট্রেন প্রায় ফাঁকা। সাউথ স্টেশন থেকেই ট্রেন ছাড়ে বলে এই সুবিধেটা রয়েছে। পরের স্টেশনগুলি থেকে প্রচুর মানুষ উঠবে। কন্ডাক্টার ভদ্রমহিলা জানালেন যে আমি এই বগিতে যে কোনো সিটে বসতে পারি। আমার ধর্মসঙ্কট শুরু হলো। হড়হড় গড়ানো সুটকেস, ব্যাকপ্যাক, বটুয়া, চিকেন বাটার মশালা, জিরা রাইস, নোনতা প্যাটিস আর মিষ্টি টার্ট নিয়ে আমি ফাঁকা বগির বিভিন্ন জানালার ধারের সিটে বসে বুঝতে চেষ্টা করলাম যে কোন সিটে বসলে বাইরেটা সবচেয়ে ভালো দেখা যাবে। মিনিট সাতেক পরে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে বগির একেবারে সামনে, ডানদিকের জানালার ধারের সিট বাছাই হলো। এই সিটের সব ভালো... লম্বা করে পা মেলে বসা যায়, পাশের জানালাটি সবচেয়ে প্রশস্ত, সামনের সিটে কোনো প্রেমিকযুগল সারাক্ষণ চুমু খাবে না বা ঝগড়া করবে না, কোনো বেয়াদব ছানা বিকট ব্যবহার করে পার পেয়ে যাবে না ... কিন্তু অসুবিধে একটাই। এই সিটের সামনে বা পাশে কোনো টেবিল নেই। তাই চুমু, ঝগড়া বা বিকট বেয়াদবির থেকে রেহাই পেলেও  চিকেন বাটার মশালা, জিরা রাইস খাবার এটি উপযুক্ত স্থান নয়। চা, নোনতা প্যাটিস আর মিষ্টি টার্ট খাবার জন্য তো নয়ই!

ট্রেন চলেছে শহরের পর শহর ছাড়িয়ে। ফ্রামিংহাম, স্প্রিংফিল্ড, পিটসফিল্ড, হান্টিংটন... নতুন নতুন যাত্রী উঠছে আমার বগিতে। তাদের চুমু, ঝগড়া, বেয়াদব ছানারা রয়েছে অন্তরালে।  আমার চোখে কেবল ট্রেনের জানলা পেরিয়ে পাল্টে যাওয়া শহর এবং শহরতলি... আমার মননে সেই একা যাওয়া...

 

যাদের যাওয়ার কথা হয়েছিল,

তারা কেউ একবাক্যে বলেনি,

‘যেতে পারি’।

 

তাদের সকলেরই কেমন যেন,

কেমন যেন দোনামোনা ভাব।

শেষপর্যন্ত জানা গেল,

একজন ছাড়া কেউই যায়নি।

 

যে গিয়েছিল,

সে কেন গিয়েছিল?

সেটাও ভাল বোঝা যাচ্ছে না,

তার বাজার করা আছে, রেশন তোলা আছে,

সপ্তাহে দুদিন গানের ইস্কুল আছে।

কখনও কখনও তার অম্বলের কষ্ট হয়।

 

এখন শোনা যাচ্ছে, সে আর ফিরবে না।

গানের ইস্কুলে এর মধ্যে তার নাম কাটা গেছে,

সাবেকি সংসারের হেঁশেলে দুবেলা দুমুঠো অন্ন বাঁচছে।

সে যে একদিন ছিল,

সে যে একদিন সব কিছুর মধ্যে ছিল

সে কথা দুদিন পরে কেউ খেয়াল রাখবে না।

এবং সেই জন্যেই বোধহয়।

সে গিয়েছিল, সে একাই গিয়েছিল।'

আমি আমার মালপত্র গুছিয়ে রেখেছি মাথার ওপরের তাকে। পায়ের কাছে একটা ঠোঙার থেকে হাতছানি দিচ্ছে গরম গরম চিকেন বাটার মশালা, জিরা রাইস  আর শশা টমেটোর স্যালাড। নাঃ, আর বিলম্ব নয়... আর বিলম্ব না, না... আর বিলম্ব নয়! সমস্ত বগিতে বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস, পিজা এবং কোল্ড কাট  স্যান্ডউইচকে কাঁচকলা দেখিয়ে ভেসে বেড়াতে লাগলো চিকেন বাটার মশালা আর জিরা রাইসের স্বপ্নালু আলিঙ্গন। আমি খুব সন্তর্পণে কোলের ওপরে কাগজের ন্যাপকিন পেতে, আমার হালকা রঙের জামা আর কালো জিনসের  প্যান্টকে বাটার মশালা মুক্ত রেখে প্লাস্টিকের চামচে ক্ষুন্নিবৃত্তি করলাম।

ট্রেন চলেছে আলবানি, শেনেকটাডি হয়ে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ে, মাঝে মাঝে মেঘ সরে রোদ ওঠে। ঝর্ণার জলের পাশে বসে থাকে ধৈর্য্যশীল বক। সন্ধ্যে নামে অচেনা প্রান্তরে। প্রাণটা এই সময় চা- চা করছিলো। শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে  চিকেন বাটার মশালা আর  জিরা রাইস হজম হয়ে গ্যাছে অনেকক্ষণ হল।  ঠোঙার ভেতরে নোনতা প্যাটিস আর মিষ্টি টার্ট হাতছানি দিচ্ছে। ভাবলাম পাশের ক্যাফে কার থেকে এক কাপ চা কেনা যাক। ক্যাফেতে চা কফি বিক্রি করছেন একজন হাসিখুশি বয়স্কা  মহিলা। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন

‘What can I do for you sweetheart?’

‘Could I please have a small black hot tea?’

একটি বাক্যেই  সাইজ, চায়ের প্রকৃতি ও উষ্ণতার আভাস দেওয়া গেল। উনি একটা মোটা সহিষ্ণু কাগজের  ঢাকনা দেওয়া কাপে ফুটন্ত জলে একটা টি ব্যাগ চুবিয়ে দাম বুঝে নিলেন। আমি ওনার কাছে আর একটা ছোট কাপে একটু দুধ চাইলাম আর এক প্যাকেট চিনি আর একটা ছোট প্লাস্টিকের চামচ। ওনার কাউন্টারে অন্য খরিদ্দারের ভিড়। তাই ওখানে আর না দাঁড়িয়ে গরম চায়ের কাপ, দুধের ছোট কাপ, চামচ আর চিনি হাতে চলন্ত ট্রেনে লটর পটর করতে করতে সিটের দিকে এগোতে এগোতে মনে পড়ল যে আমার পছন্দ করা চুমু-ঝগড়া-বেয়াদবি বিহীন আসনে কোনো টেবিল নেই! যাইহোক... বাবা রামদেবের মত কসরত করে চায়ের সামগ্রী কোলে করে বসলাম। দুটি পায়ের ফাঁকে ব্যালেন্স করে গরম চায়ের কাপের ঢাকনা খুলে সেটি ডান উরুর ওপরে রেখে, খুব অল্প দুধ ঢেলে, যেই না চিনির কাগজের প্যাকেট ছিঁড়ে চিনি ঢালতে যাবো, অমনি ট্রেনটা একটা বেমক্কা বাঁক নিলো আর আমার small black hot tea বিকট বেয়াদবের মতো আমার হাতে, পেটে এবং জানুতে ছলকে পড়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি ঘটনা ঘটালো। মোটা জিনসের আবরণীতে নিম্নাঙ্গ খানিকটা রক্ষা পেলেও দুটো হাতে ফুটন্ত চা যার একবার পড়েছে সে জানে তার বিষজ্বালা। আমি কোনো শব্দ না করে চায়ের কাপটা মাটিতে নামিয়ে রেখে সঙ্গে যত ন্যাপকিন ছিল তাই দিয়ে হাত, জামা, প্যান্ট মুছলাম। যন্ত্রণায় মুখচোখ দিয়ে হলকা বেরোচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। হাত দুটো খুব জ্বলছিল। প্রথমেই মনে হলো যে হাতে ফোস্কা পড়ে গেলে অতটা পথ সেই Nissan Rogue SUV চালাবো-টা কি করে? ঝটপট বটুয়া খুলে বের করলাম সেই বঙ্গ জীবনের অঙ্গ,  এক টিউব সুরভিত এন্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলীন। খুব মোটা করে দুই হাতে লাগাতেই ধীরে ধীরে জ্বালাটা কমতে লাগলো। ধন্বন্তরী আর বলেছে কাকে!

খানিক বাদে মেঝে থেকে সেই বেয়াদব চায়ের কাপটি তুলে নিয়ে ভাবুক ভাবুক মুখ করে নোনতা প্যাটিস আর মিষ্টি টার্ট সহযোগে চা খেয়ে ফেললাম। ব্যাস। রাতের খাওয়া শেষ! রাত পৌনে দশটা নাগাদ ট্রেন ঢুকলো সিরাকিউস স্টেশনে। জিনিসপত্র নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমেই দেখি ঋজু। তৃষ্ণার শান্তি... কতদিন বাদে... কতদিন বাদে দেখা হল! ঋজু তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, আমার জিনিসপত্রগুলো নিল, জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো মা?” “ভালো আছি রে... খুউউব ভালো”।

আমার বেয়াই কার পার্কে অপেক্ষা করছে। আমি আর ঋজু গাড়ির কাছে গেলাম। আমার হালকা রঙের জামায় আর কালো প্যান্টে ছোপ ছোপ small black hot teaয়ের স্মৃতি... দুহাতে খাবলা খাবলা সুরভিত এন্টিসেপ্টিক ক্রিম... একগাল হেসে শুধোলাম, “Hello Vikram, How are you?”

 

(ক্রমশ)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন