সমকালীন ছোটগল্প |
স্যার, একটা ভায়োলিন
একটা দ্বীপপুঞ্জ হামাগুড়ি দিয়ে একটু আগেই লোকটার পেটে ঢুকে গেলো। ছোটো-ছোটো দ্বীপমালা। সারা শরীরময় আলোকবিন্দু সহ লোকটা অসংখ্য দ্বীপ-এর সমষ্টিকে গিলে ফেললো।
লোকটার পেটে ভাতের দিনকে কাল হরণ করে নিয়েছে কে বা কারা, তা লোকটা ভুলতে বসেছিলো। কিন্তু চাইলেই কি সবকিছু ভোলা যায়? এই যেমন হামাগুড়ি দিয়ে দ্বীপপুঞ্জের সাথে যে সুবিশাল একটি সভ্যতা লোকটার পেটে ঢুকে গেলো, তার মধ্যে কী কী ছিলো -- এই প্রশ্নের উত্তরে অষ্টম শ্রেণির প্রত্ন, সেকেন্ড বেঞ্চ-এর কর্ণার থেকে উত্তর দিলো-
স্যার একটা ভায়োলিন।
প্রত্ন, একটা সম্পদশালী ঘরের ছেলে হলেও বিদ্যালয়ের সংস্কৃতি অনুযায়ী শিক্ষকের ভর্ৎসনার স্রোতে শ্রেণীকক্ষ থেকে বাইরে ভেসেই গেলো!
ভাসমান অবস্থায় পিছোতে হয়, একথা প্রত্ন জানে। ভাসতে ভাসতে প্রত্ন লোকটার পেটের ভেতরে অবস্থানরত দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে ঠেকলো।
নীচে নামলে গঙ্গা, সিন্ধু, নর্মদা, কাবেরী, সরস্বতীর মতো মেয়েরা ভায়োলিন হয়ে বাজছে। ওপরে উঠলে প্রাচীন পাহাড়ের ঢালে জমাট বরফের গায়ে খ্রীস্টপূর্ব দুই লক্ষ বছর আগের প্রথম বরফ-মানুষ ধ্যানে বসে আছেন। আর, সমস্ত দ্বীপ-মহাদেশের চতুর্দিকে পাহাড়ঘেরা সন্ন্যাসীর ধ্যানমৌন সবুজ বিপ্লব। এখন, প্রত্ন, লোকটার পেটের ভেতরে দ্বীপবাসী। বলতে গেলে প্রত্ন ও লোকটা মিলে আছে একই শরীরে। সেই হিসেবে লোকটাই হয়তো একজন প্রত্নসম্পদ!
নদীগুলোর জোয়ার-ভাঁটা কখন যেন এসে চাকভাঙা মধু হয়ে প্রত্নের সারা শরীরে মেখে গেলো। আর মহিলা নদীগুলোর তালিকাতে থাকা কাবেরী, সরস্বতীরা মৌমাছি হয়ে প্রত্নের গায়ের মধুতে মুখের ভাষা বসিয়ে দিলো।
আকাশবাণী উঠলো। প্রত্ন মাথার ওপরে তাকাতেই দেখতে পেলো, সেই বরফ মানুষ গান গাইছে - 'দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা...'
আরও
কতো কি আকাশবাণী উঠলো! এই যেমন, জীবন-জীবিকা,
নৈতিকতা - এরা সব ছুটছে আলোর গতিবেগের সাথে সাথে মৃত্যুর দিকে মরণের সংস্কৃতি হয়ে।
মৃত্যু
মানে জীবনের পরিসমাপ্তি। জীবন, মরণের রূপান্তরিত এক অবস্থায় প্রত্নের ভুলে যাওয়া হাজার
হাজার, লক্ষ লক্ষ বছরের পাথরের মর্ত্য সভ্যতার ওপর আছড়ে পড়লো চিত্রনাট্যের ফরম্যাটে
সংরক্ষণ করা কালো মেঘের সারি।
এত মেঘ দেখে নদীগুলোর তালিকাতে থাকা শীর্ষা নদী-নারী গঙ্গা মেঘমল্লার রাগের দৃষ্টিতে প্রত্ন'র দিকে তাকাতেই সুবিশাল দুটি আয়ত চোখ মেলে তার দিকে চাইলো প্রত্নপুরুষ।
সভ্যতার প্রথম বিকেলে বৃষ্টিভেজা রাস্তার ওপরে একালে রাত গভীর হচ্ছে। একালের নদী -- মহানন্দা বইতে বইতে চলেছে পূবে। নদী থাকলেই বাঁধ থাকবে। বাঁধ থাকলেই স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিকের হাঁটা-চলা, ব্যায়াম ইত্যাদি থাকবে। আর থাকবে নদী তীরবর্তী পাঠাগার, প্রত্নশালা, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি।
গভীরতম এমন রাতে প্রত্ন আর লোকটা একযোগে এ শহরের ইতিহাসবিদ গোপাল লাহা হয়ে গেলে কারও তাতে কিছু এসে না গেলেও, মহানন্দা নামে একটি মেয়ে বয়ে যেতে যেতে সিন্ধু-মৌমাছির ভায়োলিন হয়ে গোপাল লাহাকে জড়িয়ে ধরে।
এমন দৃশ্য দেখে কখন যেন পাঠাগারের গায়ে লেগে থাকা আঁধারে মানিক সুগন্ধি চাঁপাগাছ ইতিহাসের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি ঝরাতেই বদলে যাওয়া আবহাওয়ার ডিসেম্বরের সিঁড়ি বেয়ে এ শহরে শীত নেমে এলো।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন