![]() |
কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৫ |
অসীম মারা যাবে
অসীম মারা যাবে, তা আমরা জানতাম। আমরা মানে অসীমের বৌ, ছেলেমেয়ে, নিকট আত্মীয়স্বজন এবং আমি। অসীম আমার বন্ধু, সেই ছেলেবেলা থেকে, একই পাড়ায় বসবাস। ভেলোরে চিকিৎসা চলছিল। প্রোস্টেট ক্যানসার। গত জুলাইতে ডাক্তারবাবুরা হাত তুলে দিয়েছেন, আপনারা পেশেন্টকে বাড়িতে নিয়ে যান, শুশ্রূষা করুন। যতদিন বেঁচে আছেন, আপনাদের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে থাকুন।
অসীম এখন তাই আছে, আমাদের আন্তরিক সান্নিধ্যে। কবে মারা যাবে কারও জানা নেই, তবে মারা যে যাবে, এব্যাপারে সবাই ওয়াকিবহাল।
সেদিন যেমন রাত দেড়টা নাগাদ অসীমের ছেলে বিকাশ আমার ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজালো। তখনও জেগেছিলাম, বললাম, কী ব্যাপার! বিকাশ খুব ভেঙে পড়েছে, থরথর করে কাঁপছিল, বলল, বাবা আজ রাতেই মারা যাবে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, শেষবারের মতো। খবরটা শুনে দৌড়ে গেলাম। দেখলাম, অসীমের বৌ সুজাতা আর মেয়ে মান্তা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ধমক দিয়ে বললাম, তোরা কী আরম্ভ করেছিস বল তো? মান্তা কান্নার সুর ধরেই বলল, বাবা বলছে, আজ রাতেই মারা যাবে। অসীম আমার সামনের খাটেই শুয়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে বললাম, এখনও তো বেঁচে আছে তোর বাবা। তাহলে! সুজাতা বলল, তোমার বন্ধু আজ সমানেই মরে যাবার কথা বলছে। তোমাকে তাই ডাকতে বলল।
আমি অসীমের মুখের দিকে তাকালাম। অসীম চোখ-মুখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বুঝলাম, যন্ত্রণাটা আজ খুব বেড়েছে।
অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। অসীম কোনো
কথা বলল না। তিনটে নাগাদ উঠে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে যাবার আগে সুজাতাকে বললাম, চিন্তা কোরো না। অসীম আজ মরে
যাবে না। এখন ঘুমোচ্ছে। ঘুমোতে দাও।
দিন কয়েক পরে অসীম আমাকে ডেকে বলল, আমার বৌ-ছেলেমেয়েকে বুঝিয়ে দিয়েছি, আমার জমানো টাকা কোথায় কী আছে। কিন্তু কতটা বুঝেছে, কে জানে! সুজাতা বড্ড ভুলোমন। আর ছেলেমেয়ে এখনও নাবালক। তাই তুই যদি সব বুঝে নিস, আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি।
কথাটা ভুল বলেনি অসীম। আমি জানি,
বিভিন্ন জায়গায় টাকা ইনভেস্ট করেছে। তার কাগজপত্র ঠিকঠাক করে রাখা প্রয়োজন। কিছু গয়না
ব্যাঙ্কের লকারে আছে। তারও হিসেব থাকা জরুরি। অসীমের অনুপস্থিতিতে সুজাতা যে কীভাবে
সামলাবে! আবাল্যবন্ধু অসীমের জন্য এটুকু দায়িত্ব আমাকে তাই নিতেই হবে। সংসারটা যেন
ভেসে না যায়, সেদিকে সচেতন থাকতে হবে।
সুজাতার সঙ্গে বিয়ের আগে ছায়ার সঙ্গে অসীমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্কের কথা আমি জানতাম। নিশ্চিত ছিলাম, ছায়ার সঙ্গেই অসীমের বিয়ে হবে। হয়নি। বিচ্ছেদে খুব ভেঙে পড়েছিল অসীম। নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেকটা সময় লেগেছিল। তবু মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি ছায়াকে। আমাকে অনুরোধ করেছিল, মরে যাবার আগে একবার ছায়ার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তুই ছায়াকে খবরটা দিতে পারবি? আমি যোগাযোগ করেছিলাম। অসীমের কথা জেনে ছায়া খুব কেঁদেছিল। কিন্তু সুদূর আমেরিকা থেকে স্বামী-সংসার-চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে কবে দেশে ফিরতে পারবে, বলতে পারেনি।
অসীমকে এসব কথা জানাইনি। কী হবে
জানিয়ে! অসীম মারা যাবে, জানি। তবে কবে, জানা নেই!
ভাল লাগলো। ঠিক তো। মৃত্যুপথযাত্রী যে তার বেদনা দ্বিগুণিত না করে অন্তত তাকে আশায় রেখে ঠিক করেছেন লেখক। শান্তিরঞ্জন
উত্তরমুছুনভালো লাগল
উত্তরমুছুন