![]() |
কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৫ |
বেলাইন
খসখস করে একটা আওয়াজ। আস্তে আস্তে স্নায়ু ক্রিয়াশীল হতেই একটা যন্ত্রণার স্রোত বয়ে গেল মাথা থেকে পা। গোটা শরীর বিশ মণ ভারি। সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। বাইরে ভেতরে সীমাহীন অন্ধকার। সারিবদ্ধ বড় বড় টেরোডাকটাইল। ঢেউহীন নিথর সমুদ্র। একটা দ্বীপ। চারিদিক থেকে এগিয়ে আসছে সাপ। স্তুপাকার মৃতদেহ ঠুকরে মাংস খুঁটে নিচ্ছে বিরাট পাখাওলা টেরাডাকটাইল।
মাথা ছিঁড়ে পড়ছে ব্যথায়। দুটি
মৃতপ্রায় মানুষ পড়ে আছে একটু দূরে। মাথার ভেতর অসম্ভব যন্ত্রণার মধ্যেই টের পেল সে
একটা ঝোপের ভেতর শুয়ে। মোহন ধীরে ধীরে চোখ মেলে। অন্ধকার আর যন্ত্রণা। আর কোনও অনুভূতি
নেই। এবার কিছু মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে নিজের খণ্ড খণ্ডকে জড়ো করে চোখ মেলে
মোহন। কোথা থেকে একটা ক্ষীণ আলোকরেখা। অস্পষ্ট কয়েকটি পশু তাদের ঘিরে শুঁকছে সন্দেহজনকভাবে।
শেয়াল অথবা নেকড়ে। মৃত্যুর হাতে সমর্পন করে স্থির শুয়ে থাকে সে। দিন-রাত কিছু ঠাহর
হচ্ছে না। তবু ধীরে ধীরে জাগছে মস্তিষ্ক। ফিরে আসছে ব্যথার সমুদ্র। সারা গায়ে রক্ত
চটচট করছে। বিশেষত মাথা। গড়িয়ে নামছে রক্ত। আরো একজন অনেক দূরে বসে আছে। প্রেতের
মতো। বহুদূর থেকে জঙ্গল আর বড়ো বড়ো গাছের ফোকর দিয়ে এসে পড়েছে চাঁদ। আবছা কালো
আর নীলচে অন্ধকারের মধ্যে মোহন পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে। একটা মলিন আলো। একটা ট্রেনের
কামরা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরাচ্ছে সে। হু হু করে ঢুকছে
ঠাণ্ডা হাওয়া আর অন্ধকার। তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। যেন একটা অচেনা গ্রহ ছুটে
চলেছে মহাবিশ্বে। আর তারপর! তারপর একটা বিকট আওয়াজ। তীব্র ব্যথা, চিৎকার, আর কিছু
মনে নেই। নড়াচড়া দেখে একটু সরে দাঁড়িয়েছে ওরা। হঠাত মনে হলো কী যেন তার নাম! কোথা
থেকে এসেছে সে! কোথায় যাবে! সমস্ত পৃথিবীর বুকে একা একটি মানুষ সে! জীবিত। কিন্তু
না একা না। ভূতগ্রস্থের মত টলতে টলতে উঠে দাঁড়াচ্ছে আরেকজন।
কাছে একটি নদী। একটি সাঁকো। ওপারে
থিকথিক করছে মানুষ। ক্যামেরা,হ্যাজাক, আর্তনাদ। দুটি ট্রেন একসময় দুই পৃথক রেলপথে ছিল।
এখন কাগজের মণ্ডর মতো তাল তুবড়ে গেছে। ইতস্তত দূরে ছিটকে পড়ে আছে কক্ষ থেকে বিচ্যুত
বগি। ফিডিং বোতল, ছেঁড়া ফ্রক, ছিটকে পড়া সামগ্রীর সঙ্গে কাটাহাত-পা, সারি সারি মৃতমুখ
আর গোঙানির শব্দ থেকে দূরে হেঁটে যাচ্ছে একটা মানুষ। সে তো জানতো। জানতোই সিগন্যাল-লক কাজ করছে না এই লাইনে। জানতো। আরো অনেক
কিছুই জানতো। তিনমাস আগেই সে লিখিত রিপোর্ট দাখিল করেছিল উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের কাছে।
এই জেনোসাইডের দায় কার?
আর কোনও সকাল দেখবে না সে। জীবনরেখার
ওপারে পা বাড়ায় সে সবার অলক্ষ্যে। লাইনম্যান রতন পাসোয়ান। বাড়ি সিওয়ান, ঘরে তার
বুড়ো মা-বাপ তিন ছোট্টসন্তান আর লখিয়া তার বউ। পেছনে লাশের স্তুপ। নিরুদ্দেশ যাত্রায় অনুতপ্ত, দগ্ধ রতন পাসোয়ান।
পেছনে সরীসৃপের মত অনুসরণ করছে আরেকজন। বাঁচার জন্য।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন