কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল




 

(২৩)

 

একাদেমির প্রদর্শনী শেষ হয়ে গেছে, শ্রুতির ছবি মৌখিক প্রশংসা পেলেও বিক্রি হয়নি। অ্যাকোয়ারিয়ামের ছবিটা একজন পছন্দ করেছিল, দাম শুনে পালিয়ে গেছে। সে নির্বিকার, ‘কিছু যায় আসে না’ গোছের নির্লিপ্তি ভর করেছে। দেবার্ঘ্যকে একাডেমিতে এসে দেখা করতে মেসেজ করেছিল, ‘আমি বুঝি না বলে পাশ কাটিয়ে দিয়েছে। ভদ্রতাবশতঃ দেখা করার জন্য আরেকটা দিন ঠিক করতে হয়েছে। সদ্য দুটো মোটামুটি চালু কম্পানি থেকে ফাইনাল ইন্টারভিউ-কল পেয়েছে শ্রুতি। এইচ-আর পোস্টের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিল, স্যালারি মন্দ নয়। হেড্‌ অফিস মুম্বাই আর হায়দারাবাদ, আশা করছে হয়ে যাবে। সে ভাবে, একটাই উপকার করেছিল মা, যুগের হাওয়ায় ইংরেজী মিডিয়ামে পড়িয়ে। ইংরেজীতে ভালোই দখল আছে। চাকরি হলে বেঁচে যায়, একলা, স্বাধীন, নিজস্ব, জীবন। ভাগ্যে আদৌ শিকে ছিঁড়বে কোনোদিন?

সাউথ সিটি মল্‌-এ ফুড কোর্টের এককোণে বসে ঠাণ্ডা পানীয় নিয়ে বসে দেবার্ঘ্য ঘোষের জন্য অপেক্ষা করে। একমনে দু-হাতের পাতা সামনে মেলে দেখে লালচে পাতায় ফুটে-থাকা রেখা, লম্বাটে আঙুল। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে চোখ তুলে তাকায়, ভীড়ের মধ্যে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকে খুঁজছে দেবার্ঘ্য। মনের মধ্যে কেমন করে ওঠে, সাথে অদ্ভুত বিরক্তিও লেপ্টে থাকে। এরকম ফর্ম্যাল ডেটিং-এ আসা প্রথম, আগে যারা যোগাযোগ করতে চেয়েছে অভদ্রতা করে পত্রপাঠ বিদেয় দিয়েছে।

বেশ আনস্মার্টভাবে উল্টোদিকের চেয়ারে বসে দেবার্ঘ্য, গ্লাস টেনে নিয়ে জল খায়। হাসে,

--অনেকক্ষণ?

--ফিফটিন-টোয়েন্টি মিনিটস্‌ মতো।

--বোর হচ্ছিলেন?

--বোর হবো কেন এতো মানুষের মধ্যে?

--তা ঠিক।

দেবার্ঘ্য কী বলবে ভেবে পায় না, শ্রুতি কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে। দেবার্ঘ্য বলে,

--বলুন?

--আমি কী বলবো? আমি ডাকিনি তো আপনাকে, আপনারই বাড়ির লোক দেখা করতে বলেছেন।

--তা অবশ্য! আচ্ছা আপনি কি সব সময়ে এরকম সিরিয়াস থাকেন?

--মে বী!

কাঠ-কাঠ কথা শুনে দেবার্ঘ্য সরাসরি তার মুখের দিকে তাকায়, তাকিয়েই থাকে মিনিটখানেক তার বোনের মতো আহ্লাদী মুখ শ্রুতির নয়, চৌকোনো, রাগ-মেশানো চোখা, সমীহ জাগানো। শ্রুতি বিব্রত, বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করে,

--হোয়াট্‌সাপ?

--আপনার বয়ফ্রেণ্ড আছে?

একেবারে আচমকা সরাসরি এই প্রশ্ন, সামান্য টলে যায় শ্রুতি। প্রথমে জবাব দেয় না, সময় নিয়ে বলে,

--না। শুধু এটা জানার জন্যে মিট্‌ করতে চেয়েছেন?

--কিছু মনে করবেন না। আমার একজন গার্লফ্রেণ্ড ছিল কলেজে, পোষালো না। দু-বছর টিঁকে থাকার পরে ব্রেক আপ্‌, ব্যাস গল্প শেষ।

--আমি জেনে কী করবো?

দেবার্ঘ্য উপযুক্ত জবাব না পেয়ে মাথা নীচু করে সম্মতিসূচকভাবে নাড়ে, ডানহাত দিয়ে নিজের ঘাড় ডলে। মাথা চুলে ঠাসা, গা থেকে ডিও-মেশানো হালকা ঘামের গন্ধ। মুখ তুলে বলে,

--এনিওয়ে আপনার জানার বা বলার থাকলে বলুন।

--নাথিং, কিছুই না।

--সত্যি কথাটা বলি, আপনাকে মা-র খুব ভালো লেগেছে। মা মনে মনে যে কতটা আধুনিক বাবা মারা যাওয়ার পরে প্রচুর স্ট্রাগল্‌। যাকগে বাদ দিন, আপনার অ্যাপিয়ারেন্সে মা ভীষণ ইম্প্রেসড্‌, বলছিল ভরসা করার মতো মেয়ে।

শ্রুতি নীরবে শোনে, মন্তব্য করে না। দেবার্ঘ্য জল খায় অনেকটা, দম নিয়ে বলে,

--মেঘে-মেঘে বেলা অনেক, আমি থার্টি-ফাইভ প্লাস। অনেক সম্বন্ধ এসেছিল, হয়নি। অবশ্য আপনি রাজী না হলে

--আপনার মা জানেন আমার জন্ম আমার বাবা-মার বিয়ের পাঁচমাস পরেই?

দেবার্ঘ্য শোনে, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, নীরব থাকে। শ্রুতি খোঁচা মারে,

--আপনার মা-কে এটা বলে দেখবেন তো, কী রিঅ্যাকশন হয়!

--প্রথম কথা, আমি ওসব বলবো না। এবং বললেও কিছুই হবে না, এখানে আপনার কোনো রোল নেই। আলটিমেটলি দে আর ম্যারেড এবং সেটা কন্টিনিউ করছে। আপনার লাইফে কেউ থাকলে জানা বেশী দরকার।

--না, আমার এসবে কোনোদিন ইন্টারেস্ট ছিল না, আজও নেই।

--ফাইন। চলুন কিছু খাওয়া যাক বরং। বসুন, আমি নিয়ে আসছি।

ঝোড়ো হাওয়া ছেড়েছে। বাইরে পেয়ারা গাছের ডালপাতা দুলছে ছন্দে-তালে, শব্দ আসছে। বৃষ্টি নামবে, নাও নামতে পারে। মুম্বাইয়ের চাকরিটা হলো না, হায়দরাবাদেরটার ফাইন্যাল ইন্টারভিউ যথেষ্ট ভালো হয়েছে। ঝিম-ধরা রাত, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে মামপি, পজিটিভ চিন্তা করার চেষ্টা করে। কারো সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছে করে, পরামর্শ পাওয়া গেলে উপকার হত। অর্জুনের সময় নেই, খানিক এড়িয়েও যাচ্ছে মনে হয়। সম্ভবত সেট্‌ল করার চিন্তায় আছে, বলার ধাঁচে আন্দাজ করছিল শ্রুতি। বলছিল দিদির বিয়ে ফাইন্যাল হয়ে গেছে, এরপর বাড়ি থেকে ওকে চাপ দেবে। বিমর্ষ লাগে মামপির, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। দেবার্ঘ্যকে মন্দ লাগেনি যদিও ঘন্টাখানেকের আলাপে চেনা যায় না, বিয়ে-ফিয়ে নিয়ে ভাবছেই না। রোজ তার মা জানার জন্যে খোঁচাখুঁচি করে, মামপি দাঁতে-দাঁত চেপে চুপ।

একেবারে ঘুম আসছে না। মাথার কাছে থেকে মোবাইল নেয়, প্রায় একটা বাজে। হোয়াটস-অ্যাপ খুলে দেখে ক-জন অনলাইন। কেউই নেই, অর্জুন ছাড়া। দোনোমনা করে লিখে ফেলে,

‘জেগে আছিস?’

অর্জুন দেখেও জবাব দেয় না, অথচ অনলাইন। মেখলা নামের চরম নেকু মেয়েটাকে টাইম দিচ্ছে? ভ্যাজাচ্ছে? নিজেকে ফেকলু-টাইপ লাগে, অপমানিত মনে হয়, অর্জুনের নম্বর উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ফোন বন্ধ করার মুহূর্তে মেসেজ আসে,

‘এখনও জেগে আছেন?’

 দেবার্ঘ্য ঘোষ। বেশ গায়ে-পড়া লোক! পছন্দ হওয়ার আভাসমাত্র শ্রুতি দেয়নি। বিরক্ত হলেও সে জবাব দেয়,

‘হ্যাঁ। আপনিও দেখছি!’

দেবার্ঘ্য টাইপ করছে, মামপি ভাবে হায়দারবাদের চাকরির ব্যাপারটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? একেবারেই থার্ড পার্সন, মোটামুটি নিরপেক্ষ মতামত পাওয়া যেত। মনস্থির করে লিখে ফেলে,

‘একটা সাজেশন দরকার ছিল’।

বলুন। সেদিনের পরে আপনি ফোন করলেন না, ভাবলাম নেগেটিভ হয়ত। অথচ আমার বাড়িতে সব ইন্টারেস্ট নিয়ে রেডি হয়ে আছে, আপনি ইয়েস করলেই বাজার-হাট শুরু করে দেবে। আমি বলেছি সময় লাগবে...। বাই দ্য ওয়ে, কীসের সাজেশন বলুন?’

হায়দরাবাদে একটা জব অফার

আপনার? অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার পেয়ে গেছেন?’

না। লাস্ট পার্ট বাকি। ওরা দু-দিন টাইম নিয়েছে, স্যালারি এন্‌ আদার থিংস ডিস্কাস্‌ করবে, তারপর’-।

ও-কে’।

মিনিটখানেক মোবাইল হাতে করে শুয়ে থাকে মামপি, তারপর দেখে দেবার্ঘ্য টাইপ করছে,

কাল স্যাটার-ডে আমার অফ্‌ আছে। দেখা করবেন একবার?’

আবার?’

প্রব্লেম থাকলে থাক’।

ও-কে যাবো, গুড নাইট’।

সারারাত ঘুম আসতে চায় না মামপির, আকাশ-পাতাল ভেবেই যায়। সে কি অচেনা লোকটির ওপরে নির্ভর করতে শুরু করেছে? দেবার্ঘ্যর চেহারা মনে করার চেষ্টা করে। সাদামাটা, ছিপছিপে, মাঝারি উচ্চতা, চোখে চশমা, গড়পড়তা ওই বয়সের সাধারণ বাঙালি ছেলেদের মতো। ব্যবহার যথেষ্ট নম্র, ভদ্র, সাহায্য করার মানসিকতা আছে, সেদিন কথা বলে মনে হয়েছিল। আর হায়দারাবাদের চাকরি? ওরা যা অফার করছে তার চেয়ে খানিকটা বেশী চেয়েছে। রাজী না হলে যা দেবে তাতেই চলে যাবে।

দেবার্ঘ্য রাজী হবে তো!

হঠাৎই বাবুলের বাবাকে মনে পড়ে, মিল আছে কোথাও, ব্যবহারে? মাসিমণির সংসার কেমন ছায়ামাখা, শান্তি দিয়ে ঘেরা। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, কানের লতি গরম। উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শোয় মামপি, নিজেকে লজ্জা করে। 

 

(ক্রমশঃ)

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন