কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

দিগন্তসেনা




(১)


প্রাগূষার অন্ধকারে উপত্যকার বেশ কয়েকটা খাঁজ পেড়িয়ে যখন সবে মাত্র একটা পর্বতের পাদদেশে এসে দাঁড়িয়েছে শ্যামাঙ্গী, ঠিক তখনই শুভেচ্ছা ওকে জিজ্ঞেস করে ফেলল বহুদিন ধরে মনের মধ্যে জমিয়ে রেখে বয়ে নিয়ে যাওয়া এক গুঢ় প্রশ্ন, সেই নারীকে যার নাভীর থেকেই বেরিয়ে আসা একগুচ্ছ তন্তুর  সঙ্গেই কোনও একদিন নাকি ওর অস্তিত্ব জুড়ে ছিল বা প্রথম শুরু হয়েছিল। প্রশ্নটা আর কিছুই নয়, ওর নামকরণকে কেন্দ্র করে, মানে কেন ওর নাম শ্যামাঙ্গী হল, কেন অন্য কিছু নয়, এর পেছনের কাহিনী অথবা ইতিহাস। আর প্রশ্নটা যখন শ্যামাঙ্গীর কানের ভেতর দিয়ে সবে ঢুকতে শুরু করেছিল সেই মুহূর্তে সে পায়ের তলায় অজান্তে একটা ছোট্ট গুর গুর করে হেঁটে যাওয়া ইঞ্চি খানেক লম্বা  একটা জীব বা সরীসৃপ বা পাখি জাতীয় কোন কিছুকে মেরে ফেলেছিল। তারপর তার শরীরের থেকে বেরিয়ে আসা চটচটে রস যা কিনা আসলে মানুষের দেহের রক্তের মতনই লাল রঙের, সেই তরলের দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্নটা যখন মাথার মধ্যিখানে অসংখ্য তন্তুর জালে আবদ্ধ হয়ে অনুরণিত হচ্ছিল আর তার সংঘাতে ওইসব তন্তুগুলো একেবারে ছিঁড়ে  যাবার মত অবস্থায় পৌঁছে গেছিল তখন ও মাথা তুলে সোজা পাহাড়ের ওপরের দিকের বরফের দেওয়ালে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ, প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই। আসলে সে ঠিক তখনই সে ফিরে গিয়েছিল অতীতে, দেখতে পাচ্ছিল অনঙ্গ কীভাবে একটা ভাঙা, অজস্র ক্ষয়াটে ইটের জোড়া দেওয়া বাড়িকে নিজের এবং তার বউয়ের  যথাসর্বস্ব দিয়ে কিনে ফেলে, সেটাকে আমূল ভেঙে ফেলে তারপর তারই ওপরে তিল তিল করে নতুন একটা কাঠামো গড়ার এক প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। মানময়ী নিজেই প্রথম দেখেছিল ওই বাড়িটাকে, খোঁজ নিয়ে এসেছিল যে বাড়িটা বিক্রি হবে আর তার জন্যে সে তার পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত যাবতীয় সোনাদানা বেচে দিয়ে অনঙ্গের হাতে তারা তারা কাগজের নোট ধরিয়ে দিয়েছিল। পৈতৃক সম্পত্তি কাকে বলে অনঙ্গ তা জানত না। কেননা খুব ছোটবেলায়ই তার সবচেয়ে বড় দুই ভাই যাকে বলে বড়দা আর মেজদা, বাবার হাত বাক্সের মধ্যে থেকে সমস্ত টাকা পয়সা লুঠ করে নিয়ে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। ওদের দুজনকে ধরার জন্য হুলিয়া জারি করেছিল তার বাবা। তারই ফলে ওই দুই ভাই যখন ধরা পড়ে তখন তাদের কাছে কানা কপর্দকও টাকা পয়সা কিছু তো ছিলই না, বরং তারা নিজেরাই তখন কী করবে না করবে,  কোথায় যাবে তাই নিয়ে মহা চিন্তায় হাবুডুবু খেতে খেতে ধরা পড়ে যাওয়াটাকেই তাদের সৌভাগ্য বলে ধরে নিয়েছিল এবং আত্মসমর্পণ করেছিল।

মানময়ী এসব কিছু জানত না, কোনদিন শোনেওনি। সে শুধু এটুকু বুঝেছিল তার স্বামীটি সৎ। তাই তাকে বিশ্বাস করে নিজের সর্বস্ব তুলে দিয়েছিল। সে সততাকে একমাত্রিক ভেবেছিল। কিন্তু সে জানত না আসলে সততা জগৎ সংসারের আর বেশিরভাগ বস্তুর মতই বহুমাত্রিক। আর এটা জানবার জন্য তাকে আরও বছর কুড়ি আপেক্ষা করতে হয়েছিল। অপেক্ষা করতে করতে সে ক্রমশ ক্ষীণাঙ্গী এমন এক রমণীতে পরিণত হয়েছিল যে আসলে তার আর কোন রমণযোগ্যতা ছিল না। কেননা ইচ্ছে করেই সে তার রমণযোগ্যতা হারিয়ে  ফেলেছিল। তার হাত পা শরীর সবই একটু একটু করে সবই যেন তার পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে গিয়েছিল। আর অনঙ্গও তাকে অব্যাহতি দিয়েছিল। আর তার  ফলাফল স্বরূপ খুব কম বয়সেই সে নিজেও নারীসঙ্গ উত্তাপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। আর এরই ফলে শ্যামাঙ্গীর আরও একবার জন্ম হয়েছিল। তাল তাল অন্ধকারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে সে হঠাৎ আবিস্কার করে ফেলে অন্ততপক্ষে পা দুটো মাটিতে রেখে সোজা হয়ে মাটিতে দাঁড়াবার মত কোন জায়গাই তার জন্যে এই পৃথিবীতে কোথাও নেই এবং সেই কারণেই সে তার নিজের দাঁড়াবার জন্যই শুধু গোটা একটা রাষ্ট্র স্থাপন করতে এক প্রকার বাধ্যই হয়েছিল। সেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের শুভ ইচ্ছের কথা ভেবে, দেখাশোনার জন্য এক অদ্ভুত যান্ত্রিক কৌশলে শুভেচ্ছা বা তারই মত ওই রকমই আরও কাউকে কাউকে সৃষ্টি না করে তার আর কোন দ্বিতীয় উপায় ছিল না বললেই চলে।

অনঙ্গ যখন মানময়ীর শরীরের ওপর ওর সর্বস্বত্ব হারায় তখন দিনরাত তার  কেবল তার নিজের বাবার কথাই মনে হত। সে শুধু ভাবত তখন যদি তার বাবা থাকত তাহলে নিশ্চিত জড়িবুটির সাহায্যে তার বউয়ের জীবন যৌবন সবই ফিরিয়ে দিতে পারত। কথাটা ভাববার পেছনে যুক্তি বা সত্য কতটা ছিল সেটা জানা না গেলেও অসহায়তা এবং তদজনিত কারণ অবশ্যই একটা ছিল। অনঙ্গর বাবা রঘুনন্দন, অন্য আত্মীয়স্বজনদের মুখ থেকে যেমনটা জানা যায়, জড়িবুটির নানা ঔষধিগুণ জানতেন এবং  সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে মেয়েদের নানারকম রোগবালাই সারানোর ক্ষেত্রে একেবারে ধন্বতন্তরী হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষত শেষ জীবনে তিনি যখন তার সবচেয়ে ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে এসে দেশের পশ্চিমের  নানা জায়গায় থেকেছেন, তখন তার এই গুণে উপকৃত হয়ে ঠাকুরমশাইকে ঠাকুর জ্ঞানে চালটা আলুটা কলাটা মুলটা, এমনকি নদী থেকে ধরে মাছও যে কত দিয়ে যেত মানুষজন, তার সত্যিই কোনও হিসেব ছিল না। তার জড়িবুটির  গুণ নাকি এমনই ছিল, একথা অনঙ্গকে কতবার কত জায়গায় যে বলতে শোনা গেছে, তা গুণে শেষ করা যাবে না। আর ছিল তার নিয়ম শৃঙ্খলাবোধ আর শাসন। তার শেষদুটো ছেলেকে তিনি এমনভাবেই বড় করেছিলেন। কিন্তু তাঁর আগের সাতটি সন্তান তাঁর হাতছাড়া হয়ে গিয়ে লাম্পট্টে ও অন্যান্য বিষয়ে এতটাই মুখ ডুবিয়েছিল যে তাদের কথা বা পরিচয় দিতে তাঁর কিছুটা ঘৃণা মিশ্রিত প্রখর অনুভুতি হত। অবশ্য এরই মধ্যে ছিল তার দুটি মেয়ে, যাদের বড়  হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পাত্রস্থ করেছিলেন। বস্তুত রঘুনন্দনের দুই বিয়ে। প্রথম বিয়ের সুত্রে তাঁর একটি মেয়ে হয়। দ্বিতীয়বার প্রসবকালেই প্রসন্নময়ী মারা যায়। তারপর তারই ছোটবোন অন্নদাময়ীর সঙ্গে তাঁকে আবার বিয়ে দেওয়া হয়। এই দ্বিতীয় বিয়ের সূত্রেই তাঁর দুই মেয়ে আর সাত আটটি ছেলের জন্ম হয়। বলাবাহুল্য তাঁর এই পক্ষের বউটিও তার প্রসবকালেই মারা যায়। ততক্ষণে  তার প্রথম সন্তান বড় মেয়ে বিধবা হয়ে একরত্তি একটি ছেলে সন্তানকে কোলে নিয়ে বাপের কাছে এসে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালে সেই ছিল গৃহের কর্ত্রী। স্বঘোষিত নয়। বরং অঘোষিত। তার স্বভাবমিষ্টতা নাকি এমনই ছিল।

অনঙ্গর কাছ থেকে মানময়ীর সরে যাবার আসল কারণটা অনঙ্গ যে জানত না নয়, বরং বলা ভালো মানত না, পাত্তা দিত না। কিন্তু পাত্তা দিলে দেখতে পেত তার বাবার জড়িবুটি ছাড়াই তারা দুজনে দিব্যি কি সুখে স্বচ্ছন্দেই না ঘর সংসার করে যেতে পারত। সেই সময়ের প্রতিটি রাতেই অনঙ্গ কাছে এলেই মানময়ী তাকে জন্মনিরোধক যে কোনও কিছু ব্যবহারের পরামর্শ দিত। অনঙ্গ তা না শোনাতেই শ্যামাঙ্গীর পরেও সুদাম আর সম্রাটের জন্ম হয়। তারপর এই সংখ্যাটা আর বাড়ুক সেটা মানময়ী চায়নি। তাই বারবারই গর্ভপাতের জন্য ডাক্তারের দ্বারস্থ হতে হতে মানময়ী তার শরীরের শাঁস আর শক্তি দুটোই হারিয়ে ফেলছিল।  এমনকি তার ক্ষীণাঙ্গী হয়ে ওঠার পেছনেও এটিই একমাত্র সত্যিকারের কারণ।  তবু অনঙ্গ নিজের জায়গাতে স্থির ছিল। সে ভাবত আরও দু’চারটে ছেলেমেয়ে  যদি হয়, হোক না। তাতে আর অসুবিধে কিসের। সে নিজে মোটা পয়সা আয় করছে। একটার জায়গায় দশটা পালতে অসুবিধেও নেই। কিন্তু মানময়ীর শারীরিক যন্ত্রণা, মাতৃত্বের যন্ত্রণা, প্রসবের যন্ত্রণা নিছক পুরুষমানুষ হবার  কারণেই অনঙ্গের মজ্জাগত হয়নি। অবোধ বালকের হাতে না পাওয়া মোয়ার মতই এই বিষয়টিও তার ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। মেয়েমানুষ সন্তান জন্ম দেবে এটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তার অন্যান্য দাদাভাইবোনেদেরও কম বেশী তাইই হয়েছে। তবে তার বেলায়ই এ নিয়মের এমন সৃষ্টিছাড়া দশা সে নিজেও  খুব একটা মেনে নিতে পারেনি। তার সেই অসুখ দিনে কালে গুণাত্বক  হারে বেড়ে গিয়ে অঝোরে বর্ষিত হয়েছিল শ্যামাঙ্গীর ওপরে, এমনকি ছেলেদের ওপরেও, সেটা মানময়ী কিছুটা বুঝেছিল। কিন্তু তাতে তার কিছু করার ছিল না। বরং ঘরবাড়ি পালটাবার সময় অনঙ্গর শখের বাদ্যযন্ত্রটা তার হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গিয়েছিল, তা নিয়ে মানময়ী এক গোপন বেদনায় ভুগেছে। রাতে  শোয়ার সময় সবসময়ই কোন না কোন একটা ছেলেকে কোলের কাছে টেনে  নিয়ে শুয়েছে অনঙ্গের হাত থেকে বাঁচবার উপায় হিসেবে। তারপর কবে অনঙ্গও এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তাদের দুজনের কেউই সেটা খেয়াল করে দেখেনি।

সৃজনশীলতা আর প্রতিভার দীপ্তি সব সময়েই অনঙ্গকে ঘিরে রেখেছিল। আর ছিল তার অসম্ভব কল্পনাপ্রবণতা। সে কখনও এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকতে জানত না। পারত না। সব সময়ই নানান যন্ত্রপাতি নিয়ে কিছু না কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যেত। কাজের সময় বাচ্চা ছেলে দুটো যখন মার কাছে  কাছে ঘুরত, কিম্বা সদর দরজা পেড়িয়ে বাইরে এদিক ওদিক ঘুরে বেরাত, সেইরকমই কোন একদিন মানময়ী অনঙ্গকে ছেলেদের দিকে নজর দেবার কথা বলত। আর অনঙ্গও নির্বিচারে যেন আরও একটা পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য কোনও ফন্দি তার মাথায় ধরা পরে গেছে এমনই ভাবে সে ছেলে দুটোকে নিয়ে গল্প শোনাতে বসত। সেই গল্পে রাজা, রানী, রাজপুত্র, রাজকন্যা ছাড়াও আরও  নানারকমের নানা উদ্ভট উদ্ভট স্বভাবের লোকজনের উপস্থিতি লক্ষ করা যেত, যেটা ছিল আসলে অনঙ্গের মনগড়া। দরজার পেছন থেকে আড়ালে গল্প শুনতে শুনতে সেইসব চরিত্রগুলো শ্যামাঙ্গী বড় হয়ে যখন এদিকে ওদিকে খুঁজে দেখেছে, তখন এমন অভিজ্ঞতাই শ্যামাঙ্গীর হয়েছিল। আর শ্যামাঙ্গীর তৈরী নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশের পেছনেও ছিল আসলে অনঙ্গের বলা ওই গল্পগুলোই অত্যন্ত সুচতুর ও সুগোপনে কাজ করেছিল, সেটা শ্যামাঙ্গী বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু অনঙ্গ তার বিন্দু বিসর্গও জানত না। কেননা তার জগতের হিসেবের মধ্যে শ্যামাঙ্গী কোনদিনই ছিল না।

অনঙ্গ তার দুই ছেলের হাত ধরে মাঝে মাঝে সামনে খালি থাকা জমিতে ওদের নিয়ে যেত, যাতে ওরা খেলতে পারে। কখনও কখনও কীভাবে কী কী খেলা যায় তাও বলে দিত, ও তাতে সাহায্য করতেও তার কোনও দ্বিধা ছিল না। অনঙ্গ  যখন প্রথম ওখানে বাড়িটা বানায়, তখন ওই পুরো চত্বরটা সবুজ ঘাসে ঢাকা ছিল। তবে সব জায়গাই সমান ছিল না। বাড়ির দিক থেকে বেশ খানিকটা নিচু হয়ে গিয়েছিল। যেন সমতল ভূমি চলতে চলতে হঠাতই এক জায়গা থেকে বেশ কিছুটা অংশ মালভূমির মত নিচু হয়ে গিয়েছিল বা তার উল্টোটা। আর  সেইখানেই রাস্তার একপাশে এক জায়গায় তাদের বাড়িটা নানা গাছপালায় ঢাকা দেওয়া এক রহস্যপুরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকত। শুরুর দিকে বাড়ির সামনের দিকের অংশের জমিতে নানারকম চাষ করাটা ওদের স্বামী-স্ত্রীর কাছে  একরকমের মজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কী না চাষ করেছে ওরা ওখানে। ফুলকপি,   পালংশাক, আলু, সিম, বেগুন, লাউ, কুমড়ো, পটল আরও কত কী! এছাড়াও ছিল আম, বেল, নারকেল, পাতিলেবু, গন্ধরাজলেবু। ফুলের মধ্যে জুঁই, টগর,  নীল ও সাদা অপরাজিতা, নানা রঙের ও নানা রকমের জবা আর বেলফুলও। প্রতিবেশী এক বুড়ো  হঠাৎ একদিন সকালবেলা কড়া নেড়ে ডাকাডাকি করতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে ওরা দেখল, একটা ফুলকপি একমুখ হাসি নিয়ে লেবুগাছের উচ্চতায় উঠে গেছে, আর আরও একটা দিব্যি তখনও ক্ষেতে বসে  বসে হাসিতে কুটোপাটি হতে হতে অন্যটার সঙ্গে একে অপরে আলাপ ও বিস্তার এমন জমিয়েছে যে গোটা গাঁ তা দেখতে একেবারে ভিড় করে এল ওদের খেতের ওপরে। আর ঠিক সেইসময়েই সকলে অবাক বিস্ময়ে নজর করল, পাঁচিলের ধার বরাবর একটা স্থলপদ্ম গাছ তার বেশ কয়েক জোড়া হাতে একগুচ্ছ ঘুমন্ত ফুল ও কুঁড়ি সমেত আকাশের দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে। মাত্র একটাই গাছ বলে সেইসময় মানময়ীর প্রথমে কিছুটা দুঃখ ও পরে এক গোপন আনন্দ হল যা নিয়ে ও অনঙ্গের দিকে তাকানো মাত্রই ওদের দুজনের মধ্যে কিছু বার্তা বিনিময় হল,  যেটা শুধু ওরাই বুঝল। গ্রামের বাকি লোকজন এতে খানিকটা বোকা বনে গিয়ে যে যার নিজের মত একে একে চলে গেল।

শৈশব, কৈশোর এমনকি যৌবনের প্রথম বছর দশেক সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে  দাদারা ও একমাত্র ভাই তাকে এমন ঠকিয়েছে বারবার করে যে আত্মীয়স্বজনের নাম শুনলেই তার ভেতরে তীব্র আতঙ্ক এমন ভাবে ছড়িয়ে যায় যে কখনও কখনও তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সে চূড়ান্ত রেগে উঠে পাগলের মত চিৎকার চেঁচামিচি জুড়ে দেয়। তাই মানময়ী যতটা পারে তার আশেপাশের আত্মীয়স্বজনের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। পাত্র হিসেবে বিয়ের বাজারে অনঙ্গর এত কদর ছিল যে এ সময় অনেক বড়লোকের ঘরের বাবারাই তাদের মেয়েদের অনেক টাকাপয়সা, সোনাদানায় মুড়ে তাকে জামাই হিসেবে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু অনঙ্গের নির্লোভ স্বত্ত্বাকে তারা কিছুতেই বাগ মানাতে পারেনি। কেননা অনঙ্গ চেয়েছিল একজন সৎ, ধীর, স্থির, শান্ত কেউ এসে তার ঘর সামলাক। মানময়ী  তাইই ছিল। তাই মানময়ী গোটা পৃথিবীতে তার একমাত্র আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। সমরাঙ্গ দু’চারবছর অন্তর অন্তরই ওদের কাছে আসত, মাসের পর মাস  বিনা  পরিশ্রমে খেত, শুত, ঘুরে বেড়াত এদিক ওদিক আর তারপর কিছু সন্দেহের বিভূতি নিয়ে এসে মানময়ীর ওপর ঢেলে দিত যেটা শোনা মাত্রই অনঙ্গ ক্ষেপে উঠে সেই মুহূর্তেই তাকে আবার বাড়ি ছাড়া করত।

শ্যামাঙ্গীর জন্মে আহ্লাদ ছিল না কোনও। কিন্তু সে যত বেড়ে ওঠে ততই  আহ্লাদী  হয়ে ওঠে সব জায়গায় সকলের কাছেই। ব্যাপারটা যেন এইরকম যে আহ্লাদী  হবার জন্যই ওর জন্ম। কিম্বা ঈশ্বর ওকে খুব ভেবে চিন্তে এই স্থানে এবং এই সময়ের বিন্দুতেই প্রেরণ করেছেন। মেয়েটা একটু একা একা গোছের। একা খায়, একা ঘোরে, একা পড়ে বা লেখে। সব কিছুই খুব একা একা আপন খেয়ালে দিব্যি ডগমগিয়ে বেড়ে ওঠা লাউ কিম্বা কুমড়ো গাছের লতিয়ে ওঠা যেন। ছোট্ট ক’হাতের মেয়েটাকে সকলেরই খুব সমঝদার বলে মনে হয়। এর ফলে সকলেই  ওকে যার যার নিজের মনের কথা অকপটে বলে। এমনকি যে সমস্যা তার পক্ষে কখনই বোঝা সম্ভব নয়, সে কথাও ওর কাছে বলে আর পরামর্শ চায়। অনঙ্গও প্রয়োজনে শ্যামাঙ্গীর দ্বারস্থ হয়। সংসারের ব্যাপারে বা ছেলেদের ব্যাপারে পরামর্শ চায়। মানময়ী দুটো ছেলেকে সামলিয়েই হিমসিম খেয়ে হাতপা ছড়িয়ে বসে পড়ে। কিন্তু শ্যামাঙ্গীর মাথার ওপরে সবসময়েই খুব বড় একটা আকাশ দেখা যায়। সেই আকাশে সূর্য সবসময়েই তার সাতরঙা রশ্মি এমন কৌশলে বিতরণ করতে থাকে যে তা ওর ছোট্ট শরীরটার ওপরে পড়ে ঝলকে উঠেই খিলখিলিয়ে হেসে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। শিশু শ্যামাঙ্গী একদিন একটা  চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে গেলে সেটায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। শিশু সম্রাট তা দেখে  তারস্বরে কেঁদে ওঠে আর কাজের মেয়ে ঘড়া ঘড়া জল ঢালতে থাকে। হন্তদন্ত হয়ে সবাই ছুটে এসে দেখে ঘরের মধ্যে দিয়ে একটা যেন নদীর স্রোত বয়ে যাচ্ছে আর সেটা দরজা দিয়ে খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবেই বেরিয়ে যাচ্ছে। বেচারা শ্যামাঙ্গী গভীর বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কাজের মেয়েটা মানময়ীর কাছে  খুব বকাঝকা খেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটার নাম দুর্গা। সাতচল্লিশের দেশভাগে পারাপারের সময় ওর মা’র ইজ্জত লুঠ হয়।  তাতেই পেটে আসে এই মেয়ে। মা তো সন্তানকে ফেলে দিতে পারে না। বাপের মত খেদিয়েও দিতে পারে না। তাই ওর মা ওকে নিয়েই লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করে। কিন্তু মেয়েটার একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন ওর বয়েস বাড়ে না। হাতপা শরীর সব যেন কতকাল একই রকম থেকে গেছে। মানময়ী আর অনঙ্গ দুজনে মিলে ঠিক করে ছেলেমেয়েদের বাড়ার সময়টায় ওরা ওদের চারপাশটা একটা অন্য আবহে ঘিরে রাখবে। তাই শ্যামাঙ্গী, সুদাম, সম্রাট তিনজনের হামাগুড়ি পর্ব থেকেই বাতাসে সব সময় নানা অক্ষর ঘুরে ঘুরে নেচে বেড়ায়। গোটা বাড়িটা স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জন বর্ণের নানা অক্ষরে একেবারে উদ্বেলিত হয়ে থাকে। তার সঙ্গে যোগ হয় অনঙ্গের হারমোনিয়ামের আওয়াজ ও সপ্তসুর। তবে অনঙ্গ কাজে বেরালেই সম্রাট ষাঁড়ের মত চেল্লায়, সুদাম একমনে বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। শ্যামাঙ্গী সাততাড়াতাড়িই যে কোন জিনিসই শিখে ফেলে যখন তখন সবাইকে খুব চমকে দেয় এমন যেন এটাই ওর একটা খেলা।

আলালের ঘরের দুলাল হোক তার ছেলেমেয়ে এটা মানময়ীর একেবারে পছন্দ নয়। অতএব তারই পরামর্শে ওদের সবাইকে নিয়ে অনঙ্গর শিক্ষাদানপর্ব চলে। শ্যামাঙ্গীর খাতায় একটা পাখি এঁকে দিয়ে অনঙ্গ সুদামকে অঙ্ক করায়। শ্যামাঙ্গী পাখিটার পাশে ঠিক ওই রকমই আর একটা পাখি এঁকে বাবার সামনে খাতাটা মেলে ধরে। অনঙ্গ এবার একটা ঝর্ণা এঁকে দিয়ে আবার অনঙ্গকে অঙ্ক করাতে শুরু করল। শ্যামাঙ্গী ঝর্ণাটাও এঁকে বাবার সামনে খাতা এগিয়ে দিয়ে সুদামের  খাতাটা দেখতে দেখতেই সুদাম তার অঙ্ক শেষ করে বাবাকে দেখায়। অনঙ্গ অবাক হয়ে দেখে শ্যামাঙ্গীর আঁকা ঝর্ণা থেকে অঝোরে জল পড়তে পড়তে পুরো জায়গাটা একেবারে প্লাবিত হয়ে জল সোজা বাড়ি ঘরদোর ছাড়িয়ে একেবারে রাস্তায় গিয়ে পড়ছে। অনঙ্গ অমনি সুদামকে বলল, ‘কতটা জল হবে বল তো?’   সঙ্গে সঙ্গে সুদামের আঙ্কিক সংখ্যাগুলো একে অন্যের পেছনে লাইন লাগিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে গেল। সুদাম অখান থেকে উঠে ছুটে বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বাবাকে বলল, ‘সাতাশহাজার কোটি পাঁচশো বাহান্ন কিউসেক’। অনঙ্গ এবার মাথাটা বেশ সমঝদারের মত করে নেড়ে বলল, ‘হুম’।

সেদিন সন্ধ্যে থেকেই শুরু হল এক অদ্ভুত ঝড়। গ্রামের কম বেশি সকলেই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। কয়েক ঘণ্টা পর তার সঙ্গে যোগ বৃষ্টি একেবারে যেন স্বর্গ  মর্ত্য পাতাল্ কাঁপিয়ে হুড়মুড়িয়ে বজ্রবিদ্যুত সহযোগে। নিহিত পাতালপুরীরই সব বাসিন্দারা খুব ভয় পেয়ে গেল অমঙ্গল আশঙ্কায়। সকলে ঘন ঘন শাঁখ বাজাতে থাকল। কেউ কেউ আবার উলুধ্বনিও দিতে থাকল। কেউ কেউ  ঘণ্টাধ্বনিও দিতে শুরু করে দিল। সব মিলে মিশে গিয়ে একেবারে একটা বড়সড় জগাখিচুড়ি শুরু হয়ে গেল। যারা শাঁখ বাজাচ্ছিল তারা রেগে উঠে প্রায় মারমুখি হয়ে তেড়ে গেল অন্যদের দিকে এমনভাবে যাতে করে একটা তুমুল গণ্ডগোল হবার উপক্রম হল। কিন্তু ততক্ষণে বৃষ্টির বেগ অনেকটাই কমে এল। গাছপালাগুলোও বেশ খানিকটা ধীর স্থির হতে শুরু করল। আকাশের চাঁদটা আস্তে আস্তে আবার  বেরিয়ে এল। জগা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। অনঙ্গ ওকে দেকে জানতে চাইল কোথাও কোন কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা। জগা জানাল যে না তেমন কিছু হয়নি।  মানময়ী সুধাময় আর শ্যামাঙ্গীকে ডেকে পাঠাল। ওরা আসতেই বলল, ‘যা। তোরা গিয়ে তুলসগাছে জল দিয়ে প্রদীপণটা জ্বেলে দে!’ অনঙ্গ তার যন্ত্রপাতির ব্যাগ খুলে বসে ঘরের ফিউজ সারাতে গেল। পাশের বাড়ির মেমবউ এসে একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দাঁড়াতেই বাচ্চাটা মানময়ীর কোলে একেবারে ঝাঁপিয়ে   পড়ল। মানময়ী কোলে নিতেই হাত বুলিয়ে বুলিয়ে মানময়ীর  মুখ, নাক, গাল, মাথা, চুল সব দেখতে থাকল। মেমবউকে  আবার কে ডাকতেই সে চলে গেল। বাচ্চাটা কিন্তু মানময়ীর কোলে থেকে গেল। বাচ্চাটার নাম উপমা। মানময়ী  উপমাকে খুব করে আদর করতে লাগল। বাচ্চাটা খিল খিল করে হেসে উঠল। মানময়ীর কাছে ছেলে মেয়েরাও একে একে জড় হল। শ্যামাঙ্গী ওর দিকে  হাত বাড়াতেই ও শ্যামাঙ্গীর কোলে ঝাঁপিয়ে  পড়ল। মেমবউ কিন্তু সে রাতে বাচ্চাকে নিতে এল না। বাচ্চার কোনও ঝামেলা নেই। সে ওদের সঙ্গে মিলেমিশে দিব্যি রয়ে গেল। তাই ওরাও ওকে ফেরৎ দেবার বদলে নিজেদের কাছে নিয়েই দিব্যি রাতটা কাটিয়ে দিল। তিন-চার ঘণ্টা যেতে না যেতেই সবার হাঁকডাক আর হৈহুল্লোড়ের মধ্যে ওরা উঠে দেখল সদর দরজা থেকে একটা রক্তের রেখা ওদের জমি, গাছপালা, বাগান, সামনের রাস্তা পেরিয়ে পুকুরপাড় ধরে সোজা চলে গেছে মেমবউয়ের শোয়ার ঘরের দিকে। মানময়ী সোজা ঘরে ঢুকে দেখল রক্তের বন্যায় মেমবউ ভাসছে। পাশেই গুছিয়ে হাতে লিখে রাখা একটা চিঠি। চিঠিতে মেমবউ জানিয়েছে, গতবার পুজোর সময় তার ধর্ষণের এতদিন রোজ রাতে জগা ওকে দোষারোপ করে, অন্যের উচ্ছিষ্ট হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে মেমবউ কেন আজও বেঁচে আছে? তার নাকি উচিত ছিল বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করা। এমনকি সে একথাও নিত্যদিন বলত, উপমা নাকি ওর সন্তান  নয়। বাচ্চাটা নাকি আসলে ওর ওই অত্যাচারের ফলাফল। তাই  নিজের আর নিজের মেয়ের হাত থেকে  স্বামীকে মুক্তি দিতেই  মেমবউ এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। চিঠি থেকে মুখ তুলে মানময়ী দেখল গাঁ শুদ্ধু সব লোক যেন এখানে ভিড় করে আছে। জগাই কিন্তু নেই। আর একেবারে প্রথমের সারিতেই দাঁড়িয়ে আছে গাঁয়ের অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ওর মেয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জগাই সর্বসমক্ষে এসে সজোরে ঘোষণা করে, ‘মেয়েদের চোদ্দহাত কাপড়ে যে কাছা আঁটে না, এবার তা প্রমাণ হল তো, নাকি?’ সবাই  চুপ। মানময়ী সশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ওর  পেছন পেছন অন্যরাও সবাই একে একে যে যার মত চলে গেল।

(ক্রমশ)


1 কমেন্টস্:

  1. অসাধারণ একটি উপন্যাস হবে বলে মনে হচ্ছে, পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম

    উত্তরমুছুন