কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


(পর্ব ২৪)

জীবন কোনো এক ব্যক্তিজীবন নয়। জড়িয়ে থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ ও সময়ের দলিল। জীবন এক ইতিহাসের পাতা। কখনও ভয় হয় আমাকে যেন সাক্ষ্য দিতে না হয় কোনো ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তির। মানুষের মধ্যে বাস শিব ও শয়তান দুজনেরই। শিক্ষা আর সংস্কার অবদমিত করে রাখে সেই শয়তানকে। তবু সে নিয়ত মাথা তোলার চেষ্টা করে। বিজ্ঞান এবং ধর্ম হাত ধরাধরি করে চলে। ভুলে যাই। আমাদের পশু প্রবৃত্তি শয়তানকে ধ্বংস করে মানবতার জয়গান গেয়েছে পৃথিবীর সব ধর্ম। মিথ এবং মেটাফর ধর্মশাস্ত্রর মূল উপাদান কারণ কাব্য ভাষায় লেখা জীবন যাপনের উপদেশ যা পরবর্তীতে ধর্মগ্রন্থ হয়ে গেছে শুষ্ক উপাচার  মাত্র উৎসব মাত্র জনগনহত্যার মূলধন হয়ে গেছে সেখানে রয়ে উপমা এবং প্রতীক রূপক এবং দ্যোতনা বিভিন্ন দেশের ভৌগলিক এবং তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুসারে। যেমন হিন্দুদের বলি ঈদে কোরবানি। মনে রাখতে হবে সেইসময় বিশ্বে মানব সম্পদের তুলনায় প্রাণীসম্পদ ছিল বেশি এবং পশু শিকার এবং আমিষ খাবারে বাধা ছিল না। পৃথিবীর খাদ্যসম্ভার ছিল বেশি।

প্রতিটি ধর্ম সংযম শেখায়, যিনি ডায়েট চার্ট তৈরী করেন বিপুল ফি’র বিনিময়ে শূন্য শতকে, শরীর সুস্থতার  জন্য শারীরিক মানসিক সুস্থতার জন্য ব্রত উপোষ রোজার প্রচলন সব ধর্মেই। পরিশিলিত জনগনের বলি ও কোরবানির রক্তে যতটা বিবমিষা আসে শত মানুষের হত্যালীলায় তত উদ্বেল হতে দেখা যায় না।

যাইহোক, জীবন ও যাপন পাশাপাশি চলে। আবছা আলো, অস্পষ্ট কিছু অবয়ব আর তীব্র যন্ত্রণা। ফের ঘুমিয়ে পড়ি এনেস্থেসিয়ার প্রভাবে। আবার একসময় কে যেন কানের কাছে জোরে বলে "একবার তাকান, চোখ খুলুন" ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। এবার চেনা গলাও পাই। চোখ খুলি। নার্স একগাল হেসে বলে দেখুন আপনার মেয়ে। পাশে ছোট্ট কটে শুয়ে যেন এক বিদেশী পুতুল। ফর্সা টুকটুকে, লম্বা লম্বা আঙুল খয়েরি চুল। আমারই অংশ। আমার আত্মজা। অবিশ্বাস্য লাগে।

রাতে মেয়েকে কোলে দিয়ে নার্স  শিখিয়ে দেয় স্তন্যপান করানো সন্তানকে। সে এক গভীর উপলব্ধি শারীরিক মানসিক উত্তরণ যে কোনও নারীর। সন্তান ধারন এবং পালন এক অনন্য অভিজ্ঞতা পুরুষ যা থেকে  বঞ্চিত, তারা যতই আস্ফালন করুক। প্রথম দুদিন কেটে গেল নার্সিংহোমের বেডে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা অনুভূতি। ভাবছি মা হিসেবে আমাকে পছন্দ করবে তো মেয়ে। আমাকে ভালোবাসতে পারবে? সিজারিয়ান সেকশন। পাঁচদিন পর ঘরে। প্রতিদিন কত আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশি আসে সদ্যজাতাকে দেখতে। দুশো বছরের পুরনো জীর্ণ মহলে আমি ও আমার কন্যা। একটি আয়া রেখেছি। একবছর আগে মারা গেছেন শাশুড়ি তারপর শ্বশুর। পু্রনো বাড়ির ঘুলঘুলিতে পায়রার বাসা। পরিত্যক্ত চিলেকোঠা। শ্যাওলা ধরা কুয়োতলা।

একদিন দূপুরের খাবার খেতে গেছি দরদালানের ওপারের ঘরে কন্যার কাছে আয়াকে বসিয়ে। হঠাত সে এসে খবর দিল দিদি একজন এসেছেন তোমার মেয়েকে দেখতে। কখন দরজা খুললি?

মেয়েটি বলে, "আমি খুলিনি দিদি, একটু চোখ লেগে গেল তারপরেই উঠে তাকিয়ে দেখি উনি মেয়ে পাশে  বসে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। সাদা থান পরা কেউ তোমাদের মনে হয়।

আমি বয়স্কা বৃদ্ধা শুনে আধখাওয়া তাড়াতাড়ি উঠি। ঢুকে দেখি শূন্য ঘর। আয়া মেয়েটি ও দিদা ও দিদা বলে সব ঘর ঘুরে এলো। আমি নিচে গিয়ে দেখলাম দরজা যে কে সেই, দরজা ভেতর থেকে খিল ছিটকিনি। আমি বলি, তুই কি স্বপ্ন দেখছিস? সে ততই বলে, না পুরো বর্ণণা দেয়। হঠাত চুপ করে যাই। বলি ঠিক আছে। ওই বাড়িতে কয়েকমাসের শিশুকন্যা পালঙ্কে শুইয়ে চান করতে গেছি রান্নাঘরে গেছি, কখনও কোনোদিন খাট থেকে পড়ে যায়নি। কখনও এত ভূতের ভয় পেতাম কিন্তু রাত বিরেত শূন্য সেই বাড়িতে একা থাকতে ভয় পাইনি। মনে হতো ওরা আমাদের সব সময় পাশে আছে স্নেহ নিয়ে সতর্ক হয়ে। কাকতালীয় কত কী ঘটে। বয়স কম ছিল। বিশ্বাস একটি বড় শক্তি। যত বয়স বাড়ে বিশ্বাসের আড় আলগা হয়ে পড়ে। এরপর বেকার স্বামীর নানা কাণ্ড কারখানা ইস্কুল মাস্টারি একা বাড়িতে ছোট্ট শিশু পালন। অদূরে মাতামহীর বাড়ি অশিতিপর দাদু দিদারা পালা করে মেয়ে পাহারা দিতেন। বুকের দুধ জমে যেত টনটন করত, স্তন জামা ভিজে যেত। কর্মস্থলে বাথরুমে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসতে হতো দুধ। এদিকে মেয়ে ক্ষিদের চোটে সারাদিন কাঁদত পরিত্রাহী। লিখতে পারছি তাই লিপিবদ্ধ করছি কিন্তু এমন কঠিন বহু নারীর জীবনের আখ্যান। আর্থিক সংকট পিছু ছাড়ে না। বর্ষাকালে এঘরে সেঘরে বালতি হাড়ি কড়া পেতে রাখতে হতো সেই অট্টালিকার। পঞ্চাশ বছরের ভাড়াটে নামমাত্র ভাড়ায় জবরদখল। এইসব সমস্যা সমাধানে সুযোগ বুঝে এসে পড়ল পার্টির মস্তানরা, যার পোষাকি নাম ছিল নাগরিক কমিটি।

ভাই ভাই ঝগড়া ভাড়াটে তোলা এমনকি স্বামী স্ত্রী সমস্যার ভেতরেও এই সময় তারাই ডিসিশন নিতে লাগল। যা কিছু সিদ্ধান্ত পার্টি অফিস নিত। আমাদের বাড়িটি তারা বেনামে এমন স্বনামে মিলিয়ে পার্টি অফিস প্রভৃতি করার জন্য চাপ দিতে লাগল। রাজি না থাকায় বাড়ির পেছনে জমিতে রাতে মদের বোতল ফেলা, তালা ভেঙে ডাকাতির ছল, নানাভাবে ভয় দেখানো হতে লাগল।

এই সময় জীবন আরও একবার তামাশা করল আমার সঙ্গে। দ্বিতীয় সন্তানের সম্ভাবনায় খুশি  এলো। পুরনো উপন্যাসের মত - "নিয়তি অলক্ষ্যে হাসিলেন।" ঠাকুমা বলতেন একটা পয়সা পয়সা নয়। মনহীন জৈবিক ক্রিয়া জারি থাকে পৃথিবীর শ্বাপদকুলের মত। মানুষ এমন কী আর উন্নত! তারপর ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত। মাস তিনেকে পুরনো বাড়ির শ্যাওলা উঠোনে পা হড়কে গেল। কিন্তু অঘটন হলো না। ডাক্তারের হাতে রোগী গিনিপিগ। দেখাশোনা করার নেই কেউ উপরন্তু স্বামীর গ্যাসলাইটিং। টাকার সমস্যা। মাঝে মাঝেই ব্লিডিং। অস্বাভাবিক রক্তচাপ।

তারপর আর কি। নয় মাসের শেষে আলট্রা সোনোগ্রাফির রিপোর্ট জানাতে গিয়ে চোখ মুছতে দেখলাম যুক্ত ডাক্তারকে। শুনলাম দুদিন আগের রাতে আমার নিরাপদ শরীরের মধ্যে জন্মে কিছুদিন নড়ে চড়ে বড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে আমার ভেতরেই সেই কন্যা। দুদিন নারকীয় মানসিক যন্ত্রণা তার হাসপাতালে নর্মাল ডেলিভারি শুধু সদ্যজাতাকে মুড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হিন্দু সৎকার সমিতিতে এটা চাক্ষুষ করার জন্য। সেবারেও শরীর জুড়ে উঠেছিল তুফান তার শেষ নিশ্বাস টের পেয়েছিলাম আমি। সব কিছুর ব্যাখা মানুষ আবিষ্কৃত যুক্তির পথে  চলে না। তবু জীবন আমাকে একের পর এক মিসাইল এটাক করেছে। মায়ের সামনে দিয়ে মৃত সন্তানের ছোট্ট দেহটি নিয়ে চলে গেল ওরা। সেই তীব্র নাড়ি ছেঁড়ার কষ্ট কে বুঝবে পৃথিবীতে! ব্যর্থ প্রসব বেদনার পর ফের দিন আসে ফের রোদ হয় বৃষ্টি হয় কিন্তু ভেতরের সেই আমিটা ক্রমে বদলে যেতে থাকে।

দিন কাটে। কাটে না। খবরের কাগজে একই ছবি কালো অক্ষর। এর মধ্যে একবার ইতিহাস সৃষ্টি হলো যখন ক্ষুব্ধ জনগণ বামফ্রন্টের চৌঁত্রিশ বছর শাসনের অবসান ঘটিয়ে তৃণমূল পার্টিকে জিতিয়ে নিয়ে এলো। কতটা  মমতা ব্যানার্জির কৃতিত্ব আর কতটা বামফ্রন্টের মস্তানরাজ আর ঢিলে মনোভাব ভুল পার্টিলাইন কিম্বা অনিল বিশ্বাসের অকস্মাৎ প্রয়াণ ইত্যাদি, তা বলা মুস্কিল। তবে স্থবিরতা কাটল। যেখানে বামপন্থী মন্ত্রীরা লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন, এলিটিসমের অহংকারে যেখানে দিনের পর দিন পাড়ায় পাড়ায় তোলাবাজি আর মাস্তানি চলছিল, সেইসময় মমতা তাঁর বিখ্যাত চটি ও সাদা শাড়িতে কলকাতা তথা বাংলায় পথে পথে ঘরে ঘরে গিয়ে রোদে জলে ঘুরে ঘুরেছেন। ‘গিমিক’ তো বটেই! মমতা কোনো তত্ত্ব কথার ধার ধারেননি। নতুন একটা শব্দ যুক্ত হলো শব্দ ভাণ্ডারে ‘লেসার ইভিল’।

আমরা যারা মায়োকভস্কি, সমর সেন, রাশিয়ান লিটারেচার আর চেগেভারা পড়ে বড় হয়েছিলাম বামপন্থী  আদর্শে আশৈশব, তাঁদের কাছে স্থানীয় সি পি এম পার্টির একের পর এক ভুল সবচেয়ে বেশি মন তিক্ত করেছে, মন সরে গেছে রাজনীতি থেকে নিরাশ হয়ে।  

আমরা কখনও কিউবা হতে পারবো না, চিন হতে পারব না, সে শুধু আমাদের কোনো লেনিন বা মাও নেই বলে নয়, কেবল কাস্ত্রো পাইনি বলে নয়; আমরা ভিয়েতনাম হতে পারব না, তার কারণ আমরা সুবিধেবাদী।  আমরা মুখে শুধু বড় বড় কথা বলি, আসলে আমাদের কিছু করার সক্রিয়তা ও সৎসাহস নেই, আদর্শ নেই। আমাদের গোটা দেশে ধর্মের ঘুণপোকা কুরে কুরে খায়।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন