কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

রাশিদা সুলতানা

 

সমকালীন ছোটগল্প


অপত্য

একদিন স্কুল থেকে ফিরে জানতে পারি আম্মু বাসা থেকে চলে গেছে। বাড়ির সবাই আমার চারপাশে ফিসফাস করে। মা চলে যাওয়ার পর থেকে বাবা টানা দুইতিনদিন মাকে দেখতে না পেয়ে দানবীয় চিৎকারে বাতাস ভারী করে ফেলে। দাদা-দাদি, ফুপু, চাচা, ড্রাইভার, বুয়া কেউ বাবাকে একমুহূর্তের জন্য শান্ত করতে পারে না। তার ঘরে খাবার নিয়ে কেউ গেলে সব ছুঁড়ে ফেলে দেয়। দিনরাত চিৎকার করে, দাড়ি বেয়ে মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ে। দিনরাত তার তীব্র চিৎকারে বাসার অন্যদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের উপায় থাকে না।  মুখটা হাঁ করে থাকে সারাক্ষণ। এই পশুটার জন্যই আমার মা চলে গেছে। তার প্রতি আমার কোনো সহানুভূতি  হয় না। আমার মা’কে নিয়ে দাদি বিষোদ্গার করে, “তোর মা একটা ডাইনি, তোর মায়ের জন্য আমার ছেলেটা মারা যাইতেছে, তোর মতো সোনার টুকরা মেয়ে ফালাইয়া ড্রাইভারের হাত ধইরা সে পালাইছে। এমপি সা’বের ছেলের বউ থেকে এখন ড্রাইভারের বউ।” কাজের বুয়া বাবার ঘর থেকে বের হয়ে আসে, বাবা তার মাথায় ভাতের থাল ছুঁড়ে মেরেছে। তার চুল বেয়ে ভাত-ডাল গড়াচ্ছে।

দাদিকে আমি জবাব দেই, “তোমার পশু-ছেলের সেবা করার চেয়ে ড্রাইভারের সাথে থাকা ভালো।” দাদি আমার হাত ধরে হেঁচড়ে টেনে বাবার ঘরে নিয়ে যায়। “এটা তোর জন্মদাতা বাবা। পশু বলবি না। এই বাবার জন্য তোর এমপি সাহেবের নাতনি পরিচয়। পঙ্গু হোক, অসুস্থ হোক এটাই তোর বাপ। তোর মা ছিল একটা রাস্তার ফকিরের মেয়ে। একটা ভিটাবাড়িও তোর নানার ছিল না। এই ফকিরের মেয়েকে ঘরে আনা-ই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড ভুল।” দাদি চোখ মুখ উল্টে চিৎকার করে। আমি বলি, “ফকিরের মেয়ে ছাড়া এমন অসুস্থ পশুর সাথে কে থাকত এতদিন?” দাদি বলে, “তোর মায়া হয় না? তোর মায়ের শোকে আমার এই অসুস্থ ছেলেটা একফোঁটা পানিও খায় নাই গত তিনদিন। একনাগাড়ে চিৎকার করে যাইতেছে। যে কোনো সময় মারা যাইতে পারে। আল্লাহ্ হারামজাদিকে ধ্বংস করুক। তোর বাপ না হয় পশুর মতো, তুই তো একটা পরির মতো ফুটফুটে মেয়ে। তোরে ফালাইয়া কেমনে গেল? একবার তোর ভবিষ্যতের কথা ভাবল না?” দাদির যথাসাধ্য চেষ্টা মায়ের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মাক। আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি পাঁচশ’ খুন করলেও আম্মুকে আমি কোনোদিন ঘৃণা করব না।

আমার আশৈশব বাবা কখনও আমার দিকে ঠিকমতো তাকিয়েও দেখেনি। লোকটার দৃষ্টি কখনও এক জায়গায় স্থির থাকত না। জাগ্রত অবস্থায় তার শূন্য দৃষ্টি ঘরময় ঘুরে বেড়াত, উদ্দেশ্যহীন। আম্মুকে দেখেছি মাঝেমাঝে বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে বাবার সাথে খেলতে। আম্মু যেন তিন বছরের শিশু সামলাচ্ছে। দাড়ি-গোঁফ সমাচ্ছন্ন, মুখ থেকে লালা গড়ানো দীর্ঘদেহী মানুষটাকে শান্ত করতে রুমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দৌড়াচ্ছে। যেন কোন শিশুর সাথে খেলছে। যেন তার আরেকটা সন্তানের সাথে খেলছে।

আমি কোনোদিন দু’দণ্ড তার ঘরে বসি নাই। রান্নাঘরের কাছে অন্ধকার ঘরে পোষাপ্রাণীর মতো পড়ে থাকত বাবা। দেখতেও সে ছিল বানরের মতো। গাভর্তি লোম, কোটরে-বসা চোখের নীচে মুখভরা দাড়ি। শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষটাকে কে রোজ শেভ করে দেবে?

দাদা-দাদি আমাকে বাবার ঘরে নিয়ে বহুবার বোঝাতে চেয়েছেন, “এটা তোমার বাবা। আমরা মরে গেলে, তুমি তার দেখাশুনা করবে।” শক্ত করে দাদির দু’হাত ধরে রাখতাম, মনে মনে প্রাণপণ অস্বীকার করতে চাইতাম সব। দাদি যখন আত্মীয়স্বজন কাউকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিত “এটা পলাশের মেয়ে”, তারা বিস্ময়াভিভূত চোখ টমাটোর মতো গোল করে বলত “পলাশেরও মেয়ে হইছে! মাশাল্লাহ!” আর সন্দেহের বাষ্প তাদের চোখে মুখে তুলত বুদবুদ। পলাশের মতো বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী অবলা প্রাণী এমন সুস্থ, অঙ্গপ্রতঙ্গসহ স্বাভাবিক একটা সন্তান জন্ম দিয়েছে! তার স্ত্রীর অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না তো? আমার চাচা-ফুপুদেরও দেখেছি তাদের বন্ধুপরিজন কেউ বেড়াতে এলে সচেতন থাকতে কেউ যেন তাদের প্রতিবন্ধী ভাইটিকে দেখতে না পায়।

স্কুলের বন্ধুদের বাড়িতে আমি নানাসময় দাওয়াত খেলেও আমার বাসায় কোনোদিন কাউকে আসতে বলিনি, পাছে বাবাকে কেউ দেখে ফেলে। জন্মের পর থেকে বাবার প্রতি আমার সহানুভূতি কখনোই জন্মায় নাই। বহু রাত মা’কে দেখেছি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। আমার মা-ই দিনরাত লোকটাকে খাওয়ানো, গোসল করানো, সবকিছু করে দেয়। আম্মু কিছুক্ষণ তার ঘরে না থাকলেই চিৎকার, গোঙানি, জিনিসপত্র ভাংচুর শুরু হয়। দাদা-দাদি, ফুপুদের ওপর রাগ করে মাঝেমধ্যে আম্মু গোঁ ধরে থাকত। ওপাশে বাবার ঘরের শত ভাংচুর চেঁচামেচিতেও আম্মু আমাদের ঘর থেকে বের হত না। আমাকে বলত, “তাদের আপদ তারা সামলাক।” দাদা-দাদি তখন তাদের অসুস্থ সন্তানকে শান্ত করার সব ব্যর্থচেষ্টার শেষে আমাদের ঘরে এসে আম্মুকে অনুনয় করত, “মা গো, দয়া করে ঐ ঘরে যাও, আল্লাহ্ তোমারে এর পুরস্কার দিব, আমরা সবসময় দু’হাত তুলে আল্লাহ্র কাছে তোমার জন্য দোয়া করি।” দাদি আম্মুকে আরও বোঝাত, “তোমার শ্বশুর এলাকার কত  সম্মানিত মানুষ, এই মানুষটা তোমার ঘরে আইসা অনুরোধ করতেছে, তার মানটা তুমি রাখো।” আমার দাদা তাঁর এলাকায় নির্বাচিত এমপি ছিলেন। জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। সম্মানিত শ্বশুর-শাশুড়ির ভালবাসায় আর তাদের সম্মানে রক্ষার্থে আম্মু দিনরাত পশুর মতো এই মানুষটার সেবা করে গেছে।

দাদি আম্মুকে মাঝেমধ্যেই সুন্দর সুন্দর শাড়ি-গয়না কিনে দিত। ফুফু-চাচিরাও এটাসেটা দিত। আম্মু সামনাসামনি তাদের ধন্যবাদ দিলেও, আড়ালে আমাকে বলত, “আমারে চাকরের মতো খাটায় ওরা, অসুস্থ পোলার পেসাব-পায়খানা সাফ করায়, তার মজুরি দেয়। দ্যাখ, একবেলা তোমার ফুপু, চাচা, দাদা-দাদি তাদের ছেলেকে খাওয়াইতে আসে না। একবেলা কেউ তাকে দাঁতও ব্রাশ করে দেয় না। তোমার চাচা-ফুপুদের দেখবা চারপাঁচ দিনে একবারের জন্য তাদের ভাইয়ের ঘরে উঁকি দেয় না।” আমার দাদা-দাদি আম্মুকে সবসময় মামণি বলে ডাকত। তারা আত্মীয়স্বজনের কাছেও তার ভূয়সী প্রশংসা করত।

বাবা নামের এই অবলা প্রাণীটা ঘুমালে মা আমার সাথে ঘুমাতে আসে। বাবার জন্য আমাকেও আম্মু ঠিকমতো সময় দিতে পারত না। আম্মুকে অনবরত এই মানুষটার পিছনে খাটতে দেখে বহুরাত আমি ঘুমানোর আগে প্রার্থনা করতাম বাবার যেন দ্রুত শান্তিপূর্ণ মৃত্যু হয়।

আম্মু চলে যাবার পর ভাংচুর বেশি করায় বাবাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। কুকুরের মতো হাঁ করে আছে  সে। লালা গড়াচ্ছে। চোখের কোণে পিঁচুটি। অদ্ভুত দৃষ্টিতে এদিকসেদিক তাকাচ্ছে আর গোঙাচ্ছে। আমাকে কোনোদিন আদরস্পর্শ সে দেয় নাই। কখনোই কোলে তুলে চুমু খায় নাই। এটা আমার বাবা। আমার দাদা-দাদি মরে গেলে আমারই তাকে দেখতে হবে!

আম্মুর জন্য বাবার এই শোক সামলাতে দাদা-দাদি-চাচা-ফুপুরা দিনরাত হিমশিম খায়। ডাক্তার বাসায় আসে। ইনজেকশন দিয়ে বাবাকে ঘুম পাড়ায়। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে স্ট্রেচারে তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নিস্তরঙ্গ পুকুরের মতো শান্ত হয়ে আসে বাড়িটা। এই নৈঃশব্দ্য আমার কাছে ভীতিকর হয়ে ওঠে। আমি বাবার অন্ধকারাছন্ন রুমে গিয়ে দাঁড়াই। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বাড়িঘরের মতো আম্মুকে, নাকি বাবাকেই, আমি খুঁজি?

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন